শিশির_ভেজা_শিউলি #পর্ব_৩৯ #ইবনাত_ইমরোজ_নোহা

0
689

#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_৩৯
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা

(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)

জীবন মানে কি? শুধুই কি বেঁচে থাকা? বেঁচে তো সবাই থাকে। সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে কয়জন বাঁচতে পারে? কয়জন শান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারে? কয়জন প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার সংগ্ৰাম করতে করতে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে বিজয়ীর মুকুট মাথায় পড়তে পারে? ছোট এই জীবনে আমাদের কতো চাওয়া পাওয়া। অথচ আমরা আমাদের থেকে কষ্টে যারা আছে তাদের কথা কেন চিন্তা করিনা? একবার কেন ভাবিনা আমাদের চেয়ে তো তাদের অবস্থা আরো বেশি দুর্বিষহ? ধৈর্য্যের সুমিষ্ট ফল একদিন আমরা পাবোই। শুধু একটু অপেক্ষা করতে হবে। যে মেয়েটা একদিন কলঙ্কিত ছিল, অন্যায় না করেও দোষী ছিল আজ সে সুখী পরিপূর্ণ নারী। সূরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা স্মরণ করছে। কিশোরী বয়সে আবেগের বশবর্তী হয়ে পুরো পৃথিবীকে একপাশে রেখে হাত ধরেছিল এক সুদর্শন পুরুষের। বৈধ পুরুষটি ভালোবাসেনি তা নয়। খুব ভালোবেসেছে। কিন্তু আগলে রাখতে পারেনি। অবিশ্বাস, রাগ নিমিষেই শেষ করে দিয়েছে স্বামী স্ত্রীর পবিত্র বন্ধন। ভাইবোনের সম্পর্কে লেপ্টে দিয়েছিল কলঙ্ক। গ্ৰামের সবার তিক্ত কথা, অসহায়ত্ব, কলঙ্ক সহ্য হয়নি কিশোরীর। জীবনের পরিনতি হিসেবে বেছে নিয়েছিল মৃত্যু। এখন আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া জ্ঞাপন করে রমনী। সেদিন কিছু হলে কি আজ এই সুখময় মুহূর্ত আসতো তার জীবনে? পেরিয়েছে দুই বছর। যে মানুষটা একদিন একটা অসহায় মেয়েকে বলেছিল

“একবার হাতটা ধরো আমৃত্যু আমরণ তোমার হাত টা ধরে রাখবো সুরজান। ভয় নেই আমি মাকহুল সিকদার মিসবাহ আমৃত্যু ইনশিরাহ্ সূরার। আমার সুরজানের।”

সেই মানুষটা এখনো শক্ত করে ধরে রেখেছে তার হাত। আগলে রেখেছে তাকে। জীবনের কালো অতীত ভুলে তার পায়ের সাথে পা বাড়াতে সাহায্য করেছে। আজ ইনশিরাহ্ সূরা পুরোটাই তার ডাক্তারের। এই দুই বছরে দিয়া-সিহাব, জিহাদ-প্রিয়া, মেহের-রায়হানের সম্পর্ক আরো গাঢ় হয়েছে। মীরা আর নুহাশের একটা ছেলে আছে এখন। নির্জন নাম তার। কিউটের ডিব্বা সে। পাল্টে গেছে এই দুইবছরে সকলের জীবন যাত্রা। অনন্যা আর বেঁচে নেই। অনুশোচনা, একাকিত্ব, ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়ার কষ্ট, তাকে তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছিল। ধৈর্য্য ধারণ করতে পারেনি সে। হয়তো প্রকৃতির নিয়মই এমন। প্রকৃতি ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেয় না। অনন্যাও ছাড়া পায়নি। মৃত্যুকে বেছে নিয়েছে সে। কি হতো একটু সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা রাখলে? অনন্যারা কি এভাবেই শেষ হয়ে যায়? তাই হয়তো বলে কখনো কারো খারাপ চাইতে নেই। কারো ভালো করতে না পারলেও ক্ষতি করোনা। আনজুমান বেগম আজ সন্তান থেকেও সন্তান হারা। পিয়াস এখন সিটির মেয়র। এতো প্রাপ্তির মাঝেও তার প্রাপ্তির খাতা শূণ্য। তাকেও প্রকৃতি ছেড়ে দেয়নি। ভালোবাসার মানুষকে পেয়েও না পাওয়ার যন্ত্রনা মৃত্যু সমতুল্য নয় কি? রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার। সূরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে তাকালো। মিসবাহ ওয়েডিং প্ল্যানারদের সাথে কথা বলছে। কাল যে তিন প্রেমিকযুগলের বিয়ে। এক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবে তারা। সুখনীড়েই সব আয়োজন করা হচ্ছে। মিসবাহ নিজে এই প্রস্তাব দিলে কেউ না করেনি। এই মানুষটার ভালোবাসায় আজ সূরা পরিপূর্ণ। হয়তো শত ধৈর্য্যের সুমিষ্ট উপহার এই মানুষটা। মিসবাহ ওয়েডিং প্ল্যানারদের সাথে কথা বলে কি মনে করে নিজের রুমের বারান্দায় তাকালো। সূরা তার দিকেই তাকিয়ে আছে দেখে অমায়িক হাসি ফুটে উঠলো মিসবাহর মুখে। সূরার চোখ জুড়িয়ে যায়। এখন আর লুকিয়ে দেখতে হয়না তার একান্ত ব্যক্তিগত ডাক্তার কে। এখন এই সম্পূর্ণ মানুষটাই তার। মিসবাহ বাড়ির ভেতরে ছুটে আসে। কোনো দিকে না তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে গেল। বারান্দায় গিয়ে সূরাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মিসবাহ। সূরা মুচকি হাসে। এই মানুষটার প্রত্যেকটা স্পর্শ তার চেনা। মিসবাহ কন্ঠে খাদ নামিয়ে বলে

“আমার বউজান কি আমাকে কিছু বলতে চাই?”

সূরার ভ্রু কুঁচকে গেল। এই লোক কি অন্তরযামি? কিন্তু এখন কি বলবে নাকি পরে বলবে? বুঝতে পারেনা সূরা। কথা এরিয়ে গিয়ে বলে

“উহু কিছু না। আপনি ঘরে গিয়ে বসুন। আমি আপনার জন্য শরবত নিয়ে আসি।”

“লাগবেনা। এখন শুধু আমার বউজান কে লাগবে।”

সূরা বাধ্য মেয়ের মতো তার স্বামীকে সঙ্গ দেয়। সূরা মিসবাহর দিকে ঘুরে তাকালো। চোখে চোখ রেখে বলে

“আমার স্বামী কি জানে আমার কাছে সে একজন অমায়িক ব্যক্তিত্বের অধিকারী? একজন আদর্শ স্বামী। কয়জন পারে তার স্ত্রীর কাছে শ্রেষ্ঠ স্বামী হতে। কিন্তু আমার স্বামী পেরেছে। আজ আমি চিৎকার করে বলতে পারি আমার দেখা সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ, অমায়িক ব্যক্তিত্বের অধিকারী আমার স্বামী। আমার একান্ত ব্যক্তিগত প্রেমিক পুরুষ আমার ডাক্তার।”

মিসবাহ চোখে হাসে। আর কি চাই তার? সে তার সুরজানের কাছে শ্রেষ্ঠ স্বামী হতে পেরেছে। সূরা মিসবাহর বুকে মাথা রেখে বলে

“আমি বিশ্বাস করি এই মানুষটা যেমন একজন শ্রেষ্ঠ স্বামী হতে পেরেছে তেমনি একজন শ্রেষ্ঠ বাবা হতে পারবে।”

সূরার পরের কথা শুনে মিসবাহর কপালে ভাঁজ পড়ে। পরক্ষনে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে সূরার দিকে। সূরা মিসবাহর বুকে মুখ লুকিয়ে থাকায় অর্ধাঙ্গিনীর স্নিগ্ধ মুখোস্রি দেখতে পেলো না সে। মিসবাহ এখনো হতবিহ্বল চোখে চেয়ে আছে। হৃদপিন্ড ধমকে গেছে যেনো। সে কি মরে যাচ্ছে? সামান্য একটা কথা অসামান্য লাগছে কেন তার কাছে? সূরা মিসবাহকে ছেড়ে মাথা উঁচু করে তাকালো মিসবাহর দিকে। চোখে হাসে সূরা। মিসবাহর একহাত নিয়ে নিজের পেটে রাখে। মিসবাহর হাত কাঁপে। বুক কাঁপে। এর আগে তো কখনো এমন হয়নি। হবে কি করে এর আগে কি কখনো বাবা হয়েছে? এই নাম না জানা অনুভূতি কাকে বোঝাবে মিসবাহ? সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমনী কি তার অনুভূতির এক শতাংশও টের পাচ্ছে? জানা নেই মিসবাহর। সূরা ছলছল চোখে বলে

“আমাদের প্রনয়ের পূর্নতা আসছে ডাক্তার। আপনি খুশি হননি?”

লহমায় মিসবাহ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সূরাকে। এই অনুভূতি ব্যক্ত করার মতো না। মিসবাহ সূরার ললাটে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। ক্ষীন স্বরে আওরালো

“আমি ভেবেছিলাম আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি তুমি। এখন এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি তোমার পেটে বেড়ে ওঠা আমার অস্তিত্ব। আমি কি মরে যাচ্ছি সুর? এতো সুখ সুখ লাগছে কেন?”

সূরা আলতো করে মাথা রাখে মিসবাহর বুকে। তারও তো নাম না জানা সুখকর অনুভূতি হচ্ছে। বাবা মা হওয়ার অনুভূতি এতো মধুর কেন? এতো সুখকর কেন এই মুহূর্ত?

★★★★★★★

নিকষকৃষ্ণ রজনী। টলমল দীঘির জল আজ গম্ভীর। খিলখিলিয়ে হাসছে না আজ। এতো দুঃখী কেন আজ সে? নাকি এক ব্যর্থ প্রেমিকের পাগলামি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সে। এক পথ হারা পথিকের আর্তনাদে তারও কি কষ্ট হচ্ছে? অমানিশা যেনো আজ ঘিরে ধরেছে ধরনীকে। পিয়াসের এক হাতে মদের বোতল আর একহাতে ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে সূরার হাস্যোজ্জ্বল মুখোস্রি। পিয়াস বোতলে চুমুক দিল। পরক্ষনে সূরার ছবির দিকে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে আওরালো

“রাগ করেছিস সুর? রাগ করিস না কলিজা। অনেক দিন পর আজকেই খেয়েছি। তোর মাকাল ফল এখন রাজনীতিতে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। সে এখন আর ভবঘুরে না। সিটির মেয়র সে। তুই খুশি তো?”

পিয়াস ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে সূরার ছবির দিকে। পিয়াসের মনে হচ্ছে সূরা তার পাশেই বসে আছে। তাকালো পিয়াস। হ্যালুসিনেশন হচ্ছে কি? সূরা কি করে আসবে এখানে? তবুও মন বলছে হোক কল্পনা। একটু কথা বল তোর সুরের সাথে। সূরা তাকিয়ে আছে হাস্যোজ্জ্বল মুখে। পিয়াস হাত বাড়িয়ে আবার গুটিয়ে নেয়। যদি ধরতে গেলে ধোঁয়াসায় মিলিয়ে যায়। প্রতিবার তো এটাই হয়। নাহ্ আজ আর পিয়াস হাত বাড়াবেনা তার প্রেয়সীর দিকে। পিয়াস আঙ্গুল ছোট করে দেখানোর ভঙ্গিতে সুর টেনে টেনে বলে

“আমি একটু খেয়েছি। বেশি না একটু। রাগ করেছিস?”

সূরা তাকিয়ে থাকে। পিয়াস আবার বলে “আমি খুব খারাপ না রে? আমায় একটু ভালোবাসলি না কেন সুর? কি হতো আমায় ভালোবাসলে?

পিয়াসের এক চোখ দিয়ে একফোঁটা অবাধ্য অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। পিয়াস ছলছল চোখে সূরার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হাসে। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে

“আমার মতো মেরুদন্ডহীন পুরুষকে ভালোবাসা যায়? যায় না তো। যে শখের নারীর হাত শক্ত করে ধরে রাখতে পারেনা তাকে ভালোবাসা যায় না। ঘৃনা করা যায়। শুধুই ঘৃনা।”

সূরা চোখে হাসে। পিয়াস তাকিয়ে থাকে মুগ্ধ চোখে। পিয়াস শব্দ করে হাসে। চোখে অশ্রু মুখে হাসি। আহ্ কি নিদারুন যন্ত্রণা! এর চেয়ে কি মৃত্যু ভালো না? পিয়াস বলে

“ঘৃনা করিস না সুর। আমায় ঘৃনা করিস না। তোর থেকে দূরত্ব সহ্য করতে পারলেও তোর ঘৃনাভরা ওই দৃষ্টি আমার সহ্য হবেনা।”

পিয়াস হাত বাড়ালো সূরার দিকে। ধোঁয়াসায় মিলিয়ে যায় সে। পিয়াস এদিক ওদিক তাকিয়ে খোঁজে। পায়না। আবার শব্দ করে হেসে উঠে সে। সিঁড়ির উপরে শুয়ে পড়লো পিয়াস। দৃষ্টি তার নিকষকৃষ্ণ আকাশপানে। বুকের অসহনীয় বিষ ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছে হৃদয়। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। বিরবির করে বলে

“এই অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে আমায় মুক্তি দে সুর। এই কোন অভিশাপে আমি আজ ছন্নছাড়া মেঘ? আমার বুকের হৃৎপিণ্ড এই কোন যন্ত্রনা খুবলে খুবলে খাচ্ছে? আমি পারিনা সহ্য করতে সুর। আমি মেরুদন্ডহীন মানব। তোকে আগলে রাখতে পারিনি। পারিনি আমি ওই নিষ্পাপ মেয়ের চোখের অশ্রুর মূল্য দিতে। যে তার পৃথিবী কে ভুলে আমার কাছে এসেছিলো আমি পারিনি তাকে আগলে রাখতে। ছিঃ ধিক্কার জানাই তোকে পিয়াস। নিকৃষ্ট নর্দমার কীট তুই। আমার শতকোটি শ্রদ্ধা ওই অমায়িক ব্যক্তিত্বের অধিকারী পুরুষের প্রতি। যে আমৃত্যু তোকে আগলে রাখতে চাই। ব্যর্থ আমি।”

পিয়াস ডুকরে কেঁদে উঠলো। চোখ বুজে ভেজা কন্ঠে আওরালো হৃদয় নিংড়ানো হাহাকার

“শুনে যাও তোমরা। এক নর্দমার কীটের ব্যর্থ প্রেমের গল্প। সে পেয়েও হারিয়ে ফেললো এক রাজকন্যাকে। যে তার দুর্গন্ধযুক্ত হৃদয়ে সুবাস ছড়িয়েছিল তাকেই কলঙ্কিত করেছে সে। ধিক্কার জানাই সেই নর্দমার কীট কে। পেয়ে হারানোর যন্ত্রনার চেয়ে কি মৃত্যু ভালো ছিলনা তার?”

আজ এই মানবকে দেখে প্রকৃতি হাসে। খিলখিলিয়ে হেসে বলে “হে তুচ্ছ মানব তুমি কি জানো না প্রকৃতি ছাড় দিলেও ছেড়ে দেয় না।”

★★★★★★★

সুখনীড় যেন আজ নতুন রুপে সেজে উঠেছে। বাড়িতে বিয়ে বলে কথা। কিন্তু এক আলাদা সুখের অনুভুতি ঘিরে রেখেছে সুখনীড় কে। তাদের আদরের সূরা যে মা হবে। এর চেয়ে সুখের অনুভুতি আর কি হতে পারে? স্টেজে বসে আছে নতুন তিনজোড়া দম্পতি। কি সুন্দর লাগছে তাদের! আজ যে তাদের এতো বছরের প্রনয়ের পূর্নতা পাবে। এক পবিত্র বন্ধনে বাঁধা পড়বে তারা। মিসবাহ আর সূরা স্টেজের একপাশে বসে থেকে তাদেরই দেখছে। মিসবাহর কোলে নির্জন। বড্ড বেশি দুষ্টু সে। সূরা মিসবাহর দিকে তাকিয়ে চোখে হাসলো। মিসবাহও হাসে। শখের নারীকে, শখের পুরুষকে নিজের নামে লিখে নেওয়ার মধ্যে যে সুখ আছে তা কি আর কোথাও আছে? আর এমন দৃশ্য দেখতেও যে ভালো লাগে। প্রথমে সিহাব আর দিয়ার বিয়ে পড়ানো হয়। তারপরে প্রিয়া আর জিহাদের। জিহাদকে কবুল বলতে বললে সে দ্রুত তিন কবুল বলে ফেলে। হয়তো ট্রেন ছুটে যাচ্ছে তার। হাসির রোল পড়ে বিয়ে বাড়ির আঙিনায়। মেহের নিজের বিয়ে সবার পরে পড়ানো দেখে বিরক্তি প্রকাশ করে ফিসফিসিয়ে বলে

“প্রথমে আমার বিয়ে পড়ালে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো? আজব।”

রায়হান পাশে বসে থাকায় শুনতে পেল মেহেরের কথা। মনে মনে হাসে রায়হান। তার শুভ্র কাদম্বরী ঠিক আগের মতোই আছে। একটুও পাল্টায়নি। এই মেহেরকেই তো সে চেয়েছে আজীবন। পরক্ষনে মেহের আর রায়হানের বিয়ে পড়ানো হলে মেহের চটজলদি তিন কবুল বলে। আবার হেসে উঠলো সকলে। মিসবাহ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মেহেরের দিকে। আদরের ছোট বোনটা আজ অন্য কারোর নামে নিজেকে লিখে দিলো। বুকে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে তার। সূরা হয়তো বুঝলো মিসবাহর মনের অবস্থা। শক্ত করে হাত ধরে তার। মিসবাহ সূরার দিকে তাকিয়ে ক্ষীন হাসে‌। সূরা মিসবাহর কাঁধে মাথা রেখে তাকিয়ে থাকে স্টেজে নব বর বধূর দিকে। দেখতেও ভালো লাগছে তার। এভাবেই পূর্নতা পাক সকল ভালোবাসা। প্রনয়ের সমাপ্তি ঘটুক সুখময়।

★★★★★★

পড়ন্ত বিকেল। পেরিয়েছে মাস খানেক। সূরার পেটটা একটু ফুলেছে। একটা অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে তার আসার। সিহাব দিয়া আর সূরা ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। সূরার হাতে আচারের বাটি। তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে সে। মিসবাহ সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে। সূরাকে আচার খেতে দেখে ওষ্ঠধর ভেদ করে তপ্তশ্বাস ফেলে। এই মেয়ে এখন পুষ্টিকর খাবার খেতেই চাইনা। মিসবাহ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে বললো

“রুমে এসো সুর।”

সূরা কিছু বলেনা। সোফায় বাটি রেখে উঠে গেল। দিয়া আর সিহাব মিটিমিটি হাসছে। সূরা পাত্তা দেয় না। পাত্তা দিলেই সমস্যা। এরা সবকটা খচ্চর, উগান্ডার বাসিন্দা। সূরা নিজের রুমে এসে বিছানায় বসে। ওয়াসরুমে পানির শব্দে বুঝতে পারে মিসবাহ ওয়াসরুমে। কিছুক্ষণ পরে মিসবাহ টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসলে সূরা তাকায় মিসবাহর দিকে। ভ্রু কুঁচকে গেল তার। এই লোকটা দিন দিন সুন্দর হচ্ছে। কই সে তো মুটিয়ে যাচ্ছে। দেখতেও কেমন জানি লাগে। আর এই লোক সৌন্দর্যের পসরা নিয়ে বসেছে। মিসবাহ সূরার পাশে এসে বসে। সূরার গালে এক হাত রেখে আদুরে গলায় বলল

“কি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”

“আপনি দিন দিন একটু বেশিই সুন্দর হচ্ছেন। এক বাচ্চার বাবা এতো সুদর্শন হবে কেন?”

মিসবাহ কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো। মাথা গেছে নাকি এই মেয়ের। পরক্ষনে সূরার কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরে বলল

“আমার সুরজান কি জানে, আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী রমনী আমার রাজকন্যার মা।”

সূরার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল। মিসবাহ সুধায়

“আমার বউজান খেয়েছে?”

“হুঁ।”

“কি? আচার?”

সূরা কিছু বলেনা। ঠোঁট উল্টায়। আজ আবার তার উপর ফলফলাদির বর্ষন হবে। মিসবাহ উঠে দাঁড়ালো। কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। নিচে থেকে ফলের ঝুড়ি নিয়ে আসে। সূরা কিছু বলেনা। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে এই লোকের এতো পাগলামি দেখে। মিসবাহ সূরার হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে আসে। বিনব্যাগে বসে সূরাকে সাবধানে কোলের উপর বসায়। সূরা মিসবাহর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে। মিসবাহ কমলার খোসা ছাড়িয়ে একটা কোয়া সূরার মুখের কাছে ধরে। সূরা বিনাবাক্যে মুখে পুরে নিল। মিসবাহ শান্ত স্বরে বলে

“এমন করলে হবে? তুমি যদি পুষ্টিকর খাবার না খাও তাহলে আমার আম্মাটাও তো পুষ্টি পাবেনা। পরিপুষ্ট হবেনা সে। আমার চাচ্চুর রাজকন্যা আমার রাজকন্যাকে না খায়িয়ে রাখছে এটা কি মানা যায়?”

সূরা বিরক্ত হলো। সে কি না খেয়ে থাকে নাকি? আর এই লোক রাজকন্যা বলতে পাগল। রাজকুমারও তো আসতে পারে নাকি। ইদানিং মুড সুইং হয় তার। অকারনেই রাগ হয় আবার অকারনেই কান্না পায়। এখন রাগ হচ্ছে। সূরা জানে এগুলো প্রেগনেন্সির জন্য হচ্ছে তবুও কন্ট্রোল করতে পারেনা সে‌। সূরা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল

“নিজের রাজকন্যাকে নিজের পেটে রাখলেই তো হয়। তাহলে তো আর আমাকে মেনে নিতে হবে না কারোর।”

মিসবাহ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সূরার দিকে। সে কি বললো আর এই মেয়ে কি বুঝলো। বরাবর ধৈর্য্যশীল ব্যক্তি সে। সূরার এতো ঘনঘন মুড সুইং ধৈর্য্যের সাথে সামলায় মিসবাহ। মিসবাহ সূরার পেটে হাত রেখে ফিসফিসিয়ে বলে

“আম্মা একটা কথা শুনে রাখেন কখনো প্রেমে পড়লে মিশা সওদাগরের মতো কারো প্রেমে পড়বেন না। আবার নায়ক নায়ক দেখতে কারো প্রেমেও পড়বেন না। সবাই নায়ক নায়ক দেখতে হলেও সবাই কিন্তু নায়ক না। উদাহরণ স্বরূপ আপনার বাবাকে দেখেন। নায়িকা ভেবে প্রেমে পড়লাম ঠিকই কিন্তু এতো দেখি খলনায়িকা। রিনা খান।”

সূরার রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই লোককে খুন করে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে। তাকে খলনায়িকা বললো। মিসবাহ সূরাকে রাগে ফুঁসতে দেখে মিটিমিটি হাসছে। সূরা কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই মিসবাহ সূরার মুখে কমলার কোয়া পুরে দেয়। শব্দ করে হেসে উঠে মিসবাহ্। সূরা কটমট করে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে সেও ফিক করে হেসে উঠলো। পড়ন্ত বিকেলে দুই কপোত কপোতীর কিছু মধুর স্মৃতি ফ্রেম বন্দি হয়ে থাকে। আজ প্রকৃতিও যেনো বলছে “ভালোবাসা তুমি সুন্দর। বড্ড বেশি সুন্দর”।

#চলবে ……..

(কাল অন্তিম পর্ব দিবো। পাশে থাকবেন সবাই)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here