#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_১০
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা
(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)
হিমশীতল ধরনী। প্রকৃতি ধরনীর বুকে তান্ডব চালিয়ে এখন শান্ত প্রায়।শীতল অনিল এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে এক বিষাদ কন্যার মুখোস্রি, তনু, মন। ঠান্ডায় শরীরের লোমকূপ কাটা দিয়ে উঠছে তবুও রমনী তার জায়গায় স্থির অবিচল। ঘোর অমানিশায় ছেয়ে আছে ধরনী। সূরার মনও বুঝি অন্ধকারে নিমজ্জিত। কান্না পাচ্ছে তার। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু হায়! আফসোস সে পারছে না চিৎকার করে বলতে কেন তার সাথে এমন হলো? কেন সে সুস্থ ভাবে বাঁচতে পারছেনা?এ কি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। চোখের অক্ষিপট ছলছল করে উঠল সূরার একটু আগে নিচের ঘটনা মনে করে।নিচে সবাই যখন আনন্দ করছিল তখনই হঠাৎ রাহেলা বেগম মুনতাহা সিকদারের উদ্দেশ্যে বলল
“আপা আমার মেয়ে টিনা তো মিসবাহর কলেজেরই স্টুডেন্ট। মিসবাহ আর টিনা তো একে অপরকে ভালোভাবে চিনে। অতি সুন্দরী, স্মার্ট মেয়ে আমার। আমার মনে হয় ওদের চার হাত এবার এক করে দেওয়া উচিত। আপনি কি বলেন?”
সূরা ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলেও বাইরে প্রকাশ করলনা।না কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল তার মধ্যে। মিসবাহ সূরার দিকে তাকিয়ে ওর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে।বরাবরের মতোই সূরার ভেতরের উচাটন মন বুঝতে সক্ষম হলো সে।মনে মনে হাসলো এটা ভেবে যে ওর বোকা অপ্সরা সুরজান ওকে ভালোবাসলেও স্বিকার করতে নারাজ। রাহেলা বেগম জানেন না সূরার বিষয় তাই বিয়ের কথা তুলছে তা সবাই বুঝলেও সূরার মন এখন কিছু ভাবতে পারছেনা।সে এখন একটা কথায় ভাবছে মিসবাহর পাশে অন্য একটা মেয়ে।সে মিসবাহকে ভালোবাসবে। নাহ্ মিসবাহ নামক মানুষটাকে নিয়ে সে ভাবতে চাই না।বিয়ে হবে হোক। নিমন্ত্রণ করলে কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে যাবে।এই বলে মনকে শান্তনা দিলেও মন যে মানতে নারাজ। বেহায়া, নির্লজ্জ মন তার।মুনতাহা সিকদার কিছু বলবে তার আগেই মিসবাহ শান্ত স্বরে বলে উঠলো
“ফুপিমনি টিনার মতো অতি স্মার্ট, অতি সুন্দরী মেয়েকে বউ হিসেবে পাওয়া তো অতি ভাগ্যের ব্যাপার। আমার আবার ওতো অতি ভাগ্য সহ্য হবেনা। অতিরিক্ত কিছু হজম করার জন্য হজমিক্যান্ডি খাওয়া দরকার। ইউ নো আই ডোন্ট লাইক হজমি। বাট আই লাইক ফ্লাওয়ার।আমার যে একজনকেই চাই। একান্ত ব্যক্তিগত হিসেবে তাকে চাই আমার। কিন্তু সে নিষ্ঠুর রমনী, বোকা ফুল।”
মিসবাহ আর বসে না থেকে উঠে গেল। সূরা ছলছল নয়নে মিসবাহর দিকে তাকিয়ে আছে।সে নিরুপায়।তার উপায় থাকলে এই গম্ভীর, নির্লজ্জ, অসভ্য পুরুষকে সে ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখতো আমৃত্যু,আমরণ।
তখন থেকে ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে সূরা।আজ বেশি রাত হয়ে যাওয়ায় মুনতাহা সিকদার পঞ্চপান্ডবের কাউকেই যেতে দেননি।বিষাদে মন মস্তিষ্ক বিষিয়ে আছে সূরার।
“আমার সাথে অমাবস্যা বিলাস করবে সুরজান?”
হঠাৎ পুরুষালী গম্ভীর কণ্ঠে হকচকিয়ে গেল সূরা। পিছনে না ফিরেই বুঝলো কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি কে। একটু স্বাভাবিক হতে বার কয়েক জোরে শ্বাস ত্যাগ করল। ততক্ষণে মিসবাহ ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে। তার পূর্ণ দৃষ্টি সূরার উপর। রাস্তার কৃত্রিম আলোয় সূরাকে এখন মায়াবতী লাগছে মিসবাহর কাছে।সূরার কোনো রেসপন্স না পেয়ে মিসবাহ ক্ষীণ স্বরে বলে উঠলো
“বললে না তো সুরজান অমাবস্যা বিলাস করবে কিনা আমার সাথে?”
“মানুষ চন্দ্র বিলাস করে আর আপনি অমাবস্যা বিলাস করবেন? অদ্ভুত আবদার আপনার ডাক্তার।”
মিসবাহ চমকে উঠলো সূরার মুখে ডাক্তার সম্বোধন শুনে। সূরা খুব সহজে তাকে ডাক্তার সম্বোধন করে না।সূরার কি মন খারাপ? বোঝার চেষ্টা করল মিসবাহ।বুঝেও গেল তার শ্যামকন্যার মন খারাপ। কিন্তু কেন? মিসবাহ বলে
“যেদিন আমার চন্দ্রাবতী আমার বুকে মুখ লুকিয়ে থাকবে সেদিন তাকে নিয়ে চন্দ্র বিলাস করব। জ্যোৎস্না স্নিগ্ধ রাতে আমার চন্দ্রাবতীর সারা অঙ্গে আমার আধিপত্য ফলাবো। কিন্তু এখন আমার চন্দ্রাবতী অমাবস্যার অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে আছে।তাই আপাতত অমাবস্যা বিলাস করব।”
ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে সূরা মিসবাহর দিকে। দুজনের না বলা কথা বুঝি চোখে চোখে বিনিময় হচ্ছে। একফোঁটা অবাধ্য অশ্রু গড়িয়ে পড়ল সূরার কপোল বেয়ে। সিক্ত করল কপোল,হৃদয়, শরীরের শিরা উপশিরা। মিসবাহ মুচকি হেসে স্বযত্নে মুছে দিল সুরার অশ্রু ভেজা কপোল। কেঁপে উঠল সূরা। শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠলো।অপর গালেও হাত রেখে দুই হাতের আজলায় নিল সূরার মুখ। আবেগঘন কণ্ঠে বলল
“সুরজান! আমাকে কি ভালোবাসা যায়না।এই গম্ভীর,জেদি, বদমেজাজি, কঠোর লৌহ মানব টাও তোমার সান্নিধ্যের জন্য ছটফট করে। অনুভুতি তার জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমাকে অথচ দেখ সে জোয়ার তোমাকে কেন ভাসায় না সুরজান?”
“আমি যে পঁচা শামুক ডাক্তার।আমার দিকে পা বাড়ালে ক্ষতবিক্ষত হতে হবে। রক্ত ক্ষরণ হতে হতে একসময় নিঃশেষ হয়ে যেতে হবে। বিষে নীল হয়ে উঠবে শরীর। অমাবস্যার রাত্রি আমি, জ্যোৎস্না স্নিগ্ধ রাত আপনি। আমাদের যে মিলন হতে নেয় ডাক্তার। প্রকৃতির বিরুদ্ধে গেলে যে ঘোর পাপ ডাক্তার।”
“সুরজান নামক বিষ আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ুক।সে আমার পবিত্র শিউলি ফুল। আমার সুরজান। ফুলের চেয়ে পবিত্র আর কি হতে পারে।আমার একমাত্র ব্যক্তিগত চন্দ্রাবতী তুমি।যার জ্যোৎস্নার আলোয় আমার জীবনে রংধনুর পসরা বসে।আমার শিউলি ফুলের সুবাসে আমি বারবার বারংবার নেশাগ্রস্ত। আমার ব্যক্তিগত পবিত্র শিউলি ফুল তুমি।”
সূরা আর পারলো না নিজেকে শক্ত রাখতে।মিসবাহর অনুভূতির কাছে হেরে যাচ্ছে ওর সত্তা। ভেঙ্গে যাচ্ছে এতো দিনের খোলস।মিসবাহর হাত গাল থেকে নামিয়ে দৌড়ে ছাদ থেকে নেমে গেল।পিছন ফিরে দেখলো না তার বিরহে শক্ত মানবটার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মিসবাহ বহু কষ্টে উচ্চারণ করল
“আমার সুরজান তো ভীতু না। সাহসী রমনী আজ অনুভূতি লুকাতে ভীতুর তকমা গায়ে নিল।আমার পবিত্র শিউলি ফুল আজ অনুভূতিহীন রমনী।”
★★★★★★
বিষন্ন মন নিয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে সূরা।গত দুই দিন ধরে সবকিছু বিষন্ন লাগছে তার।কেন লাগছে সে নিজেও জানে না আর জানলেও কারনটা মানতে সে নারাজ।সুখনীড় থেকে আসার আজ তিনদিন। সেদিন রাতে মিসবাহর সাথে দেখা হওয়ার পর এই কয়দিন আর দেখা হয়নি।সূরার চোখ তৃষ্ণার্ত লোকটাকে একবার দেখার জন্য কিন্তু সূরা ধমকে ধামকে নিজেকে শক্ত রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। কিন্তু কোথাও না কোথাও মিসবাহর জন্য ছটফট করছে সে। তবুও যে এই রমনী মানতে নারাজ। ক্লাস নয়টার দিকে থাকায় দিয়া আগে চলে গেছে।সূরার টিউশনি ছিল একটা। কাল বাচ্চাটার পরীক্ষা তাই কিছু এক্সট্রা পড়ানোর জন্য আজ সকালে গিয়েছিল সে। কিন্তু এখন আধাঘণ্টা যাবৎ রিক্সার জন্য অপেক্ষা করেও একটাও রিক্সার দেখা নেই। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে গেল সূরার।আজ ইম্পরটেন্ট ক্লাস আছে একটা।উপায় না পেয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরতেই সামনে এসে একটা গাড়ি থামলো।সূরার বুঝতে বাকি নেই গাড়িটি কার। মিসবাহ গাড়ি থেকে নেমে সূরার সামনে এসে দাড়ালো।রোদে মুখ শুকিয়ে গেছে সুরার। বিন্দু বিন্দু মুক্ত কনা কপালে জমে আছে।গায়ের পারপেল রঙের জামাটি ঘামে ভিজে গায়ে লেপ্টে আছে।এই অবস্থায় সূরা কে বড্ড আবেদনময়ী লাগছে মিসবাহর কাছে। অজান্তেই সূরার অভিমান হচ্ছে। এই দুইদিন কোথায় ছিল এই লোক।কপালের ঘাম ওরনা দিয়ে মুছে ভ্রু কুঁচকে শক্ত কন্ঠে বলল
“রাস্তা ছাড়ুন। আমায় কলেজে যাওয়া লাগবে।”
“আমাকে কি তোমার রাস্তা ঘাটের পাতি মাস্তান মনে হয় যে শক্ত কন্ঠে বলছো রাস্তা ছাড়ুন? আমি হলাম তোমার একান্ত, ব্যক্তিগত প্রেমিক পুরুষ। সে সুবাদে লজ্জা রাঙ্গা মুখোস্রীতে লাজুক হাসি ফুটিয়ে বলবা ওগো রাস্তা ছাড়ার দরকার কি চলো আমাকে কলেজে পৌছে দাও। বড্ড আনরোমান্টিক তুমি। আমার ভবিষ্যৎ যে অন্ধকারে তলিয়ে আছে বোঝা হয়ে গেছে আমার।”
সূরা অতি শোকে পাথর হয়ে গেছে যেনো।মুখ আপনাআপনি হাঁ হয়ে গেছে ওর।মানে এই লোককে ও কি বলল আর এই লোক কিভাবে জিলাপির প্যাঁচ লাগানো সূরা এসব ভাবছে।সূরার হতভম্ব মুখ দেখে মিসবাহ মনে মনে হাসলো।এই মেয়ে বড্ড বোকা।বলল
“হা বন্ধ না করলে রাস্তার সকল যানবাহন তোমার মুখে ঢুকে যাবে।তাই মুখ বন্ধ করে গাড়িতে ওঠো।”
সূরা মুখ তো বন্ধ করে নিল কিন্তু আবার কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই মিসবাহ শান্ত কিন্তু গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো
“তুমি কি চাও আমি কোলে করে তোমাকে গাড়িতে বসায়। তুমি চাইলে আমার কোনো সমস্যা নেই বরং কাজটা করতে আমার ভালোই লাগবে।”
সূরা কটমট করে তাকালো। ফাঁকা রাস্তায় একটাও রিক্সা নেই তাই নয়লে কখনো এই বজ্জাত লোকটার গাড়ীতে উঠতোনা সে। সূরা গাড়িতে উঠতেই মিসবাহও গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিল। গন্তব্য কলেজ।পুরো রাস্তা সূরা জানালার দিকে মুখ করে ছিল। এমনিতেই ওর গাড়িতে উঠলে মাথা ঘুরায় আর আজতো সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি।গা গুলিয়ে উঠছে সূরার। মিসবাহ বার কয়েক আড়চোখে দেখেছে সূরাকে।কেমন শুকনো লাগছে মেয়েটার মুখোস্রি। কলেজ গেটে গাড়ি থামালো মিসবাহ। সূরা নামছেনা দেখে নিজে নেমে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিল।সূরাকে ডাকতেই সে চোখ খুলে তাকালো একবার। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝল পৌঁছে গেছে ওরা। হুড়মুড়িয়ে নামতেই মাথা ঘুরে গেল সূরার। মিসবাহ শক্ত হাতে ওকে ধরল। বুকে আগলে নিয়ে চিন্তিত হয়ে বলল
“সুরজান কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে? পানি খাবে একটু?”
সূরা জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে একটু স্বাভাবিক হয়ে সরে আসলো মিসবাহর থেকে। ঠান্ডা স্বরে বলল
“আমি ঠিক আছি স্যার। চিন্তা করবেন না। ধন্যবাদ আপনাকে আমাকে পৌছে দেওয়ার জন্য।আসছি।”
আর দাড়ালো না সূরা। মিসবাহ ডাকলেও পেছনে না তাকিয়ে চলে গেল সে। সূরা বিরবিরিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল
“এ কোন অনুভূতি ডাক্তার। আপনার ওই বুকে এ কোন শান্তি।এটা অনুভূতি নাকি প্রাণঘাতী বিষ। তাহলে কি আমার শিরায় শিরায় প্রাণঘাতী বিষ ছড়িয়ে পড়ছে?”
#চলবে….