#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_১৯
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা
(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)
রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর। মাইক্রো গাড়িটি চলছে আপন গতিতে। গাড়িটি লোকালয় থেকে গ্ৰামের সরুপথ ধরেছে কিয়ৎ পূর্বে। গাড়িতে সবাই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে মিনিট কয়েক। শুধু ঘুম নেই মিসবাহর চোখে। চিন্তায় ঈষৎ ঘেমে উঠেছে সে। এসি গাড়িতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম ললাটে দৃশ্যমান। শুভ্র মুখোস্রিতে মুক্ত কনার মতো জ্বলজ্বল করছে সেগুলো। মিসবাহ আড়চোখে তাকালো তার বুকে লেপ্টে ঘুমিয়ে থাকা রমনীর দিকে। একটু আগেও ছটপট করছিলো মেয়েটা। কিন্তু এখন বিড়াল ছানার মতো গুটিসুটি মেরে লেপ্টে আছে তার বুকে। মিসবাহ এক হাত দিয়ে আগলে নিল এই নিষ্ঠুর রমনীকে। অন্য হাতে ডাইভ করছে সে অতি দক্ষতার সাথে। সূরা যখন গাড়ি থেকে হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়ে তখন মিসবাহ সহ সবাই গাড়ি থেকে নামে। সূরার বমি করে বেহাল দশা। দিয়া গিয়ে আগলে ধরে তাকে। রাস্তার পাশেই বসে পড়ে সূরা। বন্ধুরা সহ রায়হানও বিচলিত হয়ে পড়ে সূরার অবস্থা দেখে। শুধু শক্ত হয়ে থাকে মিসবাহ। তার মুখের কোনো পরিবর্তন হয়না। সে গাড়ি থেকে পানির বোতল বের করে সূরা কে খাইয়ে দেয়।চোখে মুখে পানির ঝাপটা দেয়। মিসবাহর বুঝতে বাকি নেই সূরা দূরের জার্নি করতে পারে না। পিরোজপুর পৌঁছাতে তিন ঘণ্টা লাগলেও লোকালয় থেকে গ্ৰামে পৌঁছাতে আরো ঘন্টা দুয়েক লাগবে। মিসবাহ শান্ত স্বরে দিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে
“দিয়া ওকে পেছনের সিটে নিয়ে বসো।আমি মেডিসিন দিচ্ছি ওকে খাইয়ে দাও।”
সূরা ব্যস্ত কন্ঠে বলে ওঠে “না নাহ্। আমি পেছনে বসবো না।”
সবাই সূরার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। সবাইকে এভাবে তাকাতে দেখে ভরকে যায় সূরা। নিজের হয়ে কিছু বোঝানোর ভঙ্গিতে মিনমিন করে বলে
“পেছনের সিটে বসলে আরো গা গুলাবে তাই সামনে বসতে চাইছি।অন্য কিছু না।”
জিহাদ কৌতুক স্বরে বলে “আমরা কখন বললাম অন্যকিছু।”
সূরা কি বলবে বুঝতে পারলো না। সে কেন পেছনে বসবেনা বললো তাও বোধগম্য হলো না সূরার। মিসবাহর থেকে এক ইঞ্চিসম দুরত্ব তার সহ্য হবেনা সে ঢের বুঝেছে। এই লোক যে দুরত্ব বজায় রেখেও সূরার অতি নিকটে তাও জানা আছে সূরার। মিসবাহ বরাবরই গম্ভীর প্রকৃতির শান্ত স্বভাবের মানুষ। কঠিন লৌহ মানবও বটে। এর আগেও কম অবহেলা করেনি সে মিসবাহকে। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে কঠোর মানব হলেও তার ক্ষেত্রে নমনীয়, প্রেমিক পুরুষ সে। বারবার বারংবার মিসবাহকে আঘাত করতে গিয়ে ভেতরে ভেতরে নিজে ক্ষতবিক্ষত হয় সূরা। তবুও কেন এই প্রেমিক পুরুষ বোঝেনা। বরাবরের মতই তার সামনে আকাশসম প্রনয় নিয়ে হাজির হয় সে। সূরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মিসবাহ গভীর চোখে সূরার মুখোস্রি পর্যবেক্ষন করে গাড়িতে গিয়ে বসে। এই মেয়ের মনের অব্যক্ত কথা বুঝতে না পারলেই বুঝি ভালো হতো তার। সব বুঝতে পেরেও অসহনীয় যন্ত্রনা সহ্য করতে হতো না তাকে। দিয়া সূরা কে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও উঠে বসে। একে একে সবাই ওঠে বসলে গাড়ি স্টার্ট দেয় মিসবাহ। সূরার অগোচরে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেয় মিসবাহ। ঘুমালে হয়তো মেয়েটার কষ্ট কম হবে। সূরা একসময় ঘুমিয়ে গেলে মিসবাহ মেয়েটাকে নিজের বুকে আগলে নেই। অশান্ত হৃদয় মুহূর্তেই শান্ত হয়ে যায় প্রেমিক পুরুষের। মিসবাহ তাকালো ঘুমন্ত প্রেয়সীর মুখোস্রীতে। কিন্তু বুকে লেপ্টে থাকায় ঘুমন্ত প্রেয়সীকে দেখার সৌভাগ্য হলো না তার। মিসবাহ মুচকি হেসে অস্ফুটস্বরে বলল
“আমার বুকের আকাশের ব্যক্তিগত চন্দ্রবতী সে। কিন্তু সেই চন্দ্রের জ্যোৎস্না সারা অঙ্গে মাখার অধিকার আমার নেই। সামান্য অবহেলা যার সহ্য হয়না সে কি করে পারে অন্যকে অবহেলায় ক্ষতবিক্ষত করতে। বুক কেন কেঁপে ওঠে না তার?”
★★★★★★
ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে মুখোরিত মেদিনী। হিমশীতল আবহাওয়ায় কাটা দিয়ে উঠছে শরীরের প্রত্যেকটা লোমকূপ। তবুও বৃষ্টি প্রেমি মানুষগুলো বসে হাতে গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ নিয়ে। উপভোগ করে প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর রুপ। সিকদার বাড়িতে আজ রমরমা পরিবেশ। বাড়ির দুই গিন্নি আর কাজের মেয়েগুলো কোমড়ে শাড়ির আঁচল গুঁজে লেগে পড়েছে দুপুরের রন্ধন ক্রিয়ায়। পুরনো জমিদার বাড়ি আজ বুঝি প্রান ফিরে পেয়েছে। মানবশূন্য এই বাড়িতে শুধু মোজাম্মেল সিকদার আর তার এক ভৃত্য বাবলু থাকে। দুইতলা বাড়ি, অনেক বছরের পুরনো। জমিদারদের বংশভিটের সুবাদে এখনো মজবুত বাড়ির প্রত্যকটা ইট, পিলার। ঝিরিঝিরি অনিলে শিরশির করে উঠলো সূরার কায়া। জানালার কপাট খুলে রাখায় একটা আরেকটার সাথে বিকট শব্দে বারি খাচ্ছে। ঘুমের ঘোরেই নিজেকে গুটিয়ে নিল রমনী। পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো বজ্জাত শব্দের উৎসের দিকে। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে হিমশীতল অনিল চারপাশে বিদ্যমান। ঘরের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে তাকালো দেয়াল ঘড়ির দিকে। ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে সে অনেক আগেই বারোটার ঘর পেরিয়ে গেছে। হুড়মুড়িয়ে বিছানা ছাড়লো সূরা। কাল রাতে কখন এই ঘরে আসলো আর এতোক্ষন কেনই বা ঘুমালো সে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার। ফ্রেশ হওয়া প্রয়োজন কিন্তু রুমের কোথাও ওয়াসরুম নেই। পুরনো বাড়ি হওয়ায় ফ্রেশ হওয়ার জন্য কলপাড় আছে হয়তো। সে যে গ্ৰামে তার দাদার বাড়িতে আছে ঢের বুঝেছে। রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলো সূরা। পুরো বাড়ি ফাঁকা। সবাই কোথায় গেছে? হঠাৎ কিছু মানুষের হাসির শব্দ কর্নপাত হতেই শব্দের উৎস অনুসরণ করে এক কোনার ঘরের দিকে গেল সূরা। রান্না-বান্না চলছে এখানে। রসাইঘর দেখেই যে কেউ বলবে এটা জমিদার বাড়ির গিন্নিদের ব্যক্তিগত জায়গা। বেশ বড়। সূরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সবাই কে দেখছে। মুনতাহা সিকদার রান্না করছেন আর নিহারিকা সিকদার সাহায্য করছে। দিয়া, মীরা, মেহের আর বকুল টুকটাক সাহায্য করছে কম গল্প করছে বেশি। সবাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা বলছে। মা আর মীরাকে হাসি মুখে কথা বলতে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠল সূরার। ক্ষীন স্বরে সুধায়
“আম্মাজান?”
সবাই দরজার দিকে তাকালো। সূরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসি মুখে মুনতাহা সিকদার বলে
“দরজায় দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে আয়।”
সূরা ভেতরে গেলে নিহারিকা সিকদার এগিয়ে এসে বুকে আগলে নেই একমাত্র মেয়েকে। মায়ের বুকটা এতোক্ষন মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করলেও এখন বুঝি এক পলসা বৃষ্টিতে সিক্ত করলো তনু মন। মায়ের শরীরের গন্ধেও বুঝি শান্তি আছে। এই শান্তি কি পৃথিবীর কোনো কিছুর পরিবর্তে পাওয়া সম্ভব? উহু! কখনো না। মায়ের মতো আপন কে আছে এই ধরনীর বুকে? আঁখিজোড়া ভিজে উঠলো মা মেয়ের। কতোদিন পরে নিজের নাড়িছেঁড়া সন্তানকে বুকে নিতে পারছেন তিনি। বুক থেকে সরিয়ে মেয়ের ললাটে স্নেহের পরশ এঁকে দিলেন নিহারিকা সিকদার। বললেন
“আমার সুর! আমার মা! কেমন আছিস মা?”
“আলহামদুলিল্লাহ আম্মাজান। তুমি কেমন আছো? এখানে তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?”
“একসাথে আর কতো প্রশ্ন করবি? মাকে পেয়ে আরেক মাকে ভুলে গেলি? ভুলবিই তো। আমি তো আর নিজের মা না।”
মা মেয়ের আবেগ মিশ্রিত কথোপকথন মাঝ পথে থামিয়ে মুনতাহা সিকদার মন খারাপের মেকি ভান করে বলে উঠলেন। মুনতাহা সিকদারের কথায় মুচকি হাসলো উপস্থিত সবাই। সূরা এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো মুনতাহা সিকদারকে। আল্লাদি স্বরে বলল
“আমি কি আমার বড়আম্মুকে ভুলতে পারি?আমার বড়আম্মু তো বেস্ট। আর মা আবার নিজের পরের হয় নাকি। মা তো মা-ই হয়। তুমি কি জানো তোমাকে আর আম্মাজান কে জড়িয়ে ধরে আমি যে শান্তি পায় সেই শান্তি পৃথিবীর কোথাও নেই।”
সূরার মুখে বড়আম্মু সম্বোধন শুনে মুনতাহা সিকদারের চোখ ছলছল করে ওঠে। এই মেয়ে আস্তে আস্তে সবাইকে আপন করে নিচ্ছে দেখে প্রশান্তি অনুভব করলেন তিনি। ছলছল চোখে হাসলেন। তিনি মনে প্রাণে দোয়া করেন একদিন এভাবেই যেন তার ছেলেটাকেও আপন করে নেই সে। স্বাভাবিক হয়ে বলেন
“হয়েছে হয়েছে। আর পটাতে হবেনা আমাকে। আমার ছেলে মেয়ে সবাই আমার কাছে এক একটা কোহিনুর।”
এই বলে তিনি সূরার ললাটে স্নেহের পরশ এঁকে দিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বুকে আগলে নিলেন।সূরা কৌতুক স্বরে বলল
“পটে গেছো বলছো?”
মুনতাহা সিকদার মুচকি হেসে বলল “গেছি।”
“ইশ! বড়আম্মু আমি ছেলে হলে বিয়ে করে নিতাম তোমাকে। আজকাল মেয়ে পটানো কিন্তু খুব মুসকিল। পটে যাওয়া মেয়ে হাত ছাড়া করতাম না।”
মুনতাহা সিকদার সূরার দিকে কপোট রাগ দেখিয়ে চোখ রাঙানি দিলেন।সূরা হেসে উঠলো। প্রানখোলা হাসি। সূরাকে হাসতে দেখে নিহারিকা সিকদার আর মীরা ছলছল চোখে সূরার হাস্যোজ্জ্বল
মুখোস্রির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে হাসতে দেখে মায়ের মন মুহূর্তেই সুখে ভরে গেল কানায় কানায়। মেহের, দিয়া আর বকুল খিলখিলিয়ে হাসছে। লহমায় জমিদার রসাইঘরে হাসির পসরা বসলো যেনো। মেহের লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে আসলো সূরার কাছে। হাত ধরে গদগদ হয়ে বললো
“সূরা আপু তুমি এতোক্ষন ঘুমিয়ে ছিলে তাই বাইরে যেতে পারিনি আমরা। চলো না বাইরে থেকে ঘুরে আসি।”
“এখন? বাইরে তো বৃষ্টি হচ্ছে।”
দিয়া বলল “ধুর! ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে কেউ ভিজে নাকি। চল বাইরে যায়। ছেলেরা সবাই বাড়ির পেছনের পুকুরের দিকে গেছে গোসল করতে। চল আমরাও যাই।”
সূরার চোখ চকচক করে উঠে। বলে “সত্যি পুকুর আছে এখানে? আমার খুব মজা লাগে সাঁতার কাটতে।”
পরক্ষনে কি ভেবে আবার বলে “আমি এখনো ফ্রেশ হয়নি দিয়ু। গোসলখানা কোথায়? আমি ফ্রেশ হবো।”
বকুল বলল “আপুমনি পুকুর পাড়ে ফ্রেশ হয়ে নিও তুমি। চলো। খুব মজা হবে।”
সূরা একটু থেমে বলে “কিন্তু ছেলেরা গোসল করলে আমরা কিভাবে সেখানে গোসল করবো?”
মিরা বলে “ওদের সবাইকে তুলে দিয়ে আমরা নামবো। এখন চলতো। আগে যেমন তুই আর আমি সাঁতার প্রতিযোগিতা করতাম আজকেও করবো। তুই জিতলে আমার লাল শাড়ি টা তোর। তোর মনে আছে তো শাড়িটার কথা?”
“মনে থাকবে না আবার।ওই শাড়িটা আমার সবচেয়ে পছন্দের শাড়ি। সাঁতার কেটে আমি কখনো জিততে পেরেছি নাকি তোমার সাথে। তুমি তো দিতে চেয়েছিলে শাড়িটা কিন্তু আমি জিতলেই নিবো দেখো।”
“আজ তুই জিতে যাবি সুরপাখি।আর আমি নিজে হাতে তোকে শাড়িটা পড়িয়ে দিবো।”
সূরা মীরার দিকে তাকালো। মীরা তার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে । চোখাচোখি হয়ে গেল ওদের।সূরা দ্রুত চোখ সরিয়ে এদিক ওদিক তাকালো। মনের মধ্যে চাপা কিছু জ্বলজ্বল করে উঠলো যেন।সূরাকে এমন করতে দেখে মনে মনে কষ্ট পেল মীরা। লহমায় চোখ ছলছল করে ওঠে ওর। নিহারিকা সিকদার সবটাই খেয়াল করলেন। দীর্ঘশ্বাস গোপনে ফেলে কাজে মন দিলেন তিনি। সূরা আর মীরা সম্পর্কে ননদ ভাবি হলেও ওদের দেখে কখনো মনে হয়নি সেটা। সবসময় মনে হয়েছে আপন দুই বোন। বড় বোন ছোট বোনকে যেভাবে আগলে রাখে ঠিক সেভাবেই আগলে আগলে রাখতো মীরা সূরাকে। সূরাও ছিল মীরা বলতে পাগল। কতো পাগলামি করতো দুজনে। কিন্তু এখন সূরা মীরার থেকে দুরে সরে গেছে। অপরাধবোধ মেয়েটাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। মেয়েটা যে বড্ড অবুঝ।
#চলবে……..
(পাঠক পাঠিকারা রেসপন্স করবেন প্লীজ। আপনাদের আমার লেখা গল্প ভালো লাগলে ফলো দিবেন। নতুন পেজে প্রথম গল্প লিখছি।তাই আপনারা সাপোর্ট করলে ভালো লাগবে।)