#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_২২(প্রথমাংশ)
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা
(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)
গোধূলি বেলা। দুর আকাশে আজ রংধনুর সাত রঙ খেলা করছে। প্রকৃতির রুপের বুঝি অন্ত নেই। বৃষ্টি কখনো কান্না হয়ে নেমে আসে ধরনীর বুকে। তো কখনো দুর আকাশে রঙের পসরা সাজিয়ে বসে। ছাদের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে ষোড়শী এক কিশোরী। জীবনের রংধনুর রঙ মেলাতে ব্যস্ত সে। দুর আকাশে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে দিবাকর। আজকের মতো তার ছুটি। কাজে ছুটি পেলে কার না আনন্দ হয়। মুচকি হাসলো সে। তখনই এক শক্ত হাতের হেঁচকা টানে গিয়ে পরলো কারো বাহুডোরে। কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির বুকে গিয়ে ঠেকলো তার মাথা। নাসারন্ধ্রে পরিচিত এক ঘ্রাণ প্রবেশ করতেই বুঝলো ব্যক্তিটি কে। রায়হান সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিল মেহের কে। শক্ত কন্ঠে বলল
“তুই কি কখনো বড় হবিনা মেহু? ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে কি করছিলি তুই? এখনই পড়ে গেলে কি হতো ভেবে দেখেছিস?”
মেহের মুখ ছোট করে নিল। সে তো এমনি দাঁড়িয়ে ছিল। পড়তো নাকি।এই লোক আগে থেকেই একটু বেশি বেশি বুঝে কেন? তার জন্য কি এই কঠিন পুরুষটা এতোই বিচলিত? না তো। ছোট থেকেই রায়হানে কে ভালো লাগতো তার। আর বড় হতে হতে এই ভালোলাগা কবে যে মরনব্যাধি ভালোবাসায় রুপ নিল জানা নেই কিশোরীর। ভালোবাসা নাকি চোখে প্রকাশ পায়। তারও হয়তো পেয়েছিল। না পেলে রায়হান বুঝলো কীভাবে? এখানে আসার পরে সে রায়হান কে ফোন দেয় গ্ৰামে আসার জন্য। কিন্তু ফোনের অপর পাশে মেহেরের উৎকণ্ঠা বুঝি রায়হানের বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি। সেদিন রায়হান মেহের কে জানিয়ে দেয় সে যেন আবেগে না ভাসে। সেদিনের কথা মনে করে অভিমানী রমনী ডুকরে উঠে। অভিমানে গলা রোধ হয়ে আসছে তার। মেহের কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল
“পড়তাম না রায়হান ভাই। আর যদি পড়েও যেতাম তাতে আপনার কি কিছু যাই আসতো? আমি থাকি বা না থাকি আপনি তো দিব্যি ভালো থাকবেন তাইনা?”
রায়হান শক্ত কন্ঠে বলে “মেহের?”
“কি মেহের? আপনি কেন ভালোবাসলেন না আমাকে রায়হান ভাই? কেন ফিরিয়ে দিলেন আপনার হৃদয়ের দরজা থেকে? আমি তো একবারও আমার ভালোবাসার দাবি নিয়ে যাইনি আপনার কাছে। আপনি নিজে বুঝে নিয়ে আমায় ফিরিয়ে দিলেন।”
“তুই এখনো ছোট মেহু। এসব আবেগ ভুলে যা।”
“আবেগ নাকি বেশিদিন থাকে না। সময়ের পরিক্রমায় মিলিয়ে যায় সব মোহ আবেগ। আমার যদি আবেগ হতো তাহলে এতো গুলো বছর আমাকে দগ্ধ করছে কেন? মিলিয়ে যাচ্ছে না কেন? ভালো নাই বা বাসলেন রায়হান ভাই। কিন্তু আমার ভালোবাসা কে আপমান করবেন না।”
আর দাঁড়ালো না মেহের। ব্যস্ত পায়ে নেমে গেল ছাদ থেকে। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে তৃষ্ণার্ত এক প্রেমিক। বুকে তার অসহনীয় যন্ত্রনা। এই কিশোরী যদি একবার জানতো তার বিরহে কতোটা কাতর এই যুবক তাহলে কি এভাবে চলে যেতে পারতো? রায়হান অস্ফুটস্বরে বলে
“তুই যে বড্ড অবুঝ শুভ্র কাদম্বরী। তুই যদি একবার দেখতি এই হৃদয়ের প্রত্যেকটা স্পন্দন তোর নামে তবে কি তুই আমাকে তোর প্রেমের দহনে দগ্ধ করতে পারতি?”
★★★★★★
পড়ন্ত বিকেলে দিবাকর পশ্চিমাকাশে ঠায় নিয়েছে। রক্তিম আভায় প্রজ্জ্বলিত আকাশ। জমিদার বাড়ির ছোট সদস্যরা বেরিয়েছে গ্ৰাম ভ্রমন করতে। গ্ৰামের সরুপথ ধরে তারা এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যহীন পথে। মিসবাহ, রায়হান আর নুহাশ আগে আগে হাঁটছে। বাকিরা পেছনে। গ্ৰামের সরুপথে হাঁটতে খারাপ লাগছে না কারোর। বরং সবাই উপভোগ করছে এই মিষ্টি মধুর সময়টা। জিহাদ ক্যামেরা বন্দি করছে প্রকৃতির বিচিত্র রুপ। জিহাদ গদগদ হয়ে বলে
“সত্যি গ্ৰামের প্রকৃতি মানেই ভালোবাসার আর এক নাম। শহরের কোলাহল, যানযটে জীবন অতিষ্ট। আমি আর শহরে ফিরছিনা। দাদুর কাছে কিছু জমি ধার নিয়ে চাষাবাদ করে এখানেই বউ বাচ্চা নিয়ে থেকে যাবো।”
রাফি ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলে ” বাড়িতে কি কখনো এক গ্লাস পানি ঢেলে খেয়েছিস যে গ্ৰামের খেতে চাষাবাদ করে খাবি?”
সিহাব বাঁকা হেসে বলে “তাছাড়া চাষাবাদ তো দুরের কথা বউ বাচ্চা যে নিয়ে থাকবি বলছিস আগে বউ তো পেয়ে নে বাচ্চা তো বিলাসীতা।”
শব্দ করে হেসে উঠলো মেয়েরা। মেহের আর বকুল তো হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বাচ্চা দুটো মেয়ের সামনে এভাবে বন্ধু নামক শত্রুদের অপমান হজম হলো না জিহাদের। জিহাদ তেড়ে আসলো রাফি আর সিহাবের দিকে। ওদের আর পায় কে। মুহূর্তেই গ্ৰামের সরুপথে ছুটলো তিনজন। মেয়েরা হাসছে। মিসবাহরা তিনজনও দাঁড়িয়ে গেল। অন্ধকার হয়ে আসছে, এখন বাড়িতে ফিরে যাওয়া উচিৎ। মিসবাহ বলল
“অনেক ঘোরাঘুরি হয়েছে। বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিৎ। অন্ধকার হয়ে আসছে। চলো সবাই।”
সূরা আবদার করে বলল “আর একটু ঘুরে দেখি নাহ্। গ্ৰামটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।”
রায়হান বলে “মিষ্টি পরী মিসবাহ ঠিক বলেছে। আমাদের এখন ফিরে যাওয়া দরকার। অন্ধকার হয়ে গেলে বাইরে থাকা উচিৎ হবেনা।”
মেহের ফট করে বলে ওঠে “আপনার মতো সবাই ভীতু না রায়হান ভাই। কিছু হবেনা।”
রায়হান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মেহেরের দিকে। এই মেয়ে নাকি বড় হয়েছে। মিসবাহ গম্ভীর স্বরে বলে
“আমি যখন বলেছি এখন বাড়ি ফিরতে হবে তো এখনি ফিরতে হবে। আমি কারো কোনো কথা শুনতে আগ্রহী না এখন। সৃষ্টিকর্তা যখন সবার মাথায় বুদ্ধি দিচ্ছিল তখন হয়তো তোর সূরা আপু ঘাস কাটতে গেছিল। তাই মনে হয় তার মাথা পুরো ফাঁকা। সবসময় দুই লাইন বেশী বোঝা তোর সূরা আপুর প্রিয় একটা কাজ।”
মিসবাহ আর না দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে। সূরা কটমট করে তাকায় মিসবাহর যাওয়ার দিকে। কতোবড় বদ লোক হলে এভাবে অপমান করে ভাবা যায়। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ঠিকই কথা শুনিয়ে গেল তাকে। সবাই মিটিমিটি হেসে মিসবাহর কথায় সম্মতি জানিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। সূরাও পেছনে পেছনে পা বাড়ায় বাড়ির পথে। যে যার মতো কথা বলায় ব্যস্ত। হঠাৎ মিসবাহ কি মনে করে পেছনে তাকায়। মেয়েরা সবাই আছে কিন্তু সূরা নেই। কপালে ভাঁজ পড়ে মিসবাহর। দিয়া কে উদ্দেশ্যে করে ব্যস্ত কন্ঠে বলে
” সুর কোথায় দিয়া? ও তো তোমাদের সাথেই ছিল।”
দিয়া সহ সবাই ভালো করে খেয়াল করে দেখে সূরা নেই। বিচলিত হয়ে পড়ে সবাই। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গ্ৰামে সন্ধ্যার পরে কেউ বাড়ির বাইরে বের হয়না বললেই চলে। নুহাশ মীরাকে শক্ত কন্ঠে বলল
“তোমরা এতো গুলো মেয়ে একটা মেয়েকে দেখে রাখতে পারোনা। এর জন্য বলে মেয়েরা গল্প করতে পারলে আশেপাশের খেয়াল থাকে না তাদের। মীরা তুমি অন্তত আমার বোনটাকে দেখে রাখতে পারতে।”
মীরা ক্ষীন স্বরে বলে “আমাদের সাথেই তো ছিল। সবার সাথে বেশ হাসি খুশিই ছিল। আমি বুঝতে পারছি না কোথায় গেল সুর। তোমরা একটু আশেপাশে দেখো না। আমার চিন্তা হচ্ছে।”
নুহাশ ধমকে উঠে “ছিল তো কোথায় আমার বোন মীরা? এতোটা কেয়ারলেশ কি করে হতে পারো তুমি?”
নুহাশের উচ্চ স্বরে বলা কথায় মেয়েরা মাথা নিচু করে নিল। নুহাশ কখনো মীরার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলেনা। কিন্তু সূরা যে তার প্রাণ। সবার সামনে যাই বলুক নুহাশ দোষ তো তারই । মেয়েটাকে দেখে রাখা উচিত ছিল তার। চিন্তা তো তারও হচ্ছে। কিন্তু নুহাশ কি করে বলতে পারলো আমার বোন। সূরা কি শুধু তার বোন। মীরার কি কেউ না। মা বাবা মারা যাওয়ার পরে ভাই ভাবির ঘাড়ে বোঝা হয়ে তাদের সংসারে ছিল মীরা। নুহাশ এক দেখায় প্রেমে পড়ে তার। এতিম জেনেও ভালোবাসায় কখনো কমতি রাখেনি সে। নিহারিকা সিকদার আর মিজানুর সিকদার সাদরে গ্রহণ করে তাকে। তারা যেমন মা বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি তেমনি সেও স্বামীর পরিবারকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছে। আর বিয়ের পরে সূরা তো ছিল তার সবচেয়ে কাছের। নিজের বোনের চেয়ে কম ভালোবাসেনি সূরাকে। আর আজ নুহাশ সবার সামনে নিজের বোন বলে কি বোঝালো সূরা একা তার বোন ।মীরার কেউ না? ছলছল করে উঠল চোখ।মেয়েরা হয়তো এমনি। সবচেয়ে কাছের মানুষটার সামান্য কথায় আঘাত লাগলে অভিমানে চোখ ছলছল করে ওঠে। চোখ হয়তো তাদের ভেতরের কষ্ট ব্যক্ত করে। মিসবাহ শান্ত কিন্তু গম্ভীর স্বরে বলে
“নুহাশ তুই কি জমিদারদের বংশ পরম্পরা ধরে রাখার চেষ্টায় আছিস? সুরের জন্য আমরা সবাই চিন্তিত তাই বলে সম্পর্কে ছোট বড় সবার সামনে মীরা কে এভাবে বলবি? তোর কি উচিত হলো এই কথা গুলো বলা? চিন্তা, রাগ সব আমরা ব্যক্ত করতে একটা মানুষ কে বেছে নেয়। কিন্তু আমরা কি ভাবি অপর পক্ষে যে আছে তাকে আঘাত দিয়ে ফেললাম কিনা? আমি আমাদের বাড়ির বউয়ের অপমান মেনে নিব না নুহাশ।”
নুহাশ মাথা নিচু করে নিল। আড়চোখে একবার মীরার দিকে তাকালো সে। বোনের চিন্তায় কি প্রিয় অর্ধাঙ্গিনীকে আঘাত করে ফেললো সে? মিসবাহ আর কিছু না বলে যে পথে এসেছিল সে দিকেই গেল সূরার খুঁজতে। তার পিছু পিছু ছুটলো সবাই। মিসবাহ শুধু এইটুকু চাওয়া মেয়েটা যেন ঠিক থাকে। মিসবাহ বিরবিরালো
“আমি ভুল করেছি। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল তুমি আমার প্রানভোমরা সুর। একটু চোখের আড়াল হলেই দেখ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে আমার। অক্সিজেনের অভাবে মানুষ যেমন ধুঁকে ধুঁকে মরে তেমনই তোমার দুরত্বে আমি মরি প্রতিনিয়ত। তাহলে কি ধরে নিব তুমি আমার অক্সিজেন?”
#চলবে ……..
(আর দুই তিন পর্বেই সূরার অতীত খোলাসা করবো। অপেক্ষা করো আর পাশে থেকো সবাই। অতীতের মুখোমুখি হওয়ার জন্য রেডি তো তোমরা ? টিস্যু পেপার নিয়ে বসবা। চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলো না আবার।
জাস্ট ফান গাইস 😛)