#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_২৬
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা
(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)
বর্ষার মেঘমালার কখনো ভরসা নেই। কখন কান্না হয়ে ধরনীর বুক কাঁপিয়ে আছড়ে পড়ে বোধগম্য হয়না কারোর। বাতাসে আজ বুঝি পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেন নেই। থাকলে কি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসতো মিসবাহর। মিসবাহর নিঃশ্বাস যেনো থমকে গেছে। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে কেন তার? মিসবাহ ওষ্ঠধর ফাক করে তপ্ত শ্বাস ফেলে। সূরা অনুভূতিহীন চোখে তাকিয়ে আছে মিসবাহর দিকে। অনন্যা তাচ্ছিল্য হেসে বলে
“ডিভোর্সি মেয়ের প্রতি এতো দরদ আপনার? তা কি দেখিয়েছিস রে সূরা? ডিভোর্সি হয়েও তোর দর কমেনি দেখছি।”
ড্রয়িং রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। বজ্রপাতের মতো একটি শব্দ প্রতিধ্বনি হতে থাকে ডিভোর্সি।মোজাম্মেল সিকদার সহ উপস্থিত সকলে হতভম্ব। মিসবাহর কানে বারবার প্রতিধ্বনি হতে থাকে একটি শব্দ “ডিভোর্সি”। বিষ্ময়কর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে সূরার দিকে। সূরা তার দিকেই তাকিয়ে আছে নিষ্প্রান চোখে। সে চোখের ভাষা বুঝতে সক্ষম হয় না মিসবাহ। ড্রয়িং রুমে উপস্থিত সকলের মাঝে শোরগোল পড়ে যায়। জমিদার বাড়ির কন্যা ডিভোর্সি। ছিঃ ছিঃ বলে ওঠে এতক্ষন নিরব থাকা দর্শকগুলো। এদের কেই হয়তো বলে প্রতিবেশী। এরা নিজের সংসারের চেয়ে অন্যের সংসার নিয়ে বেশি মাথা ঘামায়। নাক গলিয়ে নাক বোচা করে ফেলে তবুও তাদের আগ্ৰহের শেষ নেই। সূরা মিসবাহর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মিসবাহর এক হাত ধরে। করুন চোখে মিসবাহর দিকে তাকালো সূরা। মিসবাহ অনুভূতিহীন চোখে তাকিয়ে আছে। সূরা কিছু বলবে তার আগেই কেউ এসে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে সূরাকে। আগন্তুক ব্যক্তিটি বলে
“সুর। আমার সুর। আমাকে ছেড়ে আর যাসনা কলিজা। তুই ফিরে এসেছিস। আমরা দূরে কোথাও চলে যাবো কেমন। তোকে আর কষ্ট পেতে দিবো না।”
মিসবাহ হাত ছাড়িয়ে সরে আসে সূরার থেকে। সূরা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। পিনপতন নীরবতা। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই । সবকিছু নিস্তব্ধতায় ঘেরা। সূরা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা আগন্তুক ব্যক্তিটিকে সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দেয়। নিজের জামা কাপড় ঝাড়তে শুরু করে। দেখে মনে হবে ওর গায়ে কেউ ময়লা লাগিয়ে দিয়েছে। সূরা এলোমেলো হয়ে ওঠে। প্রিয়া আগলে নেই সূরাকে। বলে
“সুর কি হয়েছে এমন করছিস কেন?”
“তুই বুঝতে পারছিস না পিয়ু আমার সারা শরীরে ময়লা লেগে আছে। ওই লোকটা আমায় কেন ছুঁয়েছে। ইশ! ছিঃ! দুর্গন্ধ বের হচ্ছে আমার শরীর থেকে।”
পিয়াস একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সূরার দিকে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা রমনীটি কি তার সূরা? নাহ্! তার সূরা তো তাকে ভালোবাসে তাহলে এই রমনীকে এতো অপরিচিত লাগছে কেন তার কাছে। পিয়াস কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই সূরা লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। সবাই ছুটে আসে সূরার কাছে। নিহারিকা সিকদার মেয়ের অবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে উঠে। পিয়াস সূরার দিকে এগিয়ে গেলে নুহাশ পিয়াসের চোয়াল বরাবর ঘুষি মেরে দেয়। চেঁচিয়ে বলে
“দূরে যা তুই। আমার পুতুলের ওপর তোর ছায়া পড়লেও আমি তোকে খুন করে ফেলবো জা***বাচ্চা।”
নুহাশ কোলে তুলে নেয় সূরাকে। বেড়িয়ে যায় বিয়ে বাড়ি থেকে। প্রিয়া ফুঁপিয়ে উঠলে রিতু গিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে। এতোকিছু মিসবাহ দূরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখে। সে আসেনা তার সুরজানের কাছে। অনুভূতি শূন্য সে। তাকে দেখলে যে কেউ বলবে পাষাণ পুরুষ সে। প্রেয়সী লুটিয়ে পড়ে রইলো মাটিতে কিন্তু পাষাণ পুরুষ কাছে গিয়ে আগলে নিল না। এতোটাই কি পাষাণ সে? কঠোর লৌহ মানব। রায়হান তাকায় মিসবাহর দিকে। এতো কিছুর পরেও কিভাবে এতোটা শান্ত এই কঠিন মানবটা? নাকি ভেতরে বয়ে চলা তান্ডব সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সে। রায়হান মিসবাহর হাত ধরে বেরিয়ে যায়। মিসবাহ বাধ্য বাচ্চার মতো যায় রায়হানের পিছু পিছু। পিয়াস মেঝেতে বসে পড়ে। আবার হারিয়ে ফেললো সে সূরাকে। বুকের অসহনীয় ব্যথা বিষিয়ে তুলেছে তনু মন। পিয়াস অস্ফুটস্বরে বলে “আমার সুর”
★★★★★★
সিকদার বাড়ির সকলের মুখে আজ নেই কোনো হাসি, নেই কোনো প্রানের উচ্ছ্বাস। অনুভূতিহীন প্রত্যেকে নিরবতা পালন করে চলেছে প্রায় পনের-বিশ মিনিট। সিকদার বাড়িতে আজ যেনো প্রান নেই। সবাই একদৃষ্টে চেয়ে আছে মেঝেতে এলোমেলো হয়ে বসে থাকা সূরার দিকে। গাড়িতেই সূরার জ্ঞান ফিরে আসে। কিন্তু জ্ঞান ফেরার পর তার কন্ঠনালি ভেদ করে বেরিয়ে আসেনি একটা শব্দও। গাড়ি সদর দরজা দিয়ে বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করলে সূরা কোনো দিকে না তাকিয়ে নেমে পড়ে গাড়ি থেকে। বসার ঘরে এসে সোফায় না বসে মেঝেতে পা গুটিয়ে বসে সে। তখন থেকে পনের-বিশ মিনিট পাড় হয়েছে কিন্তু সূরার কোনো নড়চড় নেই। দেখে মনে হবে জীবন্ত লাশ সে। নুহাশ তাকালো বোনের দিকে। মনের ভেতর থেকে যেনো কেউ বলে উঠলো তার জীবন্ত পুতুল লাশ। বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো নুহাশের। নিহারিকা সিকদার মেয়ের কাছে এগিয়ে গেলেন। পাশে বসতে উদ্যত হলে সূরা শান্ত স্বরে বলে
“আমার থেকে দূরে যাও আম্মাজান।”
নিহারিকা সিকদার সূরার পাশে বসে মেয়েকে বুকে আগলে নিলেন। ভেজা কন্ঠে বলেন
“ও মা! এমন বলে না মা। তুমি আমার বুকের মানিক। আমাকে দূরে যেতে বলোনা আম্মা।”
সূরা নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় নিহারিকা সিকদারের থেকে। একটু দূরে সরে শান্ত স্বরে বলে
“আমি তোমাকে দূরে যেতে বলেছি আম্মাজান। দেখছো না আমার সারা শরীরে কাঁদা লেগে আছে। এতো ময়লা। ময়লা পচে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। যাও, যাও দূরে যাও।”
নিহারিকা সিকদার ডুকরে উঠে। কিছু বলতে চাইলে সূরা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিজের মায়ের দিকে। মুনতাহা সিকদার এগিয়ে গিয়ে নিহারিকা সিকদারকে নিয়ে আসেন সূরার কাছে থেকে। সোফায় বসিয়ে বড় বোনের মতো বুকে আগলে নেই তাকে। নিহারিকা সিকদার বিলাপ করে কাঁদছেন। নীরবে চোখের পানি ছেড়ে দেয় মুনতাহা সিকদার। রায়হান সূরার দিকে তাকিয়ে ভাবে এই মেয়ে কি এখন নিজের মধ্যে আছে? থাকলে কি নিজের মায়ের সাথে এমন আচারন করতে পারতো? কখনোই না। যে মেয়ে পরিবার ছাড়া কিছু বুঝে না সে মেয়ে এমন আচারন করতেই পারেনা। বড্ড অন্যরকম লাগছে সূরাকে। রায়হান সূরার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাকায় পাশে বসা মিসবাহর দিকে। সে একদৃষ্টে চেয়ে আছে সূরার দিকে। দুজনেই এখন শান্ত। এতো শান্ত পরিবেশ কি ঝড়ের পূর্বাভাস নাহ্? জানা নেই রায়হানের। লহমায় সূরা শব্দ করে হেসে উঠে। সবাই বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে দেখে সূরাকে। সূরা কিছুক্ষন একা একা বিরবির করে চেঁচিয়ে বিদ্রুপের স্বরে বলে ওঠে
“জমিদার কন্যা ডিভোর্সি।”
আবার শব্দ করে হাসে সে। মুখ তুলে তাকায় মিসবাহর দিকে। চোখে হাসে সূরা। যে রমনীর চোখের গভীরে হারিয়ে যায় মিসবাহ আজ সেই রমনীর চোখ জোড়া নিষ্প্রান। এই চোখ নিষ্প্রান কেন আজ? সূরা মুচকি হেসে নিষ্প্রান কন্ঠে বলে
“ও ডাক্তার! দেখুন না কতো ময়লা আমার শরীরে। পচন ধরেছে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে চারদিকে। আমাকে ঘৃনা হচ্ছে আপনার তাইনা। আমি জানি ঘৃনা হচ্ছে। আমারো ঘৃনা হচ্ছে নিজেকে। আমি কি মরে যাবো ডাক্তার?”
ডুকরে কেঁদে উঠল নিহারিকা সিকদার। মেয়ের কষ্ট সহ্য হয়না তার। মুনতাহা সিকদার, দিয়া, মীরা, মেহেরও নিরবে অশ্রু ফেলে। মেহের ফুঁপিয়ে উঠে। বলে
“সূরা আপু এসব কেনো বলছো তুমি। তুমি কষ্ট পেয়োনা আপু। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি আপু।”
মেহেরের কথা শুনে সূরা ছলছল চোখে তাকায় মেহেরের দিকে। পরক্ষনে মোজাম্মেল সিকদারের উদ্দেশ্যে শান্ত স্বরে বলে
“দাদাজান আপনি চাইলে আমি চলে যাবো এখান থেকে। আমার জন্য আপনার অনেক অসম্মান হয়েছে আজ। আমায় মাফ করবেন।”
সূরার শান্ত স্বরে বলা কথায় মিসবাহর বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যায়। বিষ ব্যথায় নীল হয়ে উঠে শরীরের শিরা উপশিরা। ভেতরের এই দহনে দগ্ধ হতে হতে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে সে। শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে নিষ্ঠুর রমনীর দিকে। মোজাম্মেল সিকদার বলেন
“বড়গিন্নি আমার কাছে এসে বসো। আমাকে সব খুলে বলো। দাদাজান সব ঠিক করে দিবে বিশ্বাস রাখো।”
সূরা আবার হেসে ওঠে। বুকের অসহনীয় যন্ত্রনা আড়াল করতেই কি হাসির পসরা সাজিয়ে বসেছে এই রমনী। জানা নেই কারোর। সূরা কন্ঠে তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে বলে
“আমার সারা অঙ্গ কলঙ্কে ঢেকে আছে। কাঁদায় মাখামাখি। মুখে দেখো কালি লেগে আছে। ছিঃ ছিঃ দুর্গন্ধ।”
সূরা বিরবির করে মুখে হাত ঘোষে। একটা কথায় আওরায় “কালি লেগে আছে।” হয়তো মুখের কালি হাত দিয়ে তোলার আপ্রান চেষ্টা তার। নিহারিকা সিকদার আহাজারি করছেন। মিজানুর সিকদার আর পারেন না মেয়ের হাহাকার সহ্য করতে। ডুকরে উঠেন তিনি। মোজাম্মেল সিকদারের পায়ের কাছে বসে তার হাঁটুতে মাথা রেখে ভেজা কন্ঠে বলেন
“আব্বাজান আমার মেয়েটাকে বাঁচান। আমি বাবা হয়ে পারিনা আমার মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে। আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমার পাপের শাস্তি কি আমার মেয়ে পাচ্ছে? আমার বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে আব্বা।”
এতোক্ষন ধরে রাখা অশ্রু মোজাম্মেল সিকদার আর ধরে রাখতে পারেন না। সন্তানের কষ্ট কোনো বাবা মা সহ্য করতে পারেন না। মোজাম্মেল সিকদার অতি আদরের ছোট ছেলের মাথায় হাত রাখেন। সিকদার বাড়ির প্রত্যেকের আজ মন কাঁদছে। হৃদয়ে রক্তক্ষরন হচ্ছে। পঞ্চপান্ডবের চারজনের আজ বেহাল দশা। একে অপরের সামান্য কষ্ট যাদের সহ্য হয়না তারা কি করে পারবে প্রানপ্রিয় বান্ধবীর হৃদয় নিংড়ানো হাহাকার সহ্য করতে? প্রত্যেকের কঠোর ব্যক্তিত্ব আজ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই তাহলে সিকদার বাড়ির প্রত্যেক পুরুষের চোখ আজ অশ্রুসিক্ত কেন? অনিলও বুঝি আজ ভারি হয়ে উঠেছে। এতো কিছুর মধ্যেও শুধুমাত্র নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রেখেছে এক কঠোর মানব। শান্ত অবিচল চোখে তাকিয়ে আছে তার প্রানভোমরার দিকে। ব্যক্তিত্বের বাইরে কিছু করতে সে নারাজ। ভেতরের উচাটন মন বোঝাতে চায়না সে। মাহমুদ সিকদার ভাইয়ের পাশে মেঝেতে বসে কাঁধে হাত রাখেন। ডুকরে উঠেন মিজানুর সিকদার। মোজাম্মেল সিকদার ভেজা কন্ঠে বলেন
“মিজানুর আমার এতোটুকু বড়গিন্নির বিয়ে কেনো দিয়েছিলে? তোমার কাছে কি বোঝা হয়ে গিয়েছিল সে? সব খুলে বলো আমাদের।”
সূরা দাদাজানের কথা শুনে শব্দ করে হাসে। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। মেহের মীরাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে। সূরাকে দেখে তার ভয় করছে। হাসি থামিয়ে সবার দিকে তাকায় সূরা। সবার কৌতুহলী দৃষ্টি তার দিকেই দেখে মুচকি হাসে সে। মিসবাহর দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে
“বিষাদের সাগরে আব্বাজান ডুবিয়ে দেয় নি। আমি নিজে সেই সাগরে ডুবেছি। বিষাদের সাগরে ডুবে পচন ধরেছে শরীরে। বিয়ে নামক বিষাক্ত বিষ আমি নিজে পান করেছি।”
আবার হেসে উঠলো সূরা। সবার দৃষ্টি বিষ্ময়কর। এই কথার রহস্য কি? লহমায় ফুঁপিয়ে উঠে রমনী।
#চলবে…..
(সূরার অতীত কিন্তু আপনাদের সামনে।মেয়েদের ক্ষেত্রে সতীন হলে ছেলে দের ক্ষেত্রে কি হয় গাইস🤔। সে যাই হোক। পিয়াস কে ফুল দিয়ে বরন করে নিন।)