#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_৩৪
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা
(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)
দেখতে দেখতে সেই শুভক্ষণ চলেই এলো। একদম নিরিবিলি আয়োজন। জমিদার বাড়ির সদস্যরা আর পঞ্চপাণ্ডব ছাড়া তেমন কেউ নেই। আছে শুধু প্রিয়া। মোজাম্মেল সিকদার চেয়েছিলেন আদরের নাতির ধুমধাম করে বিয়ে দেবেন। পুরো পিরোজপুর জানবে আজ মোজাম্মেল সিকদারের বড় নাতি আর তার আদরের বড় গিন্নির আকদ। কিন্তু হলো কই! দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মোজাম্মেল সিকদার। হাসি মুখে গিয়ে বসেন কাজী সাহেবের পাশে। কাজী সাহেব এখন কাগজ পত্র ঠিক করতে ব্যস্ত। জমিদার বাড়ির বসার ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে যেন। সবাই হাসি মুখে অপেক্ষা করছে পবিত্র সেই মুহূর্তের। কখন মিসবাহ আর সূরা পবিত্র এক বন্ধনে আবদ্ধ হবে সেই মুহূর্তের অপেক্ষা। সবাই হাসি মুখে থাকলেও মুখে হাসি নেই শুধু এক মানবের। যার আজ সবচেয়ে বেশি খুশি হওয়ার কথা সে আজ গম্ভীর। মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। দেখে মনে হচ্ছে তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রায়হান বন্ধুর দিকে তাকালো। সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা পরনে। সবাই জোর করেছিল শেরওয়ানি পড়ার জন্য। কিন্তু এই ঘাড় ত্যাড়ার ঘাড়ের একটা রগ বরাবরই বাঁকা। তার কথা শেরওয়ানি না পড়লে কি বউ পালিয়ে যাবে নাকি বিয়ে করবেনা? বউ আমারই থাকবে। এসব শেরওয়ানি পড়ে বসে থাকতে পারবোনা। বিরক্ত হয় ছেলেরা। এটা কোনো কথা। বিয়েতে একটু তো সাজগোজের প্রয়োজন আছে নাকি। কিন্তু এই ঘাড় ত্যাড়া পুরুষকে সেই কথা কে বোঝাবে। তবে মিসবাহকে সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা তে মন্দ লাগছেনা। সুদর্শন পুরুষ সে। সাদা পাঞ্জাবি, সাদা টুপি মাথায় শুদ্ধ পুরুষ লাগছে। কিন্তু এই মানবের বিরক্তির কারণ বোধগম্য হলো না রায়হানের। রায়হান মিসবাহর একটু কাছে ঘেষে ফিসফিসিয়ে বললো
“এই ভাই এমন পল্টি মুরগির মতো ফুলে আছিস কেন? কি হয়েছে?”
মিসবাহ কটমট করে তাকালো রায়হানের দিকে। রায়হান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। ক্যাবলামার্কা হাসি দিয়ে দূরে সরে বসে। মিসবাহ শান্ত চোখে তাকালো সামনে বসা রমনীর দিকে। তার শখের নারী পর্দার ওই পাশে বসে আছে। পর্দার কথা মাথায় আসতেই মন মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় মিসবাহর। এটা কোনো কথা! এতো বছরের অপেক্ষার এই প্রতিদান পাচ্ছে সে। মেনে নেওয়া যায় এই নিষ্ঠুরতা। বাদ আছর বিয়ের কথা থাকলেও এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়। জমিদার বাড়ির বসার ঘরে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। মিসবাহ মনে মনে ভেবেই রাখে তার সুরজান যখন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামবে তখন সে ফিল্ম হিরোদের মতো ড্যাবড্যাপ করে তাকিয়ে থাকবে তার সুরজানের দিকে। এতোদিনের তৃষ্ণার্ত চোখের তৃষ্ণা মেটাবে। কিন্তু তার ভাবনায় এক বালতি পানি ঢেলে দিল বজ্জাত পঞ্চপাণ্ডবের দল। এদের মাথায় তো এমনি শয়তানি বুদ্ধি গিজগিজ করে আর তার সাথে যোগ হয়েছে তার বন্ধু নামক শত্রু। সূরাকে মিসবাহ আসার আগেই বসার ঘরে নিয়ে এসে বসিয়ে রাখে তারা। তাও ঠিক ছিল কিন্তু বর আর কনের বসার মাঝে পাতলা একটা সাদা পর্দা টাঙ্গানো কোথাকার নিয়ম। বিরক্ত তো তখন হলো যখন দেখলো সূরার মুখ পর্দা ভেদ করে দেখা গেলেও ওরনা দিয়ে মুখের সামনে একহাত সমান যে ঘোমটা দিয়েছে তা ভেদ করে সূরার মুখ কেন তাকে চেনায় দায়। মিসবাহ বিরক্ত হয়। তার মনে বলার বাসনা জাগে “এই পর্দা সরাও, আমি আমার বউ কে মন ভরে দেখবো।” কিন্তু সে এতোটাও কি নির্লজ্জ নাকি। যতই হোক লজ্জার মাথা খেয়ে তো আর নিজের বউকে দেখতে চাইতে পারেনা। হঠাৎ মনের ভেতর থেকে কেউ বলে উঠলো “মিসবাহ তোর মধ্যে লজ্জা আছে জানলে তোর সুরজান আজ নির্ঘাত অজ্ঞান হয়ে যেতো। তোর আর বিয়ে করা হতো না।” মিসবাহ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কাজী সাহেবের কথায় নড়েচড়ে বসে সে। তিনি বিয়ে পড়াতে শুরু করেছেন। সূরাকে কবুল বলতে বললে সূরা চুপ করে থাকে। মিসবাহর ভ্রু কুঁচকে যায়। বিচলিত হয়ে ওঠে মন। পেয়েও কি পাওয়া হবেনা তার শখের একান্ত ব্যক্তিগত রমনীটিকে? মিজানুর সিকদার সোফা ছেড়ে উঠে সূরার কাছে গেলে প্রিয়া সূরার পাশে থেকে সরে গিয়ে তাকে বসার জায়গা দেন। তিনি মেয়ের পাশে বসেন। নুহাশ বসে অপর পাশে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে স্বরে বলে
“আম্মাজান!”
লহমায় সূরা ফুঁপিয়ে উঠলো। হকচকিয়ে গেল সকলে। মিসবাহ সূরার কাছে উঠে যেতে চাইলে মাহমুদ সিকদার ছেলের কাধে হাত রাখেন। শান্ত স্বরে বলেন
“চিন্তা করোনা। মেয়েটা হয়তো ভয় পাচ্ছে। তোমার চাচ্চু সামলে নিবে।”
“ভয় পাবে কেন বাবা? তার মতেই তো বিয়ে হচ্ছে।”
মাহমুদ সিকদার মুচকি হেসে বলল “আমার বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান ছেলে এই প্রশ্ন করছে?”
মিসবাহ তাকালো মাহমুদ সিকদারের দিকে। লহমায় নিজের প্রশ্নে নিজেই বিরক্ত হলো সে। ভয় পাবারই তো কথা। একবার যে মেয়ে মরন যন্ত্রণা ভোগ করেছে সেই মেয়ে এতো সহজে মেনে নিতে পারবে এসব? আদৌ কি সম্ভব? মাহমুদ সিকদার শক্ত করে ছেলের হাত ধরে আছেন। হয়তো ভরসা দিচ্ছেন বাবা হিসেবে সবসময় পাশে থাকার। মিজানুর সিকদার সূরার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছে। নুহাশ বোনের হাত শক্ত করে ধরে। ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলল
“ইশ পুতুল! চোখের পানি নাকের পানি এক করে কি করেছিস বলতো? ছ্যাঃ! ছ্যাঃ! বিয়ের মেকআপ তো নষ্ট হয়ে গেল।”
মুচকি হাসে সূরা। পরক্ষনে সূরা ভয় মিশ্রিত কন্ঠে বলে “আমার ভয় করছে ভাইজান। তোমার পুতুলের ভাগ্যে কি এতো সুখ সইবে?”
মিজানুর সিকদার আদুরে স্বরে বলে “আম্মাজান! আমার আম্মা তো ভীতু না। সে সাহসী। আপনার আব্বাজানের উপরে এইটুকু ভরসা রাখেন। আমি এক রাজকুমারের হাতে আপনাকে তুলে দিচ্ছি। যে আপনার হাত কখনো ছাড়বে না।”
মীরা সূরার গালে হাত রেখে বলে “তুই আমাদের রাজকন্যা হলেও ওই সুদর্শন পুরুষের কাছে তুই তার হৃদয়ের রানী।”
সূরা ছলছল চোখে হাসে। তার হাসি ঘোমটার আড়ালেই থেকে যায়। কাজী সাহেব আবার কবুল বলতে বললে সূরা বিনা বাক্যব্যয়ে ক্ষীন স্বরে বলে “আলহামদুলিল্লাহ কবুল”। সূরার মুখে কবুল শুনে মিসবাহ অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো “আলহামদুলিল্লাহ”। সূরা পরপর তিনবার কবুল বলে নিজেকে লিখে দেয় মিসবাহ নামক প্রেমিক পুরুষের নামে। কাজী সাহেব আবার বিয়ে পড়িয়ে মিসবাহ কে কবুল বলতে বললো। মিসবাহ মুখে অমায়িক হাসি ফুটিয়ে তুলে বিনা বাক্যব্যয়ে পরপর তিনবার “আলহামদুলিল্লাহ কবুল” বলে। সূরার মুখে হাসি ফুটে উঠল। লহমায় লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠলো কপোলদ্বয়। পঞ্চপাণ্ডবের চারজন বেজায় খুশি। জিহাদ আর মেহের তো পারেনা লুঙ্গি ডান্স দেয়। প্রিয়া ছলছল চোখে হাসে। তার একটাই চাওয়া এই মেয়েটা একটু সুখে থাক। তারও তো একটু সুখ পাপ্য। প্রাপ্তির খাতা যে শূন্য এই মেয়ের। কিন্তু বড় ভাইয়ের জন্যেও কষ্ট হচ্ছে তার। নিজের ভুলের জন্য আজ সে সর্বস্বহারা। সূরার মুখে হাসি, মনে ভয়। এই সুখ সইবে তো!
★★★★★★★
পুরুষালী কান্নার আওয়াজে ভারি হয়ে উঠেছে জমিদার বাড়ির পরিবেশ। প্রকৃতি যেনো বিদ্রুপের স্বরে বলছে ” ওহে পুরুষ! তুমি পুরুষ হয়ে কাঁদছো। পুরুষ হয়ে কাঁদলে তুমি কেমন পুরুষ। পুরুষ মানুষের ভীত হবে পাহাড়ের মতো। কোনো ঝড় তুফান তাকে একচুলও নড়াতে পারবে না। তুমি পুরুষ নামের কলঙ্ক।” সত্যি কি তাই? পুরুষ বলে কি তারা মানুষ না নাকি তারা দুঃখ-কষ্ট-রাগ-অভিমান থেকে অনেক দূরে। তাদেরও কষ্ট হয়, অভিমান হয়। তাদেরও চিৎকার করে কেঁদে নিজের মনের জমিয়ে রাখা কষ্ট অশ্রুর মাঝে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। জমিদার বাড়ির সকলে বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সূরার পায়ের কাছে বসা পিয়াসের দিকে। মিসবাহ তাকালো সূরার দিকে। সে দিব্যি স্থির হয়ে বসে আছে সোফায়। নুহাশ তেড়ে যায় পিয়াস কে মারতে। মিসবাহ শক্ত করে হাত ধরে আটকে দেয়। গম্ভীর স্বরে বলে
“আমি কোনো হাঙ্গামা চাচ্ছি না নুহাশ। মাথা ঠান্ডা করে বসে থাক। আর যদি একান্তই মাথা ঠান্ডা রাখতে না পারিস তাহলে আমার মনে হয় না তোর এখানে থাকার দরকার আছে।”
“ভাইয়া তুমি এই কথা বলছো। একে আমার সহ্য হচ্ছে না। আমার পুতুলের উপর ওর ছায়াও আমি পড়তে দিবো না। ছাড়ো তুমি আমাকে।”
“তোর কি মনে হয়, যা ঘটেছে তার পেছনে শুধু কি পিয়াসের একার দোষ আছে? তোর পুতুল কোনো দোষ করেনি? ভুলে যাস না সুর নিজের ইচ্ছায় পিয়াসের হাত ধরেছিল। আমরা সুরকে ক্ষমা করে দিতে পারলে পিয়াসকে কেন পারছিনা?”
“ভাইয়া তুমি এই কথা বলছো?”
“হ্যাঁ বলছি। সত্যি টা মেনে নিতে শিখ।”
মিজানুর সিকদার ছেলের উদ্দেশ্যে বলেন “এখান থেকে এখন যাও নুহাশ।”
“বাবা আমি…..
“যেতে বলেছি আমি তোমাকে।”
নুহাশ আর এখানে থাকেনা। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যায় সে। মুনতাহা সিকদার মীরা কে নুহাশের কাছে যাওয়ার জন্য বললে মীরা নুহাশের পিছু পিছু গেল। জিহাদ রাফিকে উদ্দেশ্য করে ফিসফিসিয়ে বলল
“কেস কি মামা! এ আবার আমাগো বিদ্যার রানীর জীবনে ভিলেন হয়ে আসবেনা তো?”
রাফি জিহাদের মতোই ফিসফিসিয়ে বলে “যদি তাই হয়না নুহাশ ভাইয়ের আগে এরে আমি খুন করবো।”
সিহাব বলে “এরে খুন করার জন্য প্লানিং করা দরকার। কাজে লেগে পরি কি বলিস?”
দিয়া রাগান্বিত স্বরে বলে “তিনজনকে লাথি মেরে উগান্ডা পাঠাবো চুপ যা নয়তো। সিরিয়াসলি! তোরা কি আগে থেকেই বলদ নাকি এখন নিজেদের মোস্ট ইম্পরটেন্ট ট্যালেন্ট প্রদর্শন করছিস?”
জিহাদ ভ্রু কুঁচকে বলে “শুঁটকি মাছের বাচ্চা শুঁটকি। ওই তুই আমাগো উগান্ডা পাঠাবি। তোরে তো আমি উগান্ডার শুঁটকি মাছের লগে বিয়া দিমু। বাংলাদেশি শুঁটকি মাছ আর উগান্ডার শুঁটকি মাছ মিলা ডাউনলোড হবে বিলেতি শুঁটকি মাছ।”
দিয়া কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই রাফি হাত জোড় করে বলল “দয়া করে চুপ যা। দেখতে দে এই ব্যাটা কি করে।”
রাফির কথায় চুপ হয়ে গেল দুজনের। পিয়াস সূরার পায়ে হাত দেয়। কেঁপে উঠলো সূরা। দ্রুত পা সরিয়ে নিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠলো
“কি করছেন পিয়াস ভাই? দয়া করে পায়ে হাত দেবেন না।”
পিয়াস ছলছল চোখে হাসলো সূরার দিকে তাকিয়ে। সূরাকে একবার দেখার জন্য তৃষ্ণার্ত চোখ দেখতে পেলনা একবারও। বিয়ের লাল ওরনায় স্নিগ্ধ মুখোস্রি ঢাকা। পিয়াস ভেজা কন্ঠে বলে
“আমায় ক্ষমা করে দে সুর।”
“আপনার উপরে আমার কোনো অভিযোগ নেই পিয়াস ভাই। আমার ভাগ্যে যা ছিল তাই হয়েছে।”
পিয়াসের একচোখ দিকে একফোঁটা অবাধ্য অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। বলে
“আমায় ভালোবাসলি না কেন সুর? নিজের জেদ, তোকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। ভালোবাসা কি জোর করে পাওয়া যায়? যায় না তো। দেখ দিনশেষে আমি নিঃস্ব-একা।”
মিসবাহ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। এইসব একদম সহ্য হচ্ছে না তার। নিজের সদ্য বিয়ে করা বউ কে তারই সামনে কেউ ভালোবাসি বলছে এটা কি মানা যায়? যায় না তো। অন্য সময় হলে নুহাশের আগে সে পিয়াসকে মেরে খুন করে ফেলতো। কিন্তু এখন সে শান্ত। তার একটাই কারন সূরার অনুভূতি জানা। তাকে একটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা। তাদের দাম্পত্য জীবন ফুলে ফুলে সজ্জিত করার আগে কাটা নামক বিষাক্ত অতীত ছুড়ে ফেলা। কিন্তু এখন যে জেলাসি হচ্ছে তার কি করবে মিসবাহ? সূরা শান্ত স্বরে বলে
“আপনি আবার বিয়ে করেন পিয়াস ভাই। নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিন। আমি কখনোই আপনার ছিলাম না আর না আমাদের পথ কখনো এক ছিল।”
পিয়াস তাচ্ছিল্য হাসে। করুন স্বরে বলে “তুই বলেছিলি আমার হৃদয়ের রানী নাকি তুই হতে পারিস নি। ভুল বলেছিলিস তুই। আমার হৃদয়ের রানী একমাত্র তুই সুর। সে সিংহাসনে আর কাউকে বসানো সম্ভব না। তুই ভালো থাক।”
“আমার একটা কথা রাখবেন পিয়াস ভাই। আজ প্রথম আর আজকেই শেষ আপনার কাছে কিছু চাইবো দিবেন?”
“তুই চাইলে তো তোর পায়ের কাছে আমি আমার জান টাও দিয়ে দিতে পারি সুর। বল কি চাস?”
সূরা মাথা নিচু করেই ভেজা কন্ঠে বলে “আপনি একটা ফুটফুটে সুন্দর মেয়েকে বিয়ে করবেন পিয়াস ভাই। জীবনে কিছু করবেন। আপনাকে এভাবে দেবদাস হতে দেখলে যে আমিও আমার ডাক্তারের সাথে সুখে থাকতে পারবো না পিয়াস ভাই।”
পিয়াসের চোখ ছলছল করে। কন্ঠনালী কাঁপে। বুক কাঁপে। “আমার ডাক্তার” এই একটা মাত্র সম্বোধনেই কি সূরা তার সব উওর দিয়ে দিয়েছে। মিসবাহর মুখে হাসি ফুটে উঠল। “আমার ডাক্তার” সম্বোধনেই তার সুরজান বুঝিয়ে দিয়েছে সে একমাত্র তার। পিয়াস নিষ্প্রান কন্ঠে বলে
“ভালোবাসিস তোর ডাক্তার কে?”
সূরা ছোট করে বলে “হু”
পিয়াস কাতর চোখে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েটা চার মাস তার সাথে থাকলেও ভালোবাসি বলেনি কখনো তাকে। বিয়ের পরে পিয়াস কখনো সূরার মনের অবস্থা জানতে চাইনি। রমনীর দেহ পেলেও ভালোবাসা পাওয়া কি এতোই কঠিন? কঠিনই তো। তাহলে সে পেলনা কেন? পিয়াস বলে
“একবার ঘোমটা সরিয়ে তোর মুখ দেখার সৌভাগ্য দিবি আমায় সুর?”
নাহ্! মিসবাহর ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে চুরমার না করে শান্তি পাচ্ছে না এই ছেলে। যেখানে সে এখন পর্যন্ত দেখলো না আর এই ছেলে নাকি দেখবে। এবার তো বাড়াবাড়ি হচ্ছে। চরম লেভেলের বাড়াবাড়ি। মিসবাহ ফোঁস করে শ্বাস ফেলে সোফায় গা এলিয়ে দেয়। মাথা ধরেছে তার। সূরা মাথা তুলে মিসবাহকে একবার দেখে নেয়। ভয় হয় তার। মিসবাহ কি তাকে ভুল বুঝবে? কিন্তু বোকা রমনী বুঝলো না মিসবাহ না চাইলে তার ধারেকাছেও পিয়াস আসতে পারতো না। সূরা বলে
“আপনার মুখ দেখা আমার জন্য পাপ পিয়াস ভাই।”
পিয়াস চোখে হাসে। কাতর স্বরে বলে
“তোর সব কথা আমি রাখবো সুর। তোর মাকাল ফল নিজের জীবন গুছিয়ে নিবে। কিন্তু এই হৃদয়ের রানী শুধু একজনই থাকবে আমৃত্যু। আমি যখন মরে যাবো,,,
সূরা চকিতে তাকায় পিয়াসের দিকে। পিয়াস হয়তো বুঝলো সূরার ভয়ের কারন। আস্বস্ত করে বলল
“ভয় নেই । স্বইচ্ছায় নিজের ক্ষতি করবোনা কথা দিলাম। মানুষ মরনশীল।
আমাকে শেষ দেখা একবার হলেও দেখতে যাস। তখন তো আমার চোখ বন্ধ থাকবে। তোর পাপ হবে না। আমার লাশের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে একবার হলেও বলিস ভালোবাসি পিয়াস ভাই। বলবি তো?”
পিয়াস বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। টলমল পায়ে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। সূরা মাথা নিচু করে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দেয়। মনের ক্ষত এখনো যে তাজা হয়ে আছে। পিয়াস পেয়ে হারানোর যন্ত্রনা কাকে বোঝাবে। পেয়েও পেলো না সে। হাত বাড়ালেই ধোঁয়াসায় মিলিয়ে যায় সবকিছু। তবুও চাওয়া ভালোবাসার মানুষটা ভালো থাক।
★★★★★★★
রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর। টলমল দীঘির জল জ্যোৎস্নার আলোয় চিকচিক করছে। কাছে পিঠে বেওয়ারিশ কুকুরের কান্নার আওয়াজে গা ছমছমে পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে নিস্তব্ধতা নিমিষেই চুরমার হয়ে যাচ্ছে। দিঘীর পাড়ে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুইজন সুদর্শন পুরুষ। কারো মুখে কোনো কথা নেই। হয়তো প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর রুপ দেখতে ব্যস্ত তারা। পিয়াস ফোস করে তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে
“আপনাকে ধন্যবাদ ভাইয়া। সুরের সাথে দেখা করতে দেওয়ার জন্য।”
মিসবাহ দিঘীর জলের দিকে তাকিয়েই গম্ভীর স্বরে বলে “নিজের জীবনটা গুছিয়ে নাও পিয়াস।”
“তা হয়না ভাইয়া। আমার শিরায় শিরায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে যার বিচরণ তাকে ছাড়া অন্য কোনো রমনীর কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়া কষ্টসাধ্য।”
মিসবাহ ভরাট কন্ঠে বলে “সদ্য বিবাহিত পুরুষের কাছে তার একান্ত ব্যক্তিগত অর্ধাঙ্গিনীর প্রতি অনুভূতি প্রকাশ করছো ছেলে। ভয় করো।”
পিয়াস মুচকি হেসে বলল “যে অনুভূতি খাপছাড়া তাদের বাক্সে বন্দী করে রাখা মুশকিল।”
“আজকেই শেষ। প্রানের ভয় করো ছেলে।”
পিয়াস শব্দ করে হেসে উঠে। মিসবাহ তাকালো। ছেলেটা তার চেয়ে বছর চারেক ছোট তো হবেই। কিশোর বয়সের ভুল কি শেষ করে দিলো তাকে? নাকি ভালোবাসার মায়াজাল জড়িয়ে ধরেছে তাকে।
“ভয় দেখাচ্ছেন ভাইয়া?”
মিসবাহ মুচকি হাসে। পিয়াস তাকালো মিসবাহর দিকে। অসম্ভব সুন্দর ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই পুরুষ। নয়লে কয়জন পারে বিয়ের দিন নিজের অর্ধাঙ্গিনীর সাথে প্রাক্তনের কথা বলার অনুমতি দিতে। পিয়াস চাইনি সূরার জীবন তার জন্য আবার বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠুক। তাই মিসবাহর কাছে যখন বললো একবার সূরার সাথে শেষ বারের মতো দেখা করার যেনো অনুমতি দেয় তখন মিসবাহ বিনামূল্যে তাকে অনুমতি দিয়েছে। শুধু একটা কথাই বলেছিল
“ভেবো না তোমার উপর দয়া দেখাচ্ছি। আমি এতোটাও মহান না যে সদ্য বিয়ে করা বউকে পরপুরুষের সাথে কথা বলার অনুমতি দিবো। এখানে আমার সবচেয়ে বড় স্বার্থ লুকায়িত। আমার সুরজানকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতেই তোমার সাথে তার কথা বলানো প্রয়োজন।”
পিয়াস কৃতজ্ঞ এই মানবের কাছে। মন টা আজ বড্ড বেশি হালকা লাগছে। মিসবাহ শান্ত স্বরে বলে
“সে তুমি যদি ভাবো ভয় দেখাচ্ছি তো তাই। একটা কথা মনে রাখবে।”
মিসবাহ থামে। পিয়াসের দিকে তাকিয়ে শান্ত কিন্তু গম্ভীর পুরুষালী ভরাট কন্ঠে বলে
“আমার আকাশের চন্দ্রকান্তা একান্তই আমার। তাকে নিয়ে ভাবার অধিকারও একমাত্র আমার। জান্নাতের যে ফুলের বাগিচা আছে সেখানে তাকে নিয়ে স্বপ্নের ভেলায় ভেসে বেড়ানোর অধিকারও একমাত্র আমার। তাকে নিয়ে অন্য পুরুষের মনের সামান্য থেকে সামান্য অনুভূতিও আমি মেনে নিতে নারাজ।”
পিয়াস নিষ্প্রান হাসে। আজ তার শখের নারী একমাত্র মিসবাহ নামক ব্যক্তির। কিন্তু এতে তার একটুও কষ্ট নেই। কে বলেছে ভালোবাসলেই পেতে হবে। একপাক্ষিক ভালোবাসা বেদনাদায়ক হলেও সুন্দর। সে ভালোবাসায় না আছে কোনো আকাঙ্ক্ষা আর না আছে শখের ব্যক্তিটিকে হারিয়ে ফেলার ভয়। নিজের অনুভূতির রাজ্যে সে রাজা আর তার শখের রমনী রানী। পিয়াস বলে
“আপনার সুরজান একান্তই ব্যক্তিগত আপনার ভাইয়া। সে কখনোই আমার ছিল না। কিন্তু আমার কল্প রাজ্যের রানী সে।”
“রানী কি করে রেখেছিলে?”
“আফসোস পারিনি। কিন্তু আমার বিশ্বাস আপনি পারবেন।”
“আমৃত্যু আমরণ বুকে আগলে রাখবো।”
পিয়াস কাতর চোখে তাকিয়ে থাকে। বলে
“আপনাদের প্রনয়ের পরিপূর্ণতার খুশি সবার আগে আমায় জানাবেন ভাইয়া। সুরের কোলে ছোট সুর আসলে আমাকে জানাবেন তো?”
“নিজেকে নিয়ে ভাবা উচিত তোমার। কষ্ট কম পাবে।”
“নিজের শখের নারীকে সুখে থাকতে দেখার মধ্যেও আলাদা শান্তি আছে ভাইয়া।”
মিসবাহ আর কিছু বলেনা। গাড়িতে উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। জীবন নামক সংগ্ৰামে কেউ জিতে যায় তো কেউ হেরে যায়। এটাই নিয়ম। মেনে নিতে হবে । পিয়াস তাকিয়ে থাকে মিসবাহর যাওয়ার দিকে। নিজের ভুলের জন্য আজ সে সর্বস্বহারা। নিঃস্বতা গ্ৰাস করেছে তাকে। কিন্তু বাঁচবে সে। তার বুকের ভেতর লুকায়িত রানীকে নিয়ে বাঁচবে। থাক না কিছু অপ্রাপ্তি। তার সুখের সুখপাখি ভালো থাক নিজের সুখপাখির সাথে। পিয়াসের একচোখ দিকে অবাধ্য অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। পিয়াস আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে আওরালো
“তুই ভালো থাক সুখপাখি।
ভালো থাক নিজের সুখপাখির সাথে।”
#চলবে …….
(অপেক্ষার অবসান ঘটিয়েই ফেললাম মিসবাহ আর সূরার বিয়ে দিয়ে। কে কি নিয়ে বিয়ে খেতে এসেছেন দেখি?)