#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_৩৭
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা
(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)
সময় বহমান। চাইলেও তাকে ধরে রাখা সাধ্যের বাইরে। সে ছুটে চলে আপন গতিতে। সকলে গ্ৰাম থেকে ফিরে এসেছে প্রায় মাস খানেক। চাইলেও তো আর গ্ৰামে থাকা যায়না। শহরের কোলাহলে ফিরতেই হতো। যেদিন তারা ফিরে আসে সেই দিন মোজাম্মেল সিকদার মিসবাহ ছাড়া কারো সাথে কথা বলেননি। তার একটাই কথা গ্ৰামে তার জমিদার বাড়ি, এতো সম্পদ থাকতেও বুড়ো বয়সে তার ছেলে, ছেলের বউ, নাতি, নাতনিরা তার পাশে নেই। মিজানুর সিকদার বাবার কাছেই থাকেন। শহরে এসে কি করবেন? বুড়ো বাবাকে সঙ্গ দিলেও হয়তো অপরাধবোধ কিছুটা কমবে তার। মুনতাহা সিকদার থাকতে চাইলেও ছেলে মেয়ের কথা ভেবে আসতে হয় তাকে। সূরার নতুন সংসার সাজাতে তো তাকেই সাহায্য করতে হবে। পরিবারের ভালোবাসা, বন্ধুদের সাপোর্ট, সর্বোপরি মিসবাহর ভালোবাসার মায়াজালে আজ সূরা সুস্থ। আর প্যানিক এ্যাটাক হয়না তার। আর না দুঃস্বপ্ন এসে ভীড় জমায় চোখের অক্ষিপটে। আজ আর সূরার চোখ দুঃখের অশ্রুতে সিক্ত হয়না। এর জন্য হয়তো বলে ধৈর্য্য, সহ্য করার ক্ষমতা থাকলে একদিন তুমি ধৈর্য্যের সুমিষ্ট ফল পাবেই। যা তুমি পাওনি তা তোমার জন্য মঙ্গলজনক না। অকল্যানকর জিনিস না পাওয়ায় ভালো। যা তোমার জন্য কল্যানকর তা যেকোনো মূল্যে তুমি পাবেই। ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। পঞ্চপাণ্ডবের সকলে আজ আড্ডা দিচ্ছে কলেজ ক্যাম্পাসের বড় কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে। সবার জীবন চলছে আপন গতিতে। সিহাব আর দিয়ার বিয়ে পড়াশোনা শেষ করার আগে দিতে চাইলে সিহাব সিদ্ধান্ত নেয় আপাতত এমবিবিএস শেষ করেই বিয়ে নিয়ে ভাববে তারা। এখন যে তারা আলাদা তা না। সুপার গ্লুর মতো চিপকে থাকে দুইজন সবসময়। এই দিকে জিহাদের হিল্লে হয়েই গেছে। গ্ৰাম থেকে আসার পর থেকে তার আর প্রিয়ার মুঠোফোনে প্রেমালাপ শুনতে শুনতে কান পচে যাওয়ার জোগাড় বন্ধুমহলের। কিশোর কিশোরী নতুন নতুন প্রেমে পড়লে যে লক্ষন গুলো দেখা যায় সবগুলোই জিহাদ অতিক্রম করেছে অনেক আগেই। সে হয়তো বাথরুমে গেলেও এখন ফোন নিয়ে যায়। সিনিয়র আপুর সাথে এতো মাখোমাখো প্রেম হয় একে না দেখলে বুঝতো না বন্ধুরা কেউই। মেহের আছে নিজের মতো। কখনো কখনো রায়হানের অফিসে গিয়ে হাজির হয় তো কখনো বাইরে দেখা করতে বলে। এই মেয়েকে ভালোবাসি বলেই রায়হান পড়েছে বিপদে। এখন শত বারন করলেও শোনেনা সে। এদের দেখলে প্রকৃতি বলে উঠে “ভালোবাসা তুমি সুন্দর। বড্ড বেশি সুন্দর।”
★★★★★★
পরপর চারটা ক্লাস শেষ করে ক্যান্টিনে বসেছে পঞ্চপাণ্ডব। আজ আপাতত ক্লাস নেই আর। সিহাব আর দিয়া কোনায় বসে এখনো চিপকে আছে একে অপরের সাথে। জিহাদ ফোনে প্রেমালাপ করতে ব্যস্ত। রাফি গেছে তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে। বেচারি সূরা এদের মধ্যে ফেঁসে গেছে। কোথায় এই মুহূর্তে পঞ্চপাণ্ডব আড্ডায় মশগুল থাকবে তানা সকলে ব্যস্ত প্রেমালাপে। সূরা ধমকে উঠলো তিনজন কে
“এই তোদের আর কোনো কাজ নেই? সারাদিন চিপকে থাকিস। রোমিও জুলিয়েটের নিউ ভার্সন। মন তো চাচ্ছে এই কোকাকোলায় চুপিয়ে মারি তোদের। আর ওই জিহাদ্যার বাচ্চা। তোর এতো প্রেম কোথা থেকে আসে হ্যাঁ? টিনএজারদের মতো অল টাইম প্রেমালাপ করিস। আমি যে একটা মানুষ এখানে বসে আছি তোদের চোখে পড়েনা?”
সূরা রাগে ক্ষোভে ফুঁসছে। জিহাদ সূরার রক্তিম মুখোস্রি দেখে প্রিয়ার ফোন কেটে দেয়। সিহাব আর দিয়া দুই দিকে ছিটকে সরে বসে। সূরা শান্ত স্বরে বলে
“আমরা কি জানি আর দুই বছর পরে আমরা ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটতে ছুটতে কে কোথায় যাবো? আমাদের কি উচিৎ না বন্ধুদের সময় দেওয়া? এই ফোন, আধুনিক যুগ আমাদের শৈশব শেষ করে দিয়েছে। এখন আর বাচ্চারা খেলাধুলা করেনা। তাদের তো ফোনে গেম খেলা আছে। এখন আর কফি হাউজে বন্ধুদের আড্ডা বসে না। তাদের তো কাজ আছে। একদিন কি আমরা এই দিনগুলো মিস করবোনা? আমাদের উচিত এই মুহুর্তটা স্মৃতির পাতায় যত্ন করে তুলে রাখা।”
সূরা মন খারাপ করে বসে থাকে। সবাই মাথা নিচু করে বসে রইলো। সত্যিই তো। আগের মতো কতোদিন আড্ডা দেয়নি তারা। আর তো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া হয়না। জীবন তো চলবে নিজের গতিতে তাই বলে কি আমরা বন্ধুদের ভুলে যাবো? এ যে অন্যায়। জিহাদ থমথমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কৌতুক স্বরে বলে উঠলো
“কেস কি মামা! স্যারের সাথে ফাইট করে তবেই এসেছিস নাকি? তার রাগ আমাদের উপর বর্ষন করলি যে।”
সূরা কটমট করে তাকালো। সিহাব মুচকি হেসে বলল
“আর কতো কি যে দেখতে হবে কে জানে? জিহাদ রে, ভাই তোর মতো আমারও জীবন যৌবন সব বৃথা গেল। আরে তুই বল, বাড়িতে দুই কপোত কপোতী রোমান্স করবি কর, আশেপাশে দেখে তো করবি নাকি। আমি একটা ভোলাভালা আবিয়াত্তা মানুষ। তোদের রোমান্স দেখলে তো আমারও শখ জাগে নাকি।”
সূরা দাঁতে দাঁত চেপে উঠে দাঁড়ালো। এদের খুন করতে ইচ্ছা করছে তার। হনহনিয়ে বেরিয়ে যায় ক্যান্টিন থেকে। রাফি এসে সামনে দাঁড়িয়ে অবুঝের মতো বলে
“কি হয়েছে বিদ্যার রানী? কই যাস?”
সূরা কটকট করে তাকিয়ে রাফির বাহুতে দুম করে কিল বসিয়ে হনহন করে চলে যায়। বেচারা রাফি। আগেও নেই পেছনেও নেই তবুও সূরার রাগ পড়লো তার উপর। জিহাদ আর সিহাব শব্দ করে হাসছে রাফির কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে। জিহাদ বলে
“বিদ্যার রানী ক্ষেপেছে। চল তারাতাড়ি নয়তো কিন্তু অতি বিদ্যা ভয়ংকরী রুপ নিবে।”
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সবাই। সূরা প্রায় কলেজ গেট পেরিয়ে গেছে। সূরার মাথা এখনো রাগে ক্ষোভে ফেটে যাচ্ছে। শয়তান গুলোকে সে কি বললো আর শয়তানের নানা গুলা কি বুঝলো। সূরা বিরবির করে বলে যার সাথেই চিপকে থাকিস না কেন বিয়ে হবেনা তোদের? এটাই সূরার বাচান আর সূরার বাচান হি হে শাসান।
“ইশ! এখন চটপটি আর ফুচকা খেতে যে কি মজা লাগবে। আর মামার টকটা তো মুখে লেগে থাকার মতো। আর আইসক্রিম তো কথায় নাই।”
সূরা পাশ ফিরে কটমট করে জিহাদের দিকে তাকালো। সবগুলো দাঁত কেলিয়ে হাসছে দেখে সূরার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। সূরা হিসহিসিয়ে বললো
“একদম লোভ দেখাবিনা আমাকে। যাবোনা খেতে তোদের সাথে। রাস্তায় গিয়ে মর সবগুলা।”
রাফি বলল “আহা! তুই ভুল বুঝছিস দোস্ত। আমরা তো তোকে যেতে বলিনি। তুই তো বাড়ি যাচ্ছিলি। আচ্ছা চল তোকে রিক্সায় তুলে দিই।”
সূরা অসহায় মুখে ঠোঁট ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকালো। এটা কোনো কথা। দুর্বল জায়গায় আঘাত করে এখন বলছে যেতে বলেনি। শয়তানের নানা। সবাই মিটিমিটি হাসছে সূরার কান্ড দেখে। সিহাব বললো
“কি রে চল। পরে কিন্তু মামার দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। আর বিদ্যান রানী অরফে ভাবিজান আপনি বরং বাড়ি যান। রিক্সা দেখে দিচ্ছি।”
সূরা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে হাতে থাকা ব্যাগ দিয়ে সবাইকে মারতে লাগলো।
“বজ্জাত, শয়তানের নানা। আমাকে লোভ দেখিয়ে এখন নাটক করিস। খচ্চর ব্যাটা সবগুলা।”
জিহাদ লাফিয়ে সূরার হাত থেকে বাঁচতে দূরে সরে বলল “মাফ কর বোন। আর মারিস না। বিয়ের পরে খেয়ে খেয়ে তোর গায়ের জোর বেড়ে গেছে। আমার কি মার খাওয়ার জন্যই জন্ম হয়েছে? বিয়ের আগে তুই মারিস আর বিয়ের পরে প্রিয়া মারবে। এটাই কি আমার জীবন?”
বড্ড আফসোস জিহাদের কন্ঠে। সূরা ফিক করে হেসে দেয়। সিহাব রাফি আর জিহাদ পিঠে হাত বুলাচ্ছে। শরীরের যতো শক্তি ছিল সব শক্তি দিয়ে আজ সূরা মেরেছে তাদের। রাফি তো পারেনা কেঁদে দেয়। বেচারা সবসময় বিনা দোষে সূরার আক্রমনের শিকার হয়। সূরা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁত কেলিয়ে বললো
“চল দোস্ত ফুচকা খেতে যায়।”
জিহাদ ভ্রু কুঁচকে বলে “সা*লা ফুচকার গুষ্টি কিলাই। আহ্! এখনো জ্বলছে। স্যারের টাকা এভাবে বিপথে যাচ্ছে। খেয়ে খেয়ে মোটা হচ্ছিস তুই।”
সূরা দাঁতে দাঁত চেপে বলল “কি বললি।
দিয়া বলল “কিছু না। জানিস তো ওই মুখ খুললেই দুর্গন্ধ ছড়ায় শুধু। চলতো খাবো।”
জিহাদ কটমট করে তাকালো দিয়ার দিকে। দিয়ার ডোন্ট কেয়ার ভাব। কেউ কথা বাড়ালো না আর। ফুচকার স্টলের দিকে গেল। বন্ধুরা হয়তো এমনি। রাগ, অভিমান, খুনসুটিতে মেতে থাকে তারা। ফুচকার স্টলের সামনে গিয়ে সূরা দাঁড়িয়ে যায়। সামনে তাকিয়ে রাগে ক্ষোভে দুঃখে চোখ ছলছল করে ওঠে তার। মিসবাহ আর টিনা দাঁড়িয়ে হেসে হেসে কথা বলছে। টিনা তো পারেনা মিসবাহর সাথে চিপকে যায়। মিসবাহর এক হাত ধরে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে সূরার রাগ যেনো আকাশ ছুঁলো। পঞ্চপাণ্ডবের সকলে সূরার দিকে তাকালো। রাগে ফুঁসছে সে। আজ আর মিসবাহর রক্ষে নেই। সূরা আর দাঁড়ালো না। একটা রিক্সায় উঠে চলে গেল। জিহাদ সূরার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললো
“আজ আর স্যারের রক্ষে নেই। এই রাক্ষস রানী স্যার কে বিনা নোটিশে লবন ছাড়ায় গিলে খাবে।”
দিয়া হিসহিসিয়ে বললো “দয়া করে তোর ওই দুর্গন্ধ যুক্ত মুখ বন্ধ কর। যখনি মুখ খুলিস তখনই দুর্গন্ধ ছড়াস।”
জিহাদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল “শুঁটকি মাছ রে আমার মুখ ঠিকই আছে। আশেপাশে দেখ শুঁটকির গন্ধে মানুষ বমি করছে।”
রাফি আর সিহাব একসাথে চেঁচিয়ে বলে উঠলো “দয়া করে চুপ কর দুজনে।”
রাফি বলে “এখনি মুখ বন্ধ কর নয়তো সুপার গ্লু লাগিয়ে দিবো দুজনের মুখে।”
সিহাব বলে “এদের দুইটারে তো ম্যানহলে একসাথে চুপিয়ে রাখা উচিৎ। অলটাইম যেখানে সেখানে শুরু হয়ে যায়।”
দিয়া কটমট করে তাকালো সিহাবের দিকে। সিহাব ক্যাবলামার্কা হাসি দিয়ে আমতা আমতা করে বলল “তোকে বলিনি জান। এমন করে তাকাস ক্যান। নাদান বাচ্চার জান নিবি নাকি।”
দিয়া মুখ ভেংচি কাটে। রাফি বলে “আমি বুঝলাম না। স্যার টিনার সাথে কথা বলতেই পারে তাই বলে বিদ্যার রানীর এতো রাগের কারন কি মামা? মেয়ে জাতিকে বোঝা আমাদের কর্ম না ভাই।”
দিয়া ক্ষীন হেসে বলল “তোরা কখনও বুঝতেও পারবিনা রাফি। নারীরা কখনো শখের পুরুষের সাথে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারেনা। বলতে পারিস এটা তাদের ভালোবাসার গভীরতা।”
সবাই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সূরাকে নিয়ে তাদের চিন্তা হয়। মেয়েটা সুখে থাকুক এটাই তো একমাত্র চাওয়া।
★★★★★★
সময় বদলায়। মানুষও বদলে যায় সময়ের সাথে সাথে। একপাক্ষিক ভালোবাসা এতো বেদনাদায়ক কেন? তালুকদার বাড়ি আর আগের মতো নেই। না আছে বাড়ির মানুষ গুলো। অন্ত আর রিতু শহরে থাকে। এই বিষাক্ত গ্ৰামে অন্তের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে। প্রিয়া হোস্টেল থেকে খুব দরকার ছাড়া বাড়িতে আসে না। পিয়াস ছুটে চলেছে নিজের গন্তব্যে। সূরার মাকাল ফল এখন বাবার সাথে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে। বেঁচে থাকার জন্য ব্যস্ত থাকা প্রয়োজন তার। আনজুমান বেগম ছেলে মেয়ে থেকেও আজ যেনো নিঃস্ব। ছেলের বুকের হাহাকার আর্তনাদে মায়ের বুক হু হু করে কেঁদে ওঠে। তিনি এখনো সবকিছুর জন্য সূরাকে দোষ দেন। আমাদের আশেপাশে অনেক মানুষ আছে যারা চোখ থাকতেও অন্ধ। তিনিও তাদের মধ্যে একজন।অনন্যা আর আগের মতো নেই। ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্টের চেয়ে ভালোবাসার মানুষকে মরন যন্ত্রনায় ছটফট করতে দেখার কষ্ট কি বেশি না? ভালোবেসে আজ সে একাকিত্বকে সাদরে গ্রহণ করেছে। অনন্যা দাঁড়িয়ে আছে পিয়াসের রুমের সামনে। আজ কতোদিন পরে পিয়াস বাড়ি আসলো।
“ভেতরে আয় অনু।”
পিয়াসের ঠান্ডা কন্ঠে হকচকিয়ে গেল অনন্যা। সে যে দাঁড়িয়ে আছে পিয়াস কিভাবে বুঝলো? অনন্যা আর কিছু না ভেবে ঘরের ভেতরে যায়। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে সূরার অসংখ্য হাস্যোজ্জ্বল ছবি। অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই ঘরটা, ঘরের মানুষটা তো তারও হতে পারতো। খুব বেশি কি ক্ষতি হতো তাহলে? পিয়াস বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। অনন্যা বারান্দায় যায়। পিয়াসের পাশে দাঁড়িয়ে পিয়াসের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষটাকে সে খুব ভালোবাসে। না পাওয়ার জেদের বশে ভালোবাসার মানুষটাকে সে জীবন্ত লাশে পরিনত করেছে। অথচ এখন এই মানুষটার কষ্ট, হাহাকার তার সহ্য হয়না। সে তো চেয়েছিল কষ্ট দিতে, না পাওয়ার যন্ত্রনা পিয়াসকে বোঝাতে। তাহলে এখন কেন তার বুকে অসহনীয় ব্যথা হয়? অনন্যা ফুঁপিয়ে উঠে। পিয়াস আকাশের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে
“কাঁদছিস কেন অনু্? তুই যা চেয়েছিলি সেটাই তো হয়েছে। দেখ আজ আমি নিঃস্ব। ভালোবাসার মানুষকে পেয়েও হারানোর যন্ত্রনা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। তুই ভালো আছিস অনু। ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্টের চেয়ে পেয়ে হারানোর যন্ত্রনা অসহনীয়।”
অনন্যা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ভেজা কন্ঠে বলে
“আমাকে মাফ করে দেন পিয়াস ভাই। আমি জেদের বশে আপনাকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিয়েছি। আপনার কষ্ট আমার সহ্য হয়না পিয়াস ভাই। আমাকে সূরার কাছে নিয়ে চলুন। আমি ওর পা ধরে বলবো আপনার কাছে ফিরে আসতে। তবুও আপনি ভালো থাকুন।”
পিয়াস শব্দ করে হেসে উঠলো। তাচ্ছিল্যের হাসি। চোখ ছলছল করছে তার। হাসি থামিয়ে অনন্যার দিকে তাকিয়ে অনুভূতিহীন কন্ঠে বলে
“আমার সুখপাখি তার সুখপাখির সাথে সুখে আছে। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে অনু?”
অনন্যা ছলছল চোখে তাকিয়ে বলে “আপনার কি কষ্ট হয়না পিয়াস ভাই? সূরার সাথে অন্য পুরুষকে দেখলে কি চোখ জ্বালা করে না?”
পিয়াস ক্ষীন হাসে। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিষ্প্রভ কন্ঠে আওরালো
“একপাক্ষিক ভালোবাসা সুন্দর। বড্ড বেশি সুন্দর। এতে না আছে অভিযোগ, না আছে অভিমান আর না আছে তাকে পাওয়ার প্রত্যাশা, আকাঙ্ক্ষা। বিশ্বাস কর অনু যখন আমার শখের নারীকে তার শখের পুরুষের সাথে দেখি তখন আমার চোখ জ্বালা করে। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা হয়। অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করি আমি। বিষাক্ত বিষ ব্যথায় ককিয়ে উঠি বারবার বারংবার শতবার। কিন্তু আবার যখন দেখি আমার সুখপাখির হাসি মাখা মুখোস্রি তখন প্রশান্তিতে ভরে যায় মন। যখন ভেতর থেকে কেউ বলে ওঠে সে ভালো আছে তখন দিনশেষে শান্তির ঘুম আসে আমার অক্ষিপটে। এতো পূর্নতার মাঝেও আমি তাকে ছাড়া অপূর্ন। আমার প্রাপ্তির খাতা শূন্য। এই শহরে পিয়াসরা আমৃত্যু শখের নারীকে তার কল্প রাজ্যের রানী করে রাখে। এই শহরে পিয়াসরা অপূর্নতার মাঝেও পরিপূর্ণতা খুঁজে নেয় প্রেয়সীর হাসি মাখা স্নিগ্ধ মুখোস্রিতে। এই শহরে পিয়াসদের ভালো থাকা নির্ভর করে শখের নারীর প্রানোচ্ছ্বলতায়।”
অনন্যা ভেজা কন্ঠে বলে “এই শহরে অনন্যারা তাহলে ভালো থাকে না কেন পিয়াস ভাই?”
“অনন্যাদের ভালোবাসায় পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে। তারা যে বড্ড অবুঝ। বোকারা বোঝেনা ভালোবাসার মানুষটার সুখের মধ্যেই তাদের সুখ নিহিত।”
অনন্যা ফুঁপিয়ে উঠলো। সত্যি তো বোকা সে। কেন ভালোবাসার মানুষটার সুখে সুখী হতে পারলো না সে? তাহলে তো আজ এই মরন যন্ত্রনায় ছটফট করতে হতো না। এই অসহনীয় যন্ত্রণা কাকে বোঝাবে সে? পিয়াস আকাশের দিকে তাকিয়ে নিষ্প্রাণ কন্ঠে আওরালো
“শুনো গো প্রকৃতি! শুনছো তো!
আমার প্রাপ্তির খাতা শূন্যই থেকে গেলো
তবুও আমি পরিপূর্ণ তার হাসিতে।”
#চলবে………..