#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_২০
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা
(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)
বর্ষার হিমশীতল বাতাসে অজানা ফুলের মন মাতানো ঘ্রাণে মুখোরিত চারপাশ। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি ইতিমধ্যে ছুটি নিয়েছে। ঠান্ডা বাতাসে শিরশির করে উঠছে তনু মন। জমিদার বাড়ির অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে পড়েছে পাঁচ সুন্দরী রমনী। গন্তব্য জমিদার বাড়ির পেছন পাশের পুকুর। অজান্তেই সূরার মন মস্তিষ্ক আজ বেশ ফুরফুরে লাগছে। মন ভালো থাকায় আশেপাশের সবকিছু ভালো লাগছে তার। কাঁদায় হাঁটতেও মজা লাগছে এখন। দিয়া, মীরা আর বকুল সামনে হাঁটছে। সূরা আর মেহের পেছনে। মেহের কাঁদায় পড়ে যাওয়ার ভয়ে সূরার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে বিধায় মেহেরের মতো সূরাকেও গুটিগুটি পায়ে হাঁটা লাগছে। সূরার শৈশবের স্মৃতি মনে পড়ছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই তাকে বাড়িতে রাখতে পারতো না কেউ। কাকভেজা হয়ে যখন বাড়ি ফিরতো তখন নিহারিকা সিকদারের কাছে কতো বকা খেতে হতো তার হিসাব নেই। বৃষ্টি হলেই পুকুরে নেমে সাতার কাটতো সে। আগে একটু হ্যাংলা পাতলা থাকায় ধুপধাপ পড়েও যেতো কাঁদায় পা পিছলে। সেসব স্মৃতি মনে পড়ায় আনমনেই হেসে উঠলো সূরা। মেহের মাথা তুলে তাকালো সূরার দিকে। হঠাৎ হাসির কারন বোধগম্য হলো না কিশোরীর। মুহুর্তেই এক অভাবনীয় কাজ করে বসে সূরা। একলাফ দিয়ে কাঁদায় নিজের পা মাখামাখি করে নেয়। মেহের চেঁচিয়ে উঠে। হাতে টান পড়ায় মেহের সহ সূরা ধপাস করে পড়ে যায়। কাঁদায় দুজনের গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা।
“আহ্! মা গো মরে গেলাম। আমার বুঝি আর বিয়ে করা হলো না।”
মেহের কাঁদায় পড়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল।মেহেরের চিৎকারে মীরা,দিয়া আর বকুল পেছনে তাকায়। চোখ কপালে উঠে যাওয়ার মতো অবস্থা ওদের। সূরা আর মেহের কাঁদায় পড়ে আছে। সারা শরীরে কাঁদা মাখামাখি। মেহের কাঁদো কাঁদো মুখ করে থাকলেও সূরা হাসছে। দেখে মনে হচ্ছে পড়ে গিয়ে সে বেশ মজা পেয়েছে। দিয়া আর বকুল ওদের তোলার জন্য হাত বাড়ালেই সূরা ওদেরকে টান দিয়ে কাঁদায় ফেলে দেয়। ওদের ফেলে শব্দ করে হেসে ওঠে সূরা। মীরার মাথায় হাত। এই মেয়ে আবার দুষ্টুমি শুরু করেছে। তবে বেশ লাগছে প্রানোচ্ছ্বল সূরাকে তার। হাসি ফুটে উঠল মীরার মুখোস্রীতে। মুহুর্তেই হাসিতে ফেটে পড়ল পাঁচ রমনী।
★★★★★★
জমিদার বাড়ির পেছন সাইডে বড় পুকুরে গোসল করছে সুদর্শন কিছু যুবক। পুকুরটা জমিদার বাড়ির নিজস্ব পুকুর। মিসবাহ, নুহাশ, সিহাব, রাফি, জিহাদ সকলে সাঁতার কাটছে। অলরেডি দুইবার সাঁতার কাটার প্রতিযোগিতায় গো হারান হেরে গেছে তারা মিসবাহর কাছে। জিহাদ আফসোসের সুরে বলল
“নাহ্! জীবন যৌবন সার্থক আর হলোনা। সামান্য সাঁতার কাটায় হেরে গেলাম। এর জন্য বাবা বলে তোমাকে দিয়ে কিছু হবেনা।”
জিহাদ ফোঁস করে শ্বাস ফেলে ঠোঁট উল্টে আবার বলে “কিন্তু বুঝলাম নাহ্! বাবা কিভাবে বুঝলো আমাকে দিয়ে কিছু হবেনা। বিয়ে দিয়ে দেখুক এক মাসের মধ্যেই দাদা ডাক শুনিয়ে ছাড়বো। প্রমান করে দিবো আমাকে দিয়ে কিছু হবে কিনা। বাবার কথায় বহুত কষ্ট পাইছি ভাই।”
শব্দ করে হেসে উঠলো সবাই। হাসি থামিয়ে রাফি বলল “স্যার যে এতো ভালো সাঁতার কাটতে পারে জানতাম না ভাই।”
নুহাশ বলল “সত্যি ভাইয়া। আপনি শহরে থেকেও এতো ভালো সাঁতার কিভাবে কাটতে শিখলেন?”
মিসবাহ ক্ষীন হেসে বলল “প্রথমত আপনি বলা বাদ দে। বড় ভাই হয় আমি তোর। আমাদের সম্মানিত বাবাগণ মেলায় হারিয়ে গিয়েছিল বলেই আমরা ভাই হয়েও এতো দূরে দূরে থেকেছি।”
একটু থেমে বলে “যাই হোক সাঁতার দাদু শিখিয়েছে। তোদের ক্ষমতা নেই সাঁতার কাটায় আমাকে হারানো। আমি শুধু একজনের কাছে হেরে যেতে চাই আমৃত্যু আমরণ।”
সিহাব কৌতুক স্বরে বলল “চাও নাকি হেরে বসে আছো ভাই?”
মিসবাহ বাঁকা হেসে বলে “হেরে গেছি তো অনেক আগেই তার চোখের মায়ায়। সবকিছুতে জিতে গেল সে, হেরে গেলাম আমি। পুরস্কার হিসেবে সে জিতে নিল গম্ভীর, কঠোর লৌহ মানব এই মাকহুল সিকদার মিসবাহকে। কিন্তু সেই পুরস্কার বুকে আগলে নিল না নিষ্ঠুর রমনী।”
সবাই তাকিয়ে আছে মিসবাহর দিকে। প্রত্যকটা কথা যে মনের গভীরে থেকে বলা। কতোটা ভালোবাসতে পারলে গম্ভীর এই মানুষটাও প্রেমিক পুরুষ হয়ে ওঠে জানা নেই উপস্থিত কারোর। নুহাশ বুঝতে পারছেনা কি বলা উচিৎ তার। এখানে আসার পরে মাহমুদ সিকদার তাদের সবাইকে বলেছেন মিসবাহ সূরাকে ভালোবাসে। মিসবাহ আর সূরার বিয়ের প্রস্তাব দেন তিনি। মিসবাহকে অপছন্দ করবে এমন কেউ কি আছে? কিন্তু তার বোনটা। ছোট বোন আর বড় ভাইয়ের সম্পর্কে কথা বলায় জড়তা কাজ করে তার। পানিতে ডুব দিল নুহাশ। উঠে গেল কয়েক সেকেন্ড থেকে। পাড়ের দিকে চোখ যেতেই ছোট কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম তার। বিষ্মিত কন্ঠে বলল
“একি অবস্থা তোমাদের? শরীরে, জামায় কাঁদা লাগলো কিভাবে?”
নুহাশের কথায় সবাই পাড়ের দিকে তাকালো। মুহুর্তেই মিসবাহর কপালে ভাজ পড়ে। পাঁচ রমনী দাঁড়িয়ে। মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই এরা কারা। জিহাদ ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলে
“এই কে তোমরা? নির্লজ্জ মেয়ে মানুষ। দেখছো না আমরা ছেলেরা গোসল করছি? আমার ইজ্জত কিন্তু এখনো ফুলের মত পবিত্র। তোমরা কি লুটে নিতে এসেছো আমাকে?”
একটু থেমে চোখ ছোট ছোট করে সন্দেহাতীত কন্ঠে বলল “এই তোমরা চোর না তো? জমিদার বাড়ির পুকুরে গোসল করার শখ চোরদেরও থাকে নাকি? কেমন চোর রে বাবা।”
রাগে সূরার মাথা ফেটে যাচ্ছে। কাঁদায় মাখামাখি হয়েছে বলে চিনতে অস্বীকার করবে। সূরা চেঁচিয়ে উঠলো “জিহাদ্দ্যার বাচ্চা। তুই শুধু একবার উপরে উঠে আয়। ভালো করে বুঝিয়ে দিব আমি কে।”
“একি এ যে আমাগো বিদ্যার রানী। তা রানী সাহেবা মঙ্গলগ্ৰহে চাষাবাদ করতে গিয়ে কি কাঁদা লেগে গেছে আপনার। আচ্ছা অতো বড় গ্ৰহে কি পানি নাই যে সোজা সিকদার বাড়ির পুকুর পাড়ে টপকালেন আপনি।”
ছেলেরা শব্দ করে হেসে উঠলো। মিসবাহ এখনো চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে সূরার দিকে। ইচ্ছাকৃত কাঁদায় মাখামাখি করেছে এরা বুঝতে বাকি নেই মিসবাহর। কোনো মানে হয় এসবের। এরা কি ছোট বাচ্চা। ধমকে উঠল মিসবাহ
“এই তোমরা কি ছোট? কাঁদা নিয়ে খেলার বয়স আছে তোমাদের? কতো জীবাণু থাকে কাঁদায়। শরীর খারাপ হলে কিন্তু সবাইকে জমির খেতে চুবিয়ে আসবো বলে দিলাম। তখন ঐখানে গিয়ে ইচ্ছে মতো কাঁদা ছোড়াছুড়ি করো।”
সূরা বলে উঠলো “ইশ আসছে শুচিবায়ু সাহেব। আমরা আপনার মতো বুড়ো নাকি। আমাকে জমির খেতে চুবিয়ে আসলে কাঁদা আগে আপনার দিকে ছুঁড়ে মারবো। তখন দেখবো শুচিবায়ু কোন চুলোয় যায়।”
নুহাশ বলল “পুতুল এইভাবে কেউ কথা বলে বড়দের সাথে?”
সূরা ভেংচি কেটে অন্যদিকে তাকালো। মিসবাহর মুখে বাঁকা হাসি বিদ্যমান। মীরা বলে “এই তোমরা ওঠো এখন ।আমরা মেয়েরা গোসল করবো।”
মেয়েরা শুনে রায়হান চেঁচিয়ে উঠলো “মেয়েরা মানে মেহের তুইও নামবি নাকি পুকুরে?”
হঠাৎ রায়হানের এভাবে চেঁচিয়ে উঠার কারন কারো বোধগম্য হলোনা। সবাই রায়হানের দিকে তাকালে সে আমতা আমতা করে বলে
“না মানে আমি বলছিলাম যে মেহের তো শহরে থাকে। ছোট মেয়ে একটা। পুকুরে গোসল দিতে গিয়ে যদি অঘটন ঘটে তাই আর কি।”
মেহের বলল “আমি মোটেও ছোট না রায়হান ভাই। আর সূরা আপু সাঁতার জানে। আমিও মোটামুটি জানি। আমি তো আজ পুকুরে গোসল দিয়েই ছাড়বো।”
মিসবাহ গম্ভীর গলায় বলে “একদম জেদ করবি না মেহু। পুকুর অনেক গভীর। এই গভীর পুকুরে তোর সূরা আপু নিজেই হিমশিম খাবে সাঁতার কাটতে তোকে কি বাঁচাবে। বাড়ির ভেতরে যাও সবাই।”
সূরা কন্ঠে তেজ নিয়ে বলে “একদম মানা করতে আসবেন না। আমরা আজ পুকুরে গোসল দিব। আর কাকে সাঁতার নিয়ে কথা শোনাচ্ছেন শুনি। আমার সাথে সাঁতার কাটার প্রতিযোগিতা করলে হেরে যাবেন আপনি।”
মিসবাহ কিছু না বলে ঠোঁট চেপে হাসে। দুষ্টুমি তার চোখে মুখে। সূরা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মীরা সবাইকে আবার উঠার কথা বলতে মিসবাহ সহ সবাই একে একে উঠে যায়। ছেলেরা সিঁড়ি পার হলে মেয়েরা নিচে নামে। সূরার পথ আগলে দাড়ায় মিসবাহ। বাঁকা হেসে বলে
“আমি বুড়ো কিনা আমাদের প্রথম সন্ধিক্ষণে বুঝাবো তোমায়। তখন কিন্তু অসভ্য উপাধি দিতে পারবে না।”
“আপনি একটা নির্লজ্জ, বেহায়া, অসভ্য পুরুষ।”
“শুধু তোমার জন্য সুরজান।এই নির্লজ্জ, বেহায়া, অসভ্য পুরুষ পুরোটাই তোমার। তোমার একান্ত ব্যক্তিগত প্রেমিক পুরুষ।”
#চলবে…….