#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_২১
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা
(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)
ঝমঝম বৃষ্টিতে মুখোরিত মেদিনী। প্রকৃতি আজ বুঝি বড্ড অশান্ত। আজ নতুন রুপে সাজতে ব্যস্ত সে। আকাশের কান্নার আওয়াজে আজ আর সূরার কষ্ট হচ্ছে না। হিমশীতল অনিল এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে রমনীর মুখোস্রি। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি বিলাসী মন নেচে উঠছে বারংবার। লহমায় কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠল সূরা। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালে মুখ চুপসে যায় তার। লহমায় নজর লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। মীরা শান্ত চোখে সূরাকে দেখে। যে মেয়েটা সবসময় সে বলতে পাগল ছিল সেই মেয়েটা আজ তার থেকে কতো দুরে। সময়ের পরিক্রমায় আজ তার দিকে নজর মেলাতেও পারেনা তার সুরপাখি। মীরা নিষ্প্রাণ কন্ঠে সুধায়
“সুরপাখি কতো বেলা হয়েছে দেখেছিস? চল খাবি। দাদু তোর জন্যে অপেক্ষা করছে।”
“হুঁ, চলো।”
আর দাঁড়ালো না সূরা। মীরাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে মীরা পিছু ডাকে। সূরা পেছনে ফিরে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে মীরা সূরার গালে এক হাত রেখে আদুরে কন্ঠে বলে
“আমায় একবার ভাবিজান বলে ডাকবি সুর? আমি কি তোর এতোই পর হয়ে গেছি?”
“আমি যে সেই অধিকার অনেক আগেই হারিয়েছি।”
“যা হয়েছে ভুলে যা পাখি। ওই ঘটনায় তোর কোনো হাত ছিল না। আমরা চাইলেই কাউকে আটকে রাখতে পারিনা। প্রকৃতির নিয়ম মেনে নে পাখি।”
সূরা ক্ষীন হেসে বলে “তোমাদের উচিৎ হয়নি আমাকে ক্ষমা করা। কেনো মাফ করেছো আমায়? আমি তোমার চোখের দিকে তাকাতে পারিনা ভাবিজান। মন ভরে ভাবিজান ডাকতে পারিনা। ওর নিষ্পাপ মুখ আমি ভুলতে পারিনা। ওর পরিবর্তে আমি কেন মরে গেলাম না ভাবিজান?
আর দাঁড়ালো না সূরা। চঞ্চল পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মীরা মুখে হাত চেপে ডুকরে উঠে। কবে এই মেয়ে একটু সুখের সন্ধান পাবে। সুখ বুঝি সূরার আঁজলায় ধরা দিতে নারাজ।
★★★★★★
সিকদার বাড়ীর অন্দরমহলের ভোজনশালায় বসে আছে সবাই। মোজাম্মেল সিকদার সবার দিকে তাকালেন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাওয়ার উপক্রম তার। আজ কতো গুলো বছর পরে এই জনমানবশূন্য বাড়িটা পরিপূর্ণ লাগছে। শহরের মানুষগুলো আজ খাবার টেবিল ছেড়ে মেঝেতে মাদুর পেতে খেতে বসেছে তার সাথে। তিনি বরাবরই মেঝেতে বসে খেতে পছন্দ করেন। এবার সবার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিলেন তিনি। এখানে সূরা বাদে সবাই উপস্থিত। তিনি ক্ষীন স্বরে সুধায়
“বড় বৌমা সূরা কোথায়?”
মুনতাহা সিকদার গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে কিছু বলবে তখনই সূরা কক্ষে প্রবেশ করে। মোজাম্মেল সিকদার পূর্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সূরার মুখোস্রীতে। পরক্ষনে মুখে হাসি নিয়ে গদগদ হয়ে বলেন
“এসো বড়গিন্নি। আমার পাশে এসে বসো তো দেখি।”
সূরা মোজাম্মেল সিকদারের দিকে তাকালো। তিনি হাসি মুখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। দেখে বোঝার উপায় নেই এনার বয়স হয়েছে। এখনো বেশ শক্ত পোক্ত মানুষ তিনি। সূরা এবার ঘরে সবার দিকে তাকালো। এখানে সবাই মেঝেতে খেতে বসেছে। কারো প্লেটে খাবার না দেখে বুঝলো তার জন্য হয়তো অপেক্ষা করছে সবাই। ছেলেরা সবাই লুঙ্গি পড়েছে দেখে ফিক করে হেসে দিল সূরা। জিহাদের দিকে তাকিয়ে গা জ্বলানো হাসি দিল। জিহাদ চোখ পাকিয়ে তাকায়। সূরা এবার মোজাম্মেল সিকদারের পাশে বসা মিসবাহর দিকে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে গেল তার। জমিদার সাহেব দিব্যি শার্ট প্যান্ট পড়ে আছে। সূরা মুখ কুঁচকে বিরবিরালো
“জমিদারদের রেখে যাওয়া অসভ্য জমিদার। লুঙ্গিতে কি এলার্জি আছে তোর। ব্যাটা তুই বাঙালি জাতি লুঙ্গি পরে লুঙ্গি ডান্স দিবি। তুই কেনো প্যান্ট পরে সবসময় ফিটফাট থাকবি। যতসব ঢং!”
মিসবাহ সূরাকে বিরবির করতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। সূরার কথা শুনতে না পারলেও সূরা যে তাকেই সাবান ছাড়া ধুয়ে দিচ্ছে তা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে তার। মোজাম্মেল সিকদার আবার পাশে বসার কথা বললে সূরা কাচুমাচু করে মোজাম্মেল সিকদারের অপর পাশে বসে। তিনি কিভাবে সূরাকে চিনলো বোধগম্য হলো না সূরার। কাল এসেছে ঠিকই কিন্তু দেখা হয়নি তার সাথে। আজ প্রথম দেখা হলো। সূরা ক্ষীন স্বরে সুধায়
“দাদাজান আপনি আমাকে চিনলেন কিভাবে? আপনার সাথে তো আমার এর আগে দেখা হয়নি। আমি তাও মেহেরের ফোনে আপনার ছবি দেখেছিলাম।”
মোজাম্মেল সিকদার প্রশান্তির হাসি দিয়ে বলেন “মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল বড়গিন্নি। তোমার বলা দাদাজান ডাকে এতো শান্তি লাগছে কেন?”
সূরা মুচকি হাসলো। মেহের বলে উঠলো
” সূরা আপু তুমি সবাইকে এমন সুন্দর করে ডাকো কেন? আমি এর আগেও খেয়াল করেছি নুহাশ ভাইয়া চাচ্চু আর ছোটআম্মু কে বাবা মা ডাকলেও তুমি আব্বাজান আম্মাজান বলো।এখন তো দাদুরও ফেভারিট হয়ে গেলে তুমি।আমার কিন্তু হিংসা হচ্ছে।”
মেহেরের বাচ্চামো কথায় সবাই হাসলো। রায়হান মুখ বাকায়। এই মেয়ে কি বড় হবে না। মোজাম্মেল সিকদার বলেন
“আমার ছোট গিন্নি কিন্তু আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয়। ভুলে গেলে?”
মেহের ভেংচি কেটে বলে “জানা আছে আমার। আমাকে ভুলে গেছো তুমি বড় গিন্নিকে পেয়ে। লুচু জমিদার একটা।”
মেহেরের কথায় হাসির পসরা বসলো যেনো ভোজনশালায়। জিহাদ ভ্রু নাচিয়ে বলে
“আমারো কিন্তু একি প্রশ্ন সূরা। এমন বিচিত্র ডাকের রহস্য কী?”
সূরা মুচকি হেসে কিছু বলবে তখনই মিজানুর সিকদার শান্ত স্বরে বলে উঠলো
“তেমন কিছু না। আমি সুর কে ছোট থেকেই আম্মাজান বলে ডাকতাম। সুর বড় হতে হতে আমার সম্বোধন শুনে সেও আব্বাজান ডাকতে শুরু করে।পরে ওর মা কে আম্মাজান ডাকে। ওর নাকি এমন করে সম্বোধন করলেই বেশি আপন মনে হয় সবাইকে।”
নুহাশ হতাশার সুরে বলল “হুঁ! সবাইকে আপন মনে হলেও আমাকে আপন মনে হতো না তার। ভাইজান শোনার জন্য তাকে কম ঘুস দিতে হয়নি আমার।”
রাফি কৌতুহলী কন্ঠে সুধায় ” কি ঘুস ভাইয়া?”
নুহাশ হতাশার শ্বাস ফেলে বললো “আর বলো না। তোমরা যে শান্ত শিষ্ট সূরাকে চিনো সে মোটেও শান্ত না। এক নাম্বারের পাজি সে। আমাকে ভাইয়া বলে ডাকতো। আমার শুনতে ভালো লাগতো না। তাই আমি একদিন বললাম ভাইজান বলে যেন ডাকে। কি বলল জানো?”
সবাই নুহাশের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। সূরা মিটিমিটি হাসছে। নুহাশ বলল “পাজি টা বলে কি তার নাকি আমাকে আপন আপন মনে হয় না। ভাইজান ডাকের জন্য আমার একমাসের পকেট মানি ওকে দিতে হয়েছিল। সাথে শিউলি ফুলের মালা। একমাস আমাকে কলেজে হেঁটে যেতে হয়েছে ভাবা যায়।”
আবার যেনো হাসির পসরা বসলো ভোজনশালায়। মিসবাহ মুচকি হাসে।মেয়েটা পারেও বটে। মোজাম্মেল সিকদার একটু পানি খেয়ে সূরার উদ্দেশ্যে বললেন
“বড়গিন্নি তোমার দাদিজানের নাম কি ছিল জানো?”
মিসবাহ ভ্রু কুঁচকায়। খাওয়া থামিয়ে তাকায় মোজাম্মেল সিকদারের দিকে। সবাই তাকিয়ে আছে সেদিকে ভাবাবেগ নেই তার। শুধু মিসবাহর চাহনি দেখে মনে মনে হাসেন তিনি। বলেন
“তোমার দাদিজানের নাম ছিল সূরাবতী। আমি সুরজান বলে ডাকতাম। তোমাকেও ডাকবো আজ থেকে।”
সূরা মিজানুর সিকদারের দিকে তাকায়। তিনি সূরাকে বলেছিলেন তার সবচেয়ে আপন মানুষটার নামে সূরার নাম রেখেছেন তিনি। কিন্তু এটা যে সূরার দাদির নাম কখনো ভাবেনি সূরা। মিজানুর সিকদারকে আগে দাদা দাদির কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি এরিয়ে যেতেন। তাই পরে আর কেউ এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করেনি তাকে। কিন্তু দাদাজান এই নামে সম্বোধন করলে একটুও ভালো লাগবেনা সূরার। সে সুরজান শুধু একজনেরই । ওই সুদর্শন পুরুষের ব্যক্তিগত সুরজান সে। আর কারো না। কিন্তু মানায় বা করবে কিভাবে। মিসবাহ কন্ঠে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে
“বড় জমিদার সাহেব আমার একান্ত ব্যক্তিগত জিনিসে তোমার হস্তক্ষেপ আমি কিন্তু মেনে নেবনা। কই আমি তো তোমার কোনো জিনিসে হস্তক্ষেপ করিনা। তোমার সামান্য লুঙ্গি টাও কিন্তু নিইনা আমি। আর তুমি কিনা আমার একান্ত নিজের সম্পত্তি দখল করতে চাও।”
মোজাম্মেল সিকদার মিসবাহকে খোঁচাতে পেরে ভারি মজা পেলেন। পান খাওয়া দাঁত কেলিয়ে বললেন
“আমি কোথায় তোমার ব্যক্তিগত জিনিসে হস্তক্ষেপ করলাম ছোট জমিদার সাহেব। আমি তো বড়গিন্নি কে সুরজান বলে ডাকবো। তুমি চেতে যাচ্ছো কেন?”
“তুমি যাকে সুরজান বলে ডাকবে সে একান্ত ব্যক্তিগত আমার আকাশের চন্দ্রাবতী। তাকে সুরজান সম্বোধন করার অধিকার একমাত্র আমার। তাকে সুরজান বলার অনুমতি আমি তোমাকে দিবনা বড় জমিদার সাহেব।”
সবাই মিটিমিটি হাসছে দাদু নাতির কথা শুনে।সূরা তো পারেনা পাতালে লুকিয়ে পড়ে। এখানে বড়দের সামনে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে তার। ইচ্ছে মতো গালি দিল সে মিসবাহকে। এটা কোনো কথা হলো। এখানেও ঢাক ঢোল পিটিয়েছে এই বজ্জাত লোকটা। সূরা বিরবিরালো
“অসভ্য জমিদার। তোর সুরজানের গুষ্টি কিলায়।”
#চলবে……
(সবার রেসপন্স পেলে রাত আটটায় আর একটা পর্ব দিবো। কেমন হয়েছে বলবে কিন্তু সবাই। নতুন লিখিকা তাই ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিও। সবার জন্য ভালবাসা রইলো ❤️)