#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_২৭
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা
(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)
পাঁচ বছর পূর্বে,,,,,
হেমন্তের শেষভাগ। শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে হেমন্ত বুঝি বিদায় নেওয়ার পায়তারা করছে। ঠান্ডা ঠান্ডা অনিলে শীতল হয়ে ওঠে তনু মন। লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায়। স্নিগ্ধ সকাল। হেমন্তকালের শিশির ভেজা শিউলি ঝরে ঠাঁই নিয়েছে মাটিতে। এই ফুল যে রাতে ফুটে সকালে ঝরে যায়। বড্ড বেশি লজ্জাবতী শিউলি ফুল। শিশির ভেজা শিউলি দেখতে অসম্ভব সুন্দর। খালি পায়ে এক কিশোরী শিশির ভেজা শিউলি কুড়িয়ে নিচ্ছে। শিশির ভেজা শিউলি পায়ে স্পর্শ করতেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে কিশোরী। শিউলি ফুল গুলো কুড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে দিঘীর শেষ সিঁড়িতে বসে সে। কুড়িয়ে রাখা ফুল গুলো ভাসিয়ে দেয় দিঘীর জলে। হাসি ফুটে উঠে কিশোরীর ঠোঁটের কোণে। হন্তদন্ত হয়ে সূরার কাছে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে প্রিয়া। ব্যস্ত কন্ঠে বলে
“সুর তুই এখানে? আর আমি তোকে পুরো গ্ৰাম খুঁজে মরছি। আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল তোকে সকাল সকাল এখানেই পাওয়া যাবে।”
“কেন? কি হয়েছে?”
প্রিয়া মন খারাপ করে বলে “একি তুই ভুলে গেছিস? আজ যে কান্না দিবস।”
“পাগল হয়েছিস। আজ কান্না দিবস হতে যাবে কেন?আর কান্না দিবস আজ প্রথম শুনলাম।”
প্রিয়া কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে “আজ আমাদের রেজাল্ট দিবে সুর। আমার খুব কান্না পাচ্ছে। তাই কান্না দিবস আজ। তুই দেখিস ভাইজান আমার রেজাল্ট দেখে আমার পিঠে চ্যালাকাঠ ভাঙ্গবে।”
সূরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই মেয়ে নিজে তো চিন্তায় মরবে সাথে তাকে নিয়েই মরবে।
★★★★★★
“পুতুল! এই পুতুল! কোথায় তুই? তোর রেজাল্ট দিয়েছে। জলদি আয়।”
নুহাশের কথায় ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে সূরা। বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করছে তার। ভয়ে প্রান ওষ্ঠাগত। রান্নাঘর থেকে নিহারিকা সিকদার আর মীরা বেরিয়ে আসে। মিজানুর সিকদার তখন সোফায় বসে টিভি দেখছিলেন। টিভিতে দেখাচ্ছে আজ এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা ইতিপূর্বে করা হয়েছে। মেয়ের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। তার মেয়ে রেজাল্ট খারাপ করবে না। সূরাকে কাছে ডাকলেন তিনি। সূরা বাবার ডাকে পাশে গিয়ে বসে বাবার বুকে মাথা রাখে। মিজানুর সিকদার মেয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মুচকি হাসেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন
“আম্মাজান চিন্তা করছেন কেনো? এটা মনে রাখবেন জীবনে চলার পথে সবসময় সফলতা আসবে না। আপনি যদি অসফল না হন তাহলে কিন্তু সফলতার গল্প আপনার কখনো হবেনা।”
“আমার খুব টেনশন হচ্ছে আব্বাজান। রেজাল্ট ভালো না হলে যে আমি মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পাবো না।”
নিহারিকা সিকদার কঠোর স্বরে বলেন “ওটা আগে ভাবা উচিৎ ছিল। এখন ভেবে কি হবে? সারাদিন যে হইহই রইরই করে ঘুরে বেড়ানো হয় তখন এসব মনে থাকে নাহ্।”
সূরা কাঁদো কাঁদো মুখ করে ঠোঁট উল্টে বলে “ও আব্বাজান?”
মিজানুর সিকদার বলেন “আহ্! নিহা। আমার আম্মাজান কে আর চিন্তায় ফেলো না তো। আমার আম্মাজানের চোখের পানি কিন্তু আমি সহ্য করব না।”
“তোমার লায় পেয়ে পেয়ে ছেলে মেয়ে দুইটা এমন হয়েছে। দুইটাই হাড় জ্বালানো বদমাশ হয়েছে। শুধু আমার মন মতো আমার মীরা।”
নুহাশ চোখ ছোট ছোট করে বলে “যাহ্ বাবা! আমি আবার কি করলাম আম্মা?”
“তুই চুপ থাক।”
নুহাশ তপ্ত শ্বাস ফেলে। তার মা কে বোঝা তার কর্ম না। নুহাশ পকেট থেকে ফোন বের করে কিছুক্ষন স্ক্রল করে। তারপরে মুখ ভার করে টি টেবিলে ফোনটা রেখে সোফায় গা এলিয়ে দেয়। তার দিকে যে কৌতুহলী চোখে সবাই তাকিয়ে আছে সে দিকে তার খেয়াল নেই। শান্ত স্বরে বলে
” পুতুল! কি চাই তোর?”
সবাই ভ্রু কুঁচকায়। লহমায় চেঁচিয়ে উঠে সূরা। এক লাফে ভাইয়ের পাশে বসে ভাই কে জড়িয়ে ধরে বলে
“ভাইয়া সত্যি এ-প্লাস পেয়েছি? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”
নুহাশ মুচকি হেসে বলে “তোকে বলেছিলাম এ-প্লাস পেলে তুই যা চাইবি তোকে তাই দিবো। কিন্তু গোল্ডেন এ-প্লাস পাওয়ার জন্য তোকে কি দিই বলতো পুতুল?”
সবার মুখে হাসি ফুটে উঠে সূরার রেজাল্ট শুনে। মীরা দৌড়ে যায় রান্নাঘরে। নিহারিকা সিকদার মেয়ের কাছে এসে কপালে স্নেহের পরশ এঁকে দেয়। মিজানুর সিকদার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন। তার বিশ্বাস রেখেছে তার মেয়ে। গর্বে বুকটা ভরে যায় তার। মীরা ছুটে এসে সূরাকে মিষ্টি খাওয়াতে গেলে কাপড়ে পা বেঁধে পড়তে নিলে সূরা চেঁচিয়ে উঠে। নুহাশ দ্রুত ধরে ফেলে মীরাকে। মেয়েটা চার মাসের গর্ভবতী। সূরা মীরাকে বসিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বলে
“ভাবিজান তুমি কেনো মিষ্টি আনতে গেছো? এখনি কি হতো বলোতো। আমার কুচুপু এখনই তো ব্যাথা পেতো।”
একটু থেমে মীরার পেটে হাত দিয়ে বলে “কুচুপু ব্যথা পেয়েছিস সোনা। তোর মা পঁচা। তুই একবার আমার কাছে আয় আমরা দুজনে একসাথে থাকবো। তোর মাকে নিবো না আমাদের সাথে কেমন।”
মীরার পেটে আলগা করে মাথা রাখে সূরা। হয়তো বাচ্চার বলা কথা শুনার চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু সেটা কি সম্ভব। আজ নতুন না। প্রতিদিন তাঁর আর নুহাশের বাচ্চার সাথে কথা বলা চায়-ই চায়। আর এই দুই পাগল ভাই বোনের মাঝে ফেঁসে গেছে মীরা। সূরার কান্ডে শ্বশুড় শ্বাশুড়ীর সামনে লজ্জা পেল মেয়েটি। নুহাশ মিটিমিটি হাসে বোনের কর্মকান্ডে। মীরার বেবী হবে শুনে সূরা পুরো গ্ৰামে মিষ্টি বিলিয়েছিল। অবশ্য টাকা টা নুহাশের পকেট থেকেই গেছে। মিজানুর সিকদার আর নিহারিকা সিকদার মেয়ের কান্ড দেখে মুচকি হেসে জায়গা ত্যাগ করেন। মীরাকে আর লজ্জায় না ফেলায় ভালো। এই মেয়ের সবে তো শুরু হয়েছে। সূরা মীরার পেটে হাত বুলিয়ে বলে
“কুচুপু সোনা জানিস তো তোর ফুপি কিন্তু খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। কিন্তু আমার মন ভালো নেই। তোকে মিষ্টি খাওয়াতে পারলাম না। তুইও মন খারাপ করিস না সোনা। তোর হয়ে আমি নাহয় দুটো মিষ্টি বেশি খেয়ে নিবো। কেমন।”
নুহাশ আর মীরা সূরার কথায় হেসে উঠে। সূরা পাত্তা দেয় না। তার এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কুচুপুর সাথে বকবক করা আর সে এই কাজটাই মন দিয়ে করে।
★★★★★★
তালুকদার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে সূরা। গ্ৰামে চেয়ারম্যান পল্লব তালুকদারের বেশ নামডাক। এক কথার মানুষ তিনি। নিজের কাজের দ্বারা সম্মান, নামডাক অর্জন করেছেন তিনি। গ্ৰামের সবচেয়ে বড় বাড়িটা তাদের। পল্লব তালুকদারের দুই ছেলে মেয়ে। পিয়াস আর প্রিয়া। আর তার ছোট ভাই পলাশ তালুকদারেরও দুই ছেলে মেয়ে অন্ত আর অনন্যা। পলাশ তালুকদার আর তার স্ত্রী গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যায় বছর খানেক আগে। এই বাড়িতে সূরার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ হলো প্রিয় বান্ধবী প্রিয়া। ভারি মিষ্টি মেয়ে সে। সূরা মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে তালুকদার বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে। তার রেজাল্ট ভালো হওয়ায় নুহাশ পুরু গ্ৰামের মানুষকে মিষ্টি মুখ করার জন্য মিষ্টি নিয়ে এসেছে। ভাইয়ের পাগলামি দেখে মনে মনে হাসে সূরা। ভেতরে ঢুকতেই প্রিয়া ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে সূরাকে। গদগদ হয়ে বলে
“সুর তোকে না একটা চুমু খেতে ইচ্ছা করছে আমার। কতো ভালো রেজাল্ট হয়েছে তোর।”
“তোকে কে বলল আমার রেজাল্টের কথা?”
“বড় ভাইয়া বলেছে।”
“অন্ত ভাই আছে বাড়িতে?”
” অভিনন্দন সূরা।”
ঘর থেকে বেরিয়ে অন্ত সূরার উদ্দেশ্যে বলে। সূরা তাকায় অন্তের দিকে। নুহাশের পরে এই লোকটাকে সে বড় ভাইয়ের মতো ভালোবাসে, সম্মান করে। অন্তও যে তাকে নিজের বোনের মতো স্নেহ করে। নুহাশ আর অন্ত কলিজা, ফোপড়া, কিডনির টুকরা বন্ধু যাকে বলে। সূরা মুচকি হেসে এগিয়ে যায় অন্তের কাছে। প্যাকেট খুলে একটা মিষ্টি এগিয়ে দিয়ে বলে
“অন্ত ভাই সব কিন্তু আপনার জন্য সম্ভব হয়েছে। আপনি না পড়ালে কি আমি এতো ভালো রেজাল্ট করতে পারতাম? মুখ খুলেন। ছোট বোনের হাতে মিষ্টি খান তো দেখি।”
অন্ত মুচকি হেসে সূরার হাত থেকে মিষ্টি খায়। সূরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে
“আমার জন্য কিছুই হয়নি। তুই পরিশ্রম করেছিস বলেই সফলতা অর্জন করতে পেরেছিস। আমার জন্য হলে আমার দুই গাধি বোনও ভালো রেজাল্ট করতো।”
প্রিয়া গাল ফুলিয়ে বলে “বড় ভাইয়া এটা কিন্তু ঠিক না। আমিও কিন্তু এ-প্লাস পেয়েছি।”
“হুঁ! উদ্ধার করেছিস আমাকে এ-প্লাস পেয়ে। আর একজন তো টেনেটুনে পাস করেছে।”
“সবার সাথে আমাকে তুলনা করবে না বড় ভাইয়া।”
পেছন থেকে শক্ত কন্ঠে বলে ওঠে অনন্যা। সে যে সূরাকে বলেছে বুঝতে বাকি থাকে না সূরার। মেয়েটা তাকে কেনো এতো অপছন্দ করে জানা নেই তার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সূরা আনজুমান বেগমের কাছে যায়। নরম সুরে বলে
“আম্মাজান আপনাদের জন্য মিষ্টি পাঠিয়েছে চাচি।”
আনজুমান বেগম চেঁচিয়ে কাজের মেয়ে ফুলিকে ডাকেন। ফুলি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলে সূরার হাত থেকে মিষ্টি নিয়ে রান্নাঘরে রাখতে বলেন। তিনিও আর না দাঁড়িয়ে চলে যান রান্নাঘরে। সূরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই বাড়িতে সবাই তাকে ভালোবাসলেও অনন্যা আর আনজুমান বেগম তাকে সহ্য করতে পারেনা। সূরা অন্ত কে বলে
“অন্ত ভাই আমার কিন্তু সামনে মেডিকেলে চান্স পাওয়ার জন্য এডমিশন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে। আমি কিন্তু কাল থেকে পড়তে আসবো।”
“আচ্ছা আসিস। আর প্রিয়া তুইও কাল থেকেই বই নিয়ে বসবি আমার কাছে।”
প্রিয়া কাঁদো কাঁদো মুখ করে বসে পড়ে সোফায়। আবার পড়া লাগবে। প্রিয়ার মুখ দেখে হেসে উঠে অন্ত আর সূরা। এতোক্ষন নিরব দর্শকের ন্যায় বসে সবকিছু দেখছিল এক সুদর্শন যুবক। সোফা ছেড়ে উঠে টি টেবিলে রাখা ফুলদানি টা হাতে নিয়ে ছুড়ে মারলো দেয়ালে। লহমায় কেঁপে উঠল উপস্থিত সকলে। কাউকে কিছু না বলে হনহন করে বেরিয়ে গেল সে। সূরা অপলক তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার দিকে।
★★★★★★
দিবাকর পশ্চিমাকাশে ঠাঁই নিয়েছে কিছুক্ষণ পূর্বে। তালুকদার বাড়িতে প্রিয়ার সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে জানা নেই সূরার। গ্ৰামের মেঠোপথ ধরে হেলতে দুলতে বাড়ির দিকে যাচ্ছে সূরা। কিশোরী মন আজ বেশ ফুরফুরে। স্বপ্নের দিকে আরও একধাপ এগিয়ে গেল সূরা। বিলের রাস্তা পার হয়ে কাঁচা রাস্তায় উঠতেই পিয়াসের কথায় হকচকিয়ে যায় সূরা। পিছু ফিরে দেখে পিয়াস শিমুল গাছের নিচে বাইকে হেলান দিয়ে বসে আছে। এই লোকটাকে সূরার কাছে মাকাল ফল মনে হয়। বাইরে থেকে দেখতে সুদর্শন এই পুরুষ কিন্তু সারাদিন টোটো কম্পানির মতো ঘুরে বেড়ানো তার কাজ। এক কথায় ভবঘুরে সে। পিয়াস আবার ডেকে উঠলে সূরা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায়। পিয়াস সূরার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে
“এতো দেরি হলো কেন? জানিস কতোক্ষন ধরে অপেক্ষা করছি তোর জন্য।”
সূরা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বলে “আমি কি আপনাকে অপেক্ষা করতে বলেছি পিয়াস ভাই?”
পিয়াস মুচকি হাসে। এই মেয়েটার দিকে তাকালে তার হৃদয়ে শিহরন জাগে। হৃদয় প্রশান্তিতে ভরে যায়। এই যে এখন সূরা বিরক্তি নিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে প্রশ্নাত্মক চাহনিতে এটাও পিয়াসের ভালো লাগছে। ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়। পিয়াস শব্দ করে হেসে উঠে। বলে
“তুই জানিস তোর সব চেয়ে প্রিয় কাজ কি? তোর সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলো আমাকে তোর প্রনয়ের দহনে দগ্ধ করা।”
সূরার কুঁচকানো ভ্রু আরো কুঁচকে যায়। পিয়াস আবার হেসে ওঠে। সূরা তাকায়। এই লোকটা অতি সুদর্শন। আর এই হাসি। এতো সুন্দর কেন লাগে এই লোকটাকে হাসলে। ছেলেদের কি এতো সুদর্শন হতে আছে। নেই তো। এমন সুদর্শন পুরুষ নাকি তার মতো শ্যামকন্যাকে ভালোবাসে। ভাবা যায়। পিয়াস বলে
সূরা ফট করে বলে উঠল “আপনাকে হাসলে খুব সুন্দর লাগে পিয়াস ভাই।”
পিয়াস চকিতে তাকায় সূরার দিকে। পরক্ষনে শব্দ করে হাসে। বলে
“তুই বললে সামান্য হাসি কেন আমি তোর চরনে দূর আকাশের চন্দ্র এনে দিবো সুর।”
সূরা লজ্জা পায়। কিশোরী মনে প্রজাপতিরা ডানা ঝাপটায়। রংধনুরা সাত রঙের পসরা সাজায়। কিন্তু তার যে স্বপ্ন সে বড় ডাক্তার হবে। এখন যদি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে তাহলে যে সর্বনাশ। সূরা ক্ষীন স্বরে বলে
“আমাকে যেতে হবে পিয়াস ভাই। আম্মাজান দেরি হলে চিন্তা করবেন।”
পিয়াস শান্ত স্বরে আকুল আবেদন করে বলে “আমাকে কি ভালোবাসা যায় না সুর। তোকে আমি খুব ভালোবাসি। একবার ভালোবেসে দেখ আমি তোকে আমার হৃদয়ের রানী করে রাখবো।”
সূরা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো পিয়াসের দিকে। পিয়াস সূরার হাত ধরে তার বুকের বা পাশে আগলে নেয়। সূরা হকচকিয়ে গেল। আশেপাশে তাকায়। কেউ দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ব্যস্ত কন্ঠে বলে
“কি করছেন পিয়াস ভাই? হাত ছাড়েন। কেউ দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে? দয়া করে হাত ছেড়ে দিন।”
“আমি তোকে ভালোবাসি সুর। একবার আমাকে ভালোবেসে দেখ তোকে নতুন অনুভূতির সাথে পরিচয় করাবো আমি। আর যদি ভালো না বাসিস তাহলে কালকের মধ্যে আমার মরা মুখ দেখার জন্য প্রস্তুত থাকিস।”
সূরা বিষ্ময়কর কন্ঠে বলে “এসব কি বলছেন? এভাবে জোর করে কি ভালোবাসা হয় পিয়াস ভাই?”
“আমি ওতো সব বুঝি না। আমি শুধু জানি আমার সুরকে আমার চাই যেকোনো মূল্যে। একটা কথা রাখবি।”
সূরা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকায়। পিয়াস নরম সুরে বলে ওঠে “আমার দেহে যখন প্রান থাকবেনা তখন একবার হলেও আমাকে বলিস “ভালোবাসি”। লজ্জায় তোর মুখ যদি রক্তিম হয়ে ওঠে তাহলে আমার লাশের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলিস “ভালোবাসি”। বলবি তো? নয়লে যে মরেও আমার হৃদয় দগ্ধ হবে প্রনয়ের দহনে।”
“দয়া করে চুপ করেন পিয়াস ভাই। এসব বলবেন না। কিছু হবেনা আপনার।”
“তাহলে বল আমাকে তোর হৃদয়ে রাজ করার অনুমতি দিবি।
সূরা চোখ বন্ধ করে নেয়। কিশোরী মন বুঝতে পারেনা কি করা উচিত। এই মানুষটা যে তাকে ভালোবাসে। আর যদি সত্যি সত্যি কিছু করে বসে এই পাগল প্রেমিক। সূরার মন থমকে যায়। কেঁপে উঠে। এক নিঃশ্বাসে বলে
“দিলাম অনুমতি।
পিয়াস চমকে উঠে। বিশ্বজয় করা প্রশান্তিময় হাসি ফুটে উঠে তার মুখে।সূরার ললাটে আলতো করে ঠোঁটের পরশ এঁকে দেয় সে। সূরার বুঝি শ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। প্রথম কোনো পরপুরুষের ছোঁয়ায় কিশোরী মন নেতিয়ে পড়ে। পিয়াসের মুখোস্রীতে উজ্জ্বলতা বিরাজমান। তার যে নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। বলে
“আজ থেকে তুই শুধু আমার সুর। শুধুই আমার।”
★★★★★★
সময় চলছে নিজ গতিতে। সামনে সূরার মেডিকেল এডমিশন টেস্ট। কিন্তু সেই দিকে আপাতত খেয়াল নেই তার। সে এখন স্বপ্নের জগতের বাসিন্দা। সেখানে সে সংসার সাজায় তার পিয়াস ভাইয়ের সাথে। পিয়াসের সাথে এখন প্রতিদিন রাতে মুঠোফোনে প্রেমালাপ করে এই কিশোরী। কখনো মায়ের ফোন লুকিয়ে তো কখনো বাবার। প্রথম প্রথম প্রেমে পড়ে সবকিছু ভুলে বসে আছে সে। এখন আর ডাক্তার হওয়া নিয়ে স্বপ্ন দেখার সময় থাকে না তার। এখন শয়নে স্বপনে শুধু তার পিয়াস ভাই। কিন্তু সূরা আজও জানে না পিয়াস কে সে ভালোবাসে নাকি কিশোরী মন আবেগের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে।
“সূরা অংকটা করেছিস?”
অন্তের কথায় হকচকিয়ে যায় সূরা। আকাশের দিক থেকে চোখ সরিয়ে সামনে বসা অন্তের দিকে তাকায়। অন্ত, অনন্যা আর প্রিয়া তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সূরা কাচুমাচু করে বলে
“আমি এখনি করে দিচ্ছি অন্ত ভাই।”
“এখন কেন করবি? এটা না তোর হোমওয়ার্ক ছিল।”
“আমি ভুলে গেছি। আর কখনো এমন হবেনা অন্ত ভাই।”
অন্ত কিছুক্ষন শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সূরার দিকে। তারপর অনন্যা আর প্রিয়াকে বলে আজ আর পড়াবেনা। অনন্যা কিছুক্ষন চোখ ছোট ছোট করে সূরার দিকে তাকিয়ে থাকে। অন্ত আবার যেতে বললে অনন্যা ভেংচি কেটে চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে যায়। অন্ত প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে
“তোকে কি আলাদা ভাবে যাওয়ার জন্য বলতে হবে। যা এখন।”
“বড় ভাইয়া তুমি কি সূরাকে মারবে অংক করেনি বলে? ওকে মেরোনা। তুমি বরং ওর হয়ে আমাকে শাস্তি দিতে পারো। আমাকে তিনটা অংক দিও হোমওয়ার্ক। এর চেয়ে কঠিন শাস্তি আর কি হতে পারে।”
অন্ত দাঁতে দাঁত চেপে বলে “তিনটা অংক কোনো শাস্তি হলো। অধ্যায় পাঁচের এর সব অংক কাল তোর হোমওয়ার্ক। এখন যা।”
প্রিয়া কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে “বড় ভাইয়া তিনটা অংক করতেই তো আমি বুড়ি হয়ে যাবো। আর তুমি কিনা। আচ্ছা যাও বান্ধবীর জন্য মেনে নিলাম। এই সুর চল।”
“তুই যা। ওর সাথে আমার কথা আছে।”
প্রিয়া কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই অন্ত চোখ রাঙানি দেয়। সূরা মাথা নিচু করে বসে আছে। প্রিয়া আর কিছু না বলে চলে যায়। অন্ত সূরার দিকে তাকিয়ে বলে
“সূরা আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনবি কেমন। শুনবি তো?”
সূরা মাথা উপর নিচ নাড়ায়। মানে হ্যাঁ। সে শুনবে। অন্ত নরম স্বরে বলে
“আমাদের সর্বনাশের বয়স কোনটা জানিস? এই কিশোর-কিশোরী বয়স। জীবনের সবচেয়ে বড় বড় ভুল গুলো আমরা এই বয়সে করি। এই বয়সে আমাদের আবেগ বেশি থাকে। অজানা জিনিসের প্রতি আগ্ৰহ বেশি থাকে। ভালো জিনিস কে ভালো মনে হয়। আর মন্দ জিনিস হলেও মনে জানার আগ্ৰহ জাগে। আমরা যদি এই বয়স পার করে সামনে এগিয়ে যেতে পারি তাহলেই আমরা সফলতা পাবো। আর যদি সামান্য থেকে সামান্য ভুলও করে ফেলি না তাহলে বাস্তবতার কাছে হেরে তলিয়ে যাবো অতল গহ্বরে। ডুবে যাবো সমুদ্রে। সেখান থেকে বাঁচার উপায় নেই।”
অন্ত অনেক ক্ষন কথা বলায় হাঁপিয়ে উঠে। গলা শুকিয়ে কাঠ। টেবিল থেকে গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে সব পানি পান করে। সূরা তাকায় অন্তের দিকে। অন্ত টেবিলের উপর গ্লাসটা রেখে বলে
“তোর পড়াশোনা এভাবে চলতে থাকলে মেডিকেলে চান্স পাওয়ার স্বপ্ন ছেড়ে দিতে হবে। বড় ভাইয়ের একটা কথা রাখবি বোন পড়াশোনাটা আজ থেকে মন দিয়ে করবি। কি করবি তো।
সূরা মাথা নাড়ায়। তাকে তার স্বপ্ন পূরন করতে হবে। অন্ত নড়েচড়ে বসে। বলে
“পিয়াসের থেকে দূরে থাকবি। এখন তোর প্রথম কাজ নিজের স্বপ্ন পূরন করা।”
সূরা চমকে উঠে। অন্ত কিভাবে জানলো। কি করবে সে? কিন্তু পিয়াস যে চাই তার সাথে সুখের সংসার সাজাতে। সব কি একসাথে পাওয়া যায়? নাকি কিছু পেতে গেলে কিছু হারাতে হয়।
★★★★★★
গোধূলি বেলা। তালুকদার বাড়ির ছাদের একপাশে বসে আচার খাচ্ছে প্রিয়া আর সূরা। প্রিয়া খাচ্ছে কম মুখ দিয়ে তৃপ্তির শব্দ করছে বেশি। সূরা হেসে উঠে প্রিয়ার কান্ড দেখে। তখনই ছাদে আসে পিয়াস। গম্ভীর গলায় বলে
“পিয়ু নিচে যা। আম্মা ডাকছে তোকে।”
প্রিয়া হাতের আচারের বাটিটা রেখে উঠে দাঁড়ায়। সূরাকে বসতে বলে নেমে যায় ছাদ থেকে। পিয়াস এগিয়ে আসে সূরার কাছে। শক্ত কন্ঠে বলে
“বিয়ে করবি আমায়?”
সূরা মজার ছলে বলে “হুঁ করবো তো। আগে পড়াশোনা শেষ করি। ডাক্তারের স্বামী হবেন আপনি। ভাবা যায়।”
বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠে সূরা। পিয়াস চোয়াল শক্ত করে বলে “আমাকে দেখে কি তোর জোকার মনে হচ্ছে? আমি তোকে বিয়ে করতে চায়। আর সেটা এখনই। তুই এখনই আমার সাথে কাজী অফিসে যাবি। বিয়ে করবো আমরা।”
সূরা বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকায়। বলে “এসব কি বলছেন পিয়াস ভাই? এখন কেন বিয়ে করবো? আমার মা বাবা তাদের না জানিয়ে বিয়ে কেন করব? আর এখন এসব বলার মানে কি?
পিয়াস সূরার পাশে বসে। সূরার গালে আলতো করে হাত রেখে বলে “সবাই আমার থেকে তোকে কেড়ে নিতে চায় সুর। আজ দেখলি তো বড় ভাইয়া আমার থেকে তোকে দূরে থাকতে বললো। চল না কলিজা বিয়ে করে ফেলি। দেখবি তখন কেউ আর আমার থেকে তোকে আলাদা করতে পারবেনা।”
“আমি পারবো না সবাইকে ঠকাতে পিয়াস ভাই।”
“তুই কি চাস আমি মরে যায়। তোকে না পেলে পিয়াস তার অস্তিত্ব রাখবেনা সুর। আজ এই মুহূর্তেই তোর চোখের সামনে নিজেকে শেষ করে দিব আমি। আমি আজ পর্যন্ত যা চেয়েছি তাই পেয়েছি কিন্তু আমার সব চাওয়ার উর্ধ্বে তুই। আমি পারবো না তোকে ছাড়া বাঁচতে। ওরা আমার থেকে তোকে কেড়ে নিবে সুর।”
পিয়াস কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায়। ছাদের কিনারের দিকে এগিয়ে যায় সে। সূরাকে না পেলে যে পিয়াস অস্তিত্বহীন।সূরা ভয় পায়। কি করবে বুঝতে পারেনা। দৌড়ে পিয়াসকে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভেজা কন্ঠে বলে
“আমি রাজি পিয়াস ভাই। দয়া করে নিজের ক্ষতি করবেন না। আমি সহ্য করতে পারবোনা।”
ডুকরে উঠে সূরা। পিয়াসের মুখে তার প্রেয়সীকে জয় করার খুশি। অনুভূতি নাকি আবেগের বশে কিশোরী কোন পথে পা দিলো জানে না সে। সেই পথ কি ফুল বিছানো ফুলের বাগিচা হবে নাকি কাটাযুক্ত বাগিচা।
#চলবে…..
(আজকের পর্ব টা বড় হয়ে গেছে। একটু কষ্ট করে পড়ে নিবেন প্লীজ। সূরার অতীত থেকে একটু ঘুরে আসি আমরা । কি বলেন?)