#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_২৮
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা
(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)
পিনপতন নীরবতা তালুকদার বাড়িতে। নিহারিকা সিকদার মুখে আঁচল গুজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। মিজানুর সিকদার মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছেন। মাথা তুলবেন কি করে মেয়ে যে তার মাথা নিচু করে দিয়েছে। তালুকদার বাড়িতে আজ সকলে উপস্থিত। পিয়াসের পেছনে লুকিয়ে আছে সদ্য বিয়ে করা লাল টুকটুকে এক বউ। সদ্য বিবাহিত কিশোরী তার স্বামীর পানজাবি আঁকড়ে ধরে নিরবে চোখের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। নিহারিকা সিকদার মেয়ের কাছে এগিয়ে আসলেন। সূরার হাত ধরে পিয়াসের পেছনে থেকে সামনে টেনে আনলেন মেয়েকে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সপাটে চড় বসিয়ে দিলেন মেয়ের গালে। টাল সামলাতে না পেরে সূরা পড়ে যেতে নিলে পিয়াস আঁকড়ে ধরে নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে। সূরা ডুকরে উঠে। কখনো ফুলের টোকা পর্যন্ত দেয়নি মেয়েকে অথচ আজ সবার সামনে গায়ে হাত তুলে কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে বুঝি নিহারিকা সিকদারের। মেঝেতে বসে পড়েন তিনি।নুহাশ মাকে আগলে ধরে। সূরা জানে পরিবারের সবার চোখের মনি সে। যে বাবাকে কখনো মাথা নিচু করে থাকতে দেখেনি সূরা অথচ আজ তার জন্য তার বাবা মাথা নিচু করে বসে আছে। এই যন্ত্রনা সহ্য হয়না কিশোরীর। নিহারিকা সিকদার ভেজা কন্ঠে বলেন
“তোর একবারও আমাদের কথা মনে পড়লো না সূরা? এভাবে আমাদের শিক্ষাকে অপমান করলি তুই? কবুল বলার সময় কি বুক কাঁপেনি তোর। এই তুই কিভাবে কবুল বলতে পারলি?”
সূরা মুখে দুই হাত চেপে ডুকরে উঠে। আজ পর্যন্ত কি মা বাবা কখনো তাকে সূরা বলে ডেকেছে? তাহলে আজ কেন ডাকছে? এতোটাই অন্যায় করে ফেলেছে সে। সে কি করে বলবে কবুল বলতে কতো কষ্ট হয়েছে তার। কাজী যখন কবুল বলতে বললো তখন সূরা বলতে পারেনা। বুক কেঁপে উঠে, ঠোঁট কাঁপে। পিয়াস তখন শক্ত করে তার হাত আঁকড়ে ধরে। ভরসা দেয় যে হাত সে ধরেছে সেই হাত সে কখনো ছাড়বেনা। সূরা মিজানুর সিকদারের কাছে ছুটে যায়। বাবার পায়ের কাছে বসে মাথা রাখে বাবার কোলে। ফোপাতে ফোপাতে বলে
“আমি বুঝতে পারিনি আব্বাজান আপনাদেরকে এতো আঘাত দিয়ে ফেলবো আমি। আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমাকে পর করে দেবেন না। আমি মরে যাবো আপনাদের কে ছাড়া।”
মেয়ের মুখে মরার কথা শুনে বাবার মন কেঁপে উঠলো। মিজানুর সিকদার মেয়ের মাথায় হাত রেখে আলতো স্বরে আওরালেন “তুমি আমার মেয়ে সূরা। সবসময় এটা মনে রাখবে তোমার আব্বাজানের দরজা তোমার জন্য সবসময় খোলা থাকবে। দোয়া করি ভালো থেকো।”
“আব্বাজান! আমাকে আম্মাজান বলে ডাকবেন না?”
মিজানুর সিকদার মেয়ের কথার কোনো প্রতিত্তর করেন না। বেরিয়ে যায় তালুকদার বাড়ি থেকে। সূরা ভাইয়ের দিকে তাকালো। নুহাশ এগিয়ে আসে। সূরার মাথায় হাত রাখলে সূরা ছলছল চোখে তাকায় ভাইয়ের দিকে। নুহাশ বলে
“ভালো থাকিস। যে জীবন তুই বেছে নিয়েছিস সে জীবন তোর সুখের হোক।”
আর দাড়ায় না কেউ। সূরা ছলছল চোখে সদর দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। পিয়াস এগিয়ে গিয়ে মেঝে থেকে সূরাকে তোলে। এতোক্ষণ নিরব থাকা পল্লব সিকদার গম্ভীর কণ্ঠে বলল
“পিয়ু সূরা মা কে তোমার গুনোধর ভাইয়ের ঘরে নিয়ে যাও।”
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ান তিনি। সূরার কাছে গিয়ে মাথায় হাত রেখে বলেন “কষ্ট পাসনা মা। বাবা মা কষ্ট পেয়েছে তাই চলে গেল। তোর উপরে বেশিদিন তারা রাগ করে থাকতে পারবেনা। আর আমি জানি তুই কেমন। এই সবকিছুর পেছনে যে আমার ছেলের সম্পূর্ণ হাত আছে বুঝতে বাকি নেই আমার। পিয়ুর সাথে ভেতরে যা।”
সূরা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায়। এই মানুষটা ছোট বেলা থেকেই তাকে অনেক স্নেহ করে। সে ভেবেছিল সবাই হয়তো তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। কিন্তু সেটা হয়নি। পিয়ু সূরাকে নিয়ে যায়। আনজুমান বেগম কিছু বলতে চাইলে পল্লব তালুকদার ভরাট কন্ঠে বলে
“সূরা এই বাড়ির ছোট বউ। মেনে নাও সবাই। আর যারা মানতে পারবে না আমি মনে করি তাদের এই বিষয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে।
পিয়াস বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়। কে মানলো কে মানলো না তার যায় আসে না এতে। সে তার সুরকে পেয়ে গেছে এই ঢের।
★★★★★★
তিমিরে তলিয়ে আছে পুরো বাড়ি। আজ আর কৃত্রিম আলো বুঝি মন কাড়তে সক্ষম হচ্ছে না কারোর। ঘরের এক কোণে মেঝেতে বসে আছেন মিজানুর সিকদার। আদরের মেয়ে আজ তার কাছে নেই। বাবার বুকে সন্তানের জন্য যে ঝড় বয়ে চলেছে কাকে বোঝাবেন তিনি। বড্ড আদরের মেয়ে তার। পিয়াস কে খুব ভালো করে চিনেন তিনি। ছেলে হিসেবে ব্ড্ড অপছন্দের তালিকায় সে। বাজে বন্ধুদের সাথে বসে নেশায় বুঁদ হয়ে মাঝরাতে ঘরে ফেরে সে। মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে কেঁপে উঠলো বাবার বুক। এই কোন পথে পা বাড়ালো তার রাজকন্যা। লহমায় ঘাড়ে কারো হাতের স্পর্শে নড়েচড়ে বসেন তিনি। ভেজা কন্ঠে বলেন
“আমার আম্মাজান এই কোন জীবন বেছে নিলো নিহা? আমার মেয়েটা সুখে থাকবে তো? আমার যে অজানা ভয়ে বুক কেঁপে উঠছে। আমার মেয়েটার কি একবারও তার আব্বাজানের কথা মনে পড়ে নি? আমার পাপের শাস্তি কি আমার মেয়ে পাবে নিহা? আমার জন্য আম্মা মারা গিয়েছিলেন। এই বোঝা কি আমার নিষ্পাপ মেয়েটা বয়ে বেড়াবে?”
বলতে বলতে ডুকরে উঠেন তিনি। নিহারিকা সিকদার স্বামীর বুকে মাথা রেখে ফোঁপাতে থাকেন। মেয়ের চিন্তায় নেতিয়ে পড়ছে মায়ের মন। বাবা মা বুঝি এমনই হয়। শত অন্যায়,শত আঘাত করলেও তাদের কাছে সন্তান নিষ্পাপ, অবুঝ শিশু। কিন্তু সেই সন্তান কি কখনো ভাবে মা বাবাকে কতো কষ্ট দিয়ে ফেললো সে? সন্তান হিসেবে কলঙ্কিত সে। ব্যর্থ সন্তান।
★★★★★★
জ্যোৎস্না স্নিগ্ধ রাত। কিন্তু চন্দ্রের জ্যোৎস্নাও আজ ফিকে লাগছে নুহাশের কাছে। কোনো নাম না জানা বিষাক্ত বিষ তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। বিষের বিষ ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছে হৃদয়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একের পর এক নিকোটিনের ধোঁয়া উড়িয়ে দিচ্ছে দূর আকাশে। বড্ড আদরের বোন তার। ছোট বেলা থেকে বোনকে সবসময় আগলে রেখেছে সে। কখনো কোনো কিছুর অভাব বোধ করতে দেয়নি বোনকে। আজ যখন সূরা ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিল তখন হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল তার। কিভাবে পারবে বোনকে ওই বখাটে ছেলের সাথে মেনে নিতে? বোনের জন্য চিন্তায় মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম তার। সূরা কি সুখে থাকবে? নুহাশ আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরবির করলো
“আমার পুতুল কে ভালো রেখো আল্লাহ্। আমার ভাগে লেখা সব সুখ আমার পুতুলকে দিও। আমার পুতুলের জীবনে ফুলের টোকা টাও যেনো না পড়ে। বাবা, আম্মার চোখের অশ্রু আমার পুতুলের জীবনে অভিশাপ হয়ে না ফুল হয়ে যেনো ঝরে।”
অশ্রুতে সিক্ত হলো নুহাশের কপোল। লহমায় কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে নড়েচড়ে উঠল নুহাশ। ভেজা কন্ঠে বলে
“এখানে কেনো এসেছো মীরা? সিগারেটের ধোঁয়ায় বাবুর ক্ষতি হবে। তুমি ঘরে যাও। আমি আসছি।”
“সূরাকে নিয়ে আসলে না কেন? মেয়েটা ওখানে একা কি করছে? ওরা কি ওকে মেনে নিবে? আমার সুরপাখিটা কেন করলো এমন?”
ডুকরে কেঁদে উঠে মীরা। নুহাশ পেছনে ঘুরে বুকে আগলে নেয় মেয়েটাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে
“আমাদের সুর ভালো থাকবে মীরা। চিন্তা করো না। ঘরে চলো।”
নুহাশ মিরাকে নিয়ে ঘরে আসে। চারজন মানুষের নিদ্রাহীন রাত বুঝি আজ। সবার একটাই ভাবনা তাদের সুর ভালো থাকবে তো?
★★★★★★
রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর। তালুকদার বাড়িতে পিনপতন নীরবতা। সবাই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলেও ঘুম নেই একজোড়া চোখের। বিষাক্ত অনুভূতিতে বিষিয়ে আছে মন মস্তিষ্ক। নিজেকে অভিশাপ দিতে ব্যস্ত এক কিশোরী। কি করে পারলো ওই মানুষ গুলো কে কষ্ট দিতে? প্রকৃতিও আজ বুঝি বলছে “তুমি অভিশপ্ত কিশোরী। অভিশপ্ত তুমি।” লহমায় নিজের কোমরে শক্ত পুরুষালী এক হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠল সূরা। হকচকিয়ে গেল মেয়েটি। দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে ঘুরে তাকায় সে। পিয়াস তার দিকে তাকিয়ে আছে মুগ্ধ চোখে। পিয়াস সূরার ভয় মিশ্রিত মুখোস্রি দেখে শান্ত স্বরে বলে
“ভয় পেয়েছিস কলিজা। আমি তো। ভয় নেই।”
পরক্ষনে পিয়াস সূরার গালে হাত রেখে আদুরে গলায় বলল
“তুই আমার হৃদয়ের রানী সুর। তোকে আমি আমার হৃদয়ের রানী করে রাখবো।”
সূরা ডুকরে উঠে। পিয়াস হকচকিয়ে গেল। সূরার কাছে এগিয়ে গিয়ে বুকে আগলে নিল তার প্রানভোমরা কে। মেয়েটার কান্না তার সহ্য হয়না। এই মেয়ে টা যে খুব শখের নারী তার। ব্যস্ত কন্ঠে বলে
“কি হয়েছে সুর। বাড়ির সবার কথা মনে পড়ছে। চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আমি সবাই কে কষ্ট দিয়ে ফেললাম পিয়াস ভাই। ওরা কি আমাকে মাফ করবে? আমি বাড়ি যাবো। আমি কিভাবে পারলাম এতো বড় অন্যায় করতে?”
পিয়াস ভ্রু কুঁচকে বলে “অন্যায়! মানে কি বলতে চাইছিস তুই? আমাকে বিয়ে করা তোর কাছে অন্যায় মনে হচ্ছে নাকি আমাকে ভালোবাসা?”
সূরা তাকায় পিয়াসের দিকে।ভেজা কন্ঠে বলে “আমাকে দয়া করে ভুল বুঝবেন না পিয়াস ভাই। আমি তো শুধু,,,
“কি?”
সূরা মাথা নিচু করে নেয়। পিয়াসের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। শক্ত কন্ঠে বলে “ভুল বা অন্যায় যাই বলিস না কেন এই পিয়াস তোকে ভালোবাসে। আর তুই শুধু আমার সুর। তুই আমাকে ভালোবাসিস বা না বাসিস। এটা মনে রাখবি তুই শুধু আমার।”
সূরাকে আর কিছু বলার সুযোগ দেয়না পিয়াস। কোলে তুলে নেয় সূরাকে। সূরা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় পিয়াসের দিকে। এই মানুষটাকে সে ভালোবাসে কিনা জানেনা। কিন্তু মানুষটার সান্নিধ্য তার ভালো লাগে। এই মানুষটাকে একবার দেখার জন্য মন ছটফট করে। তার হৃদয়াসিক্ত অনুভূতির জোয়ারে ভাসতে তার ভালো লাগে। এসবই কি ভালোবাসা তাহলে ভালোবাসে সে। ভালোবাসে পিয়াস কে। কিন্তু মনের পুরুষ কি তার মনের খবর রাখে। কই তার মন তো বুঝলো না। প্রকৃতি হয়তো এক কিশোরীর মায়ায় বলে উঠলো “অবুঝ কিশোরী ভালোলাগা আর ভালোবাসার গভীরতা তুমি বুঝতে পারলে না। বুঝলে হয়তো আবেগে ভেসে যেতে না।”
★★★★★★★
সময় বহমান নদীর স্রোতের মতো। কখনো কারো জন্য অপেক্ষা করে না। অপেক্ষা যে বড্ড পোড়ায়। তাই হয়তো অপেক্ষা করতে নারাজ সে। তালুকদার বাড়ির ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে সূরা। সূরার বিয়ের আজ চার মাস পেরিয়েছে। অনেক কিছু পাল্টে গেছে এই চার মাসে। সূরার বাড়ির সবাই মেনে নিয়েছে তাদের। একমাত্র মেয়েকে দূরে সরিয়ে দিতে পারেননি তারা। সব ঠিক থাকলেও সূরা ঠিক নেই। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিল সে আর প্রিয়া। প্রিয়া চান্স পেলেও সূরা চান্স পায়নি। আনজুমান বেগম বলে দিয়েছেন বাড়ির বউদের পড়াশোনা তার পছন্দ না। এইটুকু তো বুঝেছে কিশোরী তার স্বপ্নের ডানা কাটা পড়েছে। কিশোরী বয়সে নেওয়া সিন্ধান্ত কখনো সঠিক হয় তো কখনো ভুল। আর যদি একবার ভুল হয়েই যায় তাহলে নিজের সর্বস্ব দিয়ে তার মূল্য চুকাতে হয়। দিনশেষে বড্ড একা হয়ে যায় সে। পাশে তাকিয়ে দেখে কোথাও কেউ নেই। খেলার সাথিরা আজ জীবনে কতো দূর এগিয়ে গেছে কিন্তু সে থমকে আছে একটি ভুলের মাসুল দিতে। সবকিছু থমকে গেছে যেনো তার। বিয়ের কিছুদিন পরেই একদিন রাতে নেশা করে বাড়ি ফেরে পিয়াস। সূরা সেদিন অনেক কথা শুনিয়ে দেয় তাকে। সূরার রাগ দেখে উল্টো রাগ করে পিয়াস। নেশায় বুঁদ থাকা বৈধ স্বামী তখন কিশোরী সূরার উপর স্বামীত্ব ফোলায়। সকালে যখন পিয়াসের ঘুম ভাঙ্গে তখন পাশে সূরার বিক্ষিপ্ত শরীর দেখে টনক নড়ে তার। সূরাকে আগলে নিয়ে অসংখ্যবার ক্ষমা চায় সে। সূরা কিছু বলেনা। এটাই কি ভালোবাসা। ভালোবাসা হলে এতো যন্ত্রনা কেন এতে? সেইদিনের পর থেকে পিয়াস নেশা করা ছেড়ে দেয়। যে জিনিস তার সুরকে কষ্ট দেয় সেই জিনিস তার জীবন থেকে সরিয়ে দিতে সে দ্বিতীয় বার ভাববে না। মা নামক শ্বাশুড়ি তো উঠতে বসতে কথা শুনাতে কার্পন্য করেনা কখনও। বাবার রাজকন্যা কি এতো সহজে সংসার গুছিয়ে নিতে পারে? সময় প্রয়োজন। কিন্তু তাকে সময় দিতে নারাজ তারা। সংসার জীবনে এতো আঘাত পেতে হবে জানলে কি মা বাবার রাজকন্যা কখনো এই পথে পা বাড়াতো? কিন্তু স্বামীর ভালোবাসায় সব ভুলে যায় কিশোরী। স্বামী নামক ব্যক্তিটা তাকে সবসময় আগলে রাখে। আর কি চাই তার।
“মন খারাপ আমার বোনের?”
হঠাৎ পুরুষালী ভরাট কন্ঠে হকচকিয়ে গেল সূরা। পেছনে ফিরে দেখে অন্ত দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই রিতু। দুজনের মধ্যে যে কিছু একটা চলছে বেশ বুঝতে পারে সে। অন্তের কথা প্রতিত্তর না করে সূরা মুচকি হেসে বলল
“যেখানেই চোখ যায় দুই কপোত কপোতী কে দেখতে পায়। এটা কি কোনো রোগ রিতু আপু?”
রিতু এগিয়ে আসে সূরার কাছে। কান আলতো করে মলে দিয়ে বলে
“খুব পেকেছিস না? পাজি একটা।”
খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সূরা। অন্ত আর রিতুও তাল মেলানো। রিতু হাতে রাখা আইশক্রিমের একটা ছোট কোণ সূরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে
“নে ধর। খা দেখি।”
“আমার খেতে ইচ্ছা করছে না আপু।”
“একি সূর্য আজ কোন দিকে উঠেছে? সূরার নাকি আইশক্রিম খেতে ইচ্ছা করছে না। যে আইশক্রিম শীতেও খেতে ভুলে না সে নাকি আইশক্রিম খাবেনা।এটা কি নাগরিক মেনে নিবে?”
“তুমিও না আপু। আমি মোটেও শীতে আইশক্রিম খায়না। এসব তোমাকে অন্ত ভাই বলেছে তাইনা। দাও খাচ্ছি।”
সূরা রিতুর হাত থেকে একটা কোন নিয়ে খেতে শুরু করে। রিতু আর অন্ত দাঁড়িয়ে গল্প করছে। টুকটাক কথা সূরাও বলে। একপর্যায়ে রিতুকে আনজুমান বেগম নিচে ডাকলে সে নেমে যায়। সূরা আইশক্রিম খেয়েছে বললে ভুল হবে মুখে মাখিয়েছে বেশি। অন্ত শব্দ করে হেসে উঠে সূরার কান্ড দেখে। মেয়েটা বাচ্চায় থেকে গেল। বলে
“সারা মুখে মাখিয়েছিস। তুই কি বড় হবিনা সূরা। পাগলি একটা।”
সূরা ঠোঁট উল্টায়। বলে “কই মাখিয়েছি। আপনি মিথ্যা বলবেন না তো। আমার আইশক্রিম খাওয়া একদম ক্লিন এন্ড কেয়ারের মতো সুন্দর।”
অন্ত আবার হাসে। এগিয়ে এসে সূরার মুখে লেগে থাকা আইশক্রিম হাত দিয়ে মুছে দেয়। নিজের হাত সূরার সামনে ধরে বলে “এটাই তোর ক্লিন এন্ড কেয়ারের মতো সুন্দর তাইতো।”
সূরা ফিক করে হেসে দেয়। অন্ত গলায় শব্দ করে হাসে। এসব দেখে দূরে ছাদের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা এক মানবের রাগে শরীরের শিরা ফুলে ফেঁপে ওঠে। হনহনিয়ে নেমে যায় ছাদ থেকে।
★★★★★★
অন্ধকারে তলিয়ে আছে ঘর। দরজা জানালা বন্ধ। দেখে মনে হবে গভীর রাতের অন্ধকারে তলিয়ে গেছে। কিন্তু সবে তো বিকেল। দিনের বেলায় দরজা জানালা বন্ধ করার কারন বোধগম্য হয়না সূরার। সূরা হাতরে হাতরে লাইট জালায়।পিয়াস বিছানায় কপালে এক হাত রেখে শুয়ে আছে। কৃত্রিম লাইটের আলো পিয়াসের শুভ্র মুখোস্রিতে পড়লে চোখ মুখ কুঁচকে নেয় সে। সূরা শান্ত স্বরে বলে
“দরজা জানালা সব বন্ধ করে বসে আছেন কেন? মাথা ব্যাথা করছে?”
সূরা এগিয়ে আসে পিয়াসের কাছে। পিয়াসের মাথার কাছে বসে মাথায় হাত রাখে। পিয়াস সূরার হাত সরিয়ে দেয়। এসব এখন নাকট মনে হচ্ছে তার কাছে। সূরা হতভম্ব। হঠাৎ কি হলো বুঝতে পারছে না। বলে
“কি হয়েছে পিয়াস ভাই? মাথা কি বেশি ব্যাথা করছে? আমি চুল টেনে দেই একটু। দেখবেন কমে যাবে।”
পিয়াস শক্ত কন্ঠে বলে “এই ঘর থেকে এখন যা। তোকে আমার সহ্য হচ্ছে না সূরা।”
সূরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। তাকে সহ্য হচ্ছে না মানে?সে কোথায় যাবে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে। কি করেছে সে। সূরা নরম স্বরে বলে “আমি কি করেছি পিয়াস ভাই। আমাকে না বললে আমি বুঝবো কিভাবে। আপনি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন না দয়া করে।”
পিয়াস উঠে বসে। পুরুষালী শক্ত হাতে সূরার নমনীয় গাল চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল “কি করেছিস জানতে চাস? তাহলে শোন তুই আমাকে ঠকিয়েছিস। আমি কি দিই নি তোকে সূরা। আমার হৃদয়ের রানী করে রেখেছি তোকে। আর তুই কিনা আমারই বড় ভাইয়ের সাথে ঢলাঢলি করিস। এই আমি তোকে বলেছিলাম না অন্তের সাথে কথা বলবি না। বল বলেছিলাম কিনা। ঘৃনা হচ্ছে আমার তোকে।”
সূরা নিষ্প্রান চোখে তাকিয়ে আছে পিয়াসের দিকে। বলে “এসব কেন বলছেন পিয়াস ভাই? অন্ত ভাই আমার বড়ো ভাইয়ের মতো। সে আমাকে ছোট বোনের মতো স্নেহ করে। আমাদের ভাই বোনের সম্পর্কে কলঙ্ক দেবেন না পিয়াস ভাই।”
পিয়াস শব্দ করে হেসে উঠে। পরক্ষনে চোয়াল শক্ত করে বলে “ভাই বোন মাই ফুট। আজকের পর থেকে তুই ওই সা**লা অন্তের সাথে কথা বলবি না। দেখা তো দূরে থাক। সা**লার চোখ তুলে নিবো আমি আমার জিনিসের দিকে তাকালে।”
“নিজের বড় ভাইকে গালি দিতে লজ্জা করছে না আপনার। ছিঃ!”
” না**গোর কে গালি দিচ্ছি বলে কষ্ট হচ্ছে তাইনা। তোর শরীরের এতো জ্বা,,,,,
সূরার চোখ রাঙিয়ে শক্ত কন্ঠে বলে “পিয়াস ভাই!
পিয়াসের মাথা রাগে ক্ষোভে ফেটে যাচ্ছে। সূরাকে অন্তের সাথে দেখে ওর রাগ হয় আর এখন সূরার চোখ রাঙানি যেনো আগুনে ঘি ঢেলে দিল। মুহুর্তেই পিয়াস থাপ্পর মারে সূরাকে। সূরা বিছানার পাশে বসে থাকায় ছিটকে মেঝেতে পড়ে। পিয়াস বিছানা থেকে নেমে রাগের বশে সূরার চুলের মুঠি ধরে। ব্যথায় ককিয়ে উঠল কিশোরী। ঘাড় ঘুরিয়ে অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় বৈধ স্বামী নামক পুরুষের দিকে। পিয়াস হয়তো নিজের মধ্যে নেই। থাকলে কি পারতো তার প্রানভোমরা কে আঘাত করতে। পিয়াস কোমড় থেকে বেল্ট খুলে আঘাত করে সূরাকে। সূরা গুঙ্গিয়ে উঠে। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে সে। নিজের আত্ম চিৎকার কাকে শোনাবে সে? নিজের ইচ্ছায় যে জীবন বেছে নিয়েছে তার নালিশ কাকে বলবে? সূরা অস্ফুটস্বরে আওরালো
“আব্বাজান দেখে যাও তোমার রাজকন্যা তার স্বামীর রাজ্যের রানী হতে পারেনি।”
পিয়াস নিজের রাগ ক্ষোভ উগড়ে দেয় নরম ওই দেহের উপর। আজ যেনো সে পশুতে পরিনত হয়েছে। হাপিয়ে উঠে পিয়াস। দূরে বেল্ট ছুড়ে ফেলে চলে যায় ঘর থেকে। আর রেখে যাই শরীরে রক্ত জমাট বাঁধা সূরাকে। সূরা গুঙ্গিয়ে উঠছে। মেঝেতে পড়ে থাকে সে। এটাই কি তাহলে ভালোবাসা? যদি এটাকেই ভালোবাসা বলে তাহলে দরকার নেই তার এই ভালোবাসার। ডুকরে উঠে সূরা। শরীরের ব্যথার চেয়ে মনের বিষ ব্যথা যে বেশি।
★★★★★★
গ্ৰামের ক্লাব ঘরে বসে মদ খাচ্ছে পিয়াস। এক হাতে দেশি মদের গ্লাস আর অন্য হাতে সিগারেট। মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে তার। তাহিল পূর্ণ দৃষ্টি দেয় পিয়াসের দিকে। বলে
“ভাই থাম আর কতো খাবি? এবার তো ওভার লোড হয়ে যাবে। সূরা ভাবি তখন তোকে আর ঘরে ঢুকতে দিবে না।”
শব্দ করে হেসে উঠে তাহিল, কাশেম আর জারিফ। পিয়াস গ্লাস টা নিচে রাখে। সূরা নামটা মন মস্তিষ্কের দুয়ারে কড়া নাড়ছে। লহমায় দাঁড়িয়ে যায় সে। ছুটে বেরিয়ে যায় ক্লাব ঘর থেকে। জারিফ ভ্রু কুঁচকে বলে
“কি হলো ব্যাপার টা?”
তাহিল বলে “কি আর হবে? সা**লার মনে হয় এখন লাগবে সূরাকে। ওই শা**কে একবার হলেও বিছানায় আনতাম কিন্তু এই কু***বাচ্চার জন্য সব ভেস্তে গেল। ওই শা**র সামান্য হাত ধরায় নুহাশ আমাকে সবার সামনে মেরেছিল। আজ বুঝবে কেমন মজা লাগে। এমন ডোজ দিয়েছি পিয়াস কে। সব তাল গোল পেকে যাবে।”
শব্দ করে হেসে উঠে তাহিল। জারিফ আর কাশেম বুঝতে পারেনা কি করতে চাইছে তাহিল।
★★★★★★
পিয়াস কি করবে বুঝতে পারছে না। কিভাবে পারলো সূরাকে আঘাত করতে। নিজেকে খুন করতে ইচ্ছা করছে তার।আজ মাথাটা বেশ ভারি ভারি লাগছে তার। চোখে ঝাপসা দেখছে। কই বেশি তো খায়নি আজ। পিয়াস নিজের ঘরের দিকে যেতেই একটা হাত আঁকড়ে ধরে তাকে। ঘুরে তাকায় সে। চোখের সামনে ঝাপসা কোনো নারীর অবায়ন দেখে বার কয়েক চোখের পলক ফেলে বোঝার চেষ্টা করে তার সামনে কে। মুখে হাসি ফুটে উঠল পিয়াসের। ঘোরের মধ্যে বলে
“সুর। আমার সুর। সরি জান। আমাকে মাফ করে দে। আমি মারতে চাইনি তোকে। কি থেকে কি হয়ে,,
আর বলতে পারেনা পিয়াস। ঠোঁটে নারীর চিকন আঙুলের চাপ পড়ায় থেমে যায়। লহমায় কোলে তুলে নেয় রমনীটিকে। টলমল পায়ে ঢুকে পড়ে সামনের এক ঘরে।
★★★★★★
বিছানায় জ্বরে কাতরাচ্ছে সূরা। কষ্ট হচ্ছে তার। খুব কষ্ট। হঠাৎ পাশের ঘরে কিছু অস্ফুটস্বরের গোঙানির আওয়াজ কানে আসায় ভ্রু কুঁচকে গেল তার। অনেক কষ্টে মাথা চেপে উঠে বসে সে। সারা শরীরের ব্যথায় কুঁকড়ে যায়। সূরা বিছানা ছেড়ে নেমে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। পাশের ঘরের দিকে চোখ যেতেই থমকে যায় সে। ঘরের দরজা হালকা ভিড়ানো। দরজার ফাঁক দিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য মস্তিষ্কে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ শুরু করে। এটাও কি সম্ভব? লহমায় লুটিয়ে পড়ে কিশোরী।এতো বড় আঘাত সহ্য করা কি এতোই সহজ? জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে থাকে সূরা মেঝেতে। হায়!বাবা ভাইয়ের রাজকন্যার বুঝি ঠাঁই হলো না কোথাও।
#চলবে…….