শিশির_ভেজা_শিউলি #পর্ব_৩০ #ইবনাত_ইমরোজ_নোহা

0
705

#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_৩০
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা

(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)

নিষ্ঠুর পৃথিবীতে বুঝি ঠাঁই হয়না ডিভোর্সি মেয়েদের। আচ্ছা! তারা কি ইচ্ছে করে নিজের গায়ে ডিভোর্সি তকমা লাগিয়ে নেয় নাকি এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর মানুষ গুলো লাগিয়ে দেয়। দোষ না করেও এই পৃথিবীর মানুষগুলো তাদের শাস্তি দেয়। হয়তো তখন প্রকৃতির বড্ড মায়া হয় এই অসহায় মেয়েদের উপর। তাই তো তারা লুকিয়ে নিতে চাই স্বার্থপর পৃথিবীর থেকে। সূরাকে মুখে কালি মেখে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে মীরা। নিহারিকা সিকদার নামাজ পড়তে গেছেন ঘরে। বাড়িতে এখন কেউ নেই। নুহাশ আর মিজানুর সিকদার গেছেন মসজিদে। সূরা দৌড়ে নিজের ঘরে যায়। শব্দ করে দরজা বন্ধ করে। মীরার বুক ধক করে উঠল। এইসময় সূরা দরজা বন্ধ করলো কেন? সে ছুটে যায় সূরার ঘরের দিকে। মেঝেতে পানি পড়ে থাকা খেয়াল করেনা রমনী। পা পিছলে পড়ে যায় মেঝেতে। পেটে আঘাত পেয়ে চিৎকার করে ওঠে “আম্মা গো”।আট মাসের ভরা পেট নিয়ে কাতরাতে থাকে মীরা। আজ বুঝি সব হারালো সে। তার সুরপাখি আর তার সন্তানকে হারিয়ে ফেলবে সে। ডুকরে কেঁদে উঠে মীরা। অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করে। নিজের জন্য ভাবেনা। তাকে যে তার সুরপাখি কে বাঁচাতে হবে।উঠার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। চিৎকার করে নিহারিকা সিকদার কে ডাকতে থাকে।নিহারিকা সিকদার ছুটে আসেন। মীরাকে এই অবস্থায় দেখে আঁতকে উঠেন তিনি।মীরার ব্লাড যেতে শুরু করেছে। তিনি মীরার মাথা নিজের কোলে নিয়ে বলেন

“মা! কি করে পড়লি?‌ আল্লাহ সহায় হোন। আমি কি করবো? নুহাশ কে খবর দিতে হবে। তোর কিছু হবেনা সোনা। হসপিটালে নিয়ে যাবো তোকে।”

মীরা অস্ফুটস্বরে বলে “আম্মা সুর! সুর ঘরে আম্মা। ওকে বাঁচান আম্মা। আমাকে উঠান। ও কিছু করে ফেলবে আম্মা। দয়া করে আপনার ছেলেকে ফোন দেন।”

নিহারিকা সিকদারের বুক কেঁপে উঠল অজানা ভয়ে। তিনি মীরাকে ধরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসিয়ে দেন। ছুটে যান মেয়ের কাছে। দরজা বন্ধ দেখে মুখে আঁচল গুজে ফুঁপিয়ে উঠেন। দরজা ধাক্কা দেন। দরজা বন্ধ। হয়তো আজ নিজের অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি চাই কিশোরী। সূরা সিলিংয়ের সাথে ওরনা বাঁধে। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে বাধা ওরনার দিকে। বাইরের মা বাবা আর ভাই ডাকছে তাকে। আর কখনো হয়তো বাবার মুখে শুনতে পাবে না “আম্মাজান”। মায়ের মুখে শুনতে পাবে না “আমার মা”।ভাই হয়তো আল্লাদি সুরে বলবে না “আমার পুতুল সোনা”। ভাবি নামক বড়বোনের কাছে আবদারের ঝুড়ি নিয়ে বসা হবেনা। কুচুপু কেও দেখা হবেনা।একটা কলঙ্ক এভাবেই হয়তো শেষ করে দেয় সূরার মতো মেয়েদের। যারা বাঁচতে চায় কিন্তু নিষ্ঠুর পৃথিবী কেড়ে নেয় বাঁচার উপায়। সূরার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। অস্ফুটস্বরে আওরালো

“ওরা আমায় বাঁচতে দিল না আম্মা। ওরা তোমার মেয়েকে বাঁচতে দিল না। আব্বাজান আমার জন্য আর মানুষের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। আব্বাজানের নিচু মাথা আমাকে বড্ড কষ্ট দেয়। ও আল্লাহ! আপনি আমায় ক্ষমা করে দিবেন তো।‌আমায় ফেলে দিয়েন না। মাটিকে বলেন আমাকে যেন একটু ঠাঁই দেয় তার বুকে। আমার আম্মার মতো সেও যেন আমাকে আগলে নেয়।‌ এই নিষ্ঠুর পৃথিবী আমাকে কলঙ্কে কলঙ্কিত করলো। বিশ্বাস করে যার হাত ধরলাম। পরিবার কে ছেড়ে যাকে আপন করলাম আজ সেই মানুষটা আমাকে কলঙ্ক দিলো। আমার চোখের সামনে অন্য নারীর সাথে তার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারিনা। বিশ্বাস ভেঙ্গে আমাকে অতল সাগরে ডুবিয়ে দিলো। আমি মরতে চাইনি। চাইনি আমি মরতে।”

ডুকরে উঠে সূরা। ওরনার ফাঁস গলায় দিয়ে পায়ের নিচের চেয়ার ঠেলে ফেলে দেয়। থমকে যায় পৃথিবী। কেঁদে ওঠে প্রকৃতি। আবার কোনো মায়ের বুক বুঝি খালি হলো। অবুঝ মেয়ে বুঝলো না যে নিষ্ঠুর পৃথিবী তার না হলেও মা বাবা তার ছিল। যারা তাকে আগলে রাখলো তাদের কথা কি ভাবা উচিৎ ছিল না। কিন্তু আমরা একবারও কি ভাবি। ভাবিনা। তাদের কষ্টের কথা সন্তান ভাবলে স্বার্থপরের মতো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতোনা। তারা স্বার্থপর পৃথিবীর থেকে মুক্তি পেতে নিজেও স্বার্থপরের তকমা গায়ে লেপ্টে নেয়। তাই হয়তো প্রকৃতি তাদের ঘৃনা করে।‌ ঠাঁই দেয়না তার বুকে। আত্মহত্যা একমাত্র মুক্তির পথ না। এক জীবনে লড়ায় করে বেঁচে থাকতে কয়জন পারে। আমাদের উচিৎ নিজেকে ভালোবাসা। তবেই না আমরা আত্মহত্যার পথ থেকে সরে আসবো। একটা কথা মনে প্রানে বিশ্বাস করা। কষ্টের সাথেই রয়েছে স্বস্তি। নুহাশ আর মিজানুর সিকদার দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে অর্ধমৃত সূরাকে গিয়ে ধরেন। নুহাশ নামায় বোনকে। সূরা প্রায় জ্ঞানশূন্য। মেয়েকে কোলে তুলে নেয় এক অভাগা বাবা। প্রকৃতি কেঁদে উঠে এই দৃশ্যে। আহ!কি নিদারুন যন্ত্রণা। বাবার রাজকন্যা আজ আবার বাবার কোলে উঠেছে। কিন্তু পার্থক্য এটাই আজ আর রাজকন্যা আবদার করে বলেনি “আমায় কোলে নাও আব্বাজান।”

★★★★★★

সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে মীরা আর সূরাকে। মিজানুর সিকদার চোখ বন্ধ করে বসে আছেন হসপিটাল করিডোরের চেয়ারে। নুহাশ মাকে বুকে আগলে নিয়ে শান্তনা দিচ্ছে। মীরা ভালো থাকলেও বাচ্চা কে বাঁচানো যায়নি। আট মাসের বাচ্চা প্রিম্যাচুউর হলেও ডাক্তার জানায় মীরাকে হসপিটালে আনতে দেরি হয়েছে। সূরা এখনো বিপদমুক্ত না। জ্ঞান ফিরেনি তার। মীরাকে কেবিনে দেওয়া হলে সবাই মীরার কেবিনে যায়। নুহাশের কোলে এক নিষ্প্রান নিষ্পাপ বাচ্চা তুলে দেয় নার্স। নিহারিকা সিকদার নাতিকে দেখে ফুঁপিয়ে উঠেন। শখের জিনিস গুলো বুঝি বেশিদিন থাকে না। হয়তো বাচ্চা টাও বুঝেছিল এই পৃথিবী নিষ্ঠুর।তাই হয়তো চোখ মেলে একবারও দেখেনি সে। অভিমানী অভিমান নিয়ে চলে গেছে। আধাঘণ্টা পর মীরা পিটপিট করে তাকায়। নিজের পাশে শ্বশুড় শ্বাশুড়ি আর প্রিয় স্বামীর কোলে সদ্য জন্ম নেওয়া জান্নাতের ফুল কে দেখে। নুহাশ বলে “ছেলেকে দেখাবেনা মীরা?”

মীরা ক্ষীন স্বরে সুধায় “সুর কেমন আছে?”

নিহারিকা সিকদার আর পারেন না সহ্য করতে। বিলাপ করে কাঁদেন তিনি। মীরা বিচলিত হয়ে পড়ে। ব্যস্ত কন্ঠে বলে “সুরপাখি কেমন আছে? আম্মা কাঁদছে কেন? ওকে দেখতে চায় আমি।”

“পুতুলকে ডাক্তার অবজারভেশনে রেখেছে মীরা। কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না সেখানে। নিজের ছেলেকে দেখবেনা তুমি? তাকে যে তার ঘরে রেখে আসতে হবে।”

মীরা ছলছল চোখে তাকালো। উঠতে চাইলে নিহারিকা সিকদার মীরাকে উঠিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসায়। মীরার কোলে ছেলেকে দিলে মীরা বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ছেলেকে। তার ভেতরেই তো ভালো ছিল এই প্রানটা। পৃথিবী কি পারতো না তাকে একটু জায়গা দিতে? সে আটমাস নিজের অস্তিত্বের সাথে বড় করতে পারলে পৃথিবী কেনো দূরে ঠেলে দিল এই ছোট্ট প্রানটাকে। ছেলের সারা মুখে স্নেহের পরশ এঁকে দেয় এক অভাগী মা। শান্ত স্বরে বলে

“আমার ছেলেকে সুরপাখি না দেখা পর্যন্ত কোথাও রেখে আসতে দিবনা আমি। সুর দেখবে না ওর কুচুপু কে? ও দেখবে।দেখতেই হবে।”

★★★★★★

এক কিশোরীর আত্ম চিৎকার, হাহাকারে ভারি হয়ে উঠেছে সদর হাসপাতালের পরিবেশ। মাঝে মাঝে কিছু মানুষ উঁকি দিয়ে দেখছে কিশোরী মেয়ের বিষাদময় মুখোস্রি। সূরার জ্ঞান ফিরেছে মিনিট পনের। এখানকার ডাক্তার পরিচিত হওয়ায় ঢুকতে দেয় কেবিনে। নুহাশ সূরার কোলে তুলে দেয় তার কুচুপু কে। নিস্তেজ সূরা তাকায় বাচ্চাটার দিকে। নিজেকে দোষী ভাবে সে। তাকে বাঁচাতে গিয়েই তো এই নিষ্পাপ শিশুকে বিসর্জন দেয় এক মা। কি করে সবার সামনে দাঁড়াবে সে। বুকে আগলে নিয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে সূরা। গলার ব্যথায় বিষিয়ে উঠে শরীর। তার হাহাকারে বুক ভারি হয় হসপিটালের প্রত্যেকটা মানুষের। সূরা বিরবিরিয়ে অস্পষ্টস্বরে বলে

“আমার জন্য তুই পৃথিবীর মুখ দেখতে পারলি না। ফুপি খুব খারাপ তাইনা সোনা। ফুপিকে কখনো মাফ করবিনা।কথা দে মাফ করবিনা কখনো। তোর খুনি আমি। আমি তোকে খুন করেছি। মাফ করবিনা কখনো। ফুপি তোকে খুব ভালোবাসে সোনা। খুব ভালোবাসে।”

সূরার থেকে নুহাশ ছেলেকে নিতে চাইলে সে দেয়না। পাগলামি শুরু করে। গলার স্বর ভেঙ্গে গেছে তার। গলার ব্যথায় ককিয়ে উঠে। অবস্থা বেগতিক দেখে নুহাশ ডাক্তার ডাকে। সূরাকে ঘুমের ইনজেকশন দিলে সে ঘুমিয়ে পড়ে। নুহাশ আর মিজানুর সিকদার চলে যায় জান্নাতের ফুল কে তার আসল বাগিচায় রেখে আসতে। সেটাই তো তার আসল ঠিকানা।

★★★★★★

মাঝে কেটে গেছে তিন দিন। সূরা আগের চেয়ে আরো চুপচাপ হয়ে গেছে। আজ হসপিটাল থেকে বাড়ি নিয়ে এসেছে সূরা আর মীরাকে। সূরার ঘরে বিছানায় লেপ্টে শুয়ে আছে সূরা। চোখ তার সিলিংয়ের দিকে। পাশে বসে আছে মিজানুর সিকদার, নিহারিকা সিকদার আর নুহাশ। মিজানুর সিকদার মেয়েকে উঠিয়ে বসিয়ে বুকে আগলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এখন বুঝি বাবার বুকটা শান্তি তে ভরে গেল। বাবারা কি কখনো নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে? নাকি সন্তান কখনো বাবাকে বলে আমি তোমাকে ভালোবাসি বাবা‌। একেঅপরের ওপর এই নিশ্চুপ, নিরব ভালোবাসার গভীরতা অনেক বেশি হলেও আমরা বাবার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারিনা। আর না বাবা পারে। মিজানুর সিকদার মেয়ের হাত ধরে ভেজা কন্ঠে বলেন

“আম্মাজান!আপনি কি জানেন এই পৃথিবীতে আপনার বাবার একটা রাজ্য আছে। আর সেই রাজ্যের রাজকন্যা আপনি। আমার আম্মা আমার গর্ব। আপনি হয়তো ভাবছেন কারো রাজ্যের রানী আপনি হতে পারেন নি। কিন্তু আপনি এটা কেন ভাবছেন না জন্মের পর থেকে আপনি আপনার বাবার রাজকন্যা। রাজকন্যার কি প্রয়োজন আছে রানী হবার? যে আমি আপনার নিস্তেজ শরীরের ভার বয়তে পারিনা সেই আমি আপনার নিষ্প্রান শরীরের ভার বয়বো কিভাবে আম্মা?”

নিহারিকা সিকদার মেয়েকে নিজের কোলে শুয়ে দেয়। মায়ের কোলে সূরা শান্তির চোখ বুঝে। ফুঁপিয়ে উঠে সে। নিহারিকা সিকদার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন

“আমার মা তো সাহসী। আমার মা কিভাবে পারলো আমাদের কথা না ভেবে স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের মুক্তির পথ খুঁজে নিতে। ও মা! এবার থেকে যদি নিজেকে শেষ করার কথা মনে আনো আমাকে বলো। আমিও তোমার সাথে যাবো সোনা। আমার ছোট্ট মেয়েকে আমি কিভাবে পারবো ওই মাটির অন্ধকার ঘরে রেখে আসতে। আমিও যাবো আমার মা কে আমার বুকে লুকিয়ে রাখতে। আমায় নিবা তো আম্মা?”

মা বাবার কথায় সূরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। আহ্! কি অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করছে এক অসহায় মা বাবা। নুহাশ বোনকে বলে

“পুতুল! তুই আমাদের রাজকন্যা। আমাদের রাজ্যের রাজরানী। আমার বোনের প্রান ভিক্ষা চাচ্ছি তোর কাছে সোনা। এক অসহায় বাবা মা কে ফিরিয়ে দিস না। ছোট পুতুলকে আগলে রাখতে না পারা এক ব্যর্থ ভাইকে ফিরিয়ে দিসনা।”

সূরা তাকায় ভাইয়ের দিকে। এই মানুষ গুলো তার জন্য বেঁচে আছে। কি চাই আর তার। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী সে। যার কাছে এমন পরিবার আছে তাকে যে বাঁচতেই হবে। লড়াই করতে হবে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর সাথে। সূরা শান্ত স্বরে বলে

“আমি শহরে যেতে চাই ভাইজান। আমি আবার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দিতে চাই। নিজের স্বপ্ন পূরন করতে চাই। এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে ভাইজান। আমায় এখান থেকে দূরে পাঠিয়ে দাও ভাইজান। কিন্তু এটা মনে রেখো আমি একা যেতে চাই।”

সবাই তাকালো সূরার দিকে। মেয়েটা কি হারিয়েই গেল এই নিষ্ঠুর পৃথিবী, নিষ্ঠুর সমাজের জন্য। এভাবে দিনের পর দিন পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যায় সূরা নামক মেয়ে গুলো। ডিভোর্সি হওয়ার কলঙ্কে কলঙ্কিত করে এই সমাজ তাদের। কিন্তু সত্যি কি তারা কলঙ্কিনী। ডিভোর্স, ডিপ্রেশন, কষ্ট, প্রতারনা এগুলো আমাদের জীবনের অংশ মাত্র কিন্তু জীবন না। এগুলোকেই পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন। তাই আত্মহত্যা না লড়ায় করতে হবে। বেঁচে থাকার লড়াই। তবেই না সফলতা আসবে।

★★★★★★

অন্ধকার ঘরে মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে পিয়াস। আগের সুদর্শন পিয়াস আর এই পিয়াসের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। সারাদিন নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে সে। কিন্তু যাকে ভোলার জন্য নেশায় আসক্ত কই তার আসক্তি তো কাটেনা। অন্ধকার ঘর আলোকিত হলে মুখ কুঁচকে নেয় পিয়াস। রিতুকে দেখে উঠে বসে। রিতু এগিয়ে এসে পিয়াসের পাশে বসে। গোছানো ঘর আজ অগোছালো। মদের বোতল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মদের বিদঘুটে গন্ধে গা গুলিয়ে আসছে রিতুর। রিতু তাকায় পিয়াসের দিকে। এই ছেলেটাকে সে নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসে। রিতু শান্ত স্বরে বলে

“এসব কি পিয়াস? আজ কতোদিন পরে বাসায় আসলি? কোথায় ছিলিস এতো গুলো দিন?”

পিয়াস কিছু বলে না। রিতু বলে “সূরাকে কষ্ট কেন দিলি পিয়াস? মেয়েটা তোকে বিশ্বাস করে নিজের সব কিছু বিসর্জন দিয়ে তোর হাত ধরেছিল। আর তুই কিনা সেই হাত মাঝ পথে ছেড়ে দিলি?”

পিয়াস তাচ্ছিল্য হাসে। বলে “আমি তো তার হাত সারাজীবন ধরে রাখতেই চেয়েছিলাম আপু। দেখো আমি এখনো ওর হাত ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে আছি। কিন্তু আমার সুর কই। কোথাও নেই।”

পিয়াসের এক চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। চোয়াল শক্ত করে আবার বলে “ওই ন*ষ্টা মেয়ের আমাকে দিয়ে হয়নি। আমার কাছে থেকে আমারই বড় ভাইয়ের সাথে ন*ষ্টামি করতে বাধলোনা ওর। ঘৃনা করি আমি তাকে। ঘৃনা করি।”

চেঁচিয়ে উঠল পিয়াস। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। পাগলের মতো ঘরের আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। ভয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে রিতু। সবাই ছুটে আসে পিয়াসের ঘরে। অন্ত দাঁড়িয়ে দেখে এক পাগল প্রেমিকের পাগলামি। পিয়াস ডেসিন টেবিলের কাঁচে ফুলদানি ছুঁড়ে মারে। ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। একটা কাঁচের টুকরো এসে পিয়াসের পায়ে বিঁধে। পিয়াস চোখ খিচে নিচে বসে পড়ে। অন্ত ছুটে গিয়ে পিয়াসকে ধরে। অন্তের দিকে তাকিয়ে থাকে পিয়াস। শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত বুঝি আবার তাজা হয়ে উঠল। পিয়াস ধাক্কা দেয় অন্ত কে। খোড়াতে খোড়াতে বিছানায় গিয়ে বসে। ছেলের এসব পাগলামি সহ্য হলোনা পল্লব তালুকদারের। তিনি পিয়াসের কাছে গিয়ে থাপ্পড় মারেন ছেলের গালে। মুহুর্তেই পিনপতন নিরবতায় ছেয়ে গেল তালুকদার বাড়ি। আনজুমান বেগম ছুটে গিয়ে পিয়াসকে ধরে। বড় আদরের ছেলে তার। ছেলের এই অবস্থা সহ্য করতে পারছেন না তিনি। তার জন্য সূরাকে অভিশাপ দেন। ওই মেয়ের জন্যই তো তাঁর ছেলের এই অবস্থা। অন্ত ভরাট কন্ঠে বলল

“তোমরা সবাই এই ঘর থেকে এখন যাও। আমার কথা আছে পিয়াসের সাথে। রিতু তুই আর অনন্যা থাক এখানে।”

অনন্যা চকিতে তাকায় অন্তের দিকে। ভয় হয় তার। পিয়াস রাগান্বিত স্বরে বলে “তোর সাথে আমার কোনো কথা নাই‌। তুই এখনই বিদায় হ আমার চোখের সামনে থেকে।”

পল্লব তালুকদার ছেলেকে ধমকে উঠে “পিয়াস তুমি ভুলে যাচ্ছো অন্ত তোমার বড় ভাই। আমি এসব মেয়ে নিবোনা।”

পিয়াস শব্দ করে হেসে উঠে। সবাই তাকালো তার দিকে। পিয়াস কন্ঠে তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে “বড় ভাই? কে বড় ভাই? ওই ন*ষ্ট পুরুষ আমার বড় ভাই না।ঘৃনা করি আমি সবাই কে। চলে যাও তোমরা। যাও।”

চেঁচিয়ে উঠে পিয়াস। পল্লব তালুকদার অসহায় চোখে অন্তের দিকে তাকালে সে ইশারায় আস্বস্ত করে তাকে। পল্লব তালুকদার আর আনজুমান বেগম বেরিয়ে গেলে অন্ত দরজা লাগিয়ে চেয়ার টেনে বসে।রিতু আর অনন্যা দাঁড়িয়ে দেখে অন্তকে। অন্ত শান্ত স্বরে বলে

“ছোট বেলা থেকেই তুই আমার বড্ড আদরের পিয়াস। আমি সবসময় তোর ভালো চেয়েছি। আমি জানিনা তুই কেন সূরাকে বিয়ে করেছিলি কাউকে না জানিয়ে কিন্তু এইটুকু বিশ্বাস ছিল ভালোবাসিস তুই মেয়েটাকে। ভালোবাসলে কি প্রিয় মানুষটার শরীর বেল্টের আঘাতে রক্তাক্ত করা যাই? এটাই কি ভালোবাসা?”

পিয়াস শান্ত চোখে তাকায় অন্তের দিকে। অন্ত সে চোখের ভাষা বুঝতে পারেনা। অন্ত আবার বলে

“সেদিন রাতের কথা মনে আছে তোর?তোর হয়তো মনে নেই কিন্তু আমার আছে। মেয়েটাকে মেরে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে গিয়েছিলিস তুই। নেশায় এতোটাই মাতাল ছিলিস যে অনন্যার সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটাতেও তোর বাঁধেনি।”

অন্তের কথায় চমকে উঠলো তিনজন। পিয়াস হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। কিভাবে সম্ভব। তার মানে তার ধারনায় ঠিক। সকালে যখন নিজেকে অনন্যার ঘরে পায় তখন চমকে যায় পিয়াস। তাকিয়ে দেখে ঘরে কেউ নেই। সন্দেহ জাগে মনে। সে জানে অনন্যা তাকে পছন্দ করে। রাতের কথা মনে পড়ে না তার। রাতে তো বেশি নেশা করেনি সে তবুও কেন কিছু মনে করতে পারছেনা বুঝতে পারেনা। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বাইরে বেরিয়ে যায়। অন্তের ঘরে গিয়ে সূরাকে দেখতেই মাথা খারাপ হয়ে যায় পিয়াসের। এতো কিছুর মধ্যে ভুলে যায় সবকিছু। পিয়াসের দিকে তাকিয়ে অন্ত আবার বলে

“রাতে আমি বাইরে থেকে এসে দেখি সূরা অনন্যার ঘরের সামনে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে। ওকে তুলতে গিয়েই আমাকে সবচেয়ে জঘন্য অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্যের সম্মুখিন হতে হয়। আমার ছোট ভাই আর বোনের অন্তরঙ্গ দৃশ্য আমার মস্তিষ্ককে বিষিয়ে তোলে। ছিঃ! যে দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারিনি সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য ছোট মেয়েটা সহ্য করবে কিভাবে? আমি চায়নি বাড়ির সবার সামনে নিজের ছোট বোন আর ভাইকে ছোট করতে। তাই সকলের সামনে কিছু বলেনি আমি। কিন্তু যে কলঙ্ক, যে আঘাত তোরা ওই ছোট মেয়েটাকে দিলি তার কি হবে পিয়াস? সারারাত মেয়েটা জ্বরে কাতরাতে থাকে। কিন্তু আমি একা ঘরে ছিলাম না। রিতুও ছিল।”

পিয়াস ছলছল চোখে রিতুর দিকে তাকালে রিতু বলে “হ্যাঁ, পিয়াস। আমিই ওর মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিয়েছিলাম। মেয়েটার দোষ না থেকেও তুই মেয়েটাকে কলঙ্কিত করলি।”

পিয়াস উঠে দাঁড়ালো। অনন্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বলে “কেন এমন করলি অনু? আমি হুঁশে না থাকলেও তুই তো ছিলিস‌। আমার এতো বড় ক্ষতি কেন করলি?”

অনন্যা শক্ত কন্ঠে বলে “যা করেছি বেশ করেছি পিয়াস ভাই। আমি আপনাকে বলেছিলাম আমি ভালোবাসি আপনাকে। কিন্তু আপনি কি করলেন আমাকে প্রত্যাখান করে ওই কালি মেয়েকে বিয়ে করলেন। আমি এতো সহজে মেনে নিবো। আমি যেখানে আমার ভালোবাসা পেলাম না সেখানে আপনাকে কিভাবে আপনার ভালোবাসা পেতে দেই?”

পিয়াস গলা টিপে ধরে অনন্যার। আকস্মিক ঘটনায় হকচকিয়ে গেল সকলে। অন্ত দ্রুত গিয়ে পিয়াসকে ছাড়িয়ে আনে। রিতু দুই হাত দিয়ে ধরে আনন্যাকে। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে অনন্যার। কাশতে কাশতে মেঝেতে বসে পড়ে সে। পিয়াস চেঁচিয়ে বলে

“তোকে খুন করে ফেলবো আমি। ন*ষ্টা মেয়ে মানুষ। আমার সুরকে কষ্ট দিস তুই‌।”

রিতু তাচ্ছিল্য হাসে। বলে “নিজেকে একবার প্রশ্ন করতো পিয়াস। সব দোষ কি অনন্যার‌? সে একাই কি কষ্ট দিয়েছে তোর সুরকে?‌ সে তো শুধু তোকে ভালোবেসে এসব করেছে। কিন্তু তুই কি করলি? সবার সামনে মেয়েটাকে তালাক দিলি। এই তোর গলা কাঁপল না একবারও। তালাক শব্দে নাকি মহান আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে সেখানে তোর বুক কাঁপলো না কেন?”

পিয়াস ডুকরে কেঁদে উঠলো। নিচে বসে অন্তের পা জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করে ওঠে “ভাইয়া আমি বাঁচব না সুরকে ছাড়া। ওকে এনে দাও তুমি। আমি ওকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবো। ও ভাই তোমার পায়ে পড়ি। সুর তোমার কথা শুনবে। ওতো তোমাকে নিজের বড় ভাই মনে করে। আমি নোংরা, নর্দমার কীট।আমি এখনই যাবো ওকে আনতে। আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না সে। ভাই, এ ভাই ওই মেয়েটা নিজের সব কিছু ছেড়ে আমার হাত ধরলো আর আমি ওর হাত শক্ত করে ধরে রাখলাম না কেন ভাই? ওকে ফিরিয়ে আনার সব পথ কি বন্ধ হয়ে গেল? ”

অন্ত নিচে বসে পিয়াস কে জড়িয়ে ধরে। ভাইয়ের কষ্টে বুকটা ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে তার। রিতু এগিয়ে এসে পিয়াসের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে

“সূরা আর কখনো ফিরবে না পিয়াস। আমি গেছিলাম ওর কাছে। ওই হাসি খুশি পরিবারটাকে তুই শেষ করে দিয়েছিস।সূরা চলে গেছে গ্ৰাম থেকে। মেয়েটা নাকি গলায় ফাঁস দিতে গিয়েছিল।”

চকিতে তাকায় অন্ত আর পিয়াস। পিয়াস উঠে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বলে “আমার সুর!”

“ঠিক আছে সে। শরীরটা বেঁচে আছে। কিন্তু তার আত্মার মৃত্যু ঘটেছে। সে আর কখনো ফিরবে না তোর কাছে।”

পিয়াস বিরবিরালো “আমার সুর ফিরবে।”

রাগ বড়ই অদ্ভুত জিনিস। শেষ করে দেয় সুমধুর সম্পর্ক। সম্পর্ক গড়তে বছরের পর বছর লাগে কিন্তু ভাঙ্গতে কয়েক সেকেন্ডও লাগে না। সম্পর্ক কাঁচের মতো। একবার ভেঙে গেলে আর জোড়া লাগে না। আর লাগলেও সেই দাগ রয়েই যায়। রাগের বশে আমরা অপর পক্ষের না, নিজের ক্ষতি টাই করি। জীবন বড়ই অদ্ভুত। কেউ কখনো নিজের অবস্থান থেকে সুখি না। অথচ দেখতে গেলে আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সুখি। জীবনের কষ্ট আসবেই তাই বলে কি আমরা নিজের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবো? আমার অবস্থান আমি ছাড়া কেউ ভালো বুঝবে না। অন্য কেউ হয়তো আমাদের শান্তনা দিতে পারবে কিন্তু ওই অসহনীয় যন্ত্রনার ভাগ নিতে পারবে না। তাই আমাদের উচিৎ আগে নিজেকে ভালোবাসা। দিনশেষে আমার জন্য আমিই আছি। তাই আমাদের উচিৎ নিজেকে সাহায্য করা অসহনীয় যন্ত্রনা থেকে বেরিয়ে আসতে। একবার ভেবে দেখা উচিৎ আমার জন্য কেউ কষ্ট পাচ্ছে না তো। মা বাবার কথা ভেবে বেঁচে থাকা উচিৎ। আত্মহত্যা মুক্তির পথ না। কোনো সমাধান না। হতেও তো পারতো আজ আমরা যেমন আছি তার চেয়েও খারাপ থাকতে পারতাম। নিজ অবস্থান থেকে কখনো ভালো কারো দিকে তাকাতে নেই। আজ আমাদের চোখ আছে, হাত আছে,পা আছে, ধরতে গেলে মহান রাব্বুল আলামীনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আমরা। কিন্তু আশেপাশে তাকালেই দেখা যায় কারো হাত নেই তো কারো পা নেই। কষ্ট করে বেঁচে থাকার লড়াই করে তারা। কিন্তু তাদের কষ্ট দেখার সময় কি কারো কাছে আছে।আমরা ব্যস্ত জীবনে কি কি পেলাম না তার হিসাব নিয়ে। নিষ্ঠুর পৃথিবীতে স্বার্থপর মানুষ।

#চলবে…….
বিশ্বাস করে পরিবার কে ছেড়ে যার হাত ধরলো সে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। স্বামী আর অন্য নারীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের দৃশ্য। বড় ভাইয়ের মতো ভাইয়ের সাথে মিথ্যে কলঙ্ক। গ্ৰামের মানুষের তিক্ত কথা। এতো কিছুর পরেও কি সূরাকে আপনাদের ন্যাকা মনে হচ্ছে? মিসবাহর গলায় ঝুলে পড়লেই কি ভালো মনে হতো? বিশ্বাস ভাঙ্গলে কি আবার বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা এতো সহজ।এই গল্পের একটা ডিপ্রেশড মেয়ের কষ্ট আর আল্লাহর উপর ভরসা করে বেঁচে থাকার লড়াই তুলে ধরতে চেয়েছি। জানিনা কতোটুকু পেরেছি। মাফ করবেন আমাকে। এই গল্পের পরে হয়তো আর লিখবো না। সমালোচনা সত্যি কষ্টদায়ক। এতো কষ্ট করে লিখেও যদি আপনাদের কাছে গল্পটা ভালোই না লাগে তাহলে লিখে কি লাভ।

(কাল থেকে কিন্তু মিসবাহ কে পাবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here