#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_৩১
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা
(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)
বর্তমান….
সিকদার বাড়ি আজ থমকে গেছে যেন। এক রাজকন্যার আর্তনাদ, হাহাকারে বাড়ির আনাচে কানাচে বিষাদের ছায়া। সূরার মুখে তাঁর বিষাক্ত অতীত শুনে থমকে গেছে সকলে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। শুধু চোখের অশ্রু অজান্তেই সিক্ত করছে তাদের কপোলদ্বয়। অশ্রু সিক্ত হয়নি শুধু দুই মানব মানবীর। একে অপরের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে তারা। ওই চোখ কি মনের অব্যক্ত সুপ্ত অনুভূতি ব্যক্ত করছে? জানা নেই কারোর। নিহারিকা সিকদার আর মিজানুর সিকদার মেয়ের কাছে এগিয়ে যান। মেয়েকে তুলে সোফায় বসিয়ে দেন মিজানুর সিকদার। বুকে আগলে নিয়ে ভেজা কন্ঠে বলেন
“আম্মাজান! আপনাকে বলেছিলাম না আপনি আমার রাজ্যের রাজকন্যা। আপনার কান্নায় আমার বুক ভারি হয় আম্মা। রাজকন্যারা কি এভাবে কাঁদে?”
নিহারিকা সিকদার বলেন “আমার মা তো অনেক বুঝদার। ওরা কলঙ্কিত করলেই কি আমার মা অপবিত্র হয়ে গেল? এখনো আমার মা পবিত্র যেমন পবিত্র ছিল আমার গর্ভে।”
সূরা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিহারিকা সিকদারকে। ডুকরে কেঁদে উঠল সে। অস্ফুটস্বরে বলে
“ওরা আবার তোমার মেয়েকে কষ্ট দিবে আম্মা। ওরা আবার আমাকে কলঙ্ক দিবে। ওরা কেউ ভালোনা আম্মা। তোমার মেয়েকে তুমি লুকিয়ে নাও। আমার মুখে দেখো কালি লেগে আছে। ওরা আমাকে আবার নোংরা বলেছে আম্মা। তুমি তোমার আঁচলের নিচে আমাকে লুকিয়ে রাখো আম্মা।”
সবাই অশ্রু সিক্ত চোখে দেখে এক রমনীর হাহাকার। আহ্! কি নিদারুন হাহাকার তার। এই যন্ত্রনা কেউ বোঝার নাই। ডিভোর্সি এই একটা শব্দ পৃথিবীতে জঘন্য শব্দগুলোর মধ্যে একটা। যখন একটা মেয়ে ডিভোর্সি হয় তখন কি শুধু মেয়েটার দোষ থাকে নাকি অপরপাশের মানবটির সমান দোষ থাকে। যে সারাজীবন হাত ধরে রাখার প্রতিশ্রুতি দেয় সে মাঝপথে হাত ছেড়ে দেয়। দোষ তো তার বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের এই সমাজ মেয়েদের কেন খারাপ ভাবে? মীরা ভেজা কন্ঠে বলে
“সুরপাখি! আর কান্না করিসনা সোনা। এবার তো অসুস্থ হয়ে পড়বি।”
সূরা শান্ত চোখে তাকায় মীরার দিকে। তার চাহনিতে অপরাধবোধ। সূরা ক্ষীন স্বরে বলে
“তোমার কি আমাকে দেখে কখনো রাগ হয়না ভাবিজান? আজ আমার জন্য তুমি তোমার সন্তান কে হারিয়েছো। তোমাদের সবার কাছে আমি দোষী। এই বাড়ির সম্মানহানি করেছি আমি। তোমার সন্তান আজ আমার জন্য মৃত। আর সবচেয়ে বেশি অন্যায় করেছি আরেক জনের সাথে।”
সূরা এই কথা বলে মিসবাহর দিকে তাকায়। মিসবাহ শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। সবাই সূরাকে দেখে। শান্ত মেয়েটা আজ আর শান্ত নেই। চুল, জামা কাপড় অগোছালো। সবসময় পরিপাটি থাকা মেয়েটার আজ ওরনাটাও ঠিক নেই। জীবনের কিছু কালো অতীত সবকিছু অগোছালো করে দেয়। সূরা টলমল পায়ে এগিয়ে যান মিসবাহর কাছে। মনের দুর্বলতায় শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে তার। নিহারিকা সিকদার মেয়েকে থামাতে চাইলে মিজানুর সিকদার বাঁধা দেন। সবাই দেখতে চাই সূরা কি করে। আবার বাড়ি জুড়ে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। মিসবাহ সোফায় বসে আছে নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে। সূরা মিসবাহর পায়ের কাছে বসে মাথা উঁচু করে তাকালো মিসবাহর দিকে। দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়ে। কারো মুখে কোনো কথা নেই আর না আছে ব্যকুলতা। সূরা মিসবাহর হাঁটুতে মাথা রেখে এক হাত রাখে পায়ে। থমকে যায় মিসবাহ। চকিতে তাকায় সূরার দিকে। সূরা ভেজা কন্ঠে শান্ত স্বরে বলে
“আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল আজ আপনার সামনে ডাক্তার। আমার জীবনটা খোলা বইয়ের মতো এখন। আপনার নিষ্ঠুর রমনী, পাষাণ হৃদয়ের রমনী কি এখনো নিষ্ঠুর, পাষাণ আপনার কাছে ডাক্তার?
একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারো সামনে মাথা নত করতে নেই আর না কারো পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার অনুমতি আছে। যদি অনুমতি থাকতো আমি আমার ডাক্তারের সামনে মাথা নত করে থাকতাম আমৃত্যু আমরণ।
এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমাদের মিলন সম্ভব না ডাক্তার। জান্নাতে আমার কাছে আপনি আগে আসবেন। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবো আপনার জন্য। আসবেন তোহ্?”
সূরা মাথা তুলে নিষ্প্রান চোখে তাকায় মিসবাহর দিকে। মিসবাহ এখনো শান্ত হয়ে বসে আছে। তার ভেতরের ঝড় ব্যক্ত করতে সে বরাবরের মতো এবারো ব্যর্থ। সূরা আবারও মাথা রাখে মিসবাহর হাঁটুতে। ক্ষীন স্বরে আওরালো
“আমাকে ঘৃনা করবেন না ডাক্তার। আমি সব সহ্য করতে পারলেও আপনার ঘৃনাভরা ওই দৃষ্টি কখনো সহ্য করতে পারবোনা। হয়তো সেদিনই মরন ঘটবে আমার।”
মিসবাহ আর পারেনা সহ্য করতে। এই নিষ্ঠুর রমনী আজীবন আমৃত্যু তার কাছে নিষ্ঠুর রয়ে যাবে। সে কি বোঝেনা তার প্রত্যেকটা কথায় মিসবাহর বুকে হাতুড়ি পেটা হচ্ছে যেন। চিনচিনে ব্যথায় ককিয়ে উঠছে হৃৎপিণ্ড নামক যন্ত্রটা। অসহনীয় বিষ ব্যথায় নীল হয়ে উঠছে শরীর। সেই বিষ ছড়িয়ে পড়ছে শিরায় শিরায়। মিসবাহ নড়েচড়ে উঠলে সূরা হাঁটু থেকে মাথা তুলে তাকায় মিসবাহর দিকে। মিসবাহ সূরার মুখোমুখি মেঝেতে বসে। একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে দুই প্রেমিকযুগল। কতোক্ষন তাকিয়ে থাকে কারো বোধগম্য হলো না। শুধু চোখের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তারা। মিসবাহ সূরার চোখের দিকে তাকিয়ে আলতো করে এক হাত রাখে সূরার কপোলে। হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে আলতো করে চোখের মূল্যবান অশ্রু মুছে দেয়। সূরা আবেশে চোখ বুজে। এই স্পর্শ বড্ড আকাঙ্ক্ষার। সূরা চোখ খুলে তাকালো মিসবাহর দিকে। মিসবাহ আল্লাদি স্বরে বলে
“আমার সুরজান!”
ফুঁপিয়ে উঠে সূরা। এই একটা বাক্য সূরার হৃদয়ে শিহরন জাগায়। প্রশান্তিতে ভরে যায় মন। এই একটা বাক্য তাকে বোঝায় “তুই একা না সূরা। কেউ একজন আছে যে তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তোর জন্য হাত বাড়িয়ে আছে সে। একবার সাহস করে হাতটা ধর। দেখবি আমৃত্যু আগলে রাখবে তোকে।” মিসবাহ দুই হাতের আঁজলায় সূরার মুখ নিয়ে কন্ঠে খাদ নামিয়ে বলে
“আমার হৃদয়ে যার বিচরন সে আমার চরন তার অশ্রুতে সিক্ত করছে! এই অসহনীয় যন্ত্রনা আমি কিভাবে সহ্য করবো সুরজান।
তোমার হৃদয়ের বন্ধ দুয়ারে আমি অপেক্ষারত। একবার দুয়ার খুলে দেখো
এক সমুদ্র প্রনয় নিয়ে তোমার দিকেই হাত বাড়িয়ে আছি। বিশ্বাস করো। শক্ত করে একবার হাতটা ধরো। আমার হৃদয়ের রানী করে রাখবো তোমায়।”
সূরা ছলছল চোখে তাকায়। এই লোকটা কেন বোঝেনা। মিসবাহ উঠে দাঁড়ালো। সূরার দিকে এক হাত বারিয়ে দেয়। সূরা তাকায় বারিয়ে রাখা হাতের দিকে। ভয় পায়। মিসবাহকে না। নিজের ভাগ্য কে। মিসবাহ হয়তো বুঝলো প্রেয়সীর অব্যক্ত কথা। চোখের ইশারায় আস্বস্ত করে। বারিয়ে রাখা হাতের দিকে ইশারা করে বলে
“একবার হাতটা ধরো আমৃত্যু আমরণ তোমার হাত টা ধরে রাখবো সুরজান। ভয় নেই আমি মাকহুল সিকদার মিসবাহ আমৃত্যু ইনশিরাহ্ সূরার। আমার সুরজানের।”
সূরা চোখে হাসে। মিসবাহর হাতে হাত রাখতেই শক্ত করে সূরার হাতটা ধরে মিসবাহ। সূরা উঠে দাঁড়ালো। মিসবাহ সামনে এগিয়ে যায়। কোনো দিকে না তাকিয়ে সূরার হাত ধরে বেরিয়ে যায় সিকদার বাড়ির সদর দরজা দিয়ে। সবাই দেখে তাদের যাওয়া। হয়তো তারাও চাই এবার অন্তত ছেলে মেয়ে দুটো এক হোক। কষ্টের অবসান হোক।
★★★★★★
তালুকদার বাড়িতে আজ যেনো কালবৈশাখী ঝড় বয়ে গেছে। চারিদিকে ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এপাশে ফুঁপিয়ে কাঁদছে অনন্যা। তাকে ধরে আছে বাড়ির নতুন বউ রিতু। যাই হোক না কেন বিয়ে না করে আসতে পারেনি অন্ত। সে চেয়েছিল সূরার কাছে যেতে কিন্তু ভাই কেও তো সামলাতে হবে তাকে। সূরাকে নুহাশ নিয়ে যাওয়ার পরে পিয়াস চলে আসে সেখান থেকে। বিয়ের পরে কেউ আর সেখানে না থেকে বাড়িতে আসে। বাড়িতে অনন্যা ঢুকতেই পিয়াস থাপ্পড় মারে তাকে। পিয়াস আবার অনন্যার দিকে তেড়ে গেলে অন্ত ধরলো তাকে। পিয়াস অগ্নি চোখে তাকিয়ে আছে অনন্যার দিকে। রাগান্বিত স্বরে বলে
“তোর সাহস কি করে হলো আমার সুর কে কলঙ্ক দেওয়ার। আমার সুর তোর মতো? পরপুরুষের সাথে রাত কাটাতে যার বাঁধে না সে কি করে পারে আমার সুর কে কলঙ্কিত করতে। ন*ষ্টা মেয়ে মানুষ।”
অন্ত মাথা নিচু করে নেয়। যেমনই হোক না কেন অনন্যা তার বোন। মা বাবা মারা যাওয়ার পরে অতি আদরে বড় করেছে বোনকে। ভাই আর বোনের মাঝে আজ সে নিরুপায়। পল্লব তালুকদার পিয়াসের গালে থাপ্পর মারেন। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে সকলে। হয়তো কেউ ভাবেনি পিয়াসকে তিনি মারবেন। তিনি হিসহিসিয়ে বলেন
“তোমার সাহস কি করে হলো বাড়ির মেয়েকে ন*ষ্টা বলার?”
পিয়াস শব্দ করে হাসে। চোখ মুখ শক্ত করে বলে “ন*ষ্টা কে ন*ষ্টা বলবো না তো কি বলবো? আজ ওর জন্য আমার সুর আমার কাছে নেই। ঘৃনা করি আমি তোকে। ঘৃনা করি।”
অনন্যা তাচ্ছিল্য হেসে বলে “আপনার ভালোবাসা তো পেলাম না। ঘৃনায় শ্রেয়। একটা কথা বলুন তো পিয়াস ভাই আপনি যাকে আমরা সুর আমার সুর বলছেন সে কি এখনো আপনার আছে? আমার তো মনে হয় না। আর আমার জায়গায় আপনি থাকলে কি করতেন? মেনে নিতেন নিজের ভালোবাসাকে অন্যের সাথে।”
পিয়াস কিছু বলে না। এই মেয়েকে দেখলে তার ঘৃনা করে। পিয়াস টলমল পায়ে এগিয়ে যায় নিজের রুমে। রুমে ঢুকে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দেয় সে। বিছানায় শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। একফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে চোখের কোণ ঘেঁষে। পিয়াস দেওয়ালে টাঙানো সূরার ছবির দিকে তাকালো। ঘরে সূরার অসংখ্য ছবি। পিয়াস আওরালো
“তুই কি এখন আমাকে দেখে রাগ করবি সুর? জানি রাগ করবি। তুই হয়তো রেগে কোমড়ে হাত দিয়ে বলবি
আপনি আর হাসেন না কেন পিয়াস ভাই? হাসলে আপনাকে দেখতে অতি সুদর্শন লাগে আপনি জানেন না।
তখন দেখিস আমি বলবো
আমার হাসির খোরাক আমার কাছে নেই। আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। কিন্তু তুই বললে সামান্য হাসি কেন আমি তোর চরনে দূর আকাশের চন্দ্র এনে দিবো।”
পিয়াস ফুঁপিয়ে উঠে। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। তাহলে পিয়াস কেনো কাঁদছে। পেয়ে হারানোর যন্ত্রনা কাকে বোঝাবে সে। পিয়াস সূরার ছবির দিকে তাকিয়ে কান্না ভেজা কন্ঠে বলে
“তুই আমাকে বলেছিলি তোকে আমি হৃদয়ের রানী করে রাখিনি পায়েও ঠাঁই দিই নি। কিন্তু তোকে কিভাবে বোঝায় সুর আমি তোকে হৃদয়ের কোন সিংহাসনে বসিয়েছিলাম। ব্যর্থ আমি, আমি আমার রানীর মনের রাজা হতে পারিনি। জীবন্ত পুতুল কে আমি জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিয়েছি।”
পিয়াসের কন্ঠ কাঁপে। বুকের অসহনীয় যন্ত্রনা সহ্য হয়না তার। চিৎকার করে বলে উঠলো
“শুনছো! শুনছো গো প্রকৃতি!
এক জীবন্ত পুতুল কে আমি জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিয়েছি।
আমার শখের নারী আজ অন্য কারো। এটাই কি আমার শাস্তি? এর চেয়ে কি মরন ভালো ছিল না?”
#চলবে……