#অদৃষ্টে_তুমি_আমি
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_১৫
খুব ভোরেই ভাঙলো পৃথার ঘুম। কানের নিচে উষ্ণ কিছুর উপস্থিতি পেয়ে একটু অবাক হলো ও। বালিশে শুলে তো এরকম লাগে না। তাহলে?
চোখ মেলে দেখে পৃথা ওর মাথা স্বাধীনের বাহুতে রাখা। চমকে যায় ও। হায় হায়! একি! এখানে কখন এলো ও? গত রাতের কথা পৃথা মনে করার চেষ্টা করে।
স্বাধীনের সাথে কথা হওয়ার পর ওর কপালে একটা ছোট্ট চুমু দিয়ে স্বাধীন ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর দুজনই খাটের দুপাশে যেয়ে শুয়ে পরেছিল। অল্প সল্প গল্প করার পর ঘুমিয়েও পরেছিল পৃথা। যতদূর মনে পরে স্বাধীন খুব কাছেও ছিল না ওর। তাহলে এখানে এলো কিভাবে পৃথা?
পৃথার নড়াচড়ায় স্বাধীনেরও ঘুম গেছে ভেঙে। পৃথার দিকে নিচে তাকিয়ে ঘুম ঘুম গলায় হেসে বললো,
– Good Morning beautiful.
পৃথা চট্ করে উঠে বসলো। সকাল সকালই লজ্জায় পরতে হলো ওকে। ওর অবস্থা দেখে স্বাধীন আধো উঠে পিঠ খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসলো। পৃথাকেই দেখছে ও। পৃথা ইতস্তত হয়ে জিজ্ঞেস করলো ওকে,
– আমি এদিকে কিভাবে এলাম?
স্বাধীন নড়েচড়ে বসলো তখন,
– ইশ্ পৃথা, তোমার মনে তাহলে এসবই ছিল? আগে জানলে গতকাল তোমাকে এভাবে ছেড়ে দিতাম না।
-মানে কি? আমার মনে কি ছিল?
– গতকাল রাতে ঘুমের মাঝে তুমি কি করেছ কিছুই মনে নেই তোমার?
– আশ্চর্য! ঘুমের মাঝে আবার হুশ থাকে নাকি? আর আমি এমন কি করলাম যে তুমি আমাকে এভাবে বলছো?
– আমার বলতেও লজ্জা লাগছে পৃথা।
পৃথা এবার মনে মনে ভয় পেল। সাথে রেগেও গেল,
-এই দেখ, সত্যি সত্যি বলো, আমি কি এমন করেছি। বেশি কথা ঘুরিয়ো না।
-সত্যি বলবো?
– অবশ্যই।
– তাহলে শোন। রাতে তো তুমি ঘুমিয়ে পরলে। কিছুক্ষণ পরে আমারও ঘুম চলে আসলো। প্রায় আধাঘন্টা পর আমার হাতে তোমার হাতের ছোয়া পেলাম। প্রথমে ভাবলাম তুমি বোধহয় আমাকে ডাকছো তাই তোমার দিকে তাকালাম। কিন্তু দেখি তোমার চোখ বন্ধ। আবার শুয়ে পরলাম আমি।
হঠাৎ আবার তোমার স্পর্ষ পেলাম। কিন্তু এবার বিষয়টা হলো আরও ভয়াবহ। দেখি তুমি আমার একদম কাছে চলে এসেছো। উঠে যাচ্ছো আমার বুকে। ঘুমের মাঝে আবার হাসছোও।
একটু থামলো স্বাধীন। পৃথার লাল হয়ে যাওয়া চেহারাটা দেখে ভেতর ভেতর সেইরকম মজা লাগছিল ওর। মেয়েটার মুখের ভাবে ভয় আর চোখে কৌতুহলভরা দৃষ্টি একাকার হয়ে ভারী মিষ্টি লাগছিল ওকে। স্বাধীন আবার শুরু করলো,
– এরপর জানো তুমি কি করলা?
কাঁদো কাঁদো কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো পৃথা,
-কি?
– আমার বুকে এসে চোখের পাতা আল্তো খুলে হাসলা তুমি। তারপর নিজের ঠোট দিয়ে আমার……
ঝট করে স্বাধীনের মুখ চেপে ধরলো পৃথা।
-প্লিস প্লিস প্লিস আর কিছু বলো না। আমি শুনতে পারবো না।
পৃথার প্রায় কেঁদে দেওয়ার অবস্থা দেখে স্বাধীন নিজের ঠোটের ওপর রাখা ওর হাতটায় একটা চুমু দিয়ে ওকে টেনে এক ঝটকায় নিজের কাছে নিয়ে আসলো। পৃথার মাথা নিজের বুকে গুজে ওকে জড়িয়ে ধরে হো হো করে হেসে দিল স্বাধীন।
– আরে পাগলী, এতো লজ্জা পেলে কেমনে হবে? আমি তো তোমারই স্বামী। তোমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে আমার কাছে আসার পৃথা, সেটা সজাগ থেকেই হোক অথবা ঘুমন্ত অবস্থায়।
তারপরেও পৃথার স্বাভাবিক হতে সময় লাগলো, মুখ গুজেই রইলো ও স্বাধীনের বুকে। স্বাধীনকে জিজ্ঞেস করারও এখন সাহস হচ্ছে না যে আর কি কি উল্টা পাল্টা কাজ করেছে ও ঘুমের মধ্যে।
বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে মধ্যরাতেই। স্বাধীন পৃথাকে বললো উঠতে। নিজেই ওকে হাত ধরে নিয়ে গেল ছাদ-বারান্দাটায়। বাংলোটার পেছনে একটা শান বাধা ছোট্ট পুকুর আছে। এখান থেকে সেটা স্পষ্ট দেখা যায়। স্বাধীন সেইদিকে তাকিয়ে মোটা রেলিংয়ে হাল্কা ভর দিয়ে বসল। পৃথা দাড়ালো ওর পাশে,
– সকালটা কি সুন্দর লাগছে, তাই না পৃথা? এখনো মনে হয় নিচে কেউ ওঠেনি তাই সারা শব্দ কম।
– হমম। আমরাই মনে হয় বেশি আগে উঠে পরেছি।
– উঠেছি কই? ঘুমাতেই তো দিলানা তুমি আমাকে রাতের বেলা।
-এই দেখ!ফাজলামো করো নাতো আমার সাথে।
পৃথাকে আবার লজ্জা দিতে পেরে হো হো করে হাসলো স্বাধীন। স্ত্রীর মান ভাঙাতে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
– ওই পুকুর পারে যাবা পৃথা?
– কোথাও যাব না তোমার সাথে আমি।
– ওরে আমার মিষ্টি বউটা এতো অভিমান করেছে? সরি তো জান। যাও, আর খেপাবো না তোমাকে, ওকে?
মুচকি হেসে দিল পৃথা। এটা দেখে স্বাধীনও হাসলো,
-এখন তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও। সবাই ওঠার আগে চলো একটু পুকুর পারটা থেকে ঘুরে আসি। পরে সময় নাও পাওয়া যেতে পারে।
দশ মিনিটের মধ্যেই নিচে নামলো দুজন। যারা ঘরের আর রান্নার কাজে নিয়োজিত তাদের বাদে, পরিবারের কাউকে বাইরে দেখা গেল না। বাড়িটা থেকে বের হয়ে পুকুরের পথ ধরলো স্বাধীন। গতরাতের বৃষ্টিতে খোলা জায়গাগুলো নরম হয়ে গেছে। পৃথাকে নিয়ে সাবধানে এগিয়ে পুকুর পারে আসলো ও।
পুকুর পাড়ের দুপাশে মার্বেল দিয়ে বানানো বসার স্থান। তার থেকে কয়েক ধাপ নিচে গেলেই পানি। পৃথাকে পাশে নিয়ে বসলো স্বাধীন। মগ্ন হয়ে পুকুরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলো ওকে পৃথা।
– এই? কি দেখ?
– হমম? ওওও। না তেমন করে কিছু দেখি না। সকালটা বেশ স্নিগ্ধ লাগছে।
– স্নিগ্ধ! বাহ্! বাইরে থেকেও বাংলা দেখি ভালোই রপ্ত করে রেখেছো।
-এটা কি বললা তুমি পৃথা? নিজের ভাষা কেউ ভুলতে পারে নাকি? তা সে যেখানেই থাকুক না কেন।
– হমম তা অবশ্য ঠিক। আচ্ছা বাবা, মা কি এখন দেশে আসতে পারবেন না?
– হঠাৎ এ প্রশ্ন করলা যে?
– না, কালকে রোজি আন্টি বললেন না, যে বাবার অসুস্থতার জন্য মা নাকি এই বিয়েতে আসতে পারেননি। তাই জিজ্ঞেস করলাম।
– ও হ্যা। আব্বুর কারণে আম্মু আসলে একটু আটকে গিয়েছেন। তবে এমারজেন্সি হলে তো আসবেনই।
– এমারজেন্সি আবার কি হবে?
কাছে টেনে নিল পৃথাকে স্বাধীন,
– এই যে, যখন তোমাকে তুলে আনতে যাব তোমার বাবার বাড়ি থেকে, তখন তো মা কে লাগবেই তাই না!
– হ্যা, তা তো লাগবেই। কিন্তু এতে এমারজেন্সির কি হলো?
স্বাধীনের চেহারার হাসিটা হাল্কা মলিন হতে দেখলো পৃথা,
– আছে কারণ পৃথা। এবার ঢাকায় যাওয়ার পর তুমি সবই জানতে পারবা।
– কিন্তু….
ঠিক সেই মুহূর্তে বেজে উঠলো স্বাধীনের ফোন। কে কল করেছে দেখেই হাসতে লাগলো ও। পৃথাকেও দেখালো। জাহিদের কল,
– আমাদের খোজ পরেছে বোধহয় ঘরে। হয়তো মনে করছে কোথাও পালিয়ে গিয়েছি। হাহাহা। চলো যাই।
-চলো।
………………………………………….
ইয়াসমিন চৌধুরী আজ খুব কাজে ব্যস্ত। স্বামী আজ এপোয়েন্টমেন্ট পরেছে ডাক্তারের কাছে। বিকালে সেখানে যেতে হবে দেখে কাজ সারছেন আর বিড়বিড় করে নিজের মাঝেই রাগ ঝারছিলেন তিনি। এই সময় রান্নাঘরে ঢুকলো রিনিতা। মায়ের মেজাজ গরম দেখে জিজ্ঞেস করলো,
-কি ব্যাপার মা? এতো রেগে আছ কেন?
– তো না রাগ করে আর কি করবো? এই লোকের সেবা করতে গিয়ে জানটা গেল একদম আমার। আজকে আবার ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।
– এই প্রথম ওনাকে নিয়ে তুমি ডাক্তারের কাছে যাচ্ছো তাই না?
মেয়ের কথায় রেগে ফিরে তাকালেন ইয়াসমিন। ভয়ে ভয়ে নিজেকে রিনিতা ঠিক করার চেষ্টা করলো,
-না… মানে, আমি বলতে চাচ্ছি যে এই কাজটাতো সবসময় পৃথাই করে। হাসপাতালে তো ওই নিয়ে যায়। এইবার ও না থাকায় তোমার ওপর চাপটা পরে গেছে।
– ওই কুলক্ষিণীর নাম নিবি না আমার সামনে। অসুস্থ বাপকে আমার ঘাড়ে দিয়ে অফিসের কাজের বাহানায় মজা লুটতে গেছে। ফাজিল একটা মেয়ে!
পৃথার অফিসের নাম শুনতেই চোখে ঝিলিক দিয়ে উঠলো রিনিতার
-মা জানো, পৃথাদের অফিসে নতুন বস এসেছে।
-তো? তাতে আমার কি?
– আরে মা শোন না! ওর বসের সাথে আমার দেখা হয়েছে। বেশ হ্যান্ডসম দেখতে। পারসোনালিটিফুল এপিয়েরেন্স। আর অফিসের মালিক যেহেতু, তাহলে বড়লোকও বটে।
নিজের মেয়ের কন্ঠে লজ্জার ইঙ্গিত পেলেন ইয়াসমিন। মুহূর্তেই তার রাগ গলে গিয়ে চেহারায় হাসি ফিরে আসলো। মেয়েকে ধরে জিজ্ঞেস করলেন,
– মা তোর কি পছন্দ হয়েছে নাকি পৃথার বসকে?
মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানালো রিনিতা। ইয়াসমিনের তখন খুশির ঠিকানা ছিল না,
– এটা তো খুবই ভালো কথা। দাড়া আমি খোজ নিব সে কে। তারপর তোর সাথে তার বিয়ের কথা চালাবো।
……………………………………….
দুই পক্ষের উপস্থিতিতে খুব সুন্দর করে হলুদের অনুষ্ঠানের আয়োজন হলো সন্ধ্যায়। স্থান একই থাকলেও হলুদের জন্য গতদিনের অর্থাৎ মেহেদির সব সাজসজ্জা পাল্টে ফেলা হয়েছে। আজ পুরো জায়গাটা সাজানো হয়েছে হারিকেনের আলো দিয়ে। নানা মাপের ছোট বড় হারিকেনের টিপ টিপ বাতি চারো দিক আলোকিত করে রেখেছে। শুধু যে হারিকেনই আছে তা কিন্তু না। কোথা থেকে যেন কলাপাতার বড় বড় ডালও যোগাড় হয়ে গেছে। সে দিয়ে বানানো হয়েছে বর-কনের স্টেজ। সব মিলিয়ে একটা গ্রামীণ পরিবেশের উপস্থিতি মিলেছে এখানে।
সব মেয়েরা আজ একই ধরনের এক প্যাঁচের শাড়ি পরেছে। ছেলেদেরও পাঞ্জাবী এক রংয়ের। ওদের একেকজনকে দেখে সেই মুহূর্তে বলারই উপায় হচ্ছিলো না যে এদের বেশীর ভাগই এই দেশেই থাকে না, মাত্র কিছুদিনের মেহমান হয়ে এসেছে তারা।
আঁচল আগে থেকেই পৃথার জন্য শাড়ি এবং ফুলের গয়না আলাদা করে রেখেছিল বলে,পৃথার কোনো কষ্ট হয়নি। ওরা সবাই একসাথে সাজলো বলে একে অপরকে সাহায্যও করতে পারলো। যখন সবার সাজ শেষ হলো তখন নিজেরাই মুগ্ধ হয়ে পরলো নিজেদের দেখে।
সবাই আঙিনায় আসার পর পৃথাকে যখন স্বাধীন দেখলো তখন ওর চেহারায় গতকালের মতন প্রতিক্রিয়া হলো না। একটু শুধু হেসে পৃথাকে নিজের পাশে দাড় করিয়ে রাখলো ও। এতে একটু অবাকই হলো পৃথা। গতকালের প্রতিক্রিয়া না হলেও অন্তত কিছুটা মুগ্ধতা তো থাকার কথা স্বাধীনের চেহারায়। তাহলে সেটা নেই কেন? তার মানে কি ওকে আজ সুন্দর লাগছে না? কই? পৃথার তো মনে হচ্ছে গতকাল থেকে আজকে বরং বেশী ভালো লাগছে ওকে। তাহলে কি হলো স্বাধীনের?
এসব চিন্তা মাথায় আসতেই হাল্কা দমে গেল পৃথা। ভেতর ভেতরে ক্রমাগত হতাশা বাড়তেই থাকলো ওর। যত যাই হোক, সেজেছে তো ও স্বাধীনের জন্যই। সেই স্বাধীনই যদি কিছু না বলে তা হলে তো এই কষ্টটাই ব্যর্থ!
চলবে।