অদৃষ্টে_তুমি_আমি #লেখিকা_সিনথীয়া #পর্ব_২০

0
488

#অদৃষ্টে_তুমি_আমি
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_২০

রিতা বাসায় এসে সোজা ছেলের ঘরে ঢুকলেন। বেলা হলেও জর্জ অঘোরে ঘুমোচ্ছে। রিতা এসেই ছেলেকে জোর করে ওঠালেন,
– বাবা, তাড়াতাড়ি ওঠ্। খুব জরুরী কাজ আছে। ওঠ্।
জর্জ ভীষণ বিরক্ত হলো। ঘুমের মধ‍্যেই ঝামটা মেরে কথা বললো মায়ের সাথে,
-কি আম্মা! এতো সকাল সকাল কেউ ঘুম ভাঙ্গায় নাকি?
– সকাল কই পেলি? দুপুর সাড়ে বারোটা বাজে।
– তো?
– আহ্হা! রাগ করিস না বাপ। একটু ওঠ্। একটা জিনিস দেখাবো তোকে।
– কি? উঠতে পারবো না। উঠলেই ঘুম চলে যাবে। এভাবে দেখাইলে দেখাও।
রিতা ব‍্যাগ থেকে একটা ছোট্ট লাল বাক্স বের করলেন। ওটা খুলে এগিয়ে দিলেন ছেলের সামনে।
ঘুম চোখে, ছোট জিনিশটা প্রথমে ভালো করে দেখতে পেল না জর্জ।
– কি এটা?
– ভালো করে দেখ্। দেখলেই বুঝবি।
এবার ভালো করে দেখতে পেলো জর্জ আংটিটা। আর তাতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল ওর।
– আম্মা….এটা…এটা কি?
ভারী একটা হাসি দিয়ে মাথা নাড়লেন রিতা,
– হমমমম…. এটা পৃথার জন‍্য কিনেছি। তোর নামে ওকে পরিয়ে আসবো। কেমন হয়েছে দেখ তো ডিজাইনটা?
জর্জের চোখ থেকে ততক্ষণে ঘুম পুরোপুরি চলে গেছে। ও ঝট করে উঠে বসে আংটিটা নিজ হাতে নিয়ে নিল। চকচক করতে লাগলো ওর চোখ,
– সুন্দর হয়েছে। আম্মা, কবে পরাবা আংটিটা পৃথার হাতে?
– খুব শিঘ্রই বাবা। আজ নাকি ও ফিরছে অফিস টুর থেকে। কাল সকালেই যাব ওদের বাসায়। তোর মামার সাথে দেখি কথা বলা যায় কি না। ও বুঝলে ভালো, না বুঝলেও আমি আমার কাজ করে আসবো।
– কিন্তু পৃথা যদি আপত্তি জানায়?
– ওর আপত্তি জানানোর মতন কোনো পথ আছে? বিআইত্তা মেয়ে, স্বামী, সংসার ছাড়া বাপের বাড়িতে পরে আছে। ওর ভবিষ্যৎ তো পুরাই অন্ধকার। ওকে আমি নিজের ঘরের বউ বানিয়ে বাঁচিয়ে দিচ্ছি, এতেই তো ওর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
– আর আব্বাকে নিয়ে কি করবা?
– ওনাকে তো কিছু জানানোরই দরকার নেই। কালকে সকালে শুধু আমরা দুজন যাবো, পৃথাকে আংটি পরাবো আর ওখানেই বিয়ের পাটটাও সেরে আসবো। আজকেই কাজি সাহেবের সাথে কথা বলবো আমি। তিনি সরাসরি তোর মামার বাসায় চলে যাবেন। আর ওইদিকে বাসায় ইয়াসমিনটাতো আছেই। ও সব সামলে নিবে।
মায়ের এই কথায় সেই বিচ্ছিড়ি ধরনের হাসি হাসতে শুরু করলো জর্জ। রিতাও তাল দিলেন ছেলের সাথে। দুই মা ছেলে মিলে তখন বসলেন আগামী দিনের বিস্তারিত পরিকল্পনা নিয়ে।
………………………………………
দুপুরের লাঞ্চের পর পৃথা কে নিয়ে স্বাধীন রওনা হলো। নাশিদের পরিবারের কাছ থেকে বিদাই নেওয়ার সময় খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল পৃথার। মন টা খারাপ হয়েছিল পরিবারের সবারও। এই তিন চারদিনে পৃথার সাথে একটা সুন্দর বন্ধনে বেঁধে গিয়েছিল সবাই। মনেই হয়নি যেন নতুন পরিচয় হয়েছে ওর সাথে। আর পৃথার জন‍্য এই কদিন ছিল স্বপ্নের মতন। বিয়ের তেরো বছর পর প্রথম ও শ্বশুরবাড়ির স্বাদ গ্রহন করলো। ‘বউ মা’, ‘ভাবী’ শব্দগুলোর যে মধুরতা তা বুঝতে পারলো ও এবার। এখন এদেরকে ছেড়ে ওর মন কোনো ভাবেই যেতে চাচ্ছে না।
নাশিদের মা, মিসেস রোজিকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেললো পৃথা। রোজি তো প্রকাশ‍্যেই কাঁদলেন,
– আম্মু, আমি খুব খুশি হয়েছি এবার তোমাকে দেখে। তোমার মতন এতো লক্ষী আর সুন্দর মেয়ে, বউ হিসেবে পেয়ে লিজা আসলেই অনেক লাকি রে মা। আমি এমেরিকা ফিরেই ওকে বলবো সবকিছু। ও অনেক খুশি হবে আমি জানি।
বাকিদের থেকেও বিদাই নিয়ে পৃথা আর স্বাধীন উঠলো গাড়িতে। বেশ অনেকটা পথ পৃথার মন খারাপ রইলো। ওকে চুপচাপ দেখে স্বাধীনও কিছু বললো না প্রথমে। সময় দিল ওকে কিছুটা।
আকাশটা মেঘলা হয়ে আছে। যে কোনো সময় বৃষ্টির ঢল নামার সম্ভাবনা। তারওপর বেশ কিছুটা রাস্তা খারাপ পাওয়া গেল। এর মাঝ দিয়েই আস্তে আস্তে করে ড্রাইভ করছিল স্বাধীন। হঠাৎ দুলকি চালে গাড়িটা নড়ে ওঠায় চমকে উঠলো পৃথা। তখন স্বাধীন হেসে দিল,
– welcome back!
-মানে?
-তুমি তো এতোক্ষণ এই জগতে ছিলা না। এখন ফিরে এসেছো বলে বললাম, welcome back. কি চিন্তা করছিলা?
একটু হেসে আবার হেলান দিল পৃথা,
– গত তিনটা দিন চোখের পলকে চলে গেল। এতো ভালো লেগেছে সবার সাথে যা বলে বোঝানোর না। এখন সবাইকে ভীষণ মিস করছি।
– হমমমম। এমেরিকাতে আমাদের কমিউনিটিতেও আমরা এভাবেই মজা করি। তুমি মন খারাপ করো না। তোমাকে যখন নিয়ে যাব নিজের সাথে তখন দেখবা কত মজা হয়। নাশিদরা তো থাকবেই। আরও কতোজন আছে। তুমি খুব মজা পাবা।
স্বাধীনের কথায় মন ভাল হয়ে গেল পৃথার। হাসতে লাগলো ও। তখন স্বাধীন একটু মায়াবী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-তিনটা দিন শুধু ওদের সাথেই ভালো লেগেছে তাই না? আমার সাথে থাকাটা একটুও এনজয় করোনি?
মুহূর্তেই লজ্জা পেয়ে গেল পৃথা। স্বাধীন কি ইঙ্গিত করছে বুঝেই এই লজ্জাটা আসলো চোখে। সাথে সাথেই বাম হাত দিয়ে নিচের ঠোট খুটতে খুটতে বাইরের দিকে চাইলো ও। স্বাধীনও পৃথার লজ্জা বুঝতে পেরেছে তাই হেসে নিজের স্ত্রীর ডান হাতটা নিজের বাম হাতের মাঝে গুটিয়ে নিল ও। আবার চমকে তাকালো পৃথা। ক্ষণিকের জন‍্য স্বাধীনের দুষ্টুমি ভরা দৃষ্টি দেখলো। তারপর স্বাধীন গাড়ি চালানোতেই মনোযোগ দিল।
ঢাকায় ঢুকতে ঢুকতে সন্ধ‍্যা হয়ে গেল। পৃথাকে বাসায় নামিয়ে দেওয়ার সময় স্বাধীনের ওর থেকে আলাদা হওয়ার কোনো ইচ্ছাই হচ্ছিলো না। গাড়ি থেকে নামার আগেও বউয়ের হাত শক্ত করে ধরে ছিল স্বাধীন।
– পৃথা যেও না প্লিজ। আজ আমার এপার্টমেন্টে চলো। কাল বাসায় পৌছে দেব তোমাকে।
পৃথা হাসতে হাসতেই রাগ দেখালো স্বাধীনকে,
– তুমি কি পাগল হয়ে গেলা নাকি?
– পাগল হওয়ার কি আছে? আমি তো আমার স্ত্রীকেই নিজের সাথে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছি। চলো চলো। তোমাকে কোনো ভাবেও ছাড়তে মন চাচ্ছে না। এখনো কতো কিছু দেওয়া নেওয়া বাকি আছে আমাদের মাঝে। সেইসবের হিসাব করতে হবে।
স্বাধীনের বুকে আল্তো করে চড় মারলো পৃথা,
– তোমরা ছেলেরা শুধু একটা জিনিসই বোঝো তাই না? আর আমার কাছে আসতে দেব না তোমাকে, বুঝছো? অনেক হইসে।
দুষ্টু হাসি হেসে দিল স্বাধীন,
– মাত্র দুবারেই এই অবস্থা ম‍্যাডাম? বাকি জীবন তো পরাই আছে। তখন কি হবে আপনার?
আবারও চড় খেতে হলো স্বাধীনকে পৃথার হাতে। তবে এবার পৃথা নিজের মুখ লুকালো স্বামীর বুকে। হাসতে হাসতে ওকে জড়িয়ে ফেললো স্বাধীন। এরকম ভাবেই রইলো ওরা কিছু মুহূর্ত। এরপর একটু গভীর কন্ঠেই জিজ্ঞেস করলো স্বাধীন,
– পৃথা, আজ আসলেই তোমাকে ছাড়তে মন চাচ্ছে না। আজকে আমার কাছে থাকলে কি খুব সমস‍্যা হবে?
পৃথা মাথা ওঠালো,
– এমনিতেই এক সপ্তাহ বাইরে ছিলাম। বাবার নিশ্চয়ই আমাকে ছাড়া খুব কষ্ট হয়েছে এ কটা দিন। আজ আমি আসবো সেটা সবাই জানে। এখন আবার একটা দিন দেরী করলে সমস‍্যা হবে। বাবাকেও দেখি না কতোদিন। ওনার জন‍্যও খারাপ লাগছে।
পৃথার কথাটা শুনে, স্বাধীন বুঝে আর কিছু বললো না। শুধু ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে পৃথাকে বোঝালো ওর সম্মতিটা। পৃথাও হেসে গাড়ি থেকে নামতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই ওকে টেনে নিয়ে স্বাধীন গভীর ভাবে আদর করে দিল ওর ঠোটে। হুট করে হলেও সামলে নিল পৃথা। আল্তো আদর দিয়ে নিজের ভাগটাও ও বসিয়ে দিল স্বাধীনের ঠোটে। তারপর হাসতে হাসতে নেমে গেল।
ওর লাগেজ নামিয়ে, দারোয়ানকে বুঝিয়ে দিয়ে স্বাধীন আর অপেক্ষা করলো না। চলে গেল গাড়ি নিয়ে। পৃথাও ঢুকে গেল ফ্ল‍্যাটের ভেতর।
বাসায় উঠতে উঠতে পৃথার মনে একটা সংশয় কাজ করছিল। বার বার নিজের হাতের দিকে তাকাতে থাকলো ও। তিনদিন আগের মেহেদি ভরা হাত ওর। এখন তো আরো গাঢ় হয়ে গেছে ওটার রং। এরকম অবস্থায় যদি ওর সৎ মা আর রিণিতার সামনে পরে তাহলে এটার কি জবাব দিবে ও? বুকের ভেতর দুরু দুরু করতে লাগলো পৃথার। কোনো মতে বাসার সামনে এসে বেল চাঁপলো ও। দরজা খুলে দিল ওদের বাসার ছুটা বুয়া, রহিমা। ওকে এই সময়ে বাসায় দেখে অবাক হলো পৃথা।
– রহিমা আপা, আপনি এই সময়ে বাসায় কেন? আপনি তো দুপুরেই চলে যান।
– হ আফা, তাই তো জাই। তয় আইজকা ম‍েডাম ছুডো আফারে লইয়া কই জান্ গ‍্যাসে। আমারে আইতে কইলো খালুর দেখশুন করার জইন‍্য আর আপনে আইলে দরজা খোলোনের জইন‍্য।
– ওওও। আচ্ছা আমি এসে গিয়েছি। আপনি এখন যেতে পারেন আপা।
– ছা বসাই দিমু আফা? খাইবেন কিছু?
হাসলো পৃথা।
– না, আমার কিছু লাগবে না। আপনি আপনার বাচ্চাদের এভাবে রেখে চলে এসেছেন আমার জন‍্য, এটাই অনেক। আপনি এখন যান আপা।
রহিমা বুয়া চলে যাওয়ার পর দরজা লাগিয়ে নিজের রুমে ঢুকলো পৃথা। হাপ ছেড়ে বাচঁলো ও,
– ভালো হয়েছে, এখন ওরা কেউ বাসায় নেই। পরে একটা কিছু চিন্তা করে অজুহাত বের করবো ওদের জন‍্য। এখন ফ্রেশ হয়ে আগে বাবার কাছে যাই।
কিছুক্ষণ পর বাবার রুমের দরজা নক্ করলো পৃথা। সুজন সাহেব রকিং চেয়ারে বসে টিভি দেখছিলেন। দরজায় আওয়াজ শুনে তাকালেন তিনি,
– কে?
– বাবা, আসবো?
– কে?
– বাবা, আমি পৃথা।
এই বলে পৃথা রুমে ঢুকলো। এতোক্ষণে সুজন সাহেবের কুচকে যাওয়া ভুরু সোজা হলো। মেয়েকে চিনতে পেরেছেন, তাই হাসছেন বাচ্চাদের মতন।
-আম্মা, আয়, আয়।
পৃথা এসে বাবার পাশে, খাটে বসলো।
– বাবা, কেমন আছ তুমি?
-ভালো আছি মা।
– সব ঔষুধ ঠিক মতন খেয়েছিলে তো?
– আমি তো বলতে পারবো না রে মা। তুই অথবা ইয়াসমিন যা খাওয়াস, তাই খাইসি।
বাবার করুণ, অসহায় কন্ঠে দমে গেল পৃথা। খুব মায়া লাগলো, সাথে একটু অপরাধবোধও হলো। এরকম ভাবে বাবা কে রেখে এক সপ্তাহের জন‍্য যাওয়া কি ওর ঠিক হয়েছিল?
– পৃথা, মা?
নিজের খেয়াল থেকে বের হয়ে আসলো পৃথা,
– বাবা, কিছু লাগবে তোমার?
– হ‍্যা। আমার ওই ডায়রিটা দে তো মা। আমি কতো কিছু ভুলে যাই, ভোলার আগে ওখানে লিখে রাখি তো। এই মাত্রই লিখে রেখেছি টেবিলে।
খেলাচ্ছলে হাসলো পৃথা। ডায়েরিটা এনে বাবার হাতে দিতে দিতে বললো,
– বাবা তুমি এই ডায়েরির কথা কখনোই ভুলোনা দেখি।
সুজনও হাসলেন।
– কেমনে ভুলি রে মা। সারাদিনই তো এটা হাতে নিয়ে বসে থাকি। একটু পর পরই লিখতে থাকি। কত বছর ধরে এটাই আমার সাথী হয়ে আছে। হাহাহা।
পৃথাও জোরে জোরে হাসলো বাবার সাথে। এরপর সুজন সাহব ডায়েরিটা খুললেন। পেছনের কয়েকটা পাতা ওল্টালেন,
– তুই মনে হয় এ কদিন ছিলি না তাই না মা? তোর নামে কোনো এন্ট্রি নাই এখানে।
– হ‍্যা বাবা। আমি অফিসের কাজে সিলেট গিয়েছিলাম।
-ওওও। তো কাজ হয়েছে ঠিক ভাবে।
– হ‍্যা বাবা হয়েছে। বাবা…..
-কি বল?

একটু থামলো পৃথা,
– বাবা….. তোমার….. স্বাধীনের কথা মনে আছে?
– স্বাধীন? না…. মনে করতে পারছি না তো। কে স্বাধীন?
পৃথা উঠে নিজের রুমে গেল। বাবার লেখা সব ডায়েরিগুলো খুব যত্ন সহকারে নিজের আলমারীর ভেতরে রাখে ও। সেখান থেকেই প্রথম দিকের দু একটা ডায়েরি ঘেটে নির্দিষ্ট একটা সেকশন নিয়ে ওর বাবার কাছে গেল ও।
-বাবা এটা পড়।
সুজন মেয়ের হাত থেকে ডায়েরিটা নিয়ে পরতে শুরু করলেন। আস্তে আস্তে ওনার চোখ বড় হয়ে যেতে দেখলো পৃথা,
-স্বাধীন, মানে মনসুর চাচার নাতি স্বাধীন তাই না? এখানে তো লেখা তোর সাথে ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সত‍্যি পৃথা? তোর আর স্বাধীনের কি বিয়ে হয়ে গেছে?
মুচকি হাসলো পৃথা,
– হ‍্যা বাবা। আমাদের বিয়ে তোমরা অনেক ছোটবেলায় দিয়ে দিয়েছিলে।
– তাহলে স্বাধীন কই? এখানে তো লেখা ও এমেরিকায় চলে গেছে। আর আসেনি?
– এসেছে বাবা। স্বাধীন এখন দেশে ফিরেছে আমার সাথে দেখা হয়েছে ওর। ওর সাথেই সিলেট গিয়েছিলাম আমি।
– তাই? তা আমার সাথে স্বাধীনের দেখা করাবি না মা? আমিও আমার জামাইকে দেখতে চাই।
– দেখা করাবো বাবা। ওকে বলবো এখানে আসতে। ও নিজেও তোমার সাথে দেখা করতে চায়।
– ঠিক, ঠিক। অবশ‍্যই আসতে বলিস।
– ওকে। এখন তুমি বসো, আমি তোমার জন‍্য খাবার রেডি করছি।
– আচ্ছা। আমি, এর মধ‍্যে, তোর সাথে হওয়া কথাগুলো লিখে নেই নাহলে ভুলে যাব পরে।
পৃথা রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো কি রান্না করা আছে। দেখে অবাক হলো যে ফ্রিজে বা বাইরে কোনো খাবারই নেই। বাবার জন‍্য কি মা কিছুই রান্না করেনি তাহলে?
আর কিছু চিন্তা না করে সোজা খাবার বসিয়ে দিল পৃথা। চাল ধোয়ার সময় বারবারই পৃথার চোখ চলে যাচ্ছিলো ওর মেহেদি রঙা হাতের ওপর। লজ্জায় নিজের অজান্তেই হেসে দিল ও। গত রাতের কথাটা মনে পরে গেল।
ঠিক রাত না, তখন ভোর হয়ে গেছে প্রায়। এক চাদরের মাঝেই পৃথাকে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখে শুয়ে ছিল স্বাধীন। কিছুক্ষণ আগের বাধ ভাঙা ভালোবাসায় দুজনই কিছুটা ক্লান্ত। ছাদ বারান্দা থেকে আসা আলো আধারের খেলাতেই স্বাধীন দেখছিল পৃথাকে। কখনো ওর এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুল তো কখনো ওর হাতের আঙ্গুলের সাথে খেলছিল। পৃথা কোনোটাতেই বাধা দিচ্ছিলো না। কখনো লজ্জা পেয়ে তো কখনো খিলখিলিয়ে হাসছিল ও শুধু। এমন সময় ওর হাতটা মেলে ধরলো স্বাধীন,
-তোমার মেহেদির কেমন রঙ হয়েছে দেখেছো? কি কড়া হয়েছে।
-হ‍্যা। মেহেদিটা, আই গেস, ভালো ছিল।
এই কথায় বিশ্বয়ের সাথে পৃথার দিকে তাকালো স্বাধীন,
– কি বললা তুমি? মেহেদির কোয়ালিটি ভালো বলে এই রঙ হয়েছে?
– হ‍্যা… মানে…?
– are you serious Preetha?
– কেন? ভুল কি বললাম?
স্বাধীন আবার পৃথার হাত ধরলো,
– এই মেহেদি এতো গাঢ় হয়েছে কেন জানো? তোমার স্বামীর ভালোবাসার জন‍্য বুঝছো? আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি বলেই তোমার হাতে মেহেদি এতো রঙ নিয়ে এসেছে। নয়তো যত ভালো কোয়ালিটিই হোক না কেন মেহেদির, আমার ভালোবাসা না থাকলে কোনো রঙই হতো না।
পৃথা এটা শুনে, একটু উঠে বসে হো হো করে হাসা শুরু করে দিল। ভোরের এই সময় আশপাশের নিস্তব্ধতার মাঝে অনেক জোরে শোনালো হাসি টা। স্বাধীন একেবারে অবাক হয়ে গেল,
– এভাবে হাসছো কেন?
– তুমি কি এমেরিকায় বসে খুব বলিউডের সিনেমা দেখতা নাকি? এই ডায়ালগ তো ওখান থেকেই শুনেছি।
এবার স্বাধীন বুঝলো পৃথার হাসির কারণ। অভিমানি রাগ নিয়ে অন‍্যদিকে চেয়ে রইলো। পৃথাও বুঝলো স্বাধীনের অভিমানের কারণ। হাসতে হাসতে স্বাধীনের মুখটা দুই হাতে নিল ও,
– আচ্ছা বাবা, বুঝলাম এটা তোমার ভালোবাসার জন‍্য হয়েছে আমার শাহরুখ খান। এবার খুশি?
স্বাধীন পৃথাকে আচমকা নিজের মাঝে নিয়ে নিল আবার।
– আমার ভালোবাসা নিয়ে মজা করো, তাই না? দাড়াও মজা দেখাচ্ছি এবার।
পৃথা হাসতে হাসতে পরে গেল বিছানায়। স্বাধীন আর নড়তে দেয়নি ওকে। আবার ডুবিয়ে দিয়েছিলো ওকে সেই বাধ ভাঙা ভালোবাসার জোয়ারে।
হঠাৎ বেলের আওয়াজে পৃথা চমকে বাস্তবে ফিরলো। কোথায় কি হচ্ছে বুঝতে এক মুহূর্ত লাগলো ওর। তারপর দৌড়ে গেল ও দরজা খুলতে।
ইয়াসমিন আর রিণিতা পৃথাকে দেখে সেরকম কোনো ভ্রুক্ষেপই করলো না। কেমন আছে, কখন এসেছে, কিছুই জিজ্ঞেস করলো না ওকে। সোজা নিজ নিজ রুমের দিকে হাটা শুরু করলো দুজন। পৃথাও ওদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল না তাই দরজা বন্ধ করে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
এই সময় হঠাৎ পৃথার মেহেদি ভরা হাতটা চোখে পড়লো রিনিতার।
– পৃথা দাড়া তো?
পৃথা আর ইয়াসমিন দুজনই দাড়িয়ে গেল। রিণিতা যেয়ে পৃথার হাত ঝামটা মেরে উঠিয়ে নিল,
-এসব কি হ‍্যা? তুই না অফিস ট‍্যুরে গিয়েছিলি? এতো হাত ভরে মেহেদি লাগালি কোথায়?
পৃথা প্রথমে একদম থতমত খেয়ে গেলো রিণিতার সামনে। কিন্তু পর মুহূর্তেই আবার সামলে ফেললো নিজেকে,
-আরে…সিলেটে, রাতে একটু বের হয়েছিলাম শহর দেখতে। তখন একটা মেলা হচ্ছিলো। সেখানেই মেহেদির স্টলে….
হঠাৎ ঝামটা মেরে উঠলেন ইয়াসমিন,
– এসব উদভট কাজ কি তোকে ফ্রি তে করে দিয়েছে? দেখে তো মনে হচ্ছে ভালই টাকা লেগেছে। এতো টাকা খরচে করতে গায়ে লাগলো না তোর?
পৃথা চুপ করে মাথা নামিয়ে রাখলো। আর কিছু বললে হয়তো মিথ‍্যা ধরা পরে যাবে তাই চুপ থাকলো ও। রিণিতা এর মাঝে পৃথার হাত ঝটকা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে নিজের হাত থেকে। এরপর আর কিছু হলো না। মা মেয়ে গট গট করতে করতে ওখান থেকে চলে গেল। পৃথার মনে হলো যেন একটা বোঝা নেমেছে কাধ থেকে। তাড়াতাড়ি রান্না করতে চলে গেল ও।
রাতে খাবারের পর সব গুছিয়ে নিজের রুমে আসলো পৃথা। এই পুরোটা সময় ফোনের কাছেই আসতে পারেনি ও। স্বাধীন বাসায় ঠিক ভাবে পৌছেছে কিনা সেই খোজটাও নেওয়া হয়নি। মোবাইলটা চার্জ থেকে খুলে অন করতেই দেখলো তিনটা মিস্ড কল। সবই স্বাধীনের থেকে। এটা দেখে কল ব‍্যাক করলো পৃথা। কিন্তু স্বাধীনের ফোন বন্ধ পেল।
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here