অদৃষ্টে_তুমি_আমি #লেখিকা_সিনথীয়া #পর্ব_৪

0
422

#অদৃষ্টে_তুমি_আমি
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৪

পুরো শরীরে পৃথার শিহরণ বয়ে গেল। স্বাধীন ওর এতো কাছে যে ওর শ্বাসের আওয়াজও পৃথার কানে আসছে। তার ওপর পৃথাকে স্বাধীন যা বললো তা শুনে নিজেকে স্বাভাবিক রাখা একেবারেই অসম্ভব। কম্পিত চোখে স্বাধীনকে দেখলো পৃথা। ছেলেটার চোখ সরানোর কোনো লক্ষণই নেই। একই ভাবে দেখছে ওকে নিজের মাঝে আবদ্ধ করে। পৃথারও তখন কিছুটা একই অবস্থা। নিজেও মনে হয় যেন কেমন এক মায়া জালে জড়িয়ে গিয়েছে ও। স্বাধীনের চোখ থেকে নিজের দৃষ্টি সরানোটাই তখন মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন কাজ।

হঠাৎ ফোনের রিং বেজে ওঠায় দুজনের মাঝের মুহূর্তটা কেটে গেল। সচল হয়ে উঠলো দুজন। স্বাধীন পৃথাকে ছেড়ে দিয়ে নিজের ফোন বের করলো, সেই ফাঁকে দরজা খুলে রুম থেকে বের হয়ে গেল পৃথা। স্বাধীন ওকে ধরার আগেই নাগালের বাইরে চলে গেল ও। জরুরী কল দেখে স্বাধীন আর পৃথার পেছনে যেতে পারলো না তখন।

পৃথা কোনমতে দৌড়ে নিজের ডিপার্টমেন্টে ঢুকলো। সবাই আজ কাজে এতোই মগ্ন যে পৃথার লাল হয়ে যাওয়া চেহারার দিকে কেউ খেয়াল করলো না। মনে মনে এই কারণে হাপ ছেড়ে বাঁচলো পৃথা। চুপচাপ যেয়ে নিজের কিউবিকালে বসলো। নিজের মনোযোগ অন‍্যদিকে নেওয়ার জন‍্য তাড়াতাড়ি ফাইল খুলে পড়তে বসলো ও তবে একটা অক্ষরও মাথায় ঢুকলো না। ঢুকবে কেমনে? চোখের সামনে ফাইলের বদলে স্বাধীনের রুমে ওদের মাঝে কেটে যাওয়া সেই মুহূর্তটাই ঘুরছে। স্বাধীনের বলা কথাগুলোই কানে বাজছে জোরে জোরে।
– I will make you fall in love with me at any cost.
চিন্তা করা মাত্রই আবার কেঁপে উঠলো পৃথা। এবার পাশে বসা নুপুর এটা খেয়াল করলো,
– কি ব‍্যাপার পৃথা? ঠিক আছ?

পৃথা এমন ভাবে নুপুরকে দেখলো যেন ভূত দেখেছে।
– হমম? না না আপু ঠিক আছি আমি।
– না তুমি ঠিক নেই। কাল থেকেই দেখছি কিছু একটা হয়েছে তোমার। স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশী চুপচাপ হয়ে গেছ। কোনো সমস‍্যা হয়েছে? আই মিন বাসায় সব ঠিক আছে?

পৃথার সাথে নুপুরের সম্পর্ক বেশ ভালো তাই নুপুর পৃথার বর্তমান পরিস্থিতির ব‍্যাপারে পূর্ণরুপেই অবগত। নুপুরের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক হাসি দিল পৃথা,
– আপু, কোনো সমস‍্যা হয়নি। আমি ঠিক আছি। আপনি চিন্তা করেন না।

আর কথা বাড়াতে পারলো না নুপুর। রাশেদ জানালো আধাঘন্টা পরে স্বাধীন এ টিমের একটা মিটিং ডেকেছে। সেটার প্রিপারেশনেই সবাই ব‍্যস্ত হয়ে পড়লো তখন।

কনফারেন্স রুমে মিটিং চললো প্রায় ঘন্টা খানেক। যেই ফাইলগুলো রিভিউ করতে পাঠানো হয়েছিল সেগুলো নিয়েই আলোচনা করলো স্বাধীন। কাজের ব‍্যাপারে বেশ গম্ভীর এবং অভিজ্ঞ স্বাধীন, খুব সাবলীল ভাবে টিমের সদস‍্যদের মাঝে কাজ বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হলো। যখন মিটিং একদম শেষ পর্যায়ে তখন স্বাধীন সবার উদ্দেশ‍্যে কথা বললো,
– আমি যেহেতু আপনাদের এবং এই কম্পানির জন‍্য নতুন তাই আমার আপনাদের থেকে অনেক ধরনের সাহায‍্য লাগবে সব কিছু ঠিকঠাক ভাবে বোঝার এবং শেখার জন‍্য। আশা করি আমাকে সাহায‍্য করতে আপনাদের আপত্তি হবে না।
সবাই একযোগেই সাহায‍্যের সম্মতি জানালো। তখন স্বাধীন হেসে বললো,
– আসলে সাহায‍্যটা এই মুহুর্ত থেকেই চাইতে হচ্ছে আমাকে। আমার অনেক কাজই অর্গানাইজ করতে কষ্ট হচ্ছে, এতো ফাইলস ডিভাইড করা, সব ডিপার্টমেন্টের ওয়ার্ক সেগমেন্ট এন্ড প্রসিডিউর বোঝা আমার জন‍্য ডিফিকাল্ট হয়ে দাড়িয়েছে। I think I will not be able to do all this by myself. So I was thinking it would be better if I get someone to assist me in all these matters.
স্বাধীনের কথা বুঝতে পেরে চাপা গুঞ্জন পরে গেল সবার মাঝে। স্বাধীন এটা দেখে হেসে বললো,
– আমি জানি আপনাদের ওপর কাজের চাপ এমনিতেই বেশী। তাই আমি সবাইকে ডিস্টার্ব করবো না। মমমম…. মিস পৃথা….

ঝট করে তাকালো পৃথা চোখ বড় বড় করে। সবার চোখও ওর দিকেই পড়লো। স্বাধীন সরাসরি পৃথাকে বললো,
– আপনাকে আমি অন‍্যদের থেকে কাজ কম দিয়েছি। এর কারণ আমি চাচ্ছি আপনি আমাকে আমার কাজ গুলোতে এসিস্ট করবেন। I hope you will not have any problem?

ভেতর ভেতর রাগে জ্বললেও সামনা সামনি অসহায় হয়ে রইলো পৃথা। ও কি আর সবার মাঝে না করতে পারবে? আফ্টার অল, স্বাধীন এখানে ওর বস্। ওর কথা মানতেই হবে। অগত‍্যা সম্মতি জানাতেই হলো পৃথাকে,
– No…Problem Sir. I will try my best to assist you.
-Great. I will look forward to it. Ok then, this meeting is over. You can go back to your work. Thanks.
সবাই বের হতে গেলেও পেছন থেকে পৃথাকে থাকতে বললো স্বাধীন,
– মিস পৃথা, আপনি প্লিজ বসুন। আপনার সাথে কাজ গুলো ডিসকাস করতে হবে।
পৃথাকে রেখেই বাকিরা কনফারেন্স রুম থেকে বের হয়ে গেল।

ডিপার্টমেন্টে এসে নিতা নুপুরকে বলতে লাগলো,
– ইশ নুপুর আপু! পৃথা আপু কি লাকি। স‍্যারের সাথে একান্তে বসে কাজ করতে পারবে। ইশ স‍্যার যদি আমাকেও বলতো তাকে হেল্প করতে, তাইলে কতো ভালো হতো।
নুপুর নিতার কথায় হেসে দিলেও উল্টোপাশে বসা রাশেদ বিরক্ত হলো।
– নিতা, আগে নিজেকে সাহায‍্য করো তারপর স‍্যারকে কইরো।
– কি বললেন রাশেদ ভাই? আমার আবার কিসের সাহায‍্য লাগবে?
– এই যে ভুলো মন তোমার। সেটার সাহায‍্য। নিজের ভাগের ফাইলটাতো কনফারেন্স রুমেই রেখে চলে এসেছিলে। এটা না থাকলে কাজটা করবা কেমনে শুনি? নিজেরই কিছু মনে থাকে না আবার স‍্যারকে শিখাবেন তিনি!

এই বলে রাশেদ ফাইলটা আগিয়ে দিল নিতার দিকে যেটা একটা বোকা হাসি দিয়ে নিয়ে নিল নিতা।
– ধন‍্যবাদ রাশেদ ভাই। আপনি না থাকলে যে আজ আমার কি হতো।
——————————
ওদিকে কনফারেন্স রুমে সবাই পৃথাকে স্বাধীনের কাছে একা রেখে যাওয়ার পর থেকে বুকে ড্রাম বাজছে পৃথার। স্বাধীনের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না ও, এই ভয়ে যে স্বাধীন ওর চেহারা দেখে মনের ভাব পরে ফেলতে পারে। হঠাৎ পেছনে পায়ের শব্দে পৃথা সতর্ক হয়ে উঠলো। স্বাধীন ওর কাছে এসে আবার কিছু করবে না তো? আবার কি ওকে কাছে টেনে নিবে? আবার….
স্বাধীন সামনে এসে দাড়ালো পৃথার। ওর চোখের দিকে তাকিয়েই রুমের দরজা খুলে দিয়ে পাশে দাড়ালো,
– ফাইলগুলো আমার ক‍্যাবিনে। ওখানে যেয়েই সব সর্ট আউট করতে হবে। Shall we?

স্বাধীনের মুখের দুষ্টু হাসিটা পৃথার চোখ এড়ালো না। গট গট করতে করতে বের হয়ে আসলো ও। পেছনে আসলো স্বাধীন।
মনে মনে পৃথা নিজেকেই নিজে বোঝালো,
– কোনো ভয় পাওয়া চলবে না পৃথা, নার্ভাস তো একদমই হওয়া যাবে না। ও যতই তোর কাছে আসুক, তোর সাথে যেভাবেই বিহেভ করুক, তোকে তোর গ্রাউন্ড ধরে রাখতেই হবে। You will not let your gaurd down. এতো সোজা ভাবে সারেনডার করা যাবেই না।
ক‍্যাবিনে প্রথমে পৃথাকেই ঢুকতে দিল স্বাধীন, তারপর নিজে ঢুকে দরজাটা আটকে দিল। পৃথার মনে ঢোল তো সমান তালে বাজছে। ভয় নাকি নার্ভাসনেস হচ্ছে তা কিছুই বুঝতে পারছে না ও। ওদিকে স্বাধীন কিন্তু বেশ স্বাভাবিক। ও দরজার কাছ থেকে এসে নিজের সিটে বসে পৃথার দিকে তাকালো,
– ওখানে দাড়িয়ে আছো কেন পৃথা? এখানে বসো।
টেবিলের অপর পাশের চেয়ারটা দেখিয়ে দিল স্বাধীন। ধীর পায়ে ইতস্ততা নিয়ে সেটাতে বসলো পৃথা। স্বাধীন ততক্ষণে ফাইলস বের করে ফেলেছে।
– তোমার ডিপার্টমেন্ট দিয়েই শুরু করি কি বলো? এই কন্টেন্ট গুলোর কয়েকটা জায়গা বুঝতে পারছি না। এই ক্লসগুলো কেন দিয়েছ তোমরা? দেখো আমি মার্ক করে রেখেছি। এই যে এইটা।

ফাইলটা পৃথার দিকে বাড়িয়ে দিল স্বাধীন। পৃথা খেয়াল করলো স্বাধীন একদমই স্বাভাবিক আচরণ করছে, কাজকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। এই দেখে ও নিজেও কাজে মন দিল। স্বাধীনের বাড়ানো ফাইলটা পরে দেখলো প্রথমে তারপর স্বাধীনকে বোঝাতে লাগলো। এভাবে করে প্রায় একটা ফাইলের সমস‍্যা গুলো পৃথা সমাধান করে ফেললো। ততক্ষণে পৃথা কাজে ডুবে যাওয়ার কারণে নিজের অস্বস্তি ভুলে গিয়েছিল। স্বাধীনও কাজেই ব‍্যস্ত। হঠাৎ একটা ফাইলে পৃথার চোখ আটকে গেল।
– আচ্ছা এই কাজটা তো আগে করা হয়েছে, তাহলে এখানে আবার রিপিট দেখানো হয়েছে কেনো?

স্বাধীন তখন নিজের সিটে ছিল না। দরজার এক পাশে রাখা ফিল্টার থেকে পানি খাচ্ছিলো। পৃথার কথা শুনে সোজা এসে দাড়ালো ওর পাশে।
– কই দেখি? কোনটা বলছো?
– এই যে এটা। এটা তো কিছুক্ষণ আগেই আমরা ডিসকাস করলাম। আবার রিপিট হয়েছে এখানে।

পৃথার দেখানো দুটো ফাইলই দেখতে ওর পাশে ঝুকে আসলো স্বাধীন। এক হাত টেবিলের ওপর ভর দিয়ে আরেক হাতে পৃথার বসা চেয়ারে রেখে নেমে আসলো।
– ও হ‍্যা, তাই তো। এটা দুবার রেকর্ড হয়েছে কেন? তোমাদের…

পৃথাকে জিজ্ঞেস করতে ওর দিকে স্বাধীন তাকিয়েছিল। পৃথাও ফিরে তাকালো স্বাধীনের প্রশ্ন শোনার জন‍্য। ঠিক সেই সময় তারা বুঝলো একে অপরের কতোটা কাছে চলে এসেছে দুজন।

এতোক্ষণ যেই সাবলীলতাটা পৃথার মাঝে ছিল তা হুট করে উধাও হয়ে যেয়ে ওকে ঘিরে ধরলো এক আজব অনুভূতি। স্নায়ু টানটান হয়ে গেল ওর। স্বাধীনের শ্বাসের আওয়াজ কানে বেজে ওর ভেতরটা হীম শিতল শিহরণে ভরিয়ে দিল। দেখলো স্বাধীনেরও চেহারায় আগের ভাব টা নেই। চোখের ভাষায় কেমন এক স্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে। কিছু মুহূর্তের জন‍্য আটকে গেল দুজন ঠিক এভাবেই।
এক সময় স্বাধীনের চোখ চলে গেল পৃথার হাল্কা গোলাপি অধরে…
তারপর হয়তো আবেগের টানেই ধীর গতিতে নিজেকে নিয়ে গেল সেখানে। আল্তো করে ছুয়ে দিল পৃথার অষ্ট পল্লব।
পৃথা যেন পুরোই নিস্তেজ হয়ে পরেছে। স্বাধীন ওর কাছে আসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ও শুধু সেই নেশা ভরা দু চোখের দিকেই তাকিয়েছিল। আর যখন ও স্বাধীনের ঠোটের ছোয়া পেল তখন অজান্তেই পৃথার চোখের পলক আস্তে করে নেমে গেল। এই নরম প্রশান্তি পৃথার চেনা। স্বাধীনের এই স্পর্শ পৃথার চেনা। দশ বছর আগের সেই সন্ধা রাতে ওদের বাসার ছাদে ফিরে গেল পৃথা। মনে হলো যেন সেখানেই দাড়িয়ে আছে দুজন। স্বাধীন পৃথাকে কাছে নিয়ে এসেছে নিজের। স্ত্রীকে প্রথম নিজের ভালোবাসা বোঝাচ্ছে এই ভাবে আদর করে। সেই প্রথম পৃথার মাঝে এই অনুভূতির জন্ম নিয়েছিল। আজ এতোটা বছর পরও সেই অনুভূতি এতটুকু্ও বদলায়নি।

স্বাধীন বেশ কিছুক্ষণ পৃথার ঠোটে নিজের আদর বুলিয়ে এক সময় হাল্কা সরে পৃথার চেহারার দিকে তাকালো। পৃথার চোখ এখনো বন্ধ, এখনো ঘোর কাটেনি। নিঃশব্দে হাসলো স্বাধীন। আস্তে আস্তে পৃথার চোখ খুলতে দেখলো।

পৃথা চোখটা খুলেই স্বাধীনকে আগের মতনই নিজের খুব কাছে পেল। এখনো ওকেই দেখছে ছেলেটা। হঠাৎ বর্তমানে চলে এলো পৃথা। ঘোর পুরোপুরি কেটে গেছে। সাথেসাথেই ওর চোখের সামনে এখনের পরিস্থিতিটা ভেসে উঠলো আর তাতে চরম ভাবে বিব্রতবোধ করলো ও। নিজের চেয়ারটা পেছনে ধাক্কা দিতেই স্বাধীনের হাত সরে গেল ওখান থেকে। ফাঁক পেয়ে উঠে দাড়ালো পৃথা। এক মুহূর্তও না দাড়িয়ে ক‍্যাবিন থেকে বের হয়ে গেল ও।

স্বাধীন দেখলো পৃথার চলে যাওয়া। তবে ও থামালো না। মনে মনে ভীষণ সুখ অনুভব হচ্ছে এখন ওর। পৃথা কথা দিয়ে যতই নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করুক, মনের ভাব কখনোই লুকানো সম্ভব না। ও স্বাধীনকে আজও ভালোবাসে। আজও ওর মন স্বাধীনের কাছেই আছে ঠিক যেমন স্বাধীনেরটা আছে ওর কাছে। পুরো মুখ জুড়ে হাসলো স্বাধীন। যেদিক দিয়ে পৃথা বের হয়ে চলে গেছে সেদিকে তাকিয়েই বললো ও,
– মিসেস হাসান, আমার প্রতি আপনার ফিলিংস নেই তাই না? জানি আপনি অভিমান করে আছেন। তবে আপনার স্বামী আপনার অভিমান ভাঙাবেই। আপনাকে আবার ভালবাসতে শেখাবে। পৃথাকে নিজের স্বাধীনের হতেই হবে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here