#অদৃষ্টে_তুমি_আমি
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৭
আজ পৃথার জন্য স্বাধীন আর ক্যাবিনের দরজা খুলে দিল না। বরঞ্চ ইচ্ছা করে পৃথার পিছে পিছে এগোলো যাতে পৃথা নিজেই আগে ঢোকে। তাই হলো। পৃথার পেছনে ঢুকলো স্বাধীন। পৃথা কিছু না বলে সরাসরি চেয়ারে বসে গতকালের রেখে যাওয়া একটা ফাইল উঠিয়ে পড়তে শুরু করলো তবে মন বসাতে পারলো না। কারণ ভেতর ভেতর কেন যেন একটা অস্থিরতা কাজ করেই যাচ্ছে ওর। স্বাধীনের উপস্থিতি ওর মাঝে এই অস্থিরতাটা নিয়ে আসছে।
স্বাধীন নিজের সিটে বসে সরাসরি পৃথার দিকে তাকিয়ে বললো,
– পৃথা শোন?
পৃথা ফাইল থেকে মুখ উঠিয়ে দেখতে পেল যে স্বাধীনের মুখ জুড়ে গম্ভিরতা ছেয়ে আছে। ভুরু কুচকে ফাইলটা নিচে নামালো পৃথা। স্বাধীন প্রশ্ন করলো তখন,
– নিচে যেই মেয়েটার সাথে কথা হলো ও তোমার সেই সৎ বোনটা না? কি যেন নাম ওর?
– রিনিতা।
– ও হ্যা, রিনিতা। ও তোমার সাথে এমন ব্যবহার করছিল কেন?
পৃথা কোনো উত্তর দিল না। এক কারণ এই যে স্বাধীনের কন্ঠে স্পষ্ট রাগ অনুভব করতে পারছে ও, সেটাকে বাড়াতে ইচ্ছা করছিল না। আর দ্বিতীয় কারণ হলো পৃথা, ওর নিজের জীবনের কষ্টের কথাগুলো স্বাধীনের সাথে শেয়ার করতে নারাজ। এ নিয়ে এখনো ভীষণ অভিমান করে আছে ও।
স্বাধীন দেখলো পৃথা কোনো উত্তর দিচ্ছে না। ভেতর ভেতর রিনিতা মেয়েটার ওপর রাগ উঠলেও সেটা মুখ খুলে প্রকাশ করলো না ও। ভেবে নিল এ বিষয়টা নিয়ে পৃথার সাথে পরে ভালোভাবে কথা বলবে।
আজ কাজেই মন দিল দুজন। অনেক ফাইল পরে আছে স্বাধীনের আয়ত্তে আনার। সেটাই একে একে পুরা করতে লাগলো দুজন। তবে তাই বলে স্বাধীন পৃথাকে যে একটুও নিজের দিকে আকর্ষণের চেষ্টা করেনি তা বললে খুবই ভুল হবে। কয়েকবারই পৃথা স্বাধীনের মুখে ওর দিকে তাকিয়ে দেওয়া সেই দুষ্টু হাসিটা খেয়াল করেছে। শান্ত রাগ দেখিয়ে ওখান থেকে মনোযোগ সরিয়েছে পৃথা তবে সেটা অনেক কষ্টে।
ওদের কাজ শেষ হতে হতে লাঞ্চের সময় গড়িয়ে গেল। পৃথা উঠে যেতে চাইলে স্বাধীন বললো ওকে,
– পৃথা আজ আমার সাথে লাঞ্চ করো।
পৃথা চুপ করে স্বাধীনকে একমুহূর্ত দেখলো তারপরে বললো,
– মমম না। আসলে আমরা ডিপার্টমেন্টে সবাই একসাথে লাঞ্চ করি। আমি এখানে করলে ব্যাপারটা… মানাবে না।
স্বাধীন বুঝলো পৃথার কথা। বুঝেই একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো,
– বুঝতে পারছি। ঠিক আছে, নো প্রবলেম, যাও।
পৃথা একটা হাল্কা হাসি দিয়ে বের হয়ে গেল রুম থেকে। এই প্রথম কেন যেন একটু মায়া হলো ওর স্বাধীনের প্রতি। বেচারা একা একা খেতে মনে হয় ভালো ফিল করে না। তবে পৃথাই বা এখানে কি করতে পারে। ও স্বাধীনের সাথে একা লাঞ্চ করলে অফিসে নানান কথা উঠতে পারে।
এ টিমের রুমে ঢুকতেই পৃথা দেখলো ওকে সবাই কেন যেন দেখছে। নিতা আর নুপুরের ঠোটে মিটি মিটি হাসি। ভুরু কুচকে গেল পৃথার। নুপুরকে যেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– এই নুপুর আপু। কি হয়েছে? এভাবে হাসছো কেন?
নুপুর কিছু বলতে যাবে, হঠাৎ দরজায় উদয় হলো স্বাধীনের পিওন,
– স্যার আইজকে আপনাদের সাথে লাঞ্ছ করবেন। সবাইরে নিজেদের খাবার নিয়া কনফারেন্স রুমে যাইতে বলসেন।
চট করে পৃথার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। অন্যরা ভীষণ খুশি হলেও ও হলো অবাক। কপট রাগ নিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করলো ও,
– কি ফাজিল! আমি না করলাম বলে এভাবে খাওয়ার আয়োজন করলো? ওর প্রতি মায়া করাটাই ঠিক হয়নি আমার।
সবার সাথে অগত্যাই যেতে হলো পৃথাকে। কনফারেন্স রুমে ঢুকে দেখলো টেবিলে প্লেট, গ্লাস সাজিয়ে ফেলা হয়েছে। হেড অফ দ্যা টেবিলে স্বাধীনের টিফিন বক্সটাও রাখা তবে স্বাধীন এখনো আসেনি। পিওন সবাইকে বসতে বলে স্বাধীনকে ডাকতে গেল।
পৃথা উঠে ওয়াশরুমে গিয়েছিল হাত ধুতে। বের হয়েই স্বাধীনের সামনে পরলো। ওকে দেখে সেই দুষ্টুমির হাসিটাই দিল স্বাধীন। পৃথা এবার আর চুপ থাকলো না। চাপাঁ রাগ দেখিয়ে আস্তে গলায় কথা বললো,
– এই সবের মানে টা কি? আমি তোমার সাথে লাঞ্চ করতে মানা করেছি বলে তুমি এভাবে তোমার ইচ্ছা পূরণ করবা? সবাইকে ইনভল্ভ করে ফেলবা?
হেসে অবাক হওয়ার ভান করলো স্বাধীন। কাধ ঝাকিয়ে, কেয়ার না করার একটা ভাব নিয়ে উত্তর দিল,
– হাহ্! তোমার কি মনে হয়েছে আমি তোমার জন্য সবার সাথে লাঞ্চ করছি? মোটেও না। আমার ইমপ্লোয়ি ইনারা। তাদের সাথে আমি যখন খুশি তখন লাঞ্চ করতেই পারি।
পৃথা শুনে পুরাই বোকা বনে গেল। এই উত্তর আশা করেনি ও। রাগে অসহায় হয়ে গট গট করতে করতে কনফারেন্স রুমে চলে গেল ও। পেছনে স্বাধীন বিজয়ের হাসি মুখে নিয়ে ওকে অনুসরণ করলো।
খেতে বসে দেখা গেল স্বাধীনের লাঞ্চ বক্সে শুধুই স্যান্ডউইচ আর সালাদ রাখা। দেখে সবাই একটু অবাক হলো। পৃথাও এই খাবার আসা করেনি। ওর যতদূর মনে পরে স্বাধীন খুব ভোজন রসিক ছেলে ছিল। দুপুরে এই খাবার ওর কখনোই খাওয়ার কথা না। কিন্তু এটা দেখে…. তাহলে কি ও বদলে গেছে?
নিতা ইতস্তত বোধ নিয়ে জিজ্ঞেস করে বসলো,
-মমম, স্যার… আপনি শুধু স্যান্ডউইচ খাচ্ছেন যে? আর কিছু দিয়ে লাঞ্চ করবেন না?
স্বাধীন হেসে দিল,
– আজ আর অন্য কিছু করার সময় পাইনি তাই এটাই বানিয়ে ফেলেছি সকালে। But don’t worry about me. I am completely fine.
স্বাধীনের উত্তরে সবাই অবাক হলো,
-স্যার আপনি কি রোজ নিজের লাঞ্চ নিজেই বানিয়ে নিয়ে আসেন?
-না না, তা করি না। বাসায় একজন বাবুর্চি আছেন। তিনিই রান্না করে দেন সব। আজ তিনি একটা জরুরী কাজে ছুটি নিয়েছেন বলে আমার ওপরই ঝামেলা টা পরেছে।
এই কথায় রাশেদ বলে উঠলো,
– আমাদের মতন ব্যাচেলর দের বাবুর্চি ছাড়া জীবনে চলাই অসম্ভব তাই না স্যার? আমার বাবা মা অন্য শহরে থাকেন। আমার বাসার খালাটা না থাকলে আমার খাওয়ার যে কি হতো কে জানে।
নিতা এটা শুনে খেলাচ্ছলে বলে উঠলো,
– রাশেদ ভাই, আপনি মনে হয় পরিবার অনেক মিস করেন তাই না?
– খুব মিস করি নিতা।
-তাহলে আপনার অবশ্যই উচিত নিজের পরিবার শুরু করা। বিয়ে শাদি করে ফেলেন। ভাবী মজার মজার রান্না করবেন আর আপনি আয়েশ করে খাবেন। হাহাহা।
সবাই এ কথায় জোরে হেসে নিতাকে সমর্থন করলো। রাশেদ, বোঝাই গেল, খুব লজ্জা পেয়েছে। নিজের থেকে মনোযোগ সরানোর জন্য বললো ও,
– এখানে তো আমি একা ভিকটিম না। আমাদের রিতভিক স্যারও কষ্টে আছেন। ওনাকে কেন বলছো না বিয়ের কথা নিতা? স্যার আপনিও বিয়ের পর্ব শেষ করে ফেলুন তাহলে রোজ ম্যাডামের হাতের মজার রান্না উপভোগ করতে পারবেন।
পৃথা ছাড়া বাকি সবাই রাশেদের কথার সমর্থন জানিয়ে হাসলো। স্বাধীন একবার পৃথার দিকে এক পলক দেখে নিজের হাতের খাবার প্লেটে রাখলো। তারপর খুব সাবলীল ভাবেই বললো সবার উদ্দেশ্যে,
– বিয়ের পাট আমার চুকানো শেষ অনেক আগেই।
এই একটা বাক্য পুরো রুম জুড়ে দারুণ প্রভাব ফেললো। সবাই একযোগে নিজেদের খাওয়া বন্ধ করে তাকালো স্বাধীনের দিকে। এই কথাটা বোধহয় কেউ আশাও করেনি। তবে সবচাইতে বেশী চমকে গেল পৃথা। এতোটাই যে গলায় খাওয়া আটকে কাশি শুরু হলো ওর। নুপুর পৃথার পাশে থাকায় তাড়াতাড়ি ওকে পানি এগিয়ে দিল,
– হঠাৎ কি হলো পৃথা? খাবার আটকালো নাকি গলায়। আস্তে আস্তে শ্বাস নাও।
পৃথার কাশি থামতেই ও ভয়ার্ত চোখে তাকালো স্বাধীনের দিকে। এই ছেলে কি করছে? কেন বলে দিল এটা ও?
ততক্ষণে আবার সবার মনোযোগ স্বাধীনের দিকে পরেছে। নিতা নরম এবং কিছুটা করুন সুরে জিজ্ঞেস করলো,
– স্যার আপনি… ম্যারিড?
স্বাধীন হেসে মাথা হাল্কা করে উপর নিচ ঝাকালো। পৃথার প্রতিক্রিয়া আড়চোখে খেয়াল করতে ভুললো না ও। পৃথা তো পুরোপুরি নার্ভাস হয়ে গেছে। পিঠ সোজা করে বসে আছে। চেহারায় আতংকের ছাপ। এদিকে রাশেদ উৎফুললো হয়ে বলে উঠলো,
-তাহলে তো স্যার আপনার কোনোই কষ্ট নেই। ম্যাডাম আপনার খাবারের দিকটা দেখেন নিশ্চয়ই।
স্বাধীন এর উত্তরে একটু থেমে বললো,
– আসলে আমার কাবিন পারিবারিক ভাবে আগেই হয়েছে তবে এখনো বিয়ের প্রোগ্রামটা করে বউকে তুলে আনা হয়নি। তাই…
স্বাধীন এরপর আর কিছু না বলে শুধু একটু লাজুক হাসি হাসলো। অন্যদের মুখেও তা দেখে হাসি ছড়িয়ে পড়লো।
– তাহলে স্যার সামনে নিশ্চয়ই আমরা বিয়ের দাওয়াত পাচ্ছি।
এবার স্বাধীন সরাসরি পৃথার দিকে তাকালো। ওর ভয়ে ছেয়ে যাওয়া মুখটা দেখে হেসে বললো,
– ইনশাআল্লাহ। এবার বউ কে নিজের কাছে নিয়ে আসবোই।
স্বাধীনের দৃঢ়তায় বড় বড় চোখ নিয়ে তাকালো ওর দিকে পৃথা। অন্যদের হাসাহাসির মাঝ দিয়েই চোখাচোখি হলো দুজনের। পৃথা স্বাধীনের ঠোটের সেই হাসিটা দেখে অসহায় হয়ে চুপ করে গেল।
চলবে।