অদৃষ্টে_তুমি_আমি #লেখিকা_সিনথীয়া #পর্ব_৯

0
340

#অদৃষ্টে_তুমি_আমি
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৯

প্রায় দেড় মাস হয়েছে স্বাধীনের অফিস জয়েন করার। এর মাঝে এই ব্রাঞ্চটাকে মোটামোটি ভালো ভাবে নিজের আয়ত্তে আনলেও সিলেটে তাদের আরেক শাখার ব‍্যাপারে স্বাধীনের সেরকম কিছুই জানা হয়নি। সিয়ামের সাথে এই বিষয়ে আলোচনায় তাই স্বাধীনকে একদিন ও প্রস্তাব দিল,

– স্বাধীন ভাই, আমার মনে হয় আপনি একবার সিলেটে যান। যেয়ে স্বচোক্ষে সবকিছু দেখে আসেন।
– হমম আমিও তাই ভাবছিলাম সিয়াম। ওদিকে একবার যাওয়া উচিত। আর এমনিতেও আমার সিলেট যেতেই হতো আগামী সপ্তাহে। আমার খুবই ক্লোজ একটা বন্ধুর বিয়ে আছে। সো আমাকে এটেন্ড করতেই হবে। ভালোই হলো, একসাথে দুটো কাজই করে ফেলতে পারবো।

সেই বিকেলে পৃথার ডাক পরলো স্বাধীনের কেবিনে।

-পৃথা আগামী শনিবার থেকে এক সপ্তাহের জন‍্য তোমাকে আমার সাথে সিলেটে যেতে হবে।

চোখ কপালে উঠে গেল পৃথার।
– মানে? কেন?

স্বাধীন সেই দুষ্টু হাসিটা নিয়েই পৃথার সামনে এসে দাড়ালো,
– কেন মানে? স্বামী স্ত্রী একসাথে কোথাও ঘুরতে যেতে পারে না? আমাদের হানিমুনও তো হয়নি পৃথা।

এতোটাই চমকে গেল পৃথা যে গলায় কথা আটকে গেল ওর। স্বাধীনের চোখে তাকিয়ে বুঝতে চাইলো ছেলেটা সত‍্য বলছে নাকি না। কিন্তু স্বাধীনের কোনো ভাবই বুঝতে সক্ষম হলো না ও।

পৃথার চমকে যাওয়া চেহারাটা দেখে আস্তে আস্তে স্বাধীনের মুখে হাসি ভাঙতে থাকলো। এক সময় হো হো করে হেসে দিল ও। পৃথা এটা দেখে আরও অবাক। স্বাধীন তখন বললো,
– তোমার চেহারাটা এইমুহূর্তে দেখার মতন হয়েছে পৃথা। হা হা হা।

পৃথার চেহারার ভাব তাও বদলালোনা। ও একিভাবে স্বাধীনের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে স্বাধীন বললো,
– আরে বোকা, আমাদের আরেকটা ব্রাঞ্চ আছে না সিলেটে? সেটা দেখতে যাব আমি। ওটার ব‍্যাপারে তো কিছুই জানি না।

এতোক্ষণে হাফ ছেড়ে বাঁচলো পৃথা। চেহারাও স্বাভাবিক হলো। এতোক্ষণে একটু লজ্জাও লাগলো ওর। না জানি কি কি চিন্তা মাথায় আসছিল! তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসলো ও স্বাধীনকে,
– তা আমাকে কেন যেতে হবে সিলেট?

স্বাধীন এবারও হাসি থামালো না,
– কারণ আমি চাই তুমি আমার সাথে চলো।

দুষ্টুমি খেলে গেল পৃথার মাথায়,
– মোটেও না। আমি যাব না।
-কেন?
– আমার তোমার সাথে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। অন‍্য কাউকে নিয়ে গেলে নিয়ে যাও।

এই বলে পৃথা বের হয়ে যেতে নিয়েছিল তখনই স্বাধীন বলে উঠলো,
– তুমি শিওর যাবে না?
– না।
– ঠিক আছে। কোনো ব‍্যাপারে না। এই ট্রিপে নাহয় নিতাকেই বলবো আমাকে এ‍্যাকম্পানি করতে। Yeah…I think that will be fun.

পৃথা ঝট্ করে ঘুরে তাকালো। নিজের কানকেই বিশ্বাস হলো না। ও মনে করেছিল স্বাধীন হয়তো ওকে যাওয়ার জন‍্য মানানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু এভাবে ছেলেটা অন‍্য অপশন খুজে নিবে চিন্তাতেও আসেনি পৃথার। আস্তে আস্তে রাগ উঠলো ওর। স্বাধীনকে একদম স্বাভাবিক থাকতে দেখে ভেতর ভেতর আরও জ্বলে উঠলো ও। এরই মধ‍্যে সিয়াম এসে ঢুকলো রুমে।পৃথাকে দেখে হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-ও পৃথা, তুমি এখানে?

পৃথার হয়ে আগ বাড়িয়ে উত্তর দিল স্বাধীন,
– আমিই ওনাকে ডেকেছিলাম। সিলেটের ব‍্যাপারে জানালাম। কিন্তু মিস পৃথা যেতে রাজি হচ্ছেন না। তাই আমি মনে করছি, মিস নিতাকে আমার সাথে যাওয়ার জন‍্য বলবো। কি মনে হয় আপনার মি: সিয়াম?

সিয়াম চুপ করে থাকাটাই এসময় শ্রেয় মনে করলো। এই স্বামী স্ত্রীর খুনশুটির মাঝে নিজেকে না জড়ানোই ভালো। পৃথাকে দেখলো মুখ গম্ভীর করে চলে যেতে। ও চলে যাওয়ার পর সিয়াম আসলো স্বাধীনের কাছে। দেখলো স্বাধীন মিটিমিটি হাসছে।
– কি ব‍্যাপার স্বাধীন ভাই? পৃথা যাবে না বলে আপনি নিতা কে নিয়ে যাবেন, ঠিক বুঝলাম না বিষয়টা।
– আরে ধুর! যাব তো পৃথাকে নিয়েই। তবে আমি জানি, সোজাসোজি বললে পৃথা কোনোভাবেই যেতে চাইবে না। বলেছিলাম না ও খুব অভিমানি মেয়ে? সাথে একটু ঘাড়ত‍্যারাও। এই কারণেই সেই পন্থা এ‍্যাপ্লাই করলাম যেটা করলে ও শিওর যাবে। তুমি দেখে নিও সিয়াম।

সিয়াম হেসে দিল,
– ভাই, আপনার বউ। আপনিই ভালো বুঝবেন ওকে।

পৃথা ডিপার্টমেন্টে যেয়ে ফুসতে ফুসতে নিজের কিউবিকালে বসলো। খুব রাগ উঠছে ওর। অসম্ভব রাগ। কেন এমন লাগছে ও বোঝাতে পারবে না কিন্তু রাগে গা কিরকির করছে। এমন কেন করলো স্বাধীন? একবার পৃথা না করতেই অন‍্য অপশানে চলে গেল ও? নাকি নিতাকেই আসলে নিতে চাচ্ছিলো,পৃথাকে আনুষ্ঠানিক একটা প্রস্তাব দিয়েছিল যাতে পৃথা কোনো সন্দেহ না করে। হঠাৎ পিঠ সোজা করে বসলো পৃথা,
-আসলেই মনে হয় তাই। ও নিতাকেই নিজের সাথে নিতে চাচ্ছে । কিন্তু এটা তো আমি জীবনেও হতে দিব না। আমি থাকতে নিতা কেন যাবে ওর সাথে? দাড়াও দেখাচ্ছি মজা!

কিছুক্ষণ পরেই পিওন আসলো এ টিমের ডিপার্টমেন্টে। নিতাকে নাকি স্বাধীন ডেকেছে নিজের কেবিনে। এটা শুনে নড়েচড়ে বসলো পৃথা। নিশ্চয়ই সিলেটের ট্রিপ নিয়েই কথা বলবে। বিচলিত হয়ে উঠলো পৃথা এটা চিন্তা করেই। কিভাবে থামাবে নিতাকে সেটাই খুজতে লাগলো। ততক্ষণে নিতা রুম থেকে বের হয়ে গেছে। প্রমাদ গুনতে থাকলো পৃথা।

দশ মিনিট পরে নিতা রুমে আসলো। ওকে বেশ খুশি খুশি লাগছে দেখে সবাই জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। তখন বললো ও,
– স‍্যার ডেকেছিলেন আমাকে সিলেটের প্রজেক্টের ব‍্যাপারে কথা বলতে।

এটা শোনা মাত্রই পৃথা উঠে দাড়ালো। হনহন করে রুম থেকে বের হয়ে পৌছালো স্বাধীনের কেবিনে। কোনো প্রকার নক্ না করেই ঢুকে গেল ভেতরে। ঝড়ের বেগে এসে স্বাধীনকে জিজ্ঞেস করলো,

– তুমি আসলেই তাহলে নিতাকে নিয়ে যাওয়ার প্ল‍্যান করছো?

স্বাধীন খুব সাবলীল একটা হাসি দিল,
– তুমিই তো না করে দিলে। তাইতো নিতাকে সিলেক্ট করতে হলো।
– কে বলেছে আমি না করেছি?
– তখনি তো বললে আমার সাথে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই, অন‍্য কাউকে নিতে চাইলে আমি নিতে পারি। তাইতো…
– বেশি কথা ঘোরাবানা বুঝছো? আমাকে বাদ দিয়ে অন‍্য মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার ধান্দা না? সব বুঝি আমি! তখন যা বলেছি সেটা বাদ দাও। এখন বলছি আমি যাব। নিতাকে মানা করে দাও। নিতাকে নিবা না।

স্বাধীন মনে মনে ভীষণ খুশি হলেও মুখে আহত হওয়ার ভান করলো,
– কিন্তু নিতাকে তো অলরেডি বলে দিয়েছি। এখন না করলে কেমন দেখায়?

পৃথা রাগে ফুশতে ফুশতে বললো,
– ওর যেমন ইচ্ছা লাগুক, ও তোমার সাথে যাবে না ব‍্যস! আমি যাব তোমার সাথে।

স্বাধীনের ঠোটে এতোক্ষণে হাসি আসলো।
– সত‍্যি তুমি যাবা?
– হ‍্যা।
– ঠিকাছে। নিতা বাদ।

অবাক হলো পৃথা,
– ঠিকাছে? এতো সহজেই বলে দিলা? এখনই তো টেনশন করছিলা যে নিতা কি মনে করবে ওকে না করে দিলে।
– নিতা কিছুই মনে করবে না।
– কেন? কিছু মনে করবে না কেন?
– কারণ ওকে আমার সাথে যাওয়ার কথা আমি বলিইনি।

চোখ বড় বড় হয়ে গেল পৃথার,
– মানে?
– মানে আমি নিতাকে সিলেটে নিয়ে যাওয়ার কোনো প্ল‍্যানই করিনি। ও জানেই না এই ব‍্যাপারে কিছু।
– কিন্তু ও যে বললো, সিলেটের প্রজেক্ট নিয়ে তুমি ওর সাথে কথা বলেছো?
-হ‍্যা তা বলেছি। তবে সেটা ট্রিপ বিষয়ক না। নিতা তো এইচ আর ডিপার্টমেন্টের। সিলেটে কিছু জব রিক্রুটমেন্ট হবে। সেটার দায়ভার ওকে দিয়েছি আমি।

এতোক্ষণে হাফ ছেড়ে বাচলো পৃথা। মনের বোঝাটা নেমে গেল মনে হলো। কিন্তু পর মুহূর্তেই বাস্তবতা ধাক্কা খেল ওর সাথে। স্বাধীনের চোখের দিকে বড় বড় করে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিল ও,
– তাহলে…. এতক্ষণ… নিতার ব‍্যাপারে আমাকে বোকা…..বানিয়েছো?

বড় করে হেসে দিল স্বাধীন। কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে আনলো অস্থির পৃথাকে,
– এভাবে না করলে তুমি কি যেতে রাজি হতে বলো?
কুন্ঠায়, অস্বস্তিতে নুইয়ে গেল পৃথা। স্বাধীনের আলিঙ্গনে ছটফট করতে লাগলো,
– আমাকে ছাড়ো, ছাড়ো বলছি। খুব মেজাজ গরম হচ্ছে আমার এখন। ছাড়ো, সরো।
– না ছাড়বো না আমার পৃথাকে আমি।

এই বলে এক ঝটকায় কাছে টেনে আনলো ওকে স্বাধীন। পৃথার গালে দুষ্টুমি ভরে আদর করে দিল। পৃথা তো ওর বুকে মেরেই যাচ্ছে নিজেকে ছাড়ানোর জন‍্য কিন্তু স্বাধীনের শক্তির সামনে ধাতস্থ হতে হচ্ছিলো ওকে। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে রেগে তাকালো ও হাসতে থাকা স্বাধীনের দিকে। স্বাধীন বললো তখন,
-Thanks for going with me on this trip. I want to spend some quality time with you Preetha. I really do.

পৃথা কিছু বললো না, হাসলোও না। তবে ওর চোখের রাগটা মুহূর্তেই উধাও হতে দেখলো স্বাধীন। সেখানে বসতে দেখলো অনেক চেষ্টায় চাপিয়ে রাখা লজ্জা।
…………………………
…………
মিসেসে রিতা বারান্দায় এসে তার স্বামী, আহমেদ সাহেবের পাশে বসেছেন। এ ধরনের চিত্র এ বাসায় বিরল এবং আহমেদ সাহেব খুব ভালো করেই অবগত যে তার স্ত্রী কোনো মতলবেই তার পাশে আসন গ্রহন করেছেন। রিতা মুখ খোলার আগেই বললেন তিনি,
– অন‍্যদিকে কথা না ঘুরায়ে প‍্যাচায়ে, যা বলতে আসছো তা সরাসরি বলো।

তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন রিতা,
– আমি কি তোমার কাছে শুধু মতলব নিয়েই আসি নাকি?
– আমি মতলব শব্দটাতো ব‍্যবহারই করিনি। সেটা তুমিই বলছো।

থতমত খেয়ে গেলেন রিতা। আমতা আমতা করতে লাগলেন,
– শোন… আমি আসলে জর্জ আর….পৃথার ব‍্যাপারে তোমার সাথে কথা বলতে এসেছিলাম।
– ওদের ব‍্যাপারে আবার কি কথা থাকতে পারে রিতা?
– ওইযে ওদের বিয়ে….

এবার আহমেদ সাহেব কঠোরভাবে তাকালেন তার স্ত্রীর দিকে,
– এই বিষয়ে তোমার সাথে আমার স্পষ্ট কথা হয়েছে রিতা। পৃথা অন‍্য ঘরের বউ, ওর বিয়ে হয়ে গেছে।
– কিসের বিয়ে গো? ওসব বাল‍্যবিবাহ আমি মানি না। ছোলে খেলা ছিল ওটা।
– তোমার মানা, না মানাতে কোনো কিছু আসে যায় না রিতা। বিয়েটা দুজন নাবালেগের মাঝে হলেও সেটা হয়েছে উভয় পক্ষের বড়দের সম্মতিতে। আমি নিজেই ছিলাম সেই বিয়ের সাক্ষি।

রেগে গেলেন রিতা,
– তা বিয়ে করেছে যে, তো এসে এখনো মেয়ে নিয়ে যাচ্ছে না কেন নিজেদের কাছে? ওরাও এসব ভুলে গেছে বিদেশে গিয়ে, যেয়ে দেখো।
– না, আমার মনে হয় না তারা ভুলেছে। আর সেটা নিয়ে তোমার এতো মাথা ব‍্যাথা থাকার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। কারণ ফুফু হিসেবে পৃথার জন‍্য তোমার আসলে কতোটুকু টেনশন আছে সেই ব‍্যাপারে আমার ভালোভাবেই জানা। হুহ্!…. সে যাই হোক। আমার কথা ফাইনাল। পৃথার বিয়ে নিয়ে কোনো কথা উঠবে না। আর তোমার অকর্মা ছেলের সাথে তো কখনোই না।

এই বলে, স্ত্রীকে আর কিছুই বলার সুযোগ না দিয়ে আহমেদ সাহেব উঠে ভেতরে চলে গেলেন। রিতার তখন সারা গায়ে আগুন জ্বলছিল। তার এতোদিনের এতো প্ল‍্যান এই নমুনা লোকটার জন‍্য মনে হচ্ছে ভেস্তে যাবে। না। এটা উনি হতে দিবেন না। পৃথাকে তার ঘরের বউ বানিয়ে আনবেনই তিনি। আনতেই হবে। নাহলে এতোদিনের এতো কারসাজির কোনো লাভ থাকবে না।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here