#অদৃষ্টে_তুমি_আমি
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_১০
অবশেষে সিলেটে যাওয়ার দিনটি চলে আসলো। খুব সকাল সকালই রওনা হলো স্বাধীন আর পৃথা। স্বাধীনই ড্রাইভ করছে। পৃথা পাশে বসা। যখন ভোরে স্বাধীন পৃথার বাসার নিচে থেকে ওকে পিক করতে এসেছিল তখন স্বাধীনকে একা দেখে অবাক হয়েছিল পৃথা,
– আরে? তুমি একা কেন? আমাদের সাথে না নাইম ভাই আর সোহেল ভাইয়ের যাওয়ার কথা? ওনারা কই?
স্বাধীনের হাল্কা ইতস্তত আওয়াজ বোধহয় পৃথা ধরতে পারলো না,
-ওওওরা ফ্লাইটে যাবে।
– ফ্লাইটে? কেন?
– ওদের আসলে কিছু অগ্রিম কাজ দেওয়া হয়েছে সেগুলো করবে।
– তাই? কই, গতকাল অফিসে এই ব্যাপারে তো কিছু শুনলাম না?
– রাতে ডিসিশন হয়েছে। সিয়াম বলে দিয়েছে ওদের।
-ওহহো, তাহলে আমরাও তাদের সাথে ফ্লাইটেই চলে যেতাম। খামখাই এতো বড় জার্নি করতে হবে।
পৃথার কষ্টের চেহারার সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো স্বাধীন,
– কেন? বড় জার্নিতে সমস্যা কোথায়?
এবার ইতস্তত হওয়ার পালা পৃথার। স্বাধীনের থেকে চোখ লুকিয়ে বললো ও,
– না…মানে?
নিজের মুখ নিচু করলো স্বাধীন,
– স্বামী স্ত্রীর জন্য বড় জার্নিগুলোই বেশি এনজয়েবল হয়। নিজেদেরকে একান্তে অনেক সময় দেওয়া যায়, কি বলো?
সাত সকালে এসব কথায় হুট করে নিজের লজ্জা লুকাতে পৃথার কষ্ট হলো। মাথা নিচু করে ফেললো ও। স্বাধীন হাসি দিয়ে পিছে সরে ওকে গাড়িতে ওঠার জায়গা করে দিল।
সকাল সকাল ট্রাফিক কম থাকায় ঢাকা ছাড়তে ওদের বেশী সময় লাগলো না। হাইওয়ে তে উঠতেই প্রকৃতির মাঝ দিয়ে পার হওয়ার সুযোগ হলো ওদের। সকালের এই স্নিগ্ধ পরিবেশ পৃথা বেশ উপভোগ করছিল। স্বাধীনও গাড়ি চালিয়ে আরাম পাচ্ছিলো অনেক। নিজেদের মাঝে হাল্কা পাতলা গল্প, ছোট খাটো দুষ্টুমি আর প্রকৃতির আমেজ মিলিয়ে এক অন্যরকম সময় কেটে যাচ্ছিলো ওদের।
সকালে দুজনই নাস্তা খেয়ে আসার সময় পায়নি বলে একটা রেস্তোরাঁয় থামলো। বেশ মজা করেই নাস্তা করলো ওখানে। ওরা গল্প করছে এরই মাঝে কে যেন জোরে স্বাধীনের নাম ধরে ডাকলো। আশ পাশ ফিরতেই দেখা গেল এক দম্পতিকে। ওদের টেবিলের দিকেই আসছে। পৃথা দেখলো স্বাধীনের ঠোটে হাসি ভেঙে পরেছে। সামনে থেকে আসা ছেলেটা কাছে আসতেই উঠে জড়িয়ে ধরলো ও। পৃথাও সাথে সাথে দাড়িয়ে গেল। স্বাধীনের উচ্ছাসিত আওয়াজ শুনতে পেল ও,
– আরে জাহিদ, what a pleasant surprise দোস্ত! এভাবে তোর সাথে দেখা হবে কল্পনাও করিনি।
– আমিও তো তোকে এখানে দেখে অবাক। তা নাশিদের বিয়ের জন্যই যাচ্ছিস তো তাই না?
– হ্যা নাশিদের বিয়ে তো এ্যাটেন্ড করবোই তবে তার আগে অফিসের কিছু কাজ আছে সিলেটে। সেগুলা শেষ করে আসবো। তোরা কি সোজা নাশিদের বাসায় যাচ্ছিস নাকি?
– হ্যা রে। চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা। আগে ভাগেই যেতে হচ্ছে কামলা খাটার জন্য।
এই বলে দুইজনই হেসে দিল। এর মাঝে জাহিদ হঠাৎ পৃথার দিকে তাকালো। চোখে কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করলো স্বাধীনকে,
– দোস্ত ইনি….?
পৃথার দিকে একবার চেয়ে লাজুক হাসি দিল স্বাধীন।
– আমার ওয়াইফ, পৃথা।
এতোটাই চমকে উঠলো পৃথা যে মনে হচ্ছিলো নিজের শরীরের ভারসম্য রক্ষা না করতে পেরে, পরে যাবে ও। প্রথমবার স্বাধীন কারও সাথে ওকে নিজের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। অনেক কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে মুখে একটা হাসি আনলো পৃথা। জাহিদের তখন হাসি আটখানা হয়েছে,
– Oh My God! শেষ পর্যন্ত সৌভাগ্য হলো আপনার সাথে পরিচয়ের ভাবী। আপনার কথা যে স্বাধীনের কাছে কতো শুনেছি তা বলার বাইরে। আপনার জন্য এক কথায় পাগল ও।
পৃথা স্পষ্ট লজ্জা পেয়ে বসলো। ঠোট টিপে হাসতে গিয়েও যেন হাসি বের হয়ে যেতে চাইলো। জাহিদের এভাবে অকপটে সব বলে ফেলা দেখে স্বাধীনও ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। কথা ঘোরানোর চেষ্টা করলো ও,
– তুই পারিসও কথা বলতে। আঁচল, তোমার স্বামীর মুখের লাগাম টানতে পারো না? যখন তখন যা খুশি বলে দেয়।
জাহিদের পাশে দাড়ানো মেয়েটির নাম আঁচল, সেটা বুঝলো পৃথা। মেয়েটির সাথে স্বাধীন ওকে পরিচয় করিয়ে দিল। তারপর চারজন বসে পরলো গল্প করতে। সেখান থেকেই পৃথা জানতে পারলো যে জাহিদের আর স্বাধীনদের পরিবার এমেরিকাতে প্রতিবেশী ছিলো। ওরা বেশ ভালো বন্ধু। জাহিদের কাজিন নাশিদও স্বাধীনের বন্ধু হয়। সেই নাশিদের বিয়ে এ্যাটেন্ড করতেই স্বপরিবারে জাহিদদের দেশে আসা। কথায় কথায় জাহিদ স্বাধীনকে জিজ্ঞেস করলো,
– নাশিদের ফার্ম হাউসে আসছিস কবে?
– হমম। দুদিনের কাজ আছে অফিসের। তারপরে আসবো।
-ওওও। ভাবী, চলে আসেন আমাদের প্রোগ্রামে। বেশ মজা হবে।
পৃথা শুধু মাথা নাড়লো, কিছু বললো না। মনে মনে শুধু অবাক হলো। ভাবলো পরে স্বাধীনের সাথে কথা বলবে এ নিয়ে।
আধাঘন্টা পর ওরা উঠে রেস্তোরাঁর বিল মিটিয়ে বাইরে আসলো। জাহিদদেরকে ওদের গাড়িতে উঠিয়ে দিল স্বাধীন আর পৃথা। তারপর ওদের বিদায় দিয়ে নিজেরাও রওনা দিল। তখন পৃথা জিজ্ঞেস করলো স্বাধীনকে,
– আচ্ছা কার বিয়ের কথা হচ্ছিল? আর আমি যাব মানে?
মুচকি হাসলো স্বাধীন,
– জাহিদের চাচাত ভাই নাশিদ, ওর বিয়ে হচ্ছে। শ্রীমঙ্গলে ওদের বিশাল ফার্ম হাউস আছে। ওখানেই বিয়ের আয়োজন।
– বিয়ে কবে?
– অনুষ্ঠান শুরু তিন দিন পর থেকে। বিয়ে বোধহয় আগামী শুক্রবারে মানে ছয় দিন পর।
হঠাৎ পৃথা সব বুঝে গেল,
– তুমি ইচ্ছা করে এক সপ্তাহের জন্য এসেছো যাতে বিয়ে এট্যান্ড করে যেতে পারো?
– হ্যা। (স্বাধীনের সাবলীল উত্তর)
– আর আমাকেও নিয়ে এসেছো এই কারণেই?
– এটা অনেক গুলোর মাঝে একটা কারণ বলতে পারো।
-মানে?
– মানে তোমাকে নিয়ে বিয়ে খাব এটা একটা কারণ আছে তবে মূল কারণ সেটা না।
-তাহলে কি?
স্বাধীন ডান হাতে স্টিয়ারিং ধরে বাম হাত দিয়ে পৃথার কোলো রাখা হাতটা ধরলো।
-মূল কারণ তোমাকে আগেই বলেছি আমি। I want to spend time with you.
এতো রোমান্টিক কথাও এই মুহূর্তে পৃথার ওপর কোনো কাজ করলো না। ও কপট রাগ নিয়ে বলে উঠলো,
– তা, বিয়েতে যেতে হবে, এটা আমাকে আগে জানাবা না? কোনো প্রিপারেশন নিয়ে আসিনি। সব ফরমাল কাপড় নিয়ে এসেছি। পার্টি ওয়েয়ার একটাও আনিনি।
পৃথার অভিমানে হাসলো স্বাধীন।
-ইচ্ছা করেই বলিনি তোমাকে। অফিসের কাজের শেষে হুট করে বলতে চেয়েছিলাম। আর কাপড় চোপরের চিন্তা একদমই করো না। আমরা সিলেটে সেসবের শপিং করে ফেলবো। আজ তো শনিবার, অফিসের কাজ নেই। আজই যাব শপিংয়ে।
-কিন্তু অনর্থক টাকা খরচ করার কি দরকার ছিল?বললেই বাসা থেকে নিয়ে আসতাম।
– তাহলে তো আমার ইচ্ছা পূরণ হতো না। আমার বউকে আমি নিজে পছন্দ করে কাপড় কিনে দিব। সেটাই পরে বিয়ে এ্যাটেন্ড করবে সে।
এবার আর না গলে যেয়ে পারলো না পৃথা। অজান্তেই লজ্জা পেয়ে হেসে দিল। সেই হাসি ছড়িয়ে গেল স্বাধীনেরও মুখে।
দুপুর হওয়ার আগেই সিলেটে ঢুকলো স্বাধীনের গাড়ি। একটা বিলাশ বহুল হোটেলের সামনে এসে দাড়াতেই অবাক হয়ে গেল পৃথা।
– আমরা এখানে থাকবো?
– হমম।
– সবাই?
– সবাই মানে?
– মানে ঢাকা থেকে যারা এসেছে সবাই এখানে থাকবে?
– ও! না না। ওরা থাকবে একটা রেস্ট হাউসে। এখানে শুধু আমরা দুজন থাকবো।
সতর্ক হয়ে গেল পৃথা।
– কেন? আমরা আলাদা আলাদা থাকবো কেন? আর এখানে আমরা দুজন মানে….?
তবে পৃথার প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই স্বাধীন মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে হোটেলের লবিতে ঢুকে পড়লো। পৃথা বিরক্ত হয়ে ওর পিছ ধরলো তবে আশ পাশে মানুষ থাকায় কিছু বলতে পারলো না।
রিসেপশনে যেয়ে স্বাধীন ডেস্কের অপর পাশে দাড়ানো মানুষটাকে বললো,
– আমি এখানে বুকিং দিয়েছিলাম।
– স্যার কি নামে বুকিং ছিল?
-রিতভিক হাসান এন্ড মিসেস পৃথা হাসান।
পাশে দাড়ানো ছিল পৃথা। স্বাধীনের কথায় পুরা নব্বই ডিগ্রী এ্যাঙ্গেলে ঘুরে গেল ও।
চোখ বড় বড় হয়ে গেছে আগেই। স্বাধীন পৃথার প্রতিক্রিয়া দেখেও দেখলো না। শুধু হাসলো মনে মনে।
চলবে।