#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_১৯
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
শেখ শাহনাওয়াজ কে দেখে মেহবিন অবাক হলেও কিছু বললো না। ও ভালোভাবে ওরনা মাথায় দিল। শরীরে জ্বর থাকার জন্য একটু দুর্বলতা এখনো আছে। এক পা এগুতেই ও পরে যেতে নিল তা দেখে শেখ শাহনাওয়াজ এগিয়ে এলেন মেহবিন বারান্দার রেলিং ধরে নিজেকে সামলে নিল। তারপর বড় বড় শ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো আর তালা খুলতে লাগলো চাবি দিয়ে। তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,
‘আপনি ঠিক আছেন?”
‘হুম ঠিক আছি।”
“আপনি কি অসুস্থ ডাক্তার?”
ততক্ষণে মেহবিন তালা খুলে ফেলেছে। ও বাইরে বেরিয়ে এসে বলল,,
“হুম একটু জ্বর এসেছিল। আপনি এতো সকাল সকাল কারো কিছু হয়েছে?
“সকাল সকাল কোথায় আটটা বাজে।”
“ওহ আচ্ছা কিছু বলবেন?”
“হ্যা। এখানেই কি সব বলবো?
এ কথা শুনে মেহবিন অপ্রস্তুত হয়ে গেল। এখন তো মুখর রুমে আছে। তবুও মেহবিন বলল,,
“ভেতরে চলুন নাহলে?”
“ভেতরে কেউ আছে নাকি?”
শেখ শাহনাওয়াজ এর কথা শুনে মেহবিন অবাক হয়ে গেল। ও সব সাইডে রেখে বলল,,
‘হুম আমার জামাই আছে।”
“কি?”
“কিছু না!”
“আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?”
‘আপনার সাথে কি আমার মজার সম্পর্ক চেয়ারম্যান সাহেব।”
“হয়তো আমার সাথে মজাই করছেন। আরে এমন করে বলার কিছু নেই। আমি ভেতরে যাবো না। আমি এমনিই জিজ্ঞেস করলাম আসলে আপনার জ্বর ছিল রাতে কি একাই ছিলেন নাকি তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম।”
শেখ শাহনাওয়াজ এর কথায় মেহবিন একটা শ্বাস ফেললো। সত্যি কথার ভাত নাই। মেহবিন বলল,,
‘না তেমন কেউ ছিল না একাই ছিলাম। আপনি কি ভেতরে গিয়ে বসবেন?
“না ভেতরে ঢোকা টা ঠিক হবে না। আপনাকে বলতে এসেছিলাম আজ তো সোমবার সামনে শুক্রবার জিনিয়া কে দেখতে আসবে। এই জন্য আপনার দাওয়াত। আপনি এমনিতেও যেতেন কিন্তু কিছু মেহমান আসবে তাই আপনাকে দাওয়াত দিলাম।”
“দুঃখিত সামনে শুক্রবার আমার ঢাকায় যেতে হবে মিশুকে বলে যাবো আমি কোন সমস্যা নেই। আর হ্যা প্লিজ ওকে রুমে আটকে রাখবেন না। ওর বন্ধ জায়গায় দম আটকে আসে নিজেকে পাগল পাগল মনে করে। আমি বলে যাব যাতে কোন দুষ্টুমি না করে ভদ্র ভাবে থাকে।”
“তারমানে আপনি যাবেন না?”আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তোমাদের কাউকে খাবারের দাওয়াত দেওয়া হলে সে লোক যেন তা গ্রহণ করে।
( -সহীহ্, ইবনু মা-জাহ (১৭৫০), মুসলিম)
“দুঃখিত দাওয়াত রাখতে টা পারছি না। যদি ঢাকায় না যেতে হতো তাহলে নিশ্চয়ই আপনার দাওয়াত রাখতাম।”
“সত্যিই কি রাখতেন?”
“হয়তো বা কিন্তু এক্সিডেন্টলি এন্ড আনফরচুনেটলি আই এম লাকি। আর কিছু বলবেন?”
“না এইটুকুই বলার জন্য এসেছিলাম।”
‘ওহ আচ্ছা।”
‘তাহলে আমি আসছি সাবধানে থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।”
“হুম আল্লাহ হাফেজ।”
শেখ শাহনাওয়াজ চলে গেলেন। মেহবিন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ও ওয়াশরুমে চলে গেল। তখন আমাদের নেত্রী এলো হাতে খাবার নিয়ে। বারান্দা খোলা দেখে সোজা মেহবিনের রুমে গেল ও ভেতরে গিয়ে দেখলো কেউ কম্বল মুড়ে দিয়ে শুয়ে আছে। ও ভাবলো হয়তো মেহবিনই তাই কম্বলটা মাথার দিক থেকে একটু সরিয়ে ঠিক দেবে ভেবে কম্বল সরালো। মেহবিনের জায়গায় মুখরকে দেখেই ও ‘আল্লাহ’ বলে উঠলো। মুখর নড়ে চড়ে উঠলো তা দেখে তাজেল তাড়াতাড়ি করে নিজের মুখ চেপে ধরলো ও আবার ও উকি দিয়ে দেখলো যে মুখর না মেহবিন ওখানে। ভালো করে চোখ মুখ ডলে আবারও দেখলো না এবার ও মুখরই। ও বলে উঠলো,,
“ডাক্তার রাইতের মধ্যে পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা হইয়া গেছে। আল্লাহ কি হইছে। এইডা কেমনে হইলো? কালক্যা সন্ধ্যার আগেও তো ডাক্তাররেই দেইখা গেলাম এহন পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা কেমনে হইলো।”
তখনি মেহবিন এলো ও দরজার দিকে তাকাতেই দেখলো মেহবিন। মেহবিন ওকে দেখে ওর দিকে এগিয়ে এসে বলল,,
“নেত্রী!”
মেহবিন কে দেখে তাজেল দাঁত কেলিয়ে বলল,,
“ও আল্লাহ ডাক্তার তাইলে তুমি ঠিকই আছো। পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা হও নাই।”
তাজেলের কথায় মেহবিন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,,
“মানে?’
“মানে হইলো আমি তো আইসা ভাবছিলাম কম্বলের তলে তুমি আছো। তাই কম্বল সরাইছিলাম পরে দেহি পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা আমি তো ভাবছিলাম তুমি রাইতে বদলাই গেছো।”
তাজেলের কথায় মেহবিন হাসলো আর বলল,
“তাই নাকি। তা আমি বদলে গেলে তুমি কি করতে?”
“তহন তুমি পোলা হইতা আর আমি তোমারে বিয়া করতাম।”
তাজেলের বিয়ে করার কথা শুনে মেহবিন আরো জোরে হেঁসে উঠলো। আর বলল,,
“হ্যা নেত্রী আমিও ছেলে হলে তোমায় বিয়ে করতাম। এতো সুইট আর কিউট বউ থাকতো আমার।”
তখন শোনা গেল ,,
“হুম তুমি ছেলে হলে আমিও মেয়ে হতাম। আর তোমায় বিয়ে করে নেত্রীর সতিন ও হতাম। আমিও নেত্রীর মতো সুইট আর কিউট সতিন পেতাম।”
মুখরের এমন কথায় মেহবিন আর তাজেল মুখরের দিকে তাকালো। মুখর কম্বল থেকে মাথা বের করে কথাটা বলল। মুখরের এমন কথায় তাজেল বলল,,
“ডাক্তাররে তো আমি বিয়াই করবার দিতাম না। তোমারে আবার বিয়া করতো কহন আর তুমি সতিনই হইতা কহন।”
“আমার মতো একজন কিউট মানুষটাকে তুমি সতিন বানাতে না।’
“না বানাইতাম না। তাছাড়া ২য় বউ মেলা পাজি হয় আমার সৎ মায়ের মতো।”
তাজেলের কথায় মেহবিন প্রসঙ্গ বদলে বলল,,
“হ্যা হ্যা অনেক হয়েছে এখানে কারো বদল হচ্ছে না। আর কেউ কাউকে সতিন বানাচ্ছে না। নেত্রী তুমি এখন এখানে?”
“তোমার তো জ্বর দুইদিন ধইরা তাই আমার ছুটি। দাদিরে তোমার জ্বরের কথা কইছিলাম তাই দাদি সকাল সকাল পাতলা খিচুড়ি রাইন্দা দিছে তাই নিয়াইলাম। কিন্তু আইসা দেখলাম পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালাও আছে। এই হানে তো খালি তোমার জন্যই দিছে।”
“ওহ আচ্ছা সমস্যা নেই। কাব্য আপনি উঠুন তো দেখেন উঠতে পারেন কি না। আমি বালটিতে পানি নিয়ে আসছি ঘর থেকেই হাত মুখ ধুতে হবে।”
তখন মুখর বলল,,
“আমার ওয়াশরুমে যাওয়ার দরকার ছিল।”
এ কথা শুনে মেহবিন একটু চিন্তায় পরে গেল। বারান্দা দিয়ে ওয়াশরুমে যেতে হবে। যদি কেউ দেখে নেয় এই মুহূর্তে কাউকে জানাতে চাচ্ছে না সে তাদের ব্যাপারটা। মেহবিন একটা বুদ্ধি বের করলো একটা শাল এনে মুখরকে দাড় করিয়ে ঢেকে দিল। তারপর জিজ্ঞেস করল একা যেতে পারবে কিনা ও বলল পারবে তাই শালটা দিয়েই নিজেকে আড়াল করে চলে গেল ওয়াশরুমে। মুখর যেতেই তাজেল বলল,,
“হেতি আইলো কহন?আর হেতি মনে অয় অসুস্থ মাথায় ব্যান্ডেজ আবার হাতেও ব্যান্ডেজ।”
“হুম অসুস্থ আর অসুস্থ হয়েই এখানে এসেছে। তবে নেত্রী সে যে এসেছে এটা কিন্তু কাউকে বলা যাবে না।”
তাজেল মেহবিনের কপালে গলায় হাত দিয়ে বলল,,
“ঠিক আছে। দেহি তোমার জ্বর এখন আছে না গেছে। তোমার তো দেহি জ্বরে চেহারা বচকাই গেছে গা ডাক্তার।”
তাজেলের কথায় মেহবিন হেঁসে বলল,,
“আমায় কি খারাপ দেখতে লাগছে নেত্রী?”
“আরে না তোমারে কি খারাপ লাগবার পারে। তুমি কতো সুন্দর এতেও তোমারে এক্কেরে সুন্দর লাগতাছে।”
তখন মুখর এলো মেহবিন দরজায় ভালো করে পর্দা টেনে মুখরের দিকে একটা টাওয়েল এগিয়ে দিল। মুখর নিয়ে বিছানায় বসলো ঠান্ডার মধ্যে শুধু গেঞ্জি পরে থাকবে নাকি তাই চাদরটা ও দিয়ে রাখতে বলল। মেহবিন রান্না ঘরে গেল মুখর আর তাজেল দুজনেই মানা করেছিল। কিন্তু সে তো মেহবিন মানা করেও লাভ নেই। কিছুক্ষণ পর মেহবিন নুডুলস রান্না করে নিয়ে এলো। প্লেট আনলো খিচুড়িও আনলো। মেহবিন তাজেলকে নুডুলস খেতে বলল তা তাজেল মানা করলো একটু আগেই খেয়ে এসেছে সে। তাজেল ওদের রেখে চলে গেল।আজ আর আসবে না। মেহবিন মুখরকে খাবার খেতে বলে বারান্দায় গিয়ে কেচিগেইট আটকে এলো। ও আসতেই মুখর মেহবিনের গলায় কপালে হাত দিয়ে বলল,,
“এতক্ষন নেত্রী ছিল বলে কিছু বলতে পারিনি। যাক জ্বরটা নেই তেমন এখন আলহামদুলিল্লাহ। আর তুমি কোন সাহসে জ্বরের মধ্যে কিছু গায়ে না দিয়ে শুয়েছিলে?”
“কখন ঘুমিয়ে গেছি টের পাইনি।”
“নিজের খেয়াল তো রাখে মানুষ।’
“হুম এখন খাওয়া শুরু করুন।”
“আজ কিন্তু ডান হাতেই লেগেছে গুলি।”
মুখরের কথায় মেহবিন ওর দিকে তাকালো আর নুডুলস মুখের সামনে ধরল। তখন মুখর বলল,,
“আমার খিচুড়ি দাও কতোদিন খিচুড়ি খাইনা।”
মেহবিন নুডুলস রেখে খিচুড়ি দিল। যত্ন করে মুখরকে খায়িয়ে ওষুধ খায়িয়ে দিল নিজেও খেল। তারপর মুখরকে শুয়ে থাকতে বলল। আর ভুলেও যাতে ঘরের বাইরে না যায় সেটাও বলল। তখন মুখর বলল,,
“তুমিও শুয়ে থাকো না?”
“আমার এখন ভালো লাগছে একটু রোদে বসে থাকবো।”
“আমি একা একা থাকবো নাকি? একটা উপন্যাস পড়ে শোনাও। আর আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও।”
মেহবিন একটা উপন্যাস এনে মুখরের পাশে আধশোয়া হয়ে একহাত দিয়ে মুখরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল আরেক হাত দিয়ে উপন্যাসের বইটা ধরে গল্প শোনাতে লাগলো। মুখর ও চোখ বুঝে প্রিয়সীর কন্ঠে উপন্যাস মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো। একটা সময় মুখর ঘুমিয়ে গেল। তা দেখে মেহবিন ভালো করে কম্বল টেনে দিল উপন্যাস এর বইটা রাখলো তখনি মুখর ওর কোমড় জড়িয়ে ধরলো মেহবিন কিছুই বললো না। ও মুখরকে দেখতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর মুখরকে ছাড়িয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো রান্না করতে হবে। ও ফ্রিজ থেকে মাছ মাংস বের করলো। তারপর নিজের মন মতো রান্না করতে লাগলো। রান্না শেষ করে গোসল করে আসলো এখন ওর ফ্রেশ ফিল হচ্ছে। জ্বরটা বোধহয় আর আসবে না। তখনি মুখরের ফোনটা বেজে উঠলো মুখরের বাবা ফোন দিয়েছে। মুখরকে ডাকলো কিন্তু উঠলো না তাই নিজেই ফোন রিসিভ করে সালাম দিল,,,
“আসসালামু আলাইকুম!”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম! মেহবিন তুমি! মুখর ঠিক আছে তো? আর ও কি তোমার কাছে আছে।”
“হ্যা বাবা উনি আমার কাছেই আছে আর ঠিকই আছে।’
“আলহামদুলিল্লাহ সকালে শুনলাম ওর গাড়িটা রাস্তায় এমনিই পরে আছে। আর ও বাসায় ও ফেরেনি বলে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
“ভয়ের কোন কারণ নেই বাবা উনি ঠিক আছেন শুধু মাথায় আর হাতে হালকা চোট পেয়েছেন। ওনার ওপর কিছু গুন্ডারা এটাক করলে উনি তাদের ওপর গুলি ছুড়ে গুলি শেষ হলে উনি পালিয়ে এই এলাকায় আসেন। রাত বেশ ওনার ও শরীরে তেমন শক্তি ছিল না তাই আমার বাড়িতেই চলে আসেন।”
“আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। এখন কেমন আছে মুখর ও কি করছে?”
“উনি ঘুমাচ্ছে তাই তো ফোনটা আমি ধরলাম।”
“ওহ আচ্ছা।”
তখন পাশ থেকে কেউ বলল,,
“আমি কথা বলবো আমার কাছে ফোনটা দাও।”
মেহবিন বুঝতে পারলো এটা মুখরের মায়ের গলা। তিনি ফোন নিতেই মেহবিন সালাম দিল,,
“আসসালামু আলাইকুম! কেমন আছেন মা!
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। ছেলের এই খবর শুনে আর কতো ভালো থাকবো মেহু মা। মুখর এখন কেমন আছে মেহু মা ? বেশি আঘাত পায় নি তো!”
“আরে রিল্যাক্স তেমন কিছুই হয় নি শুধু হালকা চোট পেয়েছে। এখন ঠিক আছে। আপনার ছেলে তো খেয়েদেয়ে ঘুমাচ্ছে। উনি উঠলেই আপনাকে ফোন দিতে বলবো।”
“ঠিক আছে এই নাও নাফিয়া তোমার সাথে কথা বলবে।”
“আসসালামু আলাইকুম আপু।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম মেহু।”
“তোমার ভাইয়া ঠিক আছে আপু চিন্তা করো না।”
“তোমার কাছে যেহেতু আছে তাহলে চিন্তা কিসের? আমি তোমার সাথে কথা বলবো বলে ফোনটা নিয়েছি। কেমন আছো তুমি?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোমরা কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ আমরাও ভালো আছি। বিশেষ করে আমি তো একদম ভালো আছি তোমাদের কে এভাবে রেখে।”
“ওহ হো আপু এসব কথা ছাড়ো তো । এতে না তোমার হাত আছে না আমাদের। তাই এসব কথা একবারও বলবে না এখন বলো বাবা বাড়িতে নাকি তোমরা দুজন বাবার অফিসে।”
“আমরাই অফিসে বাবা তো কিছু বলবেই না। মা কিভাবে যেন জেনেছে ভাইয়ার কিছু হয়েছে ব্যস শুনেই দৌড় বাবার অফিসে।”
“মায়েরা এরকমই বোধহয় সন্তানের একটু আঘাত ও তাদের সহ্য হয় না।”
বলেই দেখলো মুখর ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে মেহবিন বলল,,
“উনি উঠে পরেছে নাও কথা বলো।”
মেহবিন ফোনটা মুখর কে দিয়ে রান্না ঘরে চলে গেল। তখন মুখর ফোনটা নিয়ে বলল,,
“শুকরিয়া নাফি।”
‘শুকরিয়া কিসের জন্য ভাইয়া?”
“মেহুকে জিজ্ঞেস করার জন্য সে কেমন আছে। তুই জানিস মেহুর না দুদিন ধরে জ্বর। আমিও জানতাম না এ বাড়িতে এসে জানলাম। কাল ঐ অবস্থায় এ বাড়িতে আসার কতটা উদগ্রীব হয়ে আমার সেবা করছিল কি বলবো তোকে। তখনো জানতাম না ওর জ্বর । রাতে আমার সেবা করতে করতেই আমার মাথার কাছে ঘুমিয়ে পরেছিল রাতে শীতে কাঁপছিল ওকে ডেকে আমার পাশে শুয়িয়ে ছিলাম। সকালে উঠে আমার যা প্রয়োজন সব করলো আজ আর তেমন জ্বর নেই তবুও জ্বর থেকে উঠে কি কারো ভালো লাগে । আমি জানি আমি ঘুমানোর পর ঠিকই দুপুরের রান্না করেছে। কিন্তু একটা টু শব্দ করে নি। মাকে কিন্তু ঠিকই জিজ্ঞেস করলো সে কেমন আছে কিন্তু মা ছেলের চিন্তায় তাকে জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছে সে কেমন আছে। যদিও মা মেহুকে ভালোবাসে সেটা জানি কিন্তু আজ কেন যেন নিজেকে খুব অসহায় লাগছে নাফি। তুই ওকে যখন ওকে জিজ্ঞেস করলি তখন আমার অসহায়ত্ব বোধহয় কমলো। আগে না হয় ওর কেউ ছিলনা এখন তো আমরা আছি তবুও মেয়েটার কোন অভিযোগ নেই আমাদের প্রতি।
ফোনটা লাউড স্পিকারে ছিল মুখরের মা বাবা মুখরের কথা শুনে ওনাদের চোখ ছলছল করে উঠলো সাথে নাফিয়ারও। তখন মেহবিন এলো বালটিতে পানি নিয়ে আর বলল,,
“কথা বলা হয়েছে আপনার। এখনো বিছানা ছাড়েন নি? হাত মুখ ধুয়ে নিন আমি খাবার বাড়ছি ওষুধ ও তো আছে। মায়ের সাথে কথা বলেছেন?”
মুখর মেহবিনের কথা শুনে বলল,,
“এই নাফি মায়ের কাছে দে।”
মেহবিন ওকে রেখে আবার চলে গেল। মুখরের মা ফোন নিয়ে বলল,,
‘মুখর আমি বোধহয় একজন ভালো মা হতে পারি নি বল তাই না?”
তখন মুখর বলল,,
“কি আজেবাজে বকছো তুমি ভালো মা না শুধু বেস্ট মা। আমার কথায় মন খারাপ করো না ওটা এমনিই বলেছি। তুমি তো বেস্ট মা তাই ছেলের কথা শুনে পুরো দুনিয়া ভুলে গেছো। আমি এখন ঠিক আছি তুমি টেনশন করো না।”
আরো কিছুক্ষণ বাবা মায়ের সাথে কথা বলে ফোন রেখে দিল। ততক্ষণে মেহবিন সব খাবার নিয়ে এসেছে। মুখর কে ফ্রেশ হতে সাহায্য করলো তারপর ভাত মাখিয়ে খায়িয়ে ওষুধ খায়িয়ে দিল। মুখর হেঁসে বলল,,
‘নিঃসন্দেহে তুমি একজন উত্তম স্ত্রী বিহঙ্গিনী।”
‘আপনার মুখে মেহু ডাকটাও খারাপ না কাব্য।”
‘তোমার যেভাবে কাব্য ডাকতে ভালো লাগে তেমন আমার ও বিহঙ্গিনী ডাকতে ভালো লাগে।”
‘হুম ভালো। এখন চুপ করে শুয়ে থাকুন।”
“আমি কোন আইসিইউ এর পেশেন্ট না যে সবসময় শুয়ে থাকতে হবে।”
‘তা না থাকলেন অসুস্থ তো। তাছাড়া আপনি এমন একটা জায়গায় আছেন যেখানে চাইলেও বেরুতে পারবেন না।”
‘হুম!
মুখর তার কিছুক্ষণ পর এক বায়না করলো সে গোসল করবে কিন্তু এখন তো ব্যান্ডেজ ভেজাতে পারবে না। মুখরের জোরাজুরিতে ও বালটি ভরে পানি এনে ওর শরীর মুছিয়ে দিল। তারপর গেঞ্জি খুলতে বলল,,
“তুমি আবার আমাকে খালি গায়ে থাকতে বলছো?”
মেহবিন একটা হুডি এনে মুখরের সামনে ধরে বলল,,
“আপনার এটা আমার কাছেই ছিল।”
“ওহ্ আচ্ছা তাইতো বলি এটা কোথায় গেল।”
মেহবিন ওকে হুডিটা পরিয়ে দিল। সারাদিন এভাবেই গেল রাত এগারোটা মুখর এখন চলে যাবে। দিনের বেলায় তো আর এই বাড়ি থেকে বের হতে পারবে না কখন কি হয়। তাছাড়া এই বাড়িতে থাকাটাও সেফ নয় যেকোন সময় কেউ দেখে ফেলতে পারে। তাই ও ডিসাইড করেছে চলে যাবে। গাড়ি নিয়ে কেউ পাকা রাস্তায় মুখরের জন্য অপেক্ষা করছে সেটায় করেই সে বাড়ি যাবে। হুট করে মেহবিন বলল,,
“আপনার আজ যাওয়ার কি দরকার ছিল আরেকটা দিন এখানে থাকতে পারতেন তো?”
“দরকার ছিল তাই যাচ্ছি।”
“এখন তো আপনি সুস্থ না আরেকটা দিন থাকুন না। আমার একটুও অসুবিধা হবে না।”
“সরি বিহঙ্গিনী তোমার কথাটা রাখতে পারলাম না। তুমি টেনশন করো না। অসুস্থতার জন্য ছুটি দিয়েছেন আমাকে আজ একেবারে বাড়ি যাবো।সামনের সপ্তাহে আসবো।ও তোমাকে তো একটা কথা বলতে ভুলেই গেছিলাম। শুক্রবার নাফিয়াকে দেখতে আসবে।”
“ওহ আচ্ছা! আমিও শুক্রবার একটা কাজে ঢাকায় যাবো।
“আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে এখন আসি নিজের খেয়াল রেখো আর সাবধানে থেকো।”
“বাসায় গিয়ে কল করবেন সাবধানে যাবেন আমি অপেক্ষায় থাকবো।”
“হুম আল্লাহ হাফেজ ফি আমানিল্লাহ।”
“ইনশাআল্লাহ আল্লাহ হাফেজ।”
মুখর বেরিয়ে গেল মেহবিন বারান্দা থেকে দেখলো।তারপর রুমে চলে গেল। আর মুখরের ফোনের অপেক্ষা করতে লাগলো। কয়েক ঘন্টা বাদে মুখর জানালো সে সেফলি পৌঁছে গেছে। মেহবিন নিশ্চিন্ত ঘুমিয়ে পরলো। অসুস্থতার জন্য তিনদিন ছুটি নিয়েছিল সে। কাল আবার হাসপাতালে যেতে হবে।
পরদিন থেকে মেহবিনের জীবন নরমাল দিনের মতোই শুরু হলো। ফজরের নামাজ নাস্তা বানানো তাজেল কে পড়ানো নাস্তা করে রেডি হয়ে হাসপাতালে যাওয়া।তাজেল অবশ্য মুখরের কথা জিজ্ঞেস করেছিল মেহবিন বলেছে চলে গেছে। দুপুরের দিকে মেহবিনের হাসপাতালে একটা পার্সেল আসে। মেহবিন পার্সেল টা খুলতেই দেখতে পেল কতগুলো অর্কিড ফুল আর তার ওপরে একটা চিঠি। সে মুচকি হেসে চিঠিটা খুলতেই তাতে লেখা,,
“অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে কাব্যের বিহঙ্গিনীর সাথে দেখা হয়েছিল কিন্তু আশেপাশে ফুল আর পরিস্থিতি ছিল না বলে দেওয়া হয় নি। তবে জানি এটা নিয়ে বিহঙ্গিনীর মনে একটুও মন খারাপ কিংবা আক্ষেপ কোনটাই নেই। এমনকি তার মাথাতেও নেই তার কাব্য তাকে ফুল দেয় নি। তবুও আমার কথা তো আমি রাখবো তাই না। ফুল গুলো নিয়ে মুচকি একটা হাঁসি দিও সেটাই আমার প্রাপ্তি।”
ফুলের সাথেও একটা চিরকুট আছে। মেহবিন মুচকি হেসে সেই চিঠিটা খুলল সেটায় লেখা,,
‘আমার প্রতিটা সাক্ষাতের ফুল তুমি, আমার বর্ষনের ফোটায় তুমি, আমার অসীম ভালোবাসায় তুমি, আমার বিশ্বাসে তুমি, আমার চাঁদমাখা রাতের অনুভূতিতে তুমি, আমার একরাশ মায়া তুমি,আমার একাকী গহীন অনুভবে তুমি,আমার সচেতন মনে তুমি ,আমার নির্ঘুম রাতের একাকী নিঃশ্বাসে তুমি, আমার তোমায় ভেবে বিষাদে তুমি, আমার হুট করে মুচকি হাঁসির কারন তুমি,আমার আবেগ মাখা চিঠিতে তুমি, আমার কবিতায় তুমি, আমার যত্নে তুমি, আমার প্রাপ্তিতে তুমি,আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসায় তুমি।আমার পুরোনো প্রাপ্তির তারিখে তুমি। সবশেষে ভালোবাসি তোমায় আমি।”
এরকম আবেগমাখা চিরকুট দেখে কারো মুখে কি হাঁসি না ফুটে থাকতে পারে। মেহবিন মুচকি হেসে চিরকুট টা বারবার পরতে লাগলো এটা যে কতটা ভালোলাগার অনুভূতি তা বোঝানো সম্ভব নয়।
~চলবে,,