#স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৪৮
আরাবী রাস্তায় পরে আছে।এইতো আর একটু হলেই গাড়িটা ওর উপর দিয়ে চলে যাবে।আরাবীর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরল।তাহলে কি এভাবেই মৃত্যু হবে ওর?এইভাবেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হবে?ওর বাচ্চাটা?ওর বাচ্চাটার কি হবে?সে যে এখনও পৃথিবীর আলোই দেখতে পেলো না।আর জায়ান?এই মানুষটাকে তো জানানোই হলো নাহ যে সে বাবা হতে যাচ্ছে।আরাবী চোখ বন্ধ করে নিলো।চোখের সামনে ওর পুরো পরিবারের হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী ভেসে উঠল।আর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ জায়ানের সাথে কাটানো সময়গুলোর কথা মনে পরতে লাগল।তবে ভাগ্য বোধহয় একটু সহায় হলো আরাবীর উপর।তাইতো চলন্ত গাড়িটি একদম আরাবীর থেকে অল্প ক্ষানিকটা দূরেই ব্রেক কষলো।একটুর জন্যে গাড়ির নিচে চাপা পরা থেকে বেঁচে গেলো। এদিকে জায়ান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ঠিক কি থেকে কি হয়ে গেলো সবটা যেন আচমকা কোনো দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে। সজ্ঞানে আসে জায়ান নূরের চিৎকারে।নূর ‘ ভাবি ‘ বলে চিৎকার করে উঠে।হুশে আসতেই জায়ান একদম পাগলের মতো দৌড়ে যায় আরাবীর কাছে।আরাবীর রক্তে রাস্তার অনেকটুকু জায়গা লাল হয়ে গিয়েছে।জায়ান হাটু মুড়ে বসে পরে আরাবীর কাছে।তারপর আরাবীকে আঁকড়ে ধরে টেনে বুকে নিয়ে আসে।চিৎকার করে ডাকতে থাকে,
‘ আরাবী চোখ খুলো।আরাবী?শুনছ?কিছু হবে না তোমার।’
আরাবীর এখনও পুরোপুরি জ্ঞান হারায়নি।ওর কানে জায়ানের আওয়াজ পেতেই ঝাপ্সা দৃষ্টিতে তাকায় আরাবী।এইতো এইযে মানুষটার বুকে আছে ও।এখন মরে গেলেও কোনো আফসোস থাকবে না।নাহ,এটা বললে ভুল হবে।একটা আফসোস থেকে গেলো আরাবীর।ওদের সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে পারলো না আরাবী।আচ্ছা মরার আগে লোকটাকে একবার এই কথাটা জানিয়ে গেলে হয় নাহ?অন্তত মরার পর আর আফসোস থাকবে না যে ও নিজে পারেনি প্রিয় মানুষটাকে সবচেয়ে বড়ো খুশির কথাটি।আরাবী শুকনো ঢোক গিলল।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর।বার বার চেষ্টা করছে কথা বলার। কিন্তু পারছে না।যন্ত্রণায় চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।বন্ধ হয়ে আসছে ওর নিঃশ্বাস।
এদিকে আরাবীর র’ক্ত পরছে।নূর নিজের গায়ের ওড়না খুলে নিলো।সেটা নিয়ে আরাবীর পাশে বসে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘ ভাবির রক্ত পরা বন্ধ হচ্ছে না।এটা দিয়ে বেধে দেও ভাইয়া জায়গাটুকু।অল্প হলেও র’ক্ত পরা একটু কমবে।’
এদিকে আহাদ নিজের গায়ের কোট খুলে নূরের গায়ে জড়িয়ে দিলো।জায়ান যেন নূরের কথা শুনেই নি।ও কেমন যেন পাগলের মতো করছে।নূর নিজেই আরাবীর আঘাতের জায়গাটুকু বেধে দিলো কৌশলে।এদিকে আহাদ জায়ানের কাধে হাত রাখল।ভেজা কণ্ঠে বলল,
‘ ভাইয়া।ভাবিকে হসপিটাল নিতে হবে।এখনও ভাবির জ্ঞান আছে।সময় থাকতে ভাবিকে নিয়ে চলুন।’
হসপিটালের কথা শুনতেই টনক নড়ে জায়ানের।হ্যা,আরাবীকে হসপিটালে নিতে হবে।ওর চিকিৎসা করাতে হবে।কিচ্ছু হতে দিবে না ওর কাঠগোলাপকে।জায়ান আরাবীকে পাঁজাকোলে তুলে নেয়।পাশেই যেহেতু হসপিটাল তাই দ্রুত সেখানে নিয়ে যায় আরাবীকে জায়ান।ডক্টর নার্সদের ডেকে একাকার করে ফেলে পুরো হসপিটাল।চিৎকার করে বলছে,
‘ ডক্টর, নার্স আমার স্ত্রীকে বাঁচান।ওর যেনো কিছু না হয়।ওর কিছু হলে এই পুরো হসপিটাল আমি ধূলোয় মিশিয়ে দিবো।কাম ফাস্ট। সেইভ হার এট এনি কস্ট।’
ডক্টর, নার্স দ্রুত আসল।আরাবীকে স্ট্রেকচারে শোয়ানো হলো।যখনই নিয়ে যাওয়া হবে।আরাবীকে জায়ানের হাত আঁকড়ে ধরল।জায়ান দেখল আরাবীকে কিছু বলতে চাইছে।অনেক কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা।জায়ান ওর মুখটা নিচু করে আরাবীর ঠোঁটের কাছে আনল।আরাবীর ঠোঁটজোড়া কাঁপছে।নিঃশ্বাস নিচ্ছে জোড়ে জোড়ে।যেন মেয়েটা অনেক যুদ্ধে করছে।প্রিয় মানুষটাকে শেষবারের জন্যে কিছু বলার।অবশেষে নিজের সাথে যুদ্ধ করে আরাবী বহু কষ্টে উচ্চারণ করল,
‘ আপ..আপনি বা..বাবা হতে যা..যাচ্ছিলেন জায়ান।’
ব্যস,এটুকু বলেই জ্ঞান হারায় মেয়েটা।ডক্টর’রা আর এক মিনিটও অপেক্ষা করল না।অবস্থা খারাপ।দ্রুত আরাবীকে নিয়েই ওটিতে প্রবেশ করল।এদিকে আরাবীর উচ্চারণকৃত শব্দগুলো একে একে কানে বাঁজতে লাগল জায়ানের।কি বলে গেলো মেয়েটা?ও বাবা হতে চলেছে।জায়ান ধপ করে হাটু মুড়ে ফ্লোরে বসে পরল।এ কি হলো?কেন হলো?ওর আরাবী,ওদের সন্তান। কি দোষ করেছিলো ওরা?যে আজ ওদের সাথে এরকমটা হলো।
জায়ান ওর হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো।এইতো মেয়েটার হাত ওর হাতের মাঝেই ছিলো অল্প কিছুক্ষণ আগেও।আর এখন শূন্য পরে আছে হাতজোড়া।
এইভাবেই স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো আধাঘন্টা জায়ান।আহাদ জায়ানকে উঠাতে চাইলেও উঠে না জায়ান।এদিকে একটু পরেই আরাবী আর জায়ানের পুরো পরিবার এসে পৌছায় হসপিটালে।অসুস্থ মিহান সাহেবও এসেছেন।সবাই কাঁদছেন।লিপি বেগম তো হুসপিটালে এসে মেয়ের অবস্থা ভালো না শুনেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন।ওনার প্রেসার বেড়ে গিয়েছে।উনাকেও এডমিট করা হলো। নিহান সাহেব ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে ছেলের কাছে গিয়ে বসলেন।জায়ান এখনও সেভাবেই বসে আছে।নিহান সাহেব জায়ানের কাধে হাত রাখলো।বাবার হাতের ছোঁয়া পেয়ে জায়ান এইবার নড়ে উঠল।তারপর লাল হয়ে যাওয়া চোখজোড়া তুলে তাকালো বাবার দিকে।নিহান সাহেব ছেলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
‘ চিন্তা করিস না বাবা।বউমা ঠিক হয়ে যাবে।কিছু হবে না।’
জায়ান বাবার ভরসার হাত পেয়ে যেন আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।ঝাপ্টে ধরল বাবাকে।ছোটোবেলা ব্যথা পেলে যেভাবে বাবার কাছে এসে তার কোলে চড়ে উঠত।এরপর মুখ লুকোতো বাবার কাধে। ঠিক সেইভাবেই নিহান সাহেবকে জড়িয়ে ধরে তার কাধে মুখ লুকালো জায়ান।নিহান সাহেব ছেলের মাথায় আর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।তিনি জানেন ছেলে তার ভেতরে ভেতরে দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে না।এতোক্ষণ একটা ভরসাযোগ্য স্থান পাচ্ছিলো না নিজের মনটা হালকা করার জন্যে।
বাবার সান্নিধ্যে এসে শক্ত ব্যক্তিত্বের জায়ান যেন ভেঙ্গে পরল।নিহান সাহেব আর ঘাড়ে ভেজা ভেজা কিছু অনুভব করলেন।নিহান সাহেব বুঝতে পারলেন ছেলে তার কাঁদছে।নিহান সাহেবরও চোখ ভিজে উঠল।ভেজা কণ্ঠে তিনি বললেন,
‘ কাদিস না বাবা।আল্লাহ্’কে ডাক।তার অনুমতি ছাড়া একটা গাছের পাতাও নড়ে না।তিনি যা ভালো মনে করেন তাই করবেন।একটু নিজেকে সামলা।’
জায়ান আরেকটু শক্ত করে ধরল ওর বাবাকে।ছোটোবেলায় কষ্ট পেলে যেভাবে বাবার কাছে সন্তানেরা নালিশ করে ঠিক সেইভাবেই বলে উঠল,
‘ আমার আরাবী কি ক্ষতি করেছে ওদের বাবা?ওরা কেন ওকে এতো কষ্ট দিলো।আমার চোখের সামনে ওরা আমার আরাবীর সাথে এমনটা করল।আর আমি?আমি কিছুই করতে পারলাম না বাবা।আর আমাদের সন্তান?ও কি দোষ করেছে বাবা?বেচারা তো এখনও পৃথিবীর আলোও দেখতে পারলো না।এমনকি ঠিকভাবে কেউ ওর অস্তিত্বের কথাও জানতে পারলো না।ওকে কেন এতো কষ্ট পেতে হলো?জানো বাবা,আমি বাবা হতে যাচ্ছি।এই কথাটা মেয়েটা বলার জন্যে কেমন ছটফট করছিলো।কতো কষ্ট আমাকে এই কথাটা বলেছে জানো তুমি।আমি এইসব কিভাবে সহ্য করব বাবা?আমার আরাবীকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেও বাবা।আমার বাচ্চাটাহকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেও।আরাবীকে ছাড়া আমি বাঁচবো না বাবা।আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছে।আমি কি করব বাবা?কি করলে আমার আরাবী ঠিক হয়ে যাবে। তুমি আমাকে বলো বাবা। বলো!’
কথাগুলো বলেই এইবার ফু্ঁপিয়ে কেঁদে উঠল জায়ান।তবে কান্নার আওয়াজ খুবই ক্ষীণ।একমাত্র বোধহয় নিহান সাহেবই শুনতে পেলেন ছেলের আহাজারি।ছেলের মুখের প্রতিটা শব্দে যেন তার বুক কেঁপে উঠল।তিনি দাদা হবেন।।সাখাওয়াত বাড়ির নতুন ওয়ারিশ আসতে চলেছে।আর এইসব কি ঘটে গেলো।এতো কষ্ট তার ছেলেটা কিভাবে সহ্য করছেন?তিনি আর জায়ানকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পেলেন না।
এদিকে ক্ষানিক বাদেই ওটির দরজা খুলে বের হলেন ডক্টর।ওটির দরজা খোলার আওয়াজ পেতেই জায়ান উঠে দাঁড়াল।দ্রুত পায়ে ছুটে গেলো ডক্টরের কাছে।গিয়েই অস্থিরভাবে বলে উঠল,
‘ ডক্টর?আমার ওয়াইফ?ও ঠিক আছে তো?কি হলো বলছেন না কেন?’
ডক্টর হালকা শ্বাস নিলেন।বললেন,
‘ মিথ্যে ভরসা আমরা দেবো না মি.জায়ান সাখাওয়াত।আপনার ওয়াইফের অবস্থা ভালো না।আর তিনি প্রেগন্যান্টও ছিলেন।বাঁচার চান্স টেন পার্সেন্ট।’
ডক্টরের মুখে কথাটা শুনে জায়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।ও হুংকার ছুড়ল,
‘ আমার বউ, বাচ্চার কিছু হলে মেরে ফেলব আমি তোমাদের।একটাকেও আস্ত রাখব না।’
জায়ান তেড়ে যেতে নিলো।ইফতি আর আহাদ গিয়ে ধরল জায়াবকে।জায়ানকে যেন আটকে রাখা দ্বায়।ও আজ উন্মাদ হয়ে গিয়েছে।ডক্টর
ইফতি বলে উঠল,
‘ ডক্টর!আপনি যান প্লিজ।আমার ভাবিকে বাঁচান।’
এদিকে জায়ান জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিলো।নিজেকে ক্ষানিকটা শান্ত করল।তারপর বলল,
‘ আমাকে ছাড় তোরা।ডক্টরের সাথে আমার কিছু কথা আছে।’
ইফতি আর আহাদ ভয়ে ভয়ে ছেড়ে দিলো জায়ানকে।জায়ান না আবার উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে।কিন্তু না এমনটা কিছু হয়নি।ডক্টরের সাথে একটু সাইডে গিয়ে কথা বলল জায়ান।এর কিছুক্ষণ পর ডক্টর আবার ওটিতে চলে গেলেন।
এরপর কেটে গেলো গোটা একটা ঘণ্টা।জায়ান চুপচাপ ওটির সামনেই বসে রইলো।একঘণ্টা পর ডক্টর বের হলেন ওটি থেকে।
জায়ান এইবার এগিয়ে গেলো ডক্টরের কাছে।ওর আরাবী ভালো আছে। এই কথাটা শোনার জন্যে যেন ওর কান আর মন দুটোই ব্যাকুল হয়ে উঠল।জায়ান শুকনো ঢোক গিলল।বলল,
‘ ডক্টর?আমার ওয়াইফ আর বাচ্চা?ওরা ঠিক আছে তো?’
ডক্টর সবার দিকে তাকালেন।এরপর জায়ানের দিকে তাকিয়ে হতাশ কণ্ঠে বলে উঠল,
‘ উই আর এক্সট্রেমলি সরি মি.জায়ান সাখাওয়াত।আমরা আপনার ওয়াইফ আর বাচ্চা কাউকেই বাঁচাতে পারেনি।আমাদের ক্ষমা করবেন আপনারা।আমরা আমাদের বেস্টটাই ট্রায় করেছি।বাট পসিবল হয়নি।উনার অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়েছে যার কারনে আমাদের পক্ষে আর সম্ভব হয়নি।’
#চলবে__________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।কেমন হয়েছে জানাবেন।
eto kom porbo post koren kno