স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ #সাদিয়া_জাহান_উম্মি #পর্বঃ৪৯

0
630

#স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৪৯
আরাবীর জানাযা পরিয়ে ওকে কবর দেওয়া-ও শেষ।পুরো পরিবার যেন নিমেষেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে।এমন পরিস্থিতি।
ফাহিম একা হাতে ওর বাবা আর মাকে সামলাচ্ছে।কি থেকে কি হয়ে গেলো?আদরের বোনটা যে এভাবে ওদের ছেড়ে চলে যাবে কোনোদিন ভাবেনি।ফাহিম পুরুষ মানুষ।আর পুরুষ মানুষদের নাকি কাঁদতে নেই।একে একে আরাবীর সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত মনে পরছে আরাবীর।কয়েকদিন আগের কথাও মনে পরছে ফাহিমের।এইতো কদিন আগেই ফাহিমকে সাখাওয়াত বাড়িতে আসার জন্যে কতো রিকুয়েষ্ট করল।কিন্তু ফাহিম আসেনি।আরাবীকে ওদের বাসায় আসতে বলে দিয়েছিলো।মূলত নূরের সাথে যেন ফাহিমের দেখা না হয়।নূরের থেকে দূরত্ব বজায় রাখার জন্যেই ফাহিম আর এই বাড়িমুখো হয়নি।এখন আফসোস হচ্ছে।সামান্য কিছু মিছে অনুভূতির কারনে বোনটাকে কষ্ট দিয়েছিল ফাহিম।মিছে অনুভূতিই তো।নূর অন্যকারো বাগদত্তা। আর তার জন্যে ওর মনে যেই অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিলো।সেগুলো ফেলনা।কোনো দাম নেই সেই অনুভূতির। আজ এই কারনে আরাবীর সাথে আরেকটু বেশি সময় কাটাতে পারল না ফাহিম।বোনটা কতো করে বলতো এসে একটু দেখা করে যেতে।ফাহিমের চোখ ভিজে উঠে।তবুও নিজেকে সামলে নেয়।নাহ,কাঁদলে হবে না।ওকে শক্ত হতে হবে।ফাহিম শুকনো ঢোক গিলল।তাকালো ওর মায়ের দিকে।যে নিস্তেজ হয়ে পরে আছে ওর বাহুতে।বাবারও একই অবস্থা।তিনি নির্জীব প্রায়।ফাহিম বাবা মায়ের এই করুণ অবস্থা দেখে ওর বুকটা হু হু করে উঠল।
মনে মনে বলল,
‘ আরু!আরু রে।দেখ আজ তুই আমাদের কোথায় এনে দাঁড় করালি বোন।তোকে ছাড়া আমাদের নিঃশ্বাস আটকে আসছে।আমার বিশ্বাস হচ্ছে না রে আরু।এই দুটো হাত দিয়ে তোকে ওই অন্ধকার মাটির ঘরে শুইয়ে এসেছি।বাবা মাকে যে আমি সামলাতে পারছি না রে আরু।কেন চলে গেলি বোন?কেন?’

আহা,সে কি হাহাকার।কিন্তু এই হাহাকার শোনার জন্যে যে আরাবী নেই।নেই কোথাও ওর ছায়া।
—-
আলিফা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে।প্রাণপ্রিয় বান্ধবী যে আর নেই এটা মেনে নিতে পারছে না আলিফা।বুকটা যে বড্ড ব্যথা করছে।কতো শতো প্লান করে রেখেছিলো আজ কি কি করবে ওরা দুজন।এটাও বলেছিল ভীষণ বড়ো সার্প্রাইজ নাকি আছে ওর জন্যে।সেটা যে ও খালামুনি হতে যাচ্ছিলো এটাই জানাতে চেয়েছিলো আরাবী।সেটা আলিফা জানে।আলিফা দুহাতে মুখ চেপে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠল এইবার।ঠিক তখনই কাধে কারো হাতের ছোঁয়া পেতেই কেঁপে উঠে আলিফা।পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে ইফতি কোমল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে।ইফতিকে দেখে এইবার যেন আরও ভেঙ্গে পরল আলিফা।দুহাতে ঝাপ্টে ধরল ইফতি।তারপর শব্দ করে কেঁদে উঠল।কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,
‘ এটা কেন হলো ইফতি?বলতে পারেন?ওর তো কারো সাথে কোনো শত্রুতামি ছিলো না ইফতি।ও তো অনেক ভালো একটা মেয়ে ছিলো।কারো সাথে উঁচু গলায় কথা অব্দি বলতো না।তবে কেন ওকে মে’রে ফেলল?আর ওই নিস্পাপ বাচ্চাটাহ?ওর কি দোষ ছিলো?মানুষ এতো নিষ্ঠুর কেন ইফতি?’

ইফতি কি বলবে কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।ভালোবাসার মানুষটাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কিছুই নেই আজ ওর কাছে।ইফতি ব্যথাতুর ঢোক গিলল।আলিফার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিস্তেজ কণ্ঠে বলল,
‘ সব ঠিক হয়ে যাবে আলিফা।সব ঠিক হয়ে আছে।পরিস্থিতি বদলাবে। যারা অন্যায় করেছে তাদের শা’স্তি পেতে হবে।সে যেই হোক না কেন?’

আলিফা কাঁদতে লাগল ইফতির বক্ষে মুখ গুজে।

মায়ের মতো ভাবিকে হারিয়ে নূরের অবস্থাও খারাপ।বার বার আরাবীর সেই রক্তে মাখা দেহটা চোখে ভাসছে নূরের।এইতো সকালেও তো কি সুন্দর দুজন হাসিখুশি ছিলো।ও ফুপি হতে যাচ্ছে।খবরটা দেওয়ার সময় আরাবীর চোখেমুখে অন্যরকম দীপ্তি ছড়াচ্ছিল।কি সুন্দর লাগছিলো মেয়েটাকে।কতো কিছু পরিকল্পনা করল দুজন মিলে।জায়ান যে বাবা হতে যাচ্ছে সেটা কিভাবে জানাবে জায়ানকে।কিন্তু এক নিমিষেই কেমন যেন সব অন্ধকারে তলিয়ে গেলো।বাচ্চাটাও পৃথিবীর আলো দেখতে পেলো না। মায়ের সাথে তাকেও দুনিয়া ছাড়তে হলো।
ড্রয়িং রুমের কোণায় দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আছে নূর।এমনসময় সামনে এসে বসল আহাদ।নূরের বেহাল অবস্থা দেখে ওর বুকটা জ্বলছে।আহাদ নূরের মাথায় হাত রাখল।নূর চোখ উঠিয়ে তাকালো আহাদের দিকে।নূরের চেহারের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে আহাদের বুকটা ধরাস করে উঠল।দ্রুত নূরকে দুহাতে টেনে নিজের কাছে আনল।নূর আহাদের বুকের কাছের শার্ট খামছে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।এতোক্ষণ পর যেন একটা ভরসা যোগ্য স্থল পেলো।যেখানে নূর মন খুলে কাঁদতে পারবে।নূর কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘ ভাবিকে এনে দিন আহাদ।এনে দিন।আমার ভাবিকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে দিন না আহাদ।আপনি তো আমার চোখের পানি দেখতে পারেন না তাই নাহ?তাহলে এখন কিভাবে সহ্য করছেন?ভাবি!!!!!! জানেন?আমি ফুপি হতে যাচ্ছিলাম।বাবুটাকেও ওরা বাঁচতে দিলো না।কেন এমন করল ওরা?’

আহাদ চুপ করে আছে।নূরের এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিলো না আহাদ।শুধু বলল,
‘ শান্ত হও নূর।নিজেকে সামলাও।এভাবে ভেঙে পরলে চলবে?জায়ান ভাইয়ার কথাটাও তো একবার ভাবো নূর।তার কেমন লাগছে।’

জায়ানের কথা মাথায় আসতেই আহাদের থেকে সরে বসল নূর।আহাদ তাকিয়ে আছে নূরের দিকে।নূর দুহাতে চোখ মুছে নিলো।তারপর হঠাৎই চোয়ালদ্বয় শক্ত করে নিলো।বলল,
‘ ভাইয়াকে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।কেন এমনটা হতে দিলো ভাইয়া।’

নূর উঠে দাঁডালো।মনের মধ্যে ক্রোধ যেন সব জমা হয়েছে জায়ানকে নিয়ে।ভয়ানক রেগে নূর দৌড় লাগালো জায়ানের কাছে যাওয়ার জন্যে।নূরের পাগলামো দেখে আহাদও ঘাবড়ে গেলো।মেয়েটা না আবার উল্টাপাল্টা করে বসে। এদিকে নূর এক দৌড়ে জায়ানের রুমের সামনে হাজির হলো।তারপর ধুপধাপ বারি দিতে লাগল দরজায়।চিৎকার করে বলছে,
‘ ভাইয়া দরজা খুলো।খুলো বলছি।ভাইয়া।’

আহাদ এসে নূরের হাত ধরে থামালো।ওকে বোঝাতে চাইলো।
‘ নূর এমন করো না।ভাইয়ার অবস্থা এমনিতেই ঠিক নেই।তুমি এমন করলে কিভাবে হয়?’

নুর রাগি চোখে তাকালো আহাদের দিকে।ওর চোখ থেকে পানি পরেই যাচ্ছে।নূর চিৎকার করে বলে উঠল,
‘ ভাইয়ার কারনেই ভাবি আজ আমাদের মাঝে নেই।আমি ভাইয়াকে সতর্ক করেছিলাম।সে শোনেনি আমার কথা।যদি শুনতো তবে আজ ভাবি আমাদের সাথে থাকতো।’

আহাদ নরম গলায় বলে,
‘ পাগলামি করে না নূর।মৃত্যুর উপরে আমাদের কারো হাত নেই।আল্লাহ্ কখন,কাকে,কিভাবে দুনিয়া ছাড়ার জন্যে ডাক দিবেন সেটা কেউ বলতে পারেন না।’

নূর যেন কিছুতেই শুনছে না আহাদের কথা।ও বার বার একই কথা বলছে,
‘ ভাইয়ার জন্যে হয়েছে সব।ভাইয়া কেন সাবধান হলো না।’

এমন সময় জায়ানের রুমের দরজা খুলে গেলো।নূর আর আহাদ সেদিকে তাকায়।আরাবীকে ক’বর দেওয়া হলে জায়ান এসে সেইযে নিজের রুমে ঢুকেছিলো আর বের হয়নি।নুরের চিৎকারে মাত্রই খুলল দরজা।জায়ান লাল চোখজোড়া নিয়ে খুব শান্তভাবে নূরের দিকে তাকিয়ে আছে।তারপর শীতল কণ্ঠে বলে উঠল,
‘ এভাবে চেঁচামেচি করছিস কেন?নিজের রুমে যা।’

নূর জায়ানের কথায় যেন ক্রোধে আরও ফেটে পরল।ও তেড়ে গিয়ে জায়ানের বুকে এলোপাথাড়ি মারতে লাগল।কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল,
‘ তোমার জন্যে হয়েছে সব।তোমার কারনে ভাবি মা’রা গেলো।আমি বলেছিলাম ও ভাবিকে মে’রে ফেলবে।তুমি কিছু করো।তুমি পাত্ত দিলে না।তুমি শুনলে না আমার কথা।তোমার বেখায়ালিপনার কারনে আজ তুমি একই সাথে নিজের স্ত্রী আর সন্তান দুটোকেই হারালে ভাইয়া।বড়ো ভাই আর ভাবি তো বাবা মায়ের সমান হয় নাকি লোকে বলে।।আমি তো একবার মা হারিয়েছি ভাইয়া।ভাবির আদর স্নেহে নিজের মাকে অনুভব করতাম।তোমার কারনে আমি তাকেও হারিয়ে ফেললাম ভাইয়া।আর ওই সুহানাকে আমি ছাড়বো না।ছাড়বো না আমি।ও কারো সুখ সহ্য করতে পারে না।অনেক হয়েছে।আর কতো ওই মহিলার অত্যাচার সহ্য করব আমরা।তুমি কি এইভাবে চুপ থাকবে?আর কতো নিঃশেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছ?’

জায়ান এইবার টেনে নূরকে বুকে জড়িয়ে ধরল।নূর চিৎকার করে কাঁদছে।জায়ানের চোখজোড়া রক্ত লাল হয়ে উঠেছে। নূরকে শান্ত করতে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।শান্ত কণ্ঠে জায়ান বলে,
‘ হুশ! শান্ত হ।এসব কথা এতো জোড়ে বলিস না।সব ঠিক হয়ে যাবে।ভাই সব ঠিক করে দিবে।ভাইয়ের উপর বিশ্বাস রাখ।
আর আমার অন্যায়কারী শা’স্তি পাবে অবশ্যই।আমার স্ত্রী,সন্তানকে যে এইভাবে কষ্ট দিয়েছে।তাকে এর থেকেও একশগুন বেশি কষ্ট পেতে হবে।আমার আরাবী ব্যথায় যতোটা ছটফট করেছে তাকে এর থেকেও বেশি ছটফট করতে হবে।সে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে প্রতিনিয়ত মৃ’ত্যু কামনা করবে। কিন্তু মৃ’ত্যু তাকে এতো সহজে আমি দিবো না।ভিক্ষা চাইবে আমার কাছে মর’ণ।এতো সরজে তো মৃত্যু তাকে আমি দিবো না।আজ থেকে তার যন্ত্রণার প্রহর শুরু।আমার ভালোবাসার মানুষকে আমার থেকে আলাদা করার জন্যে।তাকে যেই যন্ত্রণাময় মৃত্যু আমি দিবো।তা দেখে মৃ’ত্যুও ভয় পেয়ে যাবে।’

চোয়াল শক্ত করে কথাগুলো বলল জায়ান।চোখ জোড়া তার হিংস্র সিংহের ন্যায় জ্বলজ্বল করছে।যেন এইতো নিজের শিকারের উপরে যেকোনো সময় ঝাপিয়ে পরবে।বাঁচতে সুযোগ দিবে না বিন্দুমাত্র।

#চলবে__________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।কেমন হয়েছে জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here