স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ #সাদিয়া_জাহান_উম্মি #পর্বঃ৫০

0
640

#স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৫০
আঁধার রাত্রি।শীত শীত আবহাওয়া চারদিকে।রাতটা কেমন যেন থমকে আছে।কোনো সারাশব্দ নেই।নিস্তব্ধ,নির্জন।
এই অন্ধকার রাতের মধ্যে কক্ষটার দরজা জানালা বন্ধ করে আরও অন্ধকার করে রেখেছে জায়ান।দুচোখে যেন কেউ কিছুই দেখতে পারবে না এমন অবস্থা।বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে আছে জায়ান।দৃষ্টি জোড়া ওর সিলিং এর দিকে। কেমন স্থির শান্ত হয়ে আছে ওই দু চোখ। তবে চোখ জোড়ার দিকে ভালোভাবে তাকালেই বুঝা যায়। কতটা দুঃখ আর কষ্টই চোখ জোড়ায়। হৃদয়ে কতটা ব্যথা তার। প্রিয় মানুষটা কাছে না থাকায় জায়ান যেন কেমন নির্জীব হয়ে আছে। এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিল জায়ান। এমন সময় অন্ধকার নিস্তব্ধ রাত্রির মধ্যেই জায়ানের ব্যথাতুর কণ্ঠস্বর শোনা যায়।
‘ আমার বুকটা জ্বলে যাচ্ছে আরাবী। এতটা কষ্ট কেন লাগছে? তোমাকে ছাড়া সব কিছু শূন্য শূন্য লাগছে। আমার কাছে ফিরে আসো আরাবী। এই নিস্তব্ধতা আমি যে সহ্য করতে পারছি না। আমার যে দম আটকে আসছে কাঠগোলাপ। এই যে পাশে তুমি নেই এটা আমি কিভাবে সহ্য করব আরাবি? তুমি ছাড়া একটা দিন কল্পনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। সেই আমি গোটা দুটো দিন কাটিয়ে দিলাম তোমাকে ছাড়া। আমার কাছে ফিরে আসো আরাবী।প্রমিস করছি তোমাকে আর কোনদিন কষ্ট পেতে দিব না। আমি আর কোন কিছু ছন্নছাড়া ভাবে নিব না। তোমাকে সবটা দিয়ে রক্ষা করব। আর একটা আঁচও তোমার গায়ে লাগতে দিব না।তুমি আমাদের সন্তান। তোমাদের এই দুজন ছাড়া আমি কিভাবে বাঁচব। আমি তোমাদের দুজনকেই চাই। আমার পাশে চাই সব সময়। ‘

জায়ন চোখ বন্ধ করল। ওর চোখের কার্নিশ বেয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। সেভাবেই থেকে ভেজা কন্ঠে বলল,
‘ সবাই ভাবে আমি পাথর। আমার কোন অনুভূতি নেই। কিন্তু আমার কাঠগোলাপ তুমি তো জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। আমার এই দুর্বলতা আমি যে তোমাকে ছাড়া আর কাউকে দেখাতে চাই না। তুমি আমার শান্তি, তুমি আমার শক্তি। তোমাকে ছাড়া আমি অচঁল। তোমাকে ছাড়া এই দুটো দিন আমার কাছে জাহান্নামের সমান মনে হয়েছে। তোমাকে একা এত দূরে রেখে আমি কিভাবে থাকবো আরাবী।আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।তোমাকে বুকে না নিলে যে আমার ঘুম আসেনা। আমি কিভাবে ঘুমাবো আরাবী? তোমার জায়ানকে এভাবে কষ্ট দিও না। আমার কাছে ফিরে আসো। ‘

এক অসহায় স্বামীর আর্তনাদ এর সাক্ষী রইল এই নিস্তব্ধ রাত। সে তার স্ত্রীকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। এই গোটা রাতটা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারল। জায়ানের কানে এখনো বারবার বাজছে সেই কথাগুলো।
‘ আ..আপনি বাবা হ..হতে যাচ্ছেন জা..জায়ান।’

নিষ্ঠুর সত্য যে জায়ান কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না তার আরাবী তার কাছে নেই। এই একলা ঘরে জায়ান যেন তার শক্ত খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে।বুকের মাঝে জমে থাকা কষ্টগুলো নিস্তব্ধে অশ্রু হিসেবে ঝরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আদৌ কি এই কষ্টের সমাপ্তি আছে?
——
পরের দিন সকালবেলা জায়ানের রুমের সামনে আসলো নূর। সেদিন ভাইয়ের সাথে এভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি।তাই জায়ানের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছে। নুর দীর্ঘশ্বাস ফেলল।হাতে ওর খাবারের ট্রে।মিলি বেগমের কাছ থেকে শুনেছে জায়ান নাকি দুদিন ধরে কিছুই খায়নি। দেখবে জায়ানকে কিছু খাওয়াতে পারে কিনা। দুবাই দরজায় করাঘাত করল। কিন্তু না ওপাশ হতে কোন সারা শব্দ পাওয়া গেল না। নুর আবারও দরজায় আঘাত করলো। তারপর ধীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
‘ ভাইয়া খুলো। ‘

এইবার ও নিশ্চুপ। নুর আবারও বলে উঠলো,
‘ ভাইয়া দরজাটা খুলো। আচ্ছা ঐ দিনের জন্য আমি সরি। আর কখনো এরকম করব না। প্লিজ তুমি দরজাটা খুলো। ‘

জায়ানের কোন সারা শব্দ না পেয়ে এইবার নূর বেশ জোরেই দরজায় আঘাত করলো।আঘাত করতেই দেখল দরজাটা আপনাআপনি খুলে গিয়েছে। নূর অবাক হলো বেশ। জায়ান তো এরকম কোনদিন করেনা। নূর কে চিন্তিত দেখা গেল। ও কপাল কুঁচকে ভেতরে প্রবেশ করলো। পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে আছে। নূর লাইট অন করল। কিন্তু আশেপাশে তাকিয়ে জায়ানকে কোথাও দেখতে পেল না। নূর বারান্দায় গিয়ে দেখলো। ওয়াশরুমেও চেক করল। কিন্তু না জায়ান কোথাও নেই। নুর অবাক হলো বেশ হঠাৎ করে জায়ান কোথায় গেল। হঠাৎ নুরের চোখ যায় বিছানার সাথে লাগানো টেবিলটার দিকে। টেবিলটার উপরে কিছু খাম রাখা। নুর এগিয়ে গেল সেদিকে। খামগুলো হাতে নিল। তারপর খুলে দেখলো একটা আমি ব্ল্যাঙ্ক চেক আর একটা খামে একটা চিঠি। চিঠিটা খুলল আর নূর। তারপর আস্তে ধীরে সেটা পড়া শুরু করল।

‘ নূর আমি জানি তুই আমার রুমে আসবি। আর আমাকে চারদিকে খুঁজছিস। তবে আমাকে আর খুঁজে পাবি না। আমি এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি সেটা যেতে পারলাম না আমাকে ক্ষমা করিস। যেখানে আমার আরাবী আর আমার সন্তানের কোন অস্তিত্ব নেই। সেখানে আমি কিভাবে থাকি বল? এই রুম, এই বাড়ি সবকিছু আমাকে আরাবীর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। আমি থাকতে পারবো না এখানে বোন। আমি দম আটকে মরে যাব। আর কেউ না বুঝুক তুই তো আমাকে বুঝিস বল? শোন, বাবাকে সামনে নিস। বলিস যে আমার জন্য চিন্তা করতে না। আমি একদম ঠিক আছি। আর হ্যাঁ, ওই চেকটা কাজে লাগাস। যে কোন প্রয়োজনে ব্যবহার করবি। আমার জন্য তুই কোন চিন্তা করিস না সময় হলে আমি ফিরে আসবো। ইফতিকে বলিস অফিস টা ভালোভাবে সামলে নিতে। ভালো থাকিস বোন।

তোর ভাই,
সাফওয়ান জায়ান সাখাওয়াত ‘

চিঠিটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেল নূর। এটা কিভাবে হলো? তার ভাই এটা কিভাবে করতে পারে? এভাবে সবটা ছেড়ে চলে যেতে পারে কিভাবে? ওর ভাবির মৃত্যুর দুদিন পরে সবটা মাঝপথে ফেলে কোন কিছু না বলেই চলে যাওয়াটা তার ভাইয়ের স্বভাবের সাথে কি যায়? নুরের চোখ ভিজে উঠলো। দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল চোখ থেকে। নুর ভেজা কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ তুমি আমার স্বার্থপর কিভাবে হলে ভাইয়া? গোটা পরিবারটা এভাবে শোকের মাঝে ফেলে চলে যেতে পারলে? ফিরে আসো ভাইয়া ফিরে আসো। তোমাকে আমার আর বাবার খুব প্রয়োজন।’

নুর নিস্তব্ধে কাঁদতে লাগলো। তারপর ধীর পায়ে ওর কক্ষে চলে গেল। কেউ নেই ওর পাশে কেউ নেই। বড্ড একা একা লাগছে নিজেকে। চারদিক বিষাক্ত মনে হচ্ছে। এভাবে আর পরিবারটা এলোমেলো কেন হয়ে গেল? এমনটা হওয়ার তো কথা ছিল না?

জায়ান বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে খবরটা পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে গেল। নিহান সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লেন এই খবর শুনে। ডাক্তার এসে তার চেকআপ করছে। একসাথে এত ধাক্কা তিনি সামলাতে পারেননি। বাড়িতে শোকের মাত্রা যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। এদিকে জায়ানের গুম হয়ে যাওয়া খবর শুনে সুহানা সাখাওয়াতের অবস্থা প্রায় পাগল প্রায়। এভাবে তো তার সব প্লান ভেস্তে যেতে পারে না। এত প্লানিং করে অতঃপর সাবধানে আরাবীকে শেষ করল। যার জন্য এসব করা সেই যদি না থাকে তাহলে কিভাবে হবে? তার সমস্ত প্লান এভাবে ঘেঁটে যেতে পারে না।
সুহানা সাখাওয়াত উপায় পেলেন না কি করবেন। অস্থির হয়ে কক্ষের এই দিক ওদিক বাজারে করলেন। তারপর হুট করেই ফোন লাগালেন রাশেদ শেখের কাছে।
কিন্তু সেও ফোনকল ধরছে না। সুহানা অস্থির হয়ে বলতে লাগলেন,
‘ কি করবো আমি কি করবো? যে করে হোক জায়ানকে দেশে আনতে হবে। কিন্তু কিভাবে ও কোথায় আছে তাই তো আমি জানি না। ‘

ধপ করে বিছানায় বসে পড়লেন সুহানা। দুহাতে নিজের চুল টেনে ধরলেন। চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবছেন তিনি। এভাবে কিছুক্ষণ কেটে গেল। তারপর হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ালেন।হ্যাঁ, একমাত্র এখন তিনিই পারবেন সাহায্য করতে সুহানাকে। অনেক ভেবে চিন্তে এই বহু বছর পুরনো নাম্বারটাতে কল লাগালেন সুহানা। বড্ড ভয় ভয় করছে। কিন্তু উপায় নেই তার সাহায্য যে নিতেই হবে। প্রথম দুবার কল ধরলেন না ও পাশের ব্যক্তি। তৃতীয়বারের সময় কলটা রিসিভ হল। সুহানা ভয়ার্ত কন্ঠে বললেন,
‘ হে..হে হ্যালো? ‘

কলের ওপাশ হতে ভেসে আসে পুরুষালি কণ্ঠস্বর,
‘ কি চাই শর্টকাটে কথা শেষ করো।আমি জানি অকারনে কল করার মানুষ তুমি না। ‘

মানুষটার গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে ভয়ে কেঁপে উঠলো সুহানা।তাড়াহুড়ো করে মানুষটাকে কল করে কি বড্ড ভুল করে ফেলল?

#চলবে________

ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here