অদৃষ্টে_তুমি_আমি #রোমান্টিক_গল্প #লেখিকা_সিনথীয়া #পর্বঃ১

0
1033

#অদৃষ্টে_তুমি_আমি
#রোমান্টিক_গল্প
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্বঃ১

ছোট্ট পৃথা দৌড়াচ্ছে। খিলখিল করছে ওর মুখের হাসি। ও দৌড়াচ্ছে আর পেছনে দেখছে বারবার।
– আমাকে পারবে না ধরতে। হিহিহিহি।
স্বাধীন, পৃথার ঠিক পেছনে। আস্তে দৌড়াচ্ছে যাতে পৃথা মজা পায়। ও নিজেও হেসে বলছে পৃথাকে,
-তোকে ধরেই ফেলবো আজকে। আর এবার ধরলে কখনো ছাড়বো না। হাহাহাহা।
পৃথার হাসি যেন আরও এক মাত্রায় বেড়ে যায়।
– ধরো দেখি। ধরো তো…..

হঠাৎ বাস থেমে যাওয়ায় ঝটকা দিয়ে ঘুম থেকে উঠে যায় পৃথা। তন্দ্রা কেটে যায় দ্রুত তবে এক মুহূর্ত সময় লাগে আশপাশটা বুঝতে।
– স্বাধীন….। আমি কোথায়? ….ও বাসে।

জানালা দিয়ে দেখে পৃথা এখন কতটুকু পথ এসেছে। কুড়িল বাস স্ট‍্যান্ডে এ প‍ৌছেছে মাত্র। যাক্, এখনো নিজের গন্তব্যে পৌছায়নি তাহলে। আরও প্রায় দশ মিনিট লাগবে বনানী যেতে। বেশীও লাগতে পারে। ট্র‍্যাফিক জ‍্যামের তো কোনো ঠিক ঠিকানা নেই আবার।
নিজের সিটে হেলান দিয়ে একটা দম নিল পৃথা। আকাশটা আজ বড্ড সুন্দর লাগছে। একদম পরিষ্কার। রোদও খুব তীব্র না। আকাশ দেখতে দেখতেই স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে গেল ওর। আর ততক্ষণাত চেহারায় মলিনতা ছেয়ে গেল। আজ আবার স্বপ্নে স্বাধীনকে দেখেছে পৃথা, প্রায়ই দেখে সেই তেরো বছর আগের সতেরো বছরের স্বাধীণকে। কি মারাত্মক সুন্দর সেই হাসি। কি মায়াবী চেহারা। নিজের অজান্তেই পৃথা হেসে দেয়। কিন্তু পরমুহূর্তেই হাসি উধাও হয়ে যেয়ে আবার ফিরে আসে মলিনতা। স্বাধীন কে যে এখনো কেন দেখে ও? স্বাধীন তো মনে হয় ওর অস্তিত্বই ভুলে গেছে। তাহলে ও কেন ভুলতে পারে না স্বাধীনকে? মুহুর্তেই অজানা ক্ষোভ ভর করে পৃথার ঘাড়ে।
-হুহ্! আমার বয়েই গেছে ওকে নিয়ে চিন্তা করতে। যে আমায় ভুলে যেতে পেরেছে তাকে আমারও মনে রাখার কোন প্রয়োজন নেই।
হঠাৎ ফোনের কর্কশ আওয়াজ পৃথার চিন্তায় ব‍্যাঘাত ঘটায়। ব‍্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখে মা কল দিয়েছে।
– হ‍্যালো মা।
– কি ব‍্যাপার? আজ নাস্তায় এসব কি হাবিজাবি বানিয়ে রেখে গিয়েছিশ তুই? এগুলা খাওয়া যায়?
– কেন মা? রুটি, সব্জী আর সুজির পায়েশ করেছি তো।
– মাংস করিস নাই কেন? তুই জানিস না আমার রিনি এসব সব্জি, পায়েশ দিয়ে নাস্তা করতে পারে না?
– সরি মা… আজ আসলে অফিসের তাড়া ছিল। আজ আমাদের নতুন বস্…
– কিছু হইলেই শুধু ‘সরি মা’ বলে পার পেয়ে যেতে চাস, তাই না? তোর অফিসের তাড়া তাতে আমার কি?
– আচ্ছা মা, আজ বাসায় এসে মজা করে ভুনা গোশ করে দিবনি তোমাদের। আমার আজ রাতে আসতে একটু দেরী হবে, তবে এসেই করে দিব।
– কেন?দেরী হবে কেন আসতে?
– আমি বলেছিলাম তো তোমাকে গতরাতে, আমাদের কম্পানির নতুন মালিক আসার উপলক্ষ্যে আজ রাতে ডিনার আছে। এ‍্যাটেন্ড করতেই হবে। তবে তাড়াতাড়ি চলে আসবো আমি।
– তুই তাড়াতাড়ি আসবি কি না আসবি এটা আমার দেখার বিষয় না। তবে আমাদের মাংস রান্নায় যেন দেরী না হয়। বাস্। এখন রাখলাম।
– মা, শোনো। বাবার দুপুরের ঔষধটা বেড সাইড টেবিলেই রাখা। দিয়ে দিও।
-ইশ্! মনে হয় যেন এক তোরই চিন্তা আছে তোর বাপকে নিয়ে। আমরা তো কিছুই করি না তাই না?
এই বলে ঠাশ্ করে পৃথার মুখের ওপর ফোন রেখে দিলেন ওর সৎ মা ইয়াসমিন চৌধুরী। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে পৃথা মোবাইলটা নিজের ব‍্যাগে ঢোকালো। হাসলো মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি। কি জীবন ওর!

মা মারা গিয়েছেন তখন পৃথার মাত্র দশ বছর। দাদীর কাছেই বড় হওয়া ওর। চার বছর পর বাবাকে এক প্রকার জোর করেই আবার বিয়ে দিলেন পৃথার বড় ফুফু,রিতা আহমেদ, তার বান্ধবীর ছোট বোনের সাথে। তিনিও ডিভোর্সড, এক সন্তানের জননী। অতঃপর ওদের জীবনে আগমন হলো ইয়াসমিন চৌধুরীর। তার সাথে তার মেয়ে রিনিতার। পৃথা আর রিনিতা, বয়সে প্রায় একই সমান। তবে রিনিতা, পৃথার মতন সুন্দর বা মেধাবী না। একটাই জিনিস রিনিতা বেশ ভালো পারে আর তা হলো ঢং করতে। মায়ের আষ্কারা পেয়ে পেয়ে বড় হওয়া মেয়ের এ ছাড়া সেরকম কোনো যোগ‍্যতাই নেই। আর দুর্ভাগি পৃথা! মায়ের ভালোবাসা পাবে বলে যেই “মা” কে বাসায় নিয়ে আসা হলো সে তার সৎ মা হওয়ার অস্তিত্ব তিলে তিলে প্রকাশ করতে লাগলো পৃথার জীবনে। প্রথম দিকে এতো কষ্ট ছিল না পৃথার জীবনে কারণ বাবা ওর পাশে ছিলেন। আগলে রাখতেন ওকে। তবে সাত বছর আগে বাবার আলজাইমার্স ধরা পরার পর থেকে তিনি আস্তে আস্তে অকেজ হয়ে পরেন। আর ঠিক তখন থেকেই শুরু হয় পৃথার জীবনে ঝড়। সৎ মা বাসার কতৃত্ব গ্রহণ করেন, সাথ দেন ওনাকে পৃথার ফুফু। সেই থেকে আজ পর্যন্ত পৃথা নিজের বাড়িতেই একজন কেয়ারটেকারের মতনই জীবন যাপন করছে। অনেক কষ্ট হয় তারপরেও কিছু বলে না ও। আগে বলতো, প্রতিবাদ করার চেষ্টা করতো কিন্তু তখনই ঠিক একটা কথাই শুনতে হতো ওকে,
– এতো খারাপ লাগে এই বাসায়, তো চলে যাস না কেন? এমনিতেই তো প্রথা অনুযায়ী মেয়েরা বিয়ের পর বাপের বাড়ি থাকে না। তুই পরে আছিস কেন তাহলে? আসেনা কেন তোর শ্বশুর শাশুড়ি তোকে নিতে? আমারও বাসা থেকে একটা আপদ বিদায় হতো। হুহ্! বউ এখানে রেখে গিয়ে নিজেরা আমেরিকায় আয়েশ করছে, আর আমার ঘাড়ে পরেছে এই আপদ। স্বামীর তো কোন খোজই নাই, আবার মেয়ের মুখের ঠাট কতো!

এরকম খোঁচা শুনতে শুনতে পৃথা এখন দমে গেছে। আগে খুব কাঁদতো ও তবে আস্তে আস্তে বুঝতে পারলো, আসলেই তো, মা ভুল বলে না। যার সাথে পৃথার সারা জীবনের বন্ধন সেই স্বাধীনই তো পৃথার সাথ ছেড়ে দিয়েছে। স্বামী, শ্বশুর বাড়ি , সব থেকেও পৃথা একা। তাহলে অন‍্যকে দোষ দিয়ে লাভ টা কি? অন‍্যরাতো কথা উঠাবেই।
—————–
বনানী বাসস্ট্যান্ডে নেমে পৃথা নিজের চোখ মুছলো। এইসব নিয়ে চিন্তা আসলেই ওর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায় তবে এখন এটার সময় না। আজ অফিসে অনেক বড় একটা দিন, অনেক কাজ তাই সেদিকেই মনোযোগ দিল ও।
অফিসে পা রাখার আগেই হইচই শুনতে পেল পৃথা। আজ এটাই আশা করেছে ও। তাড়াতাড়ি কাঁচের দরজা পার করে লবিতে প্রবেশ করলো। দেখলো ব‍্যাপক কাজ চলছে লবিতে। এক দিকে কেউ পরিষ্কার করায় ব‍্যস্ত তো কেউ লবিটাকে সাজানোতে। কাউকে বিরক্ত না করে আরেকটা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে সোজা নিজের ডিপার্টমেন্ট এসে পৌছালো পৃথা। বাকি জায়গাগুলোর মতন এখানটাও সরগরম। যে যার মতন নিজ নিজ কিউবিকাল সাজানোয় ব‍্যস্ত। পৃথাও নিজের ডেস্ক ঠিকঠাক করতে শুরু করে দিল। এরই মাঝে ওর কাছে এসে দাড়িয়েছে নুপূর। নুপূর এখানে পৃথার একজন সিনিয়র কলিগ এবং খুব ভালো বন্ধু। ও হাপাতে হাপাতে বললো,
– মরার ওপর খাড়ার ঘা পরেছে! এমনিতেই কি কম প্রেশারে আছি যে আরো ঝামেলা বাড়তে হলো?
– কি হয়েছে নুপূর আপু?
– স‍্যার নাকি সকালেই আসছেন অফিসে।
পৃথা এটা শুনে চেয়ার থেকে ঝট্ করে দাড়িয়ে গেল,
– কি বললা? স‍্যার সকালে আসছেন? কিন্তু ওনার তো লাঞ্চের পরে আসার কথা ছিল।
নুপূর চোখ ঘুরিয়ে বললো,
– ছিল, ‘past tense’! কিন্তু এখন নাই। আমি রাস্তাতেই জানতে পারলাম যে তিনি সকালেই আসতে চান। এবং সারাদিনই থাকবেন। দেখো তো কি ঝামেলা! এমনিতেই আমাদেরকে কোনো প্রায়র প্রিপারেশনের সময় দেয়া হয় নি। তারওপর বলা হলো আজই স‍্যার নাকি এসে আমাদের গ্রুপ, মানে তার নির্দেশায় গঠনকৃত A Team এর সাথে সামনাসামনি কথা বলবেন। তাও ভাবছিলাম যে ঠিক আছে, দুপুরের পর আসবে, নিজেকে প্রিপেয়ার করার একটু সময় পাবো। তা আর হলো না। সকালেই আসতে হচ্ছে ওনাকে! তর আর সচ্ছে না ওনার। উফফ!
পাশ থেকে সাকিব উঠে আসলো,
– স‍্যারের ওপর এতো রেগে আছেন কেন নুপূর আপু ? After all it is his company now. He can do whatever he want.

নুপূর আরচোখে রাগ নিয়ে ওর সহকর্মীর দিকে তাকালো। এরই মধ‍্যে A team এর সর্ব শেষ এবং সর্ব কনিষ্ঠ সদস‍্য নিতা এসে পৌছালো রুমে। স্বভাবে একটু অগোছালো এবং ভুলোমনের হলেও নিতা মানুষ হিসেবে বেশ প্রানচঞ্চল, হাসিখুশি। ও ঢোকার সাথে সাথেই হাহাকার শুরু করলো,
– স‍্যার নাকি এখনই আসছে?
– হ‍্যা।
– হায় হায়! এখন কি হবে? আমি তো নিজের ব‍্যাপারে কিছুই প্রিপেয়ার করি নাই।
নুপূর ছাড়া রুমে থাকা বাকি সবাই হেসে উঠলো। রাশেদ খেপালো নিতাকে তখন,
– এক নুপূর কি কম ছিল, যে ওর আরেকটা কার্বন কপি এসে পরেছে একই টিমে? হাহাহাহা।
নিতা মোটেও এসব কথায় পাত্তা না দিয়ে নিজেই কথা বলা শুরু করলো,
– আচ্ছা, আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না। আমাদের এই কম্পানি একজন প্রবাসী বাংলাদেশী কিনে নিয়েছেন, তাহলে সিয়াম স‍্যার এখন থেকে আমাদের বস্ না?
নিতার প্রশ্নের উত্তরটা দিল রাশেদ,
– কেন না? অবশ‍্যই সিয়াম স‍্যার এই সফ্টওয়েআর কম্পানির সিইও থাকছেন তবে ওনার কাছ থেকে এই কম্পানির মেজর এমাউন্ট অফ শেয়ার্স কিনে নিয়েছেন আমাদের নতুন বস্ অর্থাৎ রিতভিক হাসান। মোট কথা রিতভিক স‍্যার আর সিয়াম স‍্যার দুজনেই এখন পার্টনার। এই কম্পানি ওনাদের দুজনেরই।
– ওওও, বুঝলাম। ও ভালো কথা, আমাদের সবাইকে পাঁচ মিনিট পরে সিয়াম স‍্যার লবিতে আসতে বলেছেন। রিতভিক স‍্যার নাকি অন দা ওয়ে।

নিতার কথায় রুমের সব জোড়া চোখ ওর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। বোকার হাসি হাসলো নিতা,
– হেহেহেহে! আসলে এখানে আসার আগে সিয়াম স‍্যারের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। উনিই আমাকে দিয়ে ম‍্যাসেজটা পাঠিয়েছিলেন।
– আর এটা তুমি আমাদেরকে এখন বলছো নিতা?এতো কথার পর?
– সরি। রিতভিক স‍্যারের এখনই আসার কথা শুনে সব মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। ভুলেই গিয়েছিলাম আপনাদের বলতে।

এরই মাঝে নুপূরের ফোন বাজে। ভয়ার্ত চোখে তাকায় নুপূর,
– সিয়াম স‍্যার।
– শিট! আজকে আমরা শেষ। কনফার্ম।
– জল্দি চলো।
একবার নিজেদেরকে এবং পেছন ফিরে রুমটাকে দেখে সবাই বের হয়ে লবি তে এলো। দেখলো অন‍্য ডিপার্টমেন্টের কর্মচারীরাও এসে পরেছে। দুপাশে সারিবদ্ধ ভাবে সবাইকে দাড়াতে বলছেন সিয়াম স‍্যার।
– এমন ভাবে দাড়াবেন যাতে মিস্টার হাসান আপনাদের সবাইকেই যেন দেখতে পান।
সামনের দিকে আর জায়গা নেই বলে সারির শেষের দিকে এসে A team এর সদস‍্যরা পাশাপাশি দাড়িয়ে পরলো। পৃথা দাড়ালো নুপূর আর নিতার মাঝখানে।
ওদের দাড়াতেই সিয়াম স‍্যারের কাছে ফোন চলে আসলো। সবাইকে উদেশ‍্য করে বললেন তিনি,
– He is here.

কিছুক্ষণ পরেই দরজার বাইরে মানুষের আওয়াজ পাওয়া গেল। উৎসুক হয়ে সামনের দিকে একটু ঝুকে রইলো সবাই। মনে সবার একটাই কৌতুহল: নতুন বস্ কে, সেটা দেখার।
দরজা খুলে প্রথমে সিয়াম ঢুকলো। তার পেছনে ঢুকলো একজন।

ছাই রংয়ের স‍্যুট পরা, ক্লিন শেভ্ড, ধুসর অক্ষির মানুষটা, নিজের আত্মবিশ্বাসি ভঙ্গিতেই সবাইকে বুঝিয়ে দিল তার জন‍্যই আজকের এই আয়োজন। তার অপেক্ষাতেই এতোক্ষন ধরে সবাই দাড়ানো। তার হাটার চালে এক ধরনের আভিজাত্য ফুটে উঠছিল যেটা তার চেহারাতেও স্পষ্ট। লবিতে দাড়ানো সবার চোখে তাত্ক্ষণিক ভাবেই ছেয়ে পড়লো তার প্রতি এক নিশ্চুপ মুগ্ধতা।

শুধু একজন বাদে….

পৃথার চোখ যখন থেকে মানুষটার ওপর পরেছে তখন থেকে মনে হচ্ছে ওর পুরো দুনিয়াটা ওর সামনে দুলছে। নিজেকে সামলে রেখে দাড়িয়ে থাকতেই কষ্ট হচ্ছে ওর। এরকম ধাক্কা আজ খাবে ও, সেটা কস্মিনকালেও কল্পনাও করেনি।
ওকি ঠিক দেখছে? নাকি চোখের ভুল? না না। এই ভুল ওর জীবনেও হবে না। এই চেহারা ওর চেনা, খুব বেশি।
হঠাৎ পৃথার কেন যেন ঝট্ করে মাথায় রাগ উঠে গেল। নিজেকে সামলে ওঠার আগেই হাত মুঠ হয়ে অজান্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেল ওর।

এক এক জনের সাথে হাল্কা পাতলা কথা বলে বলে আগাচ্ছিল রিতভিক হাসান। ঠোটে নরম একটা হাসি থাকলেও চোখে ছিল দৃঢ়তা। সীয়াম সবার নাম এবং পদ বলে দিচ্ছিল ওকে। সিনিয়র মেম্বারদের সাথে অন‍্যদের তুলনায় একটু বেশী সময় কথা বললো রিতভিক। এভাবে করেই এক সময় ওরা এসে দাড়ালো A Team এর সামনে। সিয়াম হেসে বললো তখন রিতভিক কে,
– So, at last you get to meet your special team. The A Team. রিতভিক, আপনিই তো ওদের সিলেক্ট করেছিলেন। তবে আজ প্রথম আপনাদের সামনাসামনি দেখা হচ্ছে।

রিতভিক সিয়ামের দিকে তাকিয়ে একটা আনুষ্ঠানিক হাসি দিল। তারপর এ টিমের এক এক জনের সাথে হাত মিলিয়ে মিলিয়ে আগাতে লাগলো ও।
রিতভিক যতই কাছে আসছিল, পৃথার রাগ ততই দ্রুত উড়ে গিয়ে এক ধরনের নার্ভাসনেস চেপে বসতে লাগলো। ডান হাতটা ভীষণ কাঁপছে। চোখের পাতারও একই অবস্থা। ঠোট শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। রিতভিকের দিকে কোনোমতে তাকালো পৃথা। মানুষটা যে ওকে দেখতে পেরেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই তবে ওর চেহারায় কোনো ধরনের ভাব প্রকাশ পাচ্ছে না। একদম স্বাভাবিকই আছে রিতভিক। এমনকি পৃথার দিকে তাকাচ্ছেও না। তাহলে কি ও পৃথাকে দেখে চেনেনি? এটাও কি সম্ভব? হ‍্যা, অনেক বছর পার হয়ে গেছে ওদের মাঝে তবে তাও তো পৃথা এক মুহূর্তেই চিনে গেছে ওকে। না চেনার প্রশ্নই আসে না। তাহলে ও কিভাবে পৃথা কে…?

এটুকু চিন্তায় আসতে আসতে রিতভিক হাসান এসে পৃথার সামনে দাড়ালো। পৃথার চোখ দুটো বড় হয়ে গেল ওকে এতো কাছে দেখে। সেই সুন্দর হাসিটা ঠোটে রেখেই হাত বাড়িয়ে দিল রিতভিক,
– হ‍্যালো।
সেই কাঁপতে থাকা ডান হাতটা দিয়েই রিতভিকের হাত আল্তো করে ধরলো পৃথা। বলা যায় শুধু ছুয়ে দিল। তবে হাত সরাতে গিয়েই বাধা পেল পৃথা। ওর হাতের তালু নিজের হাতে পুরোপুরি নিয়ে ফেলেছে রিতভিক। হাল্কা চাঁপ দিয়ে মুঠোবন্দি করে রেখেছে, পৃথার ছোটার কোন পথ নেই। এতোক্ষণ হাতের দিকে তাকিয়ে থাকা পৃথা চমকে ওপরে তাকালো। রিতভিক হাসছে ওর দিকে চেয়ে। সিয়াম মাঝ দিয়ে কথা বললো,
– রিতভিক, ও হচ্ছে পৃথা চৌধুরী। আপনার এ টিমের আরেক সদস‍্য।
রিতভিক পৃথার দিকে অপলক তাকিয়ে হাসছে। পৃথার একটু অস্বস্তি বোধ হলো বটে তবে কিছু বলতে পারলো না তখন। রিতভিক আবার কথা বললো,
– Nice to meet you Ms. Preetha. I hope that we will put up good work together.

পৃথা একটা আনুষ্ঠানিক হাসি দিয়ে শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। ওর হাতটা ছেড়ে দিয়ে রিতভিক সামনে গেলে মনে মনে হাপ ছেড়ে বাঁচলো পৃথা। তবে ভেতর থেকে অবাকও হলো ও। কিঞ্চিত খারাপও লাগলো কি?
– আচ্ছা, ও কি আমাকে আসলেই চেনেনি? চিনলে তো বোঝা যেত চেহারায়। কিন্তু কিছুই তো বোঝা গেল না? আজিব তো?

পরিচয়পর্ব শেষে রিতভিক সেখানেই দাড়িয়ে ওকে সংবর্ধনা জানানোর জন‍্য সবাইকে ধন‍্যবাদ জানালো এবং বললো যে আস্তে আস্তে প্রতিটা ডিপার্টমেন্টের সাথেই কথা বলবে। তবে এই মুহূর্তে সে এ টিমের মেম্বারদের সাথেই নিজের কেবিনে কথা বলতে চায়।
মিনিট দশেক পরে এ টিমের সব সদস‍্য এবং সিয়াম, রিতভিকের রুমে এসে জড়ো হলো। পৃথা ইচ্ছে করেই একটু পেছনে দাড়ালো যাতে রিতভিক ওকে সরাসরি দেখতে না পায়।

সবাই আসার পর রিতভিক কথা শুরু করলো,
– Hello and welcome to the A Team. I think you already have been briefed about this arrangement, but let me clear it to you again. I have personally created this team by selecting one member from each department of this company. Out of all your colleagues, you six excelled in the qualifiers, hence here you are. You will be my personal team i.e. we will work together in every step. You will be the representative of your respective departments and will have straight access to me. I hope I have made myself clear.
সবাই একসাথেই বললো,
– Yes sir.
-good. এখন আমি আপনাদের এক একজনের একটা ছোট ইন্টারভিউ নিব। না না, ভয় পাবেন না। এটা শুধু আপনাদের সাথে একান্ত ভাবে পরিচিত হওয়ার সাধারণ একটি ড্রিল। সো আমি মিস্টার রাশেদ কে দিয়ে শুরু করতে চাচ্ছি। বাকিরা প্লিস বাইরে ওয়েট করুন।

রাশেদ ছাড়া সিয়াম সহ সবাই রিতভিকের কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। রিতভিকের কেবিনের সাথেই লাগানো এ টিম ডিমার্টমেন্ট। সবাই নিজ নিজ কিউবিকালে যেয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো আর সিয়াম চলে গেল নিজের কাজে।
এক এক জন যাচ্ছে আর অপর জন বের হচ্ছে কেবিন থেকে। সবারই সময় লাগছে ছয় থেকে সাত মিনিট এর বেশি না। যেই বের হচ্ছে তাকেই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে ইনটারভিউর ব‍্যাপারে। সবার অভিজ্ঞতাই বেশ ইতিবাচক দেখা গেল। হাসছে আর নতুন বসের প্রশংসা করছে। পৃথা এসব কোনো কথার মাঝেই ছিল না। ও ছিল নিজের ভাবনায়। এক আলাদা দুনিয়ায়। হঠাৎ ওর নাম শুনে চমকে উঠলো। নুপূর ডাকছে,
– এই পৃথা, এবার তোমার পালা। স‍্যার তোমাকে ডেকেছে।
পৃথা এবার খেয়াল করলো যে সবার ইন্টারভিউ হয়ে গেছে। ওরই শুধু বাকি। ধীর পায়ে কেবিনের দিকে গেল ও।
কেবিনের খোলা দরজার কাছে এসে পৃথা দেখতে পেল রিতভিক টেবিলের অপর পাশে নিজের সিটে বসে কিছু একটা পড়ছে। দরজায় নক দিল পৃথা,
– May I come in sir?

মাথা না উঠিয়েই উত্তর এলো,
– Yes come in and please close the door behind you.

পৃথা দরজা বন্ধ করলো কাঁপা হাতে। কেন যেন ও কাঁপছে। না, ভয় পাচ্ছে না তবে কেমন একটা নার্ভসনেস কাজ করছে ওর মাঝে। রিতভিক কে দেখার পর থেকেই হচ্ছে এমন। দরজাটা বন্ধ করে টেবিলের সামনে এসে দাড়ালো পৃথা। অবাক হলো যে রিতভিক ওকে বসতে বললো না। কথা শুরু করলো রিতভিক,
– So, shall we start?
-yes sir.
-okay. So your name is Preetha right?
-yes sir.
-Preetha Chowdhury?
-yes sir
-so your husband’s surname is Chowdhury?

পৃথার চেহারায় এতোক্ষণ কোনো ভাবান্তর ছিল না। প্রশ্নের উত্তরগুলো রিতভিকের দিকে না তাকিয়ে মাথা হাল্কা নিচু করেই দিচ্ছিল ও। হঠাৎ এই প্রশ্নে চোখ বড় বড় করে ও তাকালো রিতভিকের দিকে। মুহূর্তেই সব স্পষ্ট হলো ওর কাছে।

রিতভিক চিনেছে ওকে। তা না হলে প্রথম প্রশ্ন কখনোই এটা হতো না।
নিজের চোয়াল হাল্কা শক্ত করে দেখলো রিতভিকের ঠোটে একটা বাঁকা হাসি। হাসিটা কেমন সেটা পৃথা বোঝাতে পারবে না তবে রিতভিকের এই চেহারা ওকে ভীষণ নার্ভাস করে দিল, সাথে রাগের পারাটাও বুঝি বারলো। রিতভিকও মনে হয় বুঝলো সেটা। নিজের কেদারা থেকে উঠে দাড়ালো ও। টেবিল ঘুরে ধীরে ধীরে পৃথার কাছে আসতে আসতে বলতে লাগলো,
– Its written in your resume that you are married so I asked.

রিতভিকের কাছে আসাতে একটু পিছিয়ে গেল পৃথা। মনে মনে ইতিমধ‍্যে রাগ উঠে হলো অনেকখানি। তোতলাতে শুরু করলো ও,
– sir… its…its

ততক্ষণে রিতভিক এসে পৃথার একেবারে সামনে দাড়িয়েছে। এতোটাই কাছে যে পৃথা রিতভিকের চোখের নিচের সেই ছোট তিলটাও স্পষ্ট দেখতে পারছে। সেই তিল… রিতভিক তাকিয়ে আছে পৃথার দিকে,
– কতদিন পর দেখছি তোমাকে পৃথা।

পৃথা আজ তৃতীয়বারের মতন চমকে উঠলো। রিতভিকের লহু স্বরে বের হয়ে আসা শব্দ ওকে একদম ভেতর থেকে কাঁপিয়ে তুললো। কম্পনটা হয়তো বাইরেও ছিল দৃশ‍্যমান। নিজের কামিজের পাড় খামচে ধরলো পৃথা। চোখ খিছে একবার বন্ধ করে আবার তাকালো। সরাসরি সামনে দাড়ানো মানবের সাথে চোখে চোখ পরে গেল হঠাৎ। আর এটাই ওর মাঝে কম্পন বাড়িয়ে দিল চরম মাত্রায়।

আর একটা মুহূর্তও এখানে থাকা সম্ভব না ভেবে কোনো কথা না বলে সরে চলে যেতে চাইলো পৃথা কিন্তু তার আগেই বোধহয় রিতভিক বুঝে ফেলেছে তাই পৃথার হাত ধরে হুট করে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। আচমকা টানে তাল সামলাতে না পেরে একদম ধাক্কা খেল পৃথা রিতভিকের বুকে। সাথেসাথেই ওর কোমর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওকে নিজের মাঝে বেধে ফেললো রিতভিক। রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৃথার চিলিক পেরে উঠলো তখন। অসহ‍্যনীয় যন্ত্রনায় কাতর পৃথা অস্ফুট স্বরে আওয়াজ দিল,
– স‍্যার, প্লিস…
হাসতে হাসতে অবাক হয়ে বললো রিতভিক। চোখে জ্বলজ্বল করছে খুশি,
– স‍্যার? এখনো স‍্যার বলবে আমাকে?

পৃথা চুপ হয়ে গেল ইতস্ততায়, বিব্রতবোধে। রিতভিক সময় না নষ্ট করে নিজের আলিঙ্গন আরও একটু জোড়ালো করলো, আরও কাছে টেনে নিল পৃথাকে। এবার পৃথার সহ‍্যশক্তি সীমা ছাড়িয়ে গেল। চাঁপা গর্জনে চেঁচিয়ে উঠলো ও,
– প্লিস… লিভ মি। এটা ঠিক হচ্ছে না।
– কি ঠিক হচ্ছে না পৃথা?

রেগে তাকালো পৃথা। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-Leave…me.
-why should I do that? I have every right.

ভুরু কুচকে গেল পৃথার। শেষ বাক‍্যটা বুঝতে পারে নি।
রিতভিকের সেই হাসি এখনো লেগেই আছে ঠোটে, পৃথার বিভ্রান্ত মুখশ্রী দেখে বুঝে নিল ও। নিজের মুখটা নামিয়ে পৃথার কানের কাছে এনে ছোয়ালো। শুধালো মাদকতার স্বরে,
– ছাড়ার তো প্রশ্নই আসে না। অন‍্য কাউকে না, নিজের স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আছি আমি। আমার পৃথাকে জড়িয়ে ধরার সব অধিকার আমার আছে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here