কাব্যের_বিহঙ্গিনী #পর্ব_১৩ #লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

0
677

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_১৩
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

মেহবিন শামীমের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“কি শামীম ব্যস্ত হয়ে পরলাম তো তাই না!’

শামীম রেগে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“তোর তো সাহস কম না। তুই আমার গায়ে হাত তুলোস? তুই জানোস আমি কে? তুই মেম্বারের পোলার গায়ে হাত দিছোস তোর তো এর ফল ভোগ করতেই হইবো।”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“কেনরে তুই কি ফলের গাছ লাগিয়েছিস নাকি? আমি না জানলাম তুই কে? কিন্তু এবার তুই বুঝবি আমি কে!

শামীম রেগে মেহবিনের দিকে তেড়ে এলো। ততক্ষণে তাজেল ব্যাট নিয়ে এসেছে মেহবিন তাজেলের হাত থেকে ব্যাট নিয়ে শামীমের হাতে খুব জোরে একটা বাড়ি মারলো। আর বলল,,

“এখন বল কেমন লাগছে?”

শামীম হাত ঝাড়া মেরে আবার মেহবিনের দিকে এগিয়ে এলো। এবার মেহবিন ইচ্ছে মতো শামীমকে মারতে লাগলো মেহবিনের কানে শুধু সাইমার কান্না আর কথাগুলো বাজছিল। সেদিন সাইমা কতোটা অসহায় ছিল আর সেই সুযোগে সে কি করেছিল। মেহবিন কে মারতে দেখে মাঠের সব মানুষ এগিয়ে এলো। শামীমের সাথে চারজন ছেলে ছিল তারা থামাতে গেলেও মেহবিন দুই চারটে তাদেরকেও দিল তাই কেউ আগানোর সাহস পেল না।। মুহুর্তেই মাঝে গ্ৰামে ছড়িয়ে গেল গ্ৰামে আসা নতুন মেয়েটা মেম্বারের ছেলেকে মেরেছে। এতকিছুর মাঝে সাইমার মুখে ছিল তৃপ্তি হাঁসি হয়তো শামীমের এই অবস্থা ওকে প্রশান্তি দিয়েছে‌। তবুও আলাদা একটা ভয় কাজ করছে। না নিজের জন্য নয় মেহবিনের জন্য। মেহবিন ইচ্ছে করে এমন এমন জায়গায় মেরেছে শামীমের যা শামীম কাউকে খুলে বলতেও দ্বিধাবোধ করবে। শামীম মাটিতে শুয়ে আছে মেহবিন জোরে ব্যাটটা ফেলে বলল,,

“এই মেহবিন দূরে ছিল তাই তোর জন্য ভালো ছিল। মেহবিন মুসকান নামটা সরল সহজ হলেও মেহবিন মুসকান তা নয়। মেহবিন হচ্ছে এক জলন্ত আগুন তার থেকে দূরত্ব বজায় থাকাই উত্তম। কাছে এলে ঝলসে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।”

মেহবিন হাঁপিয়ে উঠেছে ও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বড় বড় শ্বাস নিল এখানে পানি নেই একটু পানি খাওয়ার দরকার ছিল। মেহবিন নিজেকে শান্ত করে নওশি তাজেল , কুলসুম সাইমার কাছে গেল।ওরা বেশ ভয় পেয়েছে মেহবিনের মার দেখে। মেহবিন যেতেই তখন নওশি বলল,,

“এটা কি করলেন আপু? ওরা যে খারাপ এসব করে ঝামেলা বাড়ানোর দরকার ছিল?”

“দরকার ছিল নওশি। আমি যদি ভুল না হই তাহলে ওরা এই এলাকায় সব মেয়েদের ইভটিজ করে। ওদের একটা উচিত শিক্ষা হওয়া দরকার। মেম্বারের ছেলে বলে তার সব দোষ মাফ এটা তো কোন কথা হতে পারে না। প্রত্যেককে তার নিজেদের কৃতকর্মের শাস্তি অবশ্যই পেতে হবে।”

তখন তাজেল বলল,,

“ডাক্তার তুমি এক্কেরে সেই কাম করছো। এই শামীম তো নওশি আপারও একদিন হাত ধরছিল। তোমার হাত যহন ধরলো তহন তো মনে হইতেছিল তোমার মতো আমিও ওরে মারি।”

মেহবিন নওশি বলল,,

“এই তোমরা তাদের কিছু বলোনি দেখেই আজ তারা আমার হাত ধরার সাহস পেয়েছে। যদিও এরপর থেকে আর সাহস পাবে না বোধহয়। নওশি তোমায় একটা কথা বলি মানুষ নরমের যম। যত নরম হবে তত মানুষ তার ইচ্ছে মতো তোমায় আচড় করবে। শক্ত হও দেখবে সহজে তোমাকে কেউ আঁচড় করতে পারবে না। এমন একটা যুগে আমরা বাস করি যেখানে মেয়েরা নিরাপদ নয় তাই সব মেয়েদের উচিৎ নিজেদের জন্য হলেও কিছুটা সেল্ফ ডিফেন্স শিখে রাখা। ”

তখন নওশি বলল,,

“আমরা তো আপনার মতো এতো সাহসী নই ডাক্তার আপা। আপনার মতো এই সাহস আর মনোবলের বড্ড অভাব।”

“ভয়কেই জয় করতে হবে নওশি। নাহলে সারাজীবন অন্যের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে জীবন কাটাতে হবে। তোমার জীবন তোমার অধিকার তুমি কিভাবে নিজের জীবন পরিচালনা করবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা জীবন পরিচালনা করেন কিন্তু এর সাথে তোমার ইচ্ছে এবং প্রশান্তিও গুরুত্বপূর্ণ। ”

তখন একজন মেহবিনের কাছে এসে মেহবিন কে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“আপনি না ডাক্তার আপনি এই ভাবে মারতে পারলেন?”

তখন মেহবিন বলল,,

“ডাক্তাররা শুধু বাঁচাতে নয় ক্ষেত্র বিশেষে মারতেও পারে। তাছাড়া ও খুব একটা ভালো কাজ করেনি যে তাকে সালাম করতে হবে। মার খাওয়ার মতো কাজ করেছে তাই মেরেছি।”

“আমার পোলারে মারার ফল কিন্তু তোমার ওপর বেশ ভারী হইবো। আমি কিন্তু চেয়ারম্যানসাব এর কাছে বিচার দিমু। তুমি কেমনে এই গ্ৰামে থাকো সেইটাও দেখুম।

মেহবিন বুঝতে পারলো এটাই তাহলে শামীমের বাবা। মেহবিন তার কথা শুনে শক্ত কন্ঠে বলল,,

“যার কাছে ইচ্ছে তার কাছে বিচার দিন আমার তাতে কিছু যায় আসে না। আর হ্যা এটা যেন আপনাদের ওপর ভারী না হয়ে যায়। আমার তো মনে হচ্ছে এই গ্ৰাম থেকে যেতে এখনো ঢের দেরি। এখন কথা না বলে আপনার ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে যান। ওখানে দেখবেন ডাক্তার আছে।

মেহবিনের কথা শুনে লোকটা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেল। মেহবিন সকলকে নিয়ে বাড়ি চলে গেল। সাইমা বেশ ভয়ে আছে তার বাড়ির ছেলেই শামীম কি হবে আল্লাহ ভালো জানে। সে ভয়ে ভয়ে নিজের বাড়ি ঢুকলো। তখন ওর মা বলল,,

“কিরে শামীমরে নাকি হেই নতুন মাইয়া ডাক্তার মারছে?”

সাইমার কি হলো কে জানে এতক্ষন ভয় থাকলেও এখন কেন যেন ভয়টা কাজ করছে না। সাইমা বলল,,

“হুম মারছে আমিও ওইহানেই আছিলাম।”

“তোর সামনে তোর কাকাতো ভাইরে মারলো আর তুই কিছু কইলি না খাড়াইয়া খাড়াইয়া দেখলি।”

“আমি কিছু কইলে শুনতো নাকি‌। তাছাড়া তোমাগো বাড়ির পুলা খুব ভালো কাম করে নাই। হেয় মাইর খাইছে তার কামের লাইগা‌।

বলেই সে ঘরে ঢুকে পরলো তা দেখে সাইমার মা কিছুটা অবাক হলেন। শামীমকে সে নিজের ছেলের মতো দেখেন তার ছেলে নেই বলে। তিনি তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে গেলেন মারার কথা শুনেই শামীমের মা বাবা ঐদিকে ছুটেছিলেন । তিনি ঘরদোর সব ঠিক করে এখন যাবেন। সাইমারা দুই বোন সাইমার বড় বোন দুই বছর আগে সুইসাইড করে মারা গেছে।। তবে ঘটনা আছে কারন নাকি সে নাকি কাউকে ভালোবাসতো তার বাড়ির লোক মানে নি দেখে সুইসাইড করেছে ‌।

এদিকে আরবাজ আর মুখর এসেছিল এইদিকে সব শুনে ওরা দুজন একেঅপরের দিকে তাকালো। আর হুট করেই হেঁসে উঠলো। তখনি মুখরের ফোনটা বেজে উঠলো ও ফোন ধরলো ওপাশ থেকে আওয়াজ আসলো,,

“তখন ফোন দিয়েছিলেন কেন?”

“তখন কি আপনি মারামারি করতে ব্যস্ত ছিলেন ম্যাডাম?”

মুখরের কথায় মেহবিন একটু হাসলো আর বলল,,

“এ কথা আপনার কানেও পৌঁছে গেছে?”

“শুধু আমার না পুরো গ্ৰাম জানে যে নতুন ডাক্তার মাইয়া মেম্বারের ছেলেকে পিটিয়েছে। মাইক লাগে নি এমনিতেই ফাইব জি স্পিডে চলে গেছে। অবশ্য গ্ৰামে এরকমই ঘটে কোনকিছুই লাগে না কিন্তু খুব দ্রুত খবর পুরো গ্ৰামে ছড়িয়ে পড়ে।

“ওহ ভালো তা ফোন দিয়েছিলেন কেন?”

“ব্যান্ডেজটা চেন্জ করতে হতো তো!”

“কেন চকলেট বয় কি পারতো না আমায় লাগবে কেন?”

“না চকলেট বয় তো পারতো না। ও আর মিশু তো টুইন মিশুর রক্তে ফোবিয়া আছে। এখন হুট করে জখম দেখে যদি আরবাজ আমায় ফেলেই দৌড় দেয় তাহলে আমার কি হবে?”

মুখরের কথা শুনে আরবাজ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল আর ধাপ করে একটা কিল বসিয়ে দিল। তা দেখে মুখর আউচ করে শব্দ করে উঠলো তা শুনে মেহবিন বলল,,

“কি হয়েছে আপনার?”

“মিশুর বাজপাখি আমায় মেরেছে ফোবিয়ার কথা বলেছি বলে।”

“আপনি একটা কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পূর্ন মানুষ পাঞ্জাবিওয়ালা। আপনাকে এসব নেকামোতে মানায় না।”

“সব মানুষই নিজের ব্যক্তিগত মানুষের কাছে খোলা বইয়ের মতো বুজলে বিহঙ্গিনী।আর আমার ব্যক্তিগত মানুষের সামনে আমায় মেপে মেপে নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রেখে কথা বলতে হয় না। তার কাছে আমি স্বাধীন ভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারি। জীবনের অনেক কিছুই যেগুলো বাকি সেগুলো আমি তার সামনে করি। এতে অবশ্য সে খুশিই হয় কিন্তু ওপরে ওপরে রাগ করে।”

“তো ব্যান্ডেজটা কি আমারই পাল্টাতে হবে?”

“কথার টপিক পাল্টাচ্ছো?”

“আমি তো তাও কথা বলছি আপনার মতো একদম চুপ হয়ে যাই নি। সন্ধ্যা হয়ে আসছে তো তাই বললাম।”

“না থাক আজ আর তোমার পাল্টাতে হবে না। এমনিতেই মারামারি করে টায়ার্ড তুমি। আরবাজ বেশ শক্তিশালী আশা রাখছি ও পালাবে না তাই আজ বরং ওকে দিয়েই করাই‌।”

“আচ্ছা আল্লাহ হাফেজ।”

“আল্লাহ হাফেজ!”

মুখর আরবাজের দিকে তাকিয়ে দেখলো আরবাজ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। আরবাজ এবার মুখরের চুল ধরে ঘুরাতো লাগলো মুখর না না করেও কিছু করতে পারলো না। তখন মুখর বলল,,

“ঐ তুই কোন রাগ ঝাড়ছিস বলতো? তোর সামনে ওর সাথে কথা বলেছি বলে নাকি তোকে ভীতু বলেছি বলে?”

তখন আরবাজ চুল ছেড়ে দিয়ে বলল,,

“গাধার নানা তুই যদি বুঝতি তাহলে তো হতোই?”

বলেই আরবাজ হাঁটা ধরলো। মুখর ও দৌড়ে ওকে ধরলো আর বলল,,

‘ আইচ্ছা আমি না বুঝলাম। এখন বল আমার ব্যান্ডেজ পাল্টাতে পারবি কি না নাহলে আমার হাসপাতালে যাওয়া লাগবে।”

“তোর হাসপাতালে যাওয়া বেটার হবে আমি যদি আবার তোর জখম দেখে পালিয়ে যাই।”

“আরে ভাই আমি মজা করছি আর ঐ কথা এই জন্য বলছি যাতে তারে কনভিন্স করা যায়। পরে মনে হইলো তারে দিয়ে এখন করানো উচিৎ হবে না। এমনিতেও আজ বেশ বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে তারপর আমাদের দুজনকে ওখানে দেখলে নানাজনে নানান কথা বলতো পরে তার অসুবিধা হতো।”

“হুম এখন বাড়ি চল। কিন্তু মিশুর থেকে লুকিয়ে করতে হবে ও ভুলেও যেন তোর জখম না দেখে।”

“হুম চল আমার কিউটি দোস্ত।”

“একদম ন্যাকামি করবি না নাহলে লাত্থি মাইরা এই রাস্তায় শোয়াই রাখমু।”

“আমি ডরাইছি দোস্ত আর ন্যাকামি করুম না। এহন নও বাড়ি যাই।”

এ কথা আরবাজ মুখরের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে একসাথে তাকিয়ে হেঁসে উঠলো। এরা এরকমই এদের কে ম্যাচুয়ার মানুষ মনে হলেও দুজন দুজনের কাছে ন্যাকামিতে সেরা একদম খোলা বইয়ের মতো। মুখর আর আরবাজ বাড়ির ভেতর ঢুকতেই দেখল জিনিয়া মুনিয়া নূপুর বাড়ির মহিলা সদস্যরা মেহবিনের মারামারি নিয়ে কথা বলছে মিশু এক পাশে বসে হা করে সব শুনছে। আরবাজ কে দেখে মিশু বলল,,

“বাজপাখি জানো বন্ধু নাকি একটা ছেলেকে খুব মেরেছে?”

মুখর আর আরবাজ একে অপরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“হ্যা মেরেছে কিন্তু তোমরা জানলে কিভাবে?”

তখন মুনিয়া বলল,,

“মেম্বার হাসপাতালে যাওয়ার আগে কাকাকে বলেছে।এর একটা বিহিত নাকি কাকাকেই করতে হবে। আর উনাকে সাথে করেও নিয়ে গেছে।”

‘ওহ আচ্ছা।”

_________________

পরের দিন সকাল বেলা মেম্বার আর চেয়ারম্যান আরো কিছু গন্য মান্য লোক মেহবিনের বাড়িতে গেল । মেহবিন সবাইকে বসিয়ে চা নাস্তা দিল । তারা জানালো যে একটা সালিশ হবে মেহবিনের কালকের কার্যকলাপ নিয়ে। মেহবিন নিজের সম্পর্কে কিছুই বলে নি। শুধু বলেছে এখন ওর সময় নেই সালিশ অনেক সময়ের ব্যাপার তাই ওর বন্ধ মানে শুক্রবার করলে ভালো হয়। তাছাড়া শামীম ততদিনে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠবে ওদের সবাই এবং ওখানে যারা যারা ছিল তাদের নিয়ে করলে ভালো হয় সবাই থাকলে বোঝা যাবে আসলে কার দোষ ছিল। সেখানে যা রায় হবে মেহবিন মেনে নেবে। মেহবিনের যুক্তি দেওয়া কথা শুনে সবাই ওর কথায় রাজি হয়েছে মেম্বার একটু হম্বিতম্বি করলেও চেয়ারম্যান এর ওপরে কথা বলার সাহস হয় নি। এতকিছুর মধ্যেও আজ শেখ শাহনাওয়াজ মেহবিনের বাড়ি থেকে কিছুই খেলেন না কারন তিনি তার কথা ভুলেন নি। সবাই চলে গেলে মেহবিন হাসলো এখনকার যুগেও গ্ৰামে সালিশ এর মাধ্যমে অনেক ঘটনার ফয়সালা হয়। সে কেন সময় চেয়ে নিল এটা শুধু সেই ভালো জানে।

পুরো গ্ৰাম সেদিনের পর থেকে বেশ চুপচাপ। সাইমা নওশি কুলসুম কেউ আর মেহবিনের সাথে দেখা করে নি। করেছে শুধু তাজেল ওর সব হলো মেহবিন আর মেহবিন কে সাপোর্ট করাই ওর কাজ। আজ শুক্রবার তিনটার সময় সালিশ বসবে মেহবিন কে দুটোর সময় থাকতে বলেছে শেখ শাহনাওয়াজ মিশুর সাথে না হয় একটু সময় কাটাবে। মেহবিন দুইটার সময় বোরকা হিজাব আর মাথায় ক্যাপ পরে এলো। কারন আজ ওখানে মুখর ও থাকবে। মেহবিন তাজেলকে দিয়ে সাইমা আর নওশিকে পরে আসতে বলে চেয়ারম্যান বাড়িতে এলো । মিশু অনেক কথাই বলল মেহবিন ও শুনলো । সালিশ টা হবে চেয়ারম্যান বাড়ির বাগানে ওখানে সব মানুষ এসে হাজির শেখ শাহনাওয়াজ এর কথায় মেহবিন এলো বাড়ির মহিলাদের বাইরে বের হতে মানা করেছে। শেখ শাহেনশাহ ও আজ এখানে উপস্থিত। মেহবিন কে একপাশে একটা চেয়ার দেওয়া হয়েছে কিন্তু মেহবিন বসে নি। বাকি সবার অবস্থা ভালো হলেও শামীমের অবস্থা খুব একটা ভালো না তাই সে চেয়ারে বসে রয়েছে‌। প্রথমে চেয়ারম্যান সাহেব মেহবিন কে বললেন,,

‘আপনি নতুন গ্ৰামে এসেছেন। গ্ৰামে এসেই গ্ৰামের ছেলেদের গায়ে হাত তোলা আপনার উচিৎ হয় নি।”

মেহবিন মুখটা শক্ত করে শান্ত স্বরে বলল,,

‘শামীমের ভাগ্য ভালো ওকে শুধু মেরেছি আমার হাত ধরার জন্য ওর হাত কেটে ফেলিনি সেটাই বেশি।”

মেহবিনের শান্ত স্বরে বলা কথাটা শুনে শামীম আতকে উঠলো। বাকি সবার মাঝে গুঞ্জন উঠলো। তখন মেম্বার বললেন,,

‘দেখছেন চেয়ারম্যান সাহেব মাইয়ার ত্যাজ দেখছেন। কয় মারছে তাই আমার পুলার ভাগ্য ভালো হাত কাইটা ফালাই নাই তাই বেশি। এরকম জল্লাদ মাইয়া মানুষ আমাগো এলাকায় থাহার কোন অধিকার নাই। ওরে দেইহা আরো মাইয়ারা মারামারি শিখবো।

তখন শেখ শাহেনশাহ বললেন,,

“আমি তো হুনলাম ওরা তোমার পথ আটকাইয়া কিছু জিগাস করার জন্য মারছো। এলাকার ছেলেপেলে নতুন দেইখা তোমার পথ আটকাইয়া কিছু জিগাস করতেই পারে তাই তুমি ওগো এইভাবে মারবা।

মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“ওখানে কি হয়েছে তাতো আপনি জানেন না তাই না। ওখানে তো আপনি ছিলেন না ওখানে তারা শুধু আমার পথ আটকিয়ে কথা বলছিল নাকি আমার হাত ধরে অসভ্যতামি করছিল তাতো আপনি দেখেন নি। তাহলে এতো সিওর হয়ে কিভাবে বলছেন আপনি যে ওখানে কি হয়েছিল?

হাফ্‌স ইবনে আ’সেম (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “কোন মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে সব শোনা কথা বলে বেড়াবে।” (মুসলিম ৫)

মেহবিনের এক কথায় পুরো মজলিস চুপ হয়ে গেল। শেখ শাহেনশাহ অপমানে মাথা নিচু করলেন। যদিও মেহবিনের দিকে তিনি তাকিয়েছিলেন কিন্তু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলেন না উনি। তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“তো আপনিই পরিস্কার ভাবে বলুন ওখানে কি হয়েছিল?”

তখন মেহবিন বলল,,

“এখানে ভুক্তোভোগী আমি নই। তাই যে এখানে ভুক্তভোগী তাকেই জিজ্ঞাসা করুন।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। তো শামীম তুমি বলো তোমাকে কিসের জন্য উনি মেরেছেন?

শামীম একবার মেহবিনের দিকে তাকালো মেহবিন শান্ত দৃষ্টিতে অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল। শামীমকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে ও নিজেও সেদিকে তাকালো শামীম সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিল। আর বলল,,

“আসলে সেদিন উনি সাইমার সাথে বেরিয়েছিল তাই আমি ওদের দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম কোন সমস্যা আছে কিনা? যদি উনি আমাদের গ্ৰাম কে দেখতে চান আমি ওনাকে দেখাবো। আর কোন সমস্যা থাকলে আমি সেই সমস্যার সমাধান করে দিব। ওনার একটা ফোন আসে তখন ভুলে আমার হাতের সাথে হাত লেগে যায়। তারপরেই উনি আমাকে মারতে লাগে। বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করুন আমার বন্ধুদের?

মেহবিন মনে মনে হাসে নিজেকে শিক্ষিত প্রমান করার জন্য শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে। আর কি সুন্দর করে মিথ্যে গুলো গুছিয়ে বললো। চেয়ারম্যান সাহেব শামীমের বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলেন তারা শামীমের কথার সাথে তাল মেলালো। তখন চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,,

“এখন আপনি বলুন?”

“একজন এতো বড় মেয়েকে নিশ্চয়ই হাত ছোয়া আর হাত ধরার মাঝে পার্থক্য বোঝাতে হবে না। আর সে এমনি কথা বলেছে নাকি অসভ্যতামি করেছে সেটাও বোঝাতে হবে না।

তখন মেম্বার বললেন,,

“আইচ্ছা আমি মাইনা নিমু। যদি সেইখানে থাকা কেউ একজন বলে যে সে জোর করে তোমার হাত ধরছিল আর তোমার সাথে অস্যতামি করছে।”

মেহবিন সবার দিকে তাকালো ওখানে থাকা সবাই চুপ। এতকিছুর মাঝেও মেহবিন তাজেল নওশি আর সাইমা কে দেখতে পেল না। মেহবিন নওশিকে না আশা করলেও সাইমাকে আশা করেছিল। মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো তখন কেউ সবার পেছন থেকে চিৎকার করে বলে উঠলো,,

“আমি দেখছি আমি হেইদিন ডাক্তারের লগে আছিলাম।”

কারো আওয়াজে সবাই পেছনে তাকালো তাজেল দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে সাইমা আর নওশি। তাজেল সবাইকে বলল,,

“সামনে যাইতে দেও আমাগো আমরা হইলাম সাক্ষী।”

সবাই ওদের কে জায়গা করে দিল। শামীম আর ওর বাবা সাইমাকে দেখে অবাক হয়ে গেছে। শামীম ভয় পাচ্ছে আবার সাইমার ওপর রাগ ও হচ্ছে। ও মনে মনে বলছে এখান থেকে যাক তারপর সাইমার খবর করবে। কিন্তু ও আজ সাইমার মাঝে ভয় দেখতে পাচ্ছে না। তাজেল সামনে আসতেই মেম্বার বলল,,

“ঐ তাজেল তুই হইলাম ছোট পুলাপাইন তোর বড়গো মধ্যে কথা কইতে হইবো কেন? তাছাড়া তোর কথা নেওয়া হইবো না। ”

“কেন নেওয়া হইবো না? আমিও সেইহানের একজন তাছাড়া আমি তো দেখছি শামীম ভাই ডাক্তারের হাত ধরছিল। খালি তাই না আমারেও মেলা বাজে কথা কইছে।”

“তুই চুপ থাক তাজেল বড় গো মধ্যে একদম কথা কবি না।”

তখন সাইমা বলল,,

“ও ছোট থাকলে কি হবে চাচা আমি তো ছোট না। সেই দিন শামীম ভাই আমাগো পথ আটকায়া ধরছিল ডাক্তার আপা রাস্তা ছাড়তে কইছিল হেয় ছাড়ে নাই উল্টা অসভ্যতামি করছে। তারপর ওনার একটা ফোন আইতে উনি ওখান থেকে যাইতে লাগছিল তহন শামীম ভাই ওনার হাত ধরছে। তাই ডাক্তার আপা উনারে মারছে।”

তখন নওশি বলল,,

“সাইমা যা বলছে তা সব সত্য আমিও ওখানে ছিলাম।”

তখন আরো দুই তিনজন ছেলে বলল,,

“আমরাও দেখছি!”

তখন মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“হাজারো মিথ্যার মাঝে শুধু একটা সত্যের জন্য হাত উঠানোর সাহস রাখতে হয়। যখন সেই হাতটা উঠে যায় তখন মিথ্যেটা ফিকে হয়ে যায় সেই একটা সত্যের হাতের সাথে আরো সত্যের হাত উঠে যায়।এভাবেই সত্যের জয় হয়।”

ব্যস শামীম আর ওর বাবা একটা চাপে পরে গেল ওরা ভেবেছিল ওদের ভয়ে কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু ওরা ভাবতেই পারে নি নিজের বাড়ির লোক ওকে ফাঁসিয়ে দেবে। পুরো মজলিস আবার ও গুঞ্জন উঠলো। চেয়ারম্যান সাহেব সকলকে থামালেন আর গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সবাই নিজেদের মতামত পেশ করলেন তাদের মতে মেহবিন মারলেও এতো মারা উচিত হয় নি। তাই একজন বলল,,

“সামান্য হাত ধরায় তোমার এতটা মারা উচিত হয় নাই।দেখতেছো পুলাডা খাড়াই থাকতে পারতেছে না। হেই হিসেবে তোমার ক্ষতিপূরণ দেওয়া লাগবো।”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

‘সমস্যা নেই ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেব। তো বলেন মেম্বার সাহেব কতো টাকা খরচ হয়েছে হাসপাতালে? তবে এর পরে কি হবে সেটা জানি না সেটার ক্ষতিপূরণ আমি দিতে পারবো না।”

“মানে?”

“ইন্সপেক্টর মুখর শাহরিয়ার দয়া করে আপনার কাজ টা করুন?”

তখন মুখর একটা হাঁসি দিয়ে সামনে এলো। এতক্ষন পেছনে দাঁড়িয়ে তৃপ্তির হাসি হাসছিল সে আর আরবাজ। মুখর এসেই শেখ শাহনাওয়াজ এর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,

‘শামীম ও তার বন্ধুদের কে এরেস্ট করা হবে। সে গুনে গুনে পাঁচটা মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। এবং তারা সবাই আত্মহত্যা করেছে তাদের মধ্যে শামীমের কাকাতো বোন সাইমার বড় বোন ও একজন। তাদের একেকজনের আত্মহত্যার কারন আলাদা আলাদা বলে জানা গেলেও কারন একটাই তারা সবাই শামীম ও তার বন্ধুদের জন্য ইজ্জত হাড়িয়েছিল। শেষমেশ নিজেদেরকে টিকিয়ে না রাখতে পেরে সবাই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল।

কথাটা শোনা মাত্রই শামীম লাফ দিয়ে উঠলো তার ঘাম ঝড়তে লাগলো। ওর বন্ধুদের ও তাই। এদিকে সাইমার বাবা আর সাইমা পুরোই থমকে গেল।সাথে পুরো গ্ৰামের মানুষ জন। এস আই সহ আরো কয়েকজন কনস্টেবল এসে শামীম ও তার বন্ধুদের ধরলো। শামীম চিল্লিয়ে বলল,,

“আমি কিছু করি নাই। আমারে এই ডাক্তার ফাসাইতেছে। আমি আর আমার বন্ধুরা যে ধর্ষণ করছি তার প্রমান কি?”

তখন মুখর একটা ফোন বের করে সামনে নিয়ে বলল,

“তার প্রমান তো আমরা তোমার ফোন থেকেই জেনে গেছি শামীম। ডক্টর মেহবিন এমনিই এমনিই শুধু তার হাত ধরার জন্য তোমাকে মারে নি। তুমি যে একটা ধর্ষক সেটা জেনেই এতো মেরেছে। কিন্তু আফসোস তার তোমাকে খুন করতে পারলে তার শান্তি লাগতো কিন্তু কি করবে বলো উনি তো আর খুনি নয়।”

তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“এসব কি মুখর?”

“এখন কি আপনাদের ওর ফোনের ধর্ষণের ভিডিও দেখিয়ে প্রমান করতে হবে যে ও ধর্ষক।”

মুখরের কথায় পুরো মজলিস মাথা নিচু করে নিল। কেউ ভাবতেই পারে নি নিজের এলাকার ছেলেই তার এলাকার মেয়েদের ইজ্জত লুট করবে। সেদিন সবার অগোচরে মেহবিন শামীমের ফোনটা নিয়ে নিয়েছিল কেউ দেখতেই পায় নি। যদিও ওর ভাগ্য ভালো ছিল তাই ফোনটা মাটিতে পরে গিয়েছিল। নাহলে হয়তো বা পেত না। ফোনটা ও নিজেই অন করেছিল সব তথ্য এই কয়েকদিনে সে নিজেই কালেক্ট করে আর সব মুখরকে পাঠায় মুখর এগুলো দেখে বুঝতে পেরেছিল এই জন্যই এই গ্ৰামে আত্মহত্যা বেড়েছিল। তবে এর মধ্যেও আরেকটা কথা এইসবের পেছনেও নিশাচর যুক্ত আত্মহত্যার সাথে নিশাচর এর কি সংযুক্ত থাকতে পারে এটা মুখরের মাথায় আসছে না। কিন্তু সব শুনে মেহবিনের মাথায় ঠিকই এসেছে এর সাথে কি সম্পর্ক।সবাইকে এরেস্ট করা হলে একে একে সবাই বাড়ি চলে গেল। আর মুহুর্তেই ছড়িয়ে পরলো শামীমের খবর।মুখর সবার শেষে সেই পাঁচজনের নাম ও বলেছে সব মেয়ের বাবারা এখানেই ছিল তারা তেরে শামীম আর তার বন্ধুদের মারতে গিয়েছিল পুলিশ তাদের থামায়। তারা সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন। সাইমার বাবা সব শুনেই শামীম কে কয়েকটা থাপ্পর মেরেছে এতোক্ষণ শামীমের বাবা লম্ফঝম্প করলেও এখন নিশ্চুপ। কারন তিনি তার ভাতিজাদের খুব আদর করতেন। সাইমা তো খুব কাঁদছে নওশি ওকে সামলাচ্ছে মেহবিন এসে সাইমাকে সামলালো। শামীম কে নিয়ে যাওয়ার পর মেহবিন বলেছিল ক্ষতিপূরণ দিতে হবে কি না সকলেও মাথা নিচু করে না করে দিয়েছে। সাইমার বাবা সাইমা কে নিয়ে গেল। তাজেল মেহবিনের হাত ধরে নওশিকে নিয়ে বাড়ির পথে আগালো। হুট করে নওশি বলল,,

“ডাক্তার আপা আজ কিন্তু আপনি আপনার নেত্রীর জন্যই জিতে গেলেন। কারন আমরা আপনার কথায় এখানে এসেছিলাম ঠিকই কিন্তু সব বলার সাহস ছিল না। তাজেল যদি তখন না বলতো আমি আছি নাহলে আমরা সাহস পেতাম না। ঐ যে আপনি বললেন না শুধু একটা হাত উঠানোর সাহস থাকতে হয়। সেই হাতটাই আপনার নেত্রীর। ওর জন্যই সাইমা আর আমি সাহস পেয়েছি।”

তখন তাজেল বলল,,

“আমার ডাক্তার পড়াইতে যাইয়া আমারে কইছে মিথ্যার কাছে মাথা না নুয়াইতে। তোমরা যদি নাও আইতা আমি একাই চিল্লাইতাম আমার ডাক্তারের লাইগা। আমার কথা নিক আর না নিক। কইছে একজন রে কইতে হেই একজন না হয় আমিই হইতাম। হে তো ভুল কিছু করে নাই। ঔ শামীমরে আমার একটুও ভালো লাগে না।”

মেহবিন তাজেলকে কোলে তুলে বলল,,

“আমার নেত্রী সত্যি সত্যি একদিন বড় যোগ্য নেত্রী হবে।”

~চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here