“এসব রাজনীতি ফাজনীতি করা ছেলে আমি বিয়ে করব না মা, কিছুতেই না।”
শিরিনা বেগম বিরক্ত চোখে পড়ার টেবিলের সামনে দাঁড়ানো মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।মেয়েটা গাল ফুলিয়ে ওড়নার কোণা হাতে পেচাচ্ছে আর বার বার এক ই কথা বলছে। তিনি মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন-
“এরকম বললে তো হবে না কুহু। তোর বাবা এ ছেলেকে পছন্দ করেছেন। তুই অন্তত গিয়ে দেখাটা করে আয়। না গেলে তোর বাবার সম্মান যাবে যে।”
কুহু একবার মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকালো। পরক্ষনেই দুহাত কানে চেপে চোখ বন্ধ করে মৃদু চিৎকার করলো “নায়ায়ায়া এ হতে পারে না”। তারপর শাবানা স্টাইলে দৌড়ে গিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে গেলো। বালিশে মুখ গুজে মিথ্যা কান্নার ভং ধরলো।
শিরিনা বেগম হতাশ চোখে তার সিনেমাবাজ মেয়ের কান্ড কারখানা দেখলেন। এই মেয়ে সারাদিন বাংলা সিনেমা দেখে আর আশির দশকের নায়িকাদের মতো ঢং করে।।তিনি মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন-
” ভালো করে সেজেগুজে রেডি হয়ে ভার্সিটি যাবি।ক্লাস শেষ করে সোজা ছেলের সাথে দেখে করতে যাবি।বুঝেছিস?”
কুহু প্রতিউত্তরে গুনগুন করে কান্নার সুর তুললো। শিরিনা বেগম মেয়ের ঢং আর সহ্য করতে পারলেন না তিনি মুখ ঘুরিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
মায়ের চলে যাওয়ার আভাস পেয়ে কুহু বিছানায় উঠে বসলো। কোমড়ে হাত দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছুক্ষন ভাবলো। তার প্রফেসর বাবা কি করে একজন রাজনীতিবিদের সাথে বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লাগতে পারে এই কথা কিছুতেই তার বোধগম্য হচ্ছে না। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ৮ টার উপর বাজে। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে গেলো সে।তাকে রেডি হয়ে ভার্সিটি যেতে হবে।
মোয়াজ্জেম সাহেব ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। শিরিনা বেগম ডায়নিং টেবিলে ব্রেকফাস্ট রেডি করছেন। বার বার তাকাচ্ছেন সিড়ির দিকে, কুহু নামলো কিনা দেখছেন। কুহু নামলো না, কুহুর পরিবর্তে নামলো যিয়াদ। তার কাধে একটা স্কুল ব্যাগ।ধুপধাপ শব্দ করে নামছে। সিড়ির শেষ ধাপে এসে বাবাকে দেখে থেমে গেলো সে। শব্দ কমিয়ে খুব ধীরে ধীরে নামতে লাগলো। ডায়নিং টেবিলের চেয়ারটা খুব আস্তে করে টান দিয়ে সরাল।তারপর ব্যাগ টা নিচে নামিয়ে রেখে বসে পড়লো। মোয়াজ্জেম সাহেব পেপার পড়া শেষ করে কাগজ ভাজ করে রেখে উঠে আসলেন। তিনি এসে যিয়াদের সামনাসামনি একটা চেয়ার টেনে বসলেন।
যিয়াদ গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে একবার তার পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর বাবাকে দেখে নিলো। পড়নে ফর্মাল ড্রেস,কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছেন। ইন করা শার্ট সাথে কালো প্যান্ট,কাচাপাকা চুল। চোখের দৃষ্টি এখনো অনেক ভালো তাই চশমা ব্যবহার করেন না। যিয়াদ ঢকঢক করে পানি খেলো।এবার তার প্রফেসর বাবা তাকে কঠিন কঠিন কিছু প্রশ্ন করবে সেটারই পূর্ব প্রস্তুতি স্বরূপ সে গলাটা ভিজিয়ে নিলো।
মোয়াজ্জেম সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন পরখ করলেন। মুখটা শুকনো লাগছে বোধহয় রাতে কম ঘুমাচ্ছে। তিনি সরাসরি প্রশ্ন করলেন-
“মুখটা শুকনো কেন?রাতে ঘুমোও নি?”
“দেরিতে ঘুমিয়েছি বাবা।পদার্থবিজ্ঞানের একটা অংক সলভ করতে দেরি হয়ে গিয়েছে।”
মোয়াজ্জেম সাহেবকে খুব প্রসন্ন দেখা গেলো। ছেলে পদার্থবিজ্ঞানের জন্য ঘুম বিসর্জন দিয়েছে শুনে তিনি বেশ খুশি হলেন।তিনি পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করার জন্য তৈরি হলেন। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন-
“নিউটনের সেকেন্ড ল সম্পর্কে সবথেকে ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা কি বলো তো।”
যিয়াদের প্লেটে শিরিনা বেগম পরোটা দিলেন। যিয়াদের বেশ ক্ষুধা লেগেছে। কিন্তু বাবার প্রশ্ন শুনে তার জিহবা আটকে গেছে। সে নিউটনের তিনটা সূত্রের আগামাথা সব ই জানে কিন্তু বাবার সামনে আসলেই সব গুলিয়ে ফেলে।সে মনে মনে উত্তর রেডি করতে চেষ্টা করলো কিন্তু অস্থিরতায় পারলো না।
মোয়াজ্জেম সাহেব ভ্রু কুচকে ছেলেকে দেখলেন। তার এই অসম্ভব মেধাবি ছেলেটা কোনো এক কারনে তার সামনে এলেই ভড়কে যায়। তিনি ছেলের ভয় ভাঙানোর জন্য প্রতিনিয়তই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।খাবার টেবিলে তিনি বিভিন্ন প্রশ্ন করে ছেলেকে সহজ করতে চাচ্ছেন কিন্তু এতে কোনো কাজ হচ্ছে না বরং তার ছেলে খাবার টেবিলটাকেই ভয় পেতে শুরু করেছে। তিনি ছেলেকে আশ্বাস দিয়ে বললেন-
“অস্থির না হয়ে মাথা ঠান্ডা করে চিন্তা করো।”
শিরিনা বেগম স্বামীর প্লেটে নাস্তা দিতে দিতে বললেন-
“ছেলেটা গত রাতে ভালো করে ঘুমোয় নি।দিন রাত পড়েই যাচ্ছে। খাবার টেবিলে অন্তত ছেলেটাকে রেহাই দাও।”
মোয়াজ্জেম হোসেন স্ত্রীর কথায় একমত হলেন। তিনি স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন-
“কুহু কোথায়?”
“রেডি হয়ে একবারে নামবে।”
কিছুক্ষন পর ই কুহু নেমে এলো। শিরিনা বেগম সিড়ির দিকে তাকিয়ে মেয়েকে দেখলেন।একটা ল্যাভেন্ডার কালারের আনারকলি পড়েছে কুহু।চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে পিছন দিকে নিয়ে ক্লিপ দিয়ে আটকে দিয়েছে। বেশ পরিপাটি করেই সেজেছে। কুহু তার বাবাকে দেখে খুব ভদ্রভাবে যিয়াদের পাশের চেয়ার টেনে ভার্সিটির ব্যাগটা পাশে রেখে বসলো।মৃদু স্বরে বলল-
“গুড মর্নিং বাবা।”
মোয়াজ্জেম সাহেব পরোটা ছিড়তে ছিড়তে উত্তর দিলেন-
“গুড মর্নিং। এত দেরি করে খেতে এসেছো কেন?তোমার ভার্সিটি কয়টায়?”
কুহু মিন মিন করে বললো-
“রেডি হতে দেরি হয়েছে বাবা।”
“সময়জ্ঞান জীবনে খুব ই গুরত্বপূর্ণ। এটা মেইনটেইন করে চলবে।”
কুহু একপাশে মাথা হেলিয়ে বুঝালো এবার থেকে সে মেইনটেইন করবে সময়। শিরিনা বেগমও খেতে বসলেন। খাওয়ার এক পর্যায়ে মোয়াজ্জেম সাহেব কুহুকে উদ্দেশ্য করে বললেন-
“আজ ভার্সিটির পর তুমি আমার বন্ধুর ছেলের সঙ্গে দেখা করতে যাবে।তোমার মা নিশ্চয়ই তোমাকে তার সব ডিটেইল বলেছে। ”
কুহু একবার অসহায় চোখে তার মায়ের দিকে তাকালো। শিরিনা বেগম মেয়ের দিকে তাকালেন না।তিনি খাবার খেতে ব্যস্ত।মোয়াজ্জেম সাহেব আবারো বললেন-
“ভদ্রভাবে কথা বার্তা বলবে। ছেলেটি খুব ভদ্র এবং চুপচাপ।তাকে কোনো রকম অস্বস্তিতে ফেলবে না।”
কুহু তার বাবার সামনে কিছু বলার সাহস পেলো না।কিন্তু তার খুব বলতে ইচ্ছে হলো “রাজনীতি ফাজনীতি করা ছেলে আমি বিয়ে করব না বাবা”। কিন্তু সে বলতে পারলো না। চেয়ারে শক্ত হয়ে বসে রইলো। মোয়াজ্জেম সাহেব খাওয়ার ফাকে একবার মেয়েকে দেখে নিয়ে বললেন-
” কি বলেছি বুঝতে পেরেছো?”
“জী বাবা।”
যিয়াদ খাওয়ার ফাঁকে বড় বোনকে আড়চোখে একবার দেখে নিলো। তার বোন যে চিপায় পড়েছে তা তার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছে। কিন্তু করার কিছু নেই।
————–
কুহু ভার্সিটির গেটের সামনে এসে রিক্সা থেকে নামলো। গেটের সামনে ফুচকা দেখে তার জিভে পানি এসে গেলো। সকালে খাবার টেবিলে সে ভাল করে খেতে পারে নি তাই ফুচকা দেখে ক্ষিধেটা বেড়ে গেছে। কিন্ত এখন ফুচকা খেলে চলবে না তার ক্লাসের দেরি হয়ে যাবে। সে শুকনো মুখে ভার্সিটিতে ঢুকলো। ক্লাসে ঢুকে পিছনের দিকে সিটে তনয়াকে দেখতে পেলো। কুহুকে দেখেই হাত উচিয়ে ডাকলো তনয়া। কুহু হেটে গিয়ে ধপ করে তনয়ার পাশে বসে পড়লো। তনয়া ভ্রু কুচকে কুহুকে পরখ করলো। প্রশ্ন করলো-
“মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছিস কেন?”
কুহু উদাস হয়ে উত্তর দিলো-
“দ্বীন দুনিয়া কিছু ভাল্লাগে না রে।”
“কেন?”
“বাবা কোথাকার কোন রাজনীতিবিদের সাথে আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছে।আজ ক্লাসের পর আমাকে দেখা করতে যেতে বলেছে।”
তনয়া বড় বড় চোখে কুহুকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললো-
“এ জন্যই সেজেগুজে ভদ্র হয়ে এসেছিস?”
কুহু মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললো-
“হুম্মম্মম।”
“তো অসুবিধা কোথায় যা দেখা করে আয়।”
“আমার রাজনীতিবিদ পছন্দ না।”
“তাহলে এভাবে গেলে তো তোকে দেখে পছন্দ করে ফেলবে। তার চেয়ে বরং একটু বিশ্রি করে সেজে যা, তাহলে পছন্দ করবে না। আয় তোর কাজলটা লেপ্টে দিই।”
কুহু ছিটকে দূরে সরে গেলো। তনয়ার দিকে তাকিয়ে বলল-
“পাগল হয়েছিস!! এত সুন্দর করে ববিতার মতো করে কাজল দিলাম আর তুই লেপ্টে দিবি!”
“দুনিয়ায় এত নায়িকা থাকতে তুই আশির দশকের নায়িকাদের পিছনে পড়ে আছিস কেন বুঝিনা।”
কুহু লাজুক মুখে হেসে বলল-
“ওদেরকে আমার ভালো লাগে। ওদের মতো অভিনয় করতে ভালো লাগে।”
বলেই সে ওড়নার কোণা টেনে মুখে চেপে নায়িকাদের মতো করে হাসলো। কুহুর এসব ঢং দেখে তনয়া মুখ সরিয়ে নিলো। আজ সারাদিনের জন্য সে যথেষ্ট ঢং দেখে ফেলেছে। আর দেখতে চায় না। প্রতিদিন ই কুহুর এসব দেখে দেখে সে রীতিমতো অতিষ্ট। এম্নিতে ভাব ধরছে মানা যায় কিন্তু মাঝে মাঝে কুহু আশির দশকের বাংলা ছবির নায়িকাদের মতো সেজেগুজে ভার্সিটি আসে। এরকম সুন্দরি একটা মেয়েকে এই গেটাপে দেখে ছেলেরা তখন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কেউ কেউ তো বিভিন্ন নামে ডেকে ওঠে।
কুহু তনয়ার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল-
“একটা বুদ্ধি দে না কিভাবে কি করব।”
তনয়া কুহুর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল-
“আগে গিয়ে দেখা কর। পরে বাসায় গিয়ে বলে দে যে পছন্দ হয় নি। রাজনীতি যেহেতু করে নিশ্চয়ই বয়স বেশি,ভুড়ি-টুড়িও থাকতে পারে।যেকোনো একটা খুঁত বের করে না করে দিবি।”
কুহুর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেলো।বুদ্ধিটা বেশ লেগেছে তার কাছে। তার মনটা খুশি হয়ে গেলো।সে খুশি মনে ব্যাগ থেকে টিস্যুতে মোড়ানো একটা পরোটা আর ডিম ভাজি বের করলো। তনয়া চোখ কপালে তুলে বললো-
“একি!!এসব কি এনেছিস?”
কুহু ডিম ভাজিটা পরোটার ভিতর রেখে রোল করতে করতে বললো –
“টেনশনে খেতে পারি নি বুঝলি। এখন বুদ্ধি পেয়ে টেনশন কিছুটা কমেছে। তাই এখন খাব।”
তনয়া সামনে তাকিয়ে দেখলো স্যার এসে ঢুকেছে ক্লাসে।এদিকে ক্লাসের এইদিকটা পরোটা আর ডিম ভাজির গন্ধে ম ম করছে। কয়েকজন পিছন ফিরে অলরেডি তাকিয়ে দেখেও নিয়েছে। তনয়া অবিশ্বাস্য চোখে কুহুর দিকে তাকিয়ে বললো-
“তুই কি মানুষ?”
কুহু উত্তর দিতে পারলো না। সে বড় করে একটা কামড় দিলো পরোটা আর ডিম ভাজির রোলটাতে।তারপর মুখ ভর্তি খাবার চিবাতে চিবাতে তনয়ার দিকে তাকিয়ে গা জ্বালা হাসি দিলো।
__________
একটা ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্টের লিফটে দাঁড়িয়ে দাঁত দিয়ে নখ কাটছে কুহু। তার গন্তব্য ছাদ। ছাদে একটা ক্যাফে আছে। ক্যাফেটা এই রেস্টুরেন্টের ই একটা অংশ।এই ক্যাফেটার বিশেষত্ব হচ্ছে এইখান থেকে শহরটা খুব সুন্দর করে দেখা যায়।দারুণ ভিউ! প্রি বুকিং ছাড়া এই ক্যাফেতে টেবিল পাওয়া যায় না।ভি আই পি রাই কেবল আসতে পারে এখানে। চারপাশে নিরিবিলি ভাব রাখার জন্য অধিকাংশ টেবিলের বুকিং নেয়া হয় না। ইচ্ছে করে খালি করে রাখে কর্তৃপক্ষ।
লিফট চলে এলো ছাদে। লিফটের দরজা খুলতেই সামনে বিশাল ছাদ নজরে এলো। ছাদের এখানে ওখানে ছড়ানো ছিটানো টেবিল চেয়ার।বেশিরভাগ ই খালি। কুহু লিফট থেকে বেরিয়ে খোপার ক্লিপটা খুলে দিলো। পিঠ পর্যন্ত চুল গুলো ঝর ঝর করে নেমে গেলো। নিজের সব কিছু ঠিকঠাক করলো।সে বিয়ের করতে চায় না তাই বলে নিজেকে কি একটু পরিপাটি দেখাবে না? সব ঠিকঠাক করে কুহু এক সাইডে থাকা কাউন্টার টার কাছে গেলো। যেতে যেতে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো পাঞ্জাবি পড়া কোনো লোক বসে আছে কিনা।তার জানামতে রাজনীতিবিদরা বেশির ভাগ পাঞ্জাবিই পড়ে।কিন্তু এমন কাউকে সে পেলো না। সে কাউন্টারে থাকা লোকটাকে জিজ্ঞেস করলো-
“এক্সকিউজ মি,আমার একটা টেবিল বুক করা ছিলো । ”
“কি নামে বুক করা ছিলো ম্যাম?”
“শাহাদ খান।”
“ওহ ম্যাম,আসুন।স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।”
কুহু লোকটির পিছু পিছু গেলো। লোকটি তাকে ছাদের অন্যপাশে নিয়ে গেলো। হাত দিয়ে কোনার দিকে একটা টেবিল দেখিয়ে বলল-
“এই যে আপনার টেবিল ম্যাম।”
কুহু তাকিয়ে দেখলো কাচ ঘেরা রেলিঙের কাছে একটা টেবিল।সেখানের একটা চেয়ারে এশ কালার শার্ট আর কালো প্যান্ট পরিহিত একটা ছেলে বসে আছে। পায়ের উপর পা তুলে মোবাইল টিপছে। কুহু মনে মনে ভাবলো এটাই কি সেই রাজনীতিবিদ ছেলে? একে দেখতে তো রাজনীতিবিদ মনেই হয় না।কুহু হেটে গিয়ে টেবিলটার সামনে দাঁড়ালো। এতক্ষন মোবাইল টিপতে থাকা ছেলেটা তার আসার আভাস পেয়ে মুখ তুলে তাকালো। কুহু এক নজর সামনে থাকা ছেলেটাকে দেখে বোকা বনে গেলো।এর কি খুত বের করবে সে? এ তো পুরাই রসগোল্লা।
ছেলেটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কুহুর দিকে তাকালো। কুহু মুখ ফসকে বলে ফেললো-
“আমি হুকু।আপনার সাথে দেখা করতে……”
বলেই কুহু থেমে গেলো। এ কিসব বলছে সে? সামনে থাকা ছেলেটা কিছু বুঝতে না পেরে বললো-
“হোয়াট?”
কুহু মনে মনে নিজেকে গালি দিলো। তারপর কোনোমতে বললো –
“আমি আসলে কুহু। আমি দেখা করতে এসেছি।”
সামনে থাকা ছেলেটি কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো।তারপর চেয়ার দেখিয়ে বলল-
“বসুন।”
কুহু বসলো। একটু ভদ্রতাসূচক হাসলোও।কিন্তু ছেলেটা সেই হাসিতে যোগ দিলো না বরং সে কুহুকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করলো। তারপর টেবিলে থাকা মেন্যুটা এগিয়ে দিয়ে বলল-
“কি নিবেন অর্ডার করুন।”
“আমি কিছু নিব না। আপনি নিন।”
“কফি?”
কুহু ঘাড় বাকিয়ে সম্মতি দিয়ে বলল-
“ওকে।”
শাহাদ দূরে দাঁড়ানো ওয়েটারকে ইশারা করে দুটো কফি আনতে বললো।তারপর তাকালো কুহুর দিকে। মেয়েটাকে বেশ চঞ্চল মনে হচ্ছে,অস্থির স্বভাব।এসেই নাম ভুল করেছে। অস্থিরতার দরুন বলেছে “হুকু”।এখনো ব্যাগের কোণা নখ দিয়ে খুটছে। চোখের মনি স্থির নেই বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। শাহাদ চিন্তা করলো এভাবে বসে না থেকে কিছু কথাবার্তা বললে হয়ত মেয়েটা সহজ হবে।সে প্রশ্ন করলো-
” কিসে পড়ছেন?”
“অনার্স সেকেন্ড ইয়ার।ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট। দ্য রয়াল ডিপার্টমেন্ট। ”
শাহাদ দম ধরে গেলো।একটা প্রশ্নতে এতগুলো ইনফরমেশন দিয়ে দিলো।এই মেয়ে তো কথাও বেশি বলে। পরের প্রশ্ন আর শাহাদকে করতে হলো না কুহু নিজে থেকেই প্রশ্ন করলো-
“আপনি কি আসলেই রাজনীতি করেন?”
শাহাদ কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো কুহুর দিকে। তারপর উত্তর দিলো-
“হ্যা।”
এই কথা শুনে কুহুর মন ভেংগে গেলো।হ্যান্ডসাম দেখতে ছেলেটা রাজনীতি করে? রাজনীতি না করে অন্য কিছু করলে তো এক নিমিষে বিয়ে করে ফেলত কুহু।সে হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“হোয়াই?কেন করেন?”
শাহাদ কুহুকে ভালো করে দেখলো। মেয়েটি কি হতাশ হলো নাকি তার রাজনীতি করা নিয়ে?সে উত্তর দিলো-
“এটা আমার ফ্যামিলি ট্রাডিশন।”
কুহুর মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো।পুরো ফ্যামিলি রাজনীতি করে। আহারে!! এই ছেলে ভুল ফ্যামিলিতে জন্মেছে। তার ইচ্ছে হলো দুই কানে দুই হাত চেপে “নায়ায়া” বলে একটা চিৎকার দিতে। কিন্তু তা সম্ভব না।
কফি চলে এলো। কফির ট্রে থেকে দুটো কফির কাপ দুজনের সামনে রেখে ওয়েটার বিদায় নিলো। শাহাদ ট্রে তে থাকা পাত্র থেকে একটা সুগার কিউব তুলে তার কফিতে ছেড়ে দিয়ে হালকা নাড়তে লাগলো। কুহুও শাহাদের দেখাদেখি একটা সুগার কিউব নিলো। ভালো করে নেড়ে এক চুমুক মুখে দিয়ে মুখ কুচকে ফেললো। এত তিতা? সে আরো দুটো সুগার কিউব নিয়ে কাপে ফেললো।শাহাদের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে অনায়াসে এই তিতা কফি খাচ্ছে। শাহাদের দিকে তাকিয়ে কফি নাড়তে গিয়ে কুহু কাপ থেকে কফি ফেলে দিলো। গরম কফি ছিটকে পড়লো তার হাতে। “আহ” করে মৃদু শব্দ করে উঠলো।
শাহাদ তৎক্ষনাৎ ব্যস্ত হয়ে নিজের কাপ নামিয়ে রাখলো। টেবিলে টিস্যু খুজে না পেয়ে হাত দিয়েই কুহুর হাতে থাকা কফি মুছতে লাগলো।কুহুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“বেশি গরম?”
কুহু যতটা না গরম কফি পড়ায় চমকে গেলো তার চেয়ে বেশি স্তম্ভিত হয়ে গেলো শাহাদের কাজে।সে শাহাদের দিকে তাকিয়ে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে জানাল বেশি গরম না। শাহাদ তার হাত সরিয়ে ওয়েটারকে ডেকে বললো টিস্যু দিতে। কুহু অস্বস্তি কাটাতে বললো-
“আরেহ টিস্যু আমার কাছেই আছে।”
বলে সে ভার্সিটির ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে টিস্যু বের করলো। কিন্তু টিস্যুর পরিবর্তে বের হয়ে এলো টিস্যুতে মোড়ানো কুহুর আধ খাওয়া পরোটা আর ডিম ভাজির রোলটা। যেটাকে কুহু টিস্যু ভেবে বের করেছে। শাহাদ ভ্রু কুচকে টেবিলে থাকা আধ খাওয়া পরোটা ডিম ভাজির রোলটার দিকে তাকিয়ে কুহুকে জিজ্ঞেস করলো-
“হোয়াট দ্য হেল ইজ ইট?”
চলবে
#পর্ব-১
#টক_ঝাল_মিষ্টি
#তামান্না_আঁখি