#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_২১
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
জোরে চিৎকার করে দাঁড়িয়ে গেল সে, বলল – এ সিনেমা আমি দেখবো না। আমি হোস্টেলে যাব।
জায়ান আর তৃষাম চমকে উঠলো। ভরকে গেল পূর্বাশার চিৎকারে। অপ্রস্তুত হলো তৃষাম। আশেপাশে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে টেনে ধরলো পূর্বাশার এক হাত, বলল – কি করছিস কি? বস।
পূর্বাশা বসলো না বরং চোখ মুখ খিচে আবার বলল – আমি এই ছবি দেখবো না। আমি হোস্টেলে যাব।
জায়ান তাকালো পূর্বাশার পানে। মেয়েটা ভয়ে কেমন কুকরে গেছে। মায়া হলো তার। আসলে হরর মুভি দেখতে নিয়ে আসাটাই তার ভুল হয়েছে। তার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল মেয়েটা ভয় পেতে পারে। কিসের জন্য নিয়ে এলো আর কি হলো। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো জায়ান। নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো, বলল – আচ্ছা এই মুভি আর দেখবো না। চলুন বাইরে।
পূর্বশা দেরী করলো না আর এক মুহূর্তও। জায়ানের কথা শেষ হতেই আগে আগে কক্ষ ত্যাগ করলো সে। তৃষামও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এই মুভি দেখতে তারও ভয় লাগছিলো কিছুটা। শুধু মাত্র মান ইজ্জতের ভয়ে কিছু বলতে পারেনি এতক্ষন। বোনের সম্মুখে যদি বলতো হরর মুভি দেখবো না আমার ভয় লাগে। তাহলে বোন নিশ্চই তাকে ভীতু ভাবতো। যাক এ যাত্রায় অন্তত পূর্বাশা বাইরে বাঁচিয়ে দিল তাকে। একে একে হরর মুভির থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এলো পূর্বাশা, তৃষাম আর জায়ান। কিন্তু এখনই কি চলে যাবে তার? এখানে এসেছে তারা ঘন্টা খানেকও হয়নি। হরর মুভি না হয় দেখতে পারবে না ভয় লাগে অন্য মুভিও তো রয়েছে তাই না। এখন না হয় সেগুলোর মধ্যেই দেখা যাক একটা। জায়ান এবারও রোমান্টিক মুভিটা বাদ দিল। সিলেক্ট করলো একটু মোটিভেশনাল ধাঁচের মুভি। এতে অতি মাত্রায় রোম্যান্সও থাকবে না আর ভয়ের ও কিছু থাকবে না। যা থাকবে শিক্ষনীয় কিছুই। পূর্বাশাকে নিয়ে আবার এক কক্ষের মধ্যে ঢুকলো জায়ান আর তৃষাম। এই থিয়েটারটাও ফাঁকা বেশ। তাই সম্মুখের দিকের তিনটা সিট দখল করেই বসে পড়লো তারা। সম্মুখের পর্দায় শুরু হলো সিনেমা। সিনেমার প্রথমেই দেখা গেল একটা মেয়ে ভালোবাসতো একটা ছেলেকে। আর ছেলেটা তাকে খুব বাজেভাবে ঠকিয়ে অন্য নারীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। ফলস্বরূপ মেয়েটা ভেঙে পড়েছে ভীষণভাবে। আ’ত্ম’হ’ত্যা’র’ও চেষ্টা করেছে। তখন তার বন্ধু বান্ধীরা এসে তার পাশে দাঁড়ায়। একজন বান্ধবী বলল – এমন সিদ্ধান্ত কেউ নেয়? একটা গেলে তিনটা আসবে।
অন্য একজন বান্ধবী বলল – শোন যা হয়েছে ভালো হয়েছে। ধর এমন ঘটনা যদি বিয়ের পর ঘটতো তখন তুই কি করতি? না পারতি সহজে ছাড়তে না পারতি গিলতে। তার থেকে আগেভাগে ওর স্বরূপ তোর সম্মুখে চলে এসেছে তুই নিজেকে সরিয়ে নিতে পেরেছিস।
তৃতীয় এক বন্ধু বলল – শোন,
“সঠিক মানুষকে ভালোবাসলে চেনা যায় একজনকে আর ভুল মানুষকে ভালোবাসলে চেনা যায় পুরো জগৎকে। পুরো জগৎকে চেনা জন্য হলেও আমাদের জীবনে কিছু কিছু বেদনাদায়ক ভুলের প্রয়োজন আছে। তাই হয়তো আমরা কখনও কখনও ভুল মানুষকে ভালোবেসে ফেলি।”
তৃতীয় বন্ধুর কথার পরিপ্রেক্ষিতেই চতুর্থ এক বন্ধু উত্তর দিল – তা ঠিক। তবে আমি মনে করি কি এই প্রেম পিরিতিই ভালো না। প্রেম করলে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না।
চতুর্থ ব্যক্তির কথায় অন্তর যেন কাঁপিয়ে দিল জায়ানের। চলমান মুভির ভিতরকার কারো কথা কর শোনার শক্তি পেল না সে। ফিরে তাকালো পূর্বাশার পানে। মেয়েটা গালে হাত দিয়ে বেশ মনোযোগ সহকারে দেখছে মুভিটা। জায়ানের চোখ মুখ শুকিয়ে গেল। এ কোন মোটিভেশনাল মুভি দেখাতে সে নিয়ে এসেছে পূর্বাশাকে। এ তো দেখা যাচ্ছে তাকে চির কুমার রাখার মতো মোটিভেশনাল একটা মুভি। প্রেম শুরুর আগেই প্রেম ভাঙার বুদ্ধি দিচ্ছে। না এ মুভি আর দেখা যাবে না তাহলে নির্ঘাত তাকে কুমারই মরতে হবে। এবার নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো জায়ান, থমথমে কন্ঠে বলল – আর মুভি দেখবো না। হোস্টেলে ফিরবো আমরা।
পূর্বশা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো জায়ানের পানে। নরম কন্ঠে বলল – মুভিটা তো ভালোই। দেখি না একটু।
সাথে সাথেই যেন জায়ানের হৃদয় প্রতিবাদ করে উঠলো। তীব্র বেগে বলল – হ্যা আমি আপনাকে এই মুভি দেখতে দেই আর আপনি প্রেম হওয়ার আগেই আমাকে একটা ছ্যাকা দিয়ে দিন।
তবে হৃদয়ের কথা হৃদয়েই গোপন রাখলো জায়ান। মুখে আর প্রকাশ করলো না। তার রাশভারী কন্ঠে বলল – আমার কাজ আছে। হঠাৎ মনে পড়লো, দেরী হলে হয়তো সমস্যা হবে।
কি আর করার। মুভিটা সম্পূর্ণ দেখার ইচ্ছে থাকলেও সে ইচ্ছে আর পূরণ করতে পারলো না সে। জায়ানের পিছু পিছুই বেরিয়ে এলো হলের বাইরে।
_____________________________________
দিন গড়ালো, রাতের দেখা মিললো। আকাশের সূর্যটা ডুবে গিয়ে দেখা মিললো সুন্দর এক চাঁদে। গোল থালার মতো এক মস্ত চাঁদ জায়গা করে নিয়েছে আকাশের মাঝে। সম্ভবত আজ পূর্নিমার রাত। জায়ান জানালা থেকে বসে বসে দেখছিলো চাঁদ খানা। হঠাৎ তার মনে পড়লো পূর্বাশার কথা। আজ সারাদিনে দেখা হয়নি মেয়েটার সাথে। এর মানে এই নয় যে সারাদিনে জায়ানের মনে পড়েনি পূর্বাশাকে। অবশ্যই মনে পড়েছে তবে ক্রাস, প্রজেক্ট বিভিন্ন কাজে মেয়েটার সাথে দেখা করার ফুসরত মিলেনি তার। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো জায়ান। তৃষামের দিকে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো তার পাশে। ছেলেটা বিরস মুখে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিলো শুধু। জায়ান একবার তাকালো সেদিকে অতঃপর আদেশের সুরে বলল – তোর বোনকে কল করে বাইরে বেরুতে বল।
বইয়ের পাতা থেকে দৃষ্টি সরালো তৃষাম। তাকালো জায়ানের পানে, বলল – কেন?
– বাইরে খেতে যাব আজ।
তৃষাম সরু দৃষ্টিতে তাকালো জায়ানের পানে, সন্দিহান সুরে বলল – কেন আমার বোনের সাথে এত কি তোর? কোনো দিন সিনেমা দেখতে নিয়ে যাচ্ছিস তো কোনোদিন বাইরে খেতে। কাহিনী কি?
তৃষামের প্রশ্ন একটুও যেন টলাতে পারলো না জায়ানকে। ভাবলেশহীন ভাবে সে জবাব দিল – সেদিনের ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত তাই। কাল সিনেমা দেখিয়ে নিজের অনুতপ্তবোধটা একটু লাঘব করতে চাইছিলাম কিন্তু তা তো একটা সিনেমাও ভালোভাবে দেখতে পারলাম না। তাই আজ বাইরে খাইয়ে অর্থাৎ ট্রিট দিয়ে নিজের অনুতপ্তবোধটা লাঘব করতে চাইছি একটু।
– শুধু কি অনুতপ্তবোধ নাকি অন্যকিছু?
জায়ানের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। তীক্ষ্ম কন্ঠে সে বলল – আর কি হবে? অতিরিক্ত চিন্তা বাদ দিয়ে তোর বোনকে ফোন লাগা।
তৃষাম দ্রুত নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। পিঠ থেকে টি শার্ট সরিয়ে বলল – আগে পিঠটা একটু চুলকে দে তাহলে আমি কল করবো পূর্বাকে।
জায়ান দাঁতে দাঁত চাপলো, রুক্ষ কন্ঠে বলল – কল দিবি নাকি তোর না’ই’টি পড়া ভিডিও দেব ভাইরাল করে।
তৃষামের মুখটা থমথমে হলো। থমথমে কন্ঠেই সে বলল – ব্ল্যাকমেইল করতে হবে না। আর দিচ্ছি আমি।
****
কল পেয়েই নিচে নেমে এলো পূর্বাশা। আজ একটু তৈরি হয়েই মেয়েটা। কারন এটা সে বেশ ভালোই বুঝেছে এই সময় এভাবে হঠাৎ জরুরী তলব মানে কোথাও যাবে তারা। পূর্বাশা বাহিরে বের হতেই জায়ান তাদের নিয়ে কলেজের পাশেই এক রেস্টুরেন্টে গেল। এক টেবিলে বসলো তিনজন। জায়ানকে দেখেই যেন পাশের টেবিলের মেয়েগুলো নেচে উঠলো। নিজেদের মধ্যে কিছু একটা বলতে বলতে হাসলো। যদিও জায়ানের চোখ এড়ায়নি বিষয়গুলো তবে তেমন একটা পাত্তা দিল না সে। মেনু কার্ডটা হাতে নিয়ে বারিয়ে দিল পূর্বাশার পানে, বলল – খাবার অর্ডার করুন।
পূর্বাশা ধরলো না মেনু কার্ডটা। মাথা নুইয়ে মিনমিনে কন্ঠে বলল – আমি এ দেশী খাবার সম্পর্কে জানি না কিছু। কোন নামের খাবারে কি থাকে তাও জানি না। অর্ডারটা বরং আপনিই করুন।
জায়ান একবার তাকালো পূর্বাশার পানে অতঃপর মেনুকার্ড দেখে অর্ডার করে দিল কিছু খাবার। কিঞ্চিৎ সময় যেতেই একজন ওয়েটার খাবারগুলো এনে রাখলো তাদের সম্মুখে। জায়ান নিজের হাত তুলে খাবারগুলো ঠেলে দিতে শুরু করলো এক একজনের দিকে। তখনই পাশের টেবিলের একটা মেয়ে উঠে এলো। দাঁড়ালো তার পাশে। কন্ঠে কিছুটা ইতস্তত নিয়েই জায়ানকে উদ্দেশ্যে করে চাইনিজ বাক্যেই শুধালো – আপনি কি সিঙ্গেল?
জায়ান আড় চোখে তাকালো পূর্বাশার পানে। মেয়েটার এদিকে কোনো খেয়াল নেই। গোল গোল চোখে সে দেখছে খাবার গুলো। এদিকে একটা মেয়ে এসে জায়ানকে জিজ্ঞেস করছে সিঙ্গেল নাকি মিঙ্গেল আর ওদিকে পূর্বাশা তার দিকে দেখছেই না। থমথমে হলো জায়ানের মুখমন্ডল, গম্ভীর কন্ঠে সে চাইনিজ বাক্যে উত্তর দিল – আমি বিবাহিত।
সহসা চমকে উঠলো পূর্বাশা আর তৃষাম। সম্পূর্ণ চাইনিজ ভাষা আয়ত্তে না এলেও সে এখন অল্প বিস্তার জানে চাইনিজ ভাষা। এখানে এলো তো একদম কম দিন হলো না। তাই মেয়েটা বা জায়ানের কথাপকথন বুঝতে বেশি অসুবিধা হলো না বেশি। অবাক হলো মেয়েটা। জায়ান আবার বিয়ে করলো কবে? আর যদি বিয়েই করে থাকে তবে তার বউ কে? এখানে এসে যতদিন জায়ানকে দেখেছে কখনও তো মনে হয়নি জায়ান বিবাহিত। আবার হতেও পারে। মনে মনে অবাক হলেও পূর্বাশা তবে মুখে প্রকাশ করলো না। মেয়েটা চলে গেল তাদের পাশ থেকে। নিজের অবাকত্ব আর ধরে রাখতে পারলো না তৃষাম, অবাক কন্ঠে সে শুধালো – তুই বিয়ে করলি কবে? এতদিন ধরে তোর সাথে আছি আমরা জানলাম না কেন?
জায়ান খাবারের দিকে মনোনিবেশ করলো, নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল – বিয়ে করিনি।
– কিন্তু তুই বললি যে তুই বিবাহিত।
– একদিন না এক দিন তো হবো। সারাজীবন তো আর সিঙ্গেল থাকবো না।
– তাই বলে…
নিজের কথাটা আর সম্পূর্ণ করতে পারলো না তৃষাম। তার আগেই তাকে থামিয়ে দিল জায়ান, তীক্ষ্ম কন্ঠে শুধালো – খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। খাওয়া শুরু কর।
তৃষাম চুপচাপ খাওয়া শুরু করলো। খেতে খেতেই তাকালো পূর্বাশার পানে, বলল – ওহ পূর্বা তোকে তো একটা কথা বলাই হয়নি।
পূর্বাশা নিজের খাওয়া থামালো, তাকলো তৃষামের পানে। বার কয়েক পলক ঝাপটে শুধালো – কি?
– আসলে আমার বন্ধু জায়ান খুব লাজুক মানুষ তো তাই ও বলতে পারছে না, ওর হয়ে আমাকে বলতে হচ্ছে আর কি।
জায়ান নিজেও এবার খাওয়া থামিয়ে দিল। ভ্রু কুঁচকে তাকালো তৃষামের পানে। কি এমন কথা যা সে লজ্জায় বলতে পারছে না বলে তৃষাম বলবে। তৃষাম একবার তাকালো দুইজনের উৎসুক মুখশ্রীর দিকে অতঃপর পূর্বাশাকে উদ্দেশ্য করে বলল – আসলে জায়ান তোর সাথে করা সেদিনের ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত। আর সেই অনুতপ্তবোধ থেকেই কাল সিনেমা দেখতে নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু সেখান থেকে যেহেতু সিনেমা না দেখেই চলে আসতে হলো তাই এখানে আজ আবার তোকে ডেকেছে। ও আসলে তোর কাছে ক্ষমা চাইছে।
পূর্বাশা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলো, বলল – এর আবার কিসের প্রয়োজন ছিল। আমি তো আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি উনাকে।
তৃষাম আড় চোখে তাকালো জায়ানের দিকে অতঃপর বলল – তবুও, তবে তোকে রোজ রোজ এই সিনেমা দেখতে নিয়ে যাওয়া, বাইরে খাওয়ানো সব কিছুই কিন্তু ওর অনুতপ্ত বোধ থেকে। এর মধ্যে ছিটে ফোঁটা কিন্তু অন্য কিছু নেই। তুই আবার অন্য কিছু ভেবে বসিস না।
চলবে…….
ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v
গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link
[ আহরাব ইশতিয়াদ এবং নিশিতা জুটির উপর লেখা আমার প্রথম উপন্যাস “স্নিগ্ধ প্রেয়শী” পড়ে নিন বইটই অ্যাপে, মাত্র ৪০ টাকা। বইয়ের লিংক এবং কিভাবে কিনবেন পেয়ে যাবেন কমেন্ট বক্সে ]