স্নিগ্ধ_প্রিয়া #সাদিয়া_শওকত_বাবলি #পর্ব_১৫

0
845

#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১৫

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

সময় প্রবাহমান। সে বয়ে চলে নিজের গতিতে। থেমে থাকে না কারোর জন্যই। এর মধ্যে কেটে গেছে বেশ অনেকটা দিন। পূর্বাশাদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়ে ক্লাস শুরু হওয়ার দিনক্ষনও চলে এসেছে। পূর্বাশার পা ও এখন একদম ঠিক। এত দিনে তার সাথে জায়ান বা ইয়ানের দেখা হয়নি একবারও। দেখা হবে কিভাবে, সে তো বাহিরে বেরই হয়নি। পায়ের ব্যথা নিয়ে সারাদিন হোস্টেল রুমে বসেই সময় কাটিয়েছে সে। বিভিন্ন বিউটি প্রডাক্টে গায়ের রংটাও উজ্জ্বল হয়েছে তার অনেকটা। তাছাড়া আবহাওয়ারও একটা ব্যাপার রয়েছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া এবং চীনের আবহাওয়ার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। এই আবহাওয়ার তারতম্যের জন্যও গায়ের রংটা উজ্জ্বল হয়েছে পূর্বাশার। এছাড়াও আরও কি কি নাকি তেলেসমতি কাজকারবার রয়েছে সেনজেই, সুজা এবং জেফির। এতদিন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত থাকার জন্য নিজেদের কাজকারবার দেখাতে পারেনি পূর্বাশাকে তাই আজ তিনজনই লেগে পড়েছে নিজেদের কাজে। কাজ যে তাদের প্রথম ক্লাস।

দীর্ঘ সময় ধরে সেনজেই, সুজা আর জেফি বেশ দৌড়া দৌড়ি করে কি একটা চটচটে আঠার মতো পদার্থ নিয়ে হাজির হলো পূর্বাশার সম্মুখে। তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে সেনজেই পা ধরলো তার। পড়নের পাজামা পা এর নিচের অংশ থেকে টেনে তুলতে নিলেই তাকে বাঁধা দিল পূর্বাশা। সেনজেই মানলো না তার বাঁধা। পায়ের নিচের অংশ থেকে পাজামাটা টেনে হাঁটু অব্দি তুলে দিল তার। পূর্বাশা যেন লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। বড় হওয়ার পর তার মায়ের সম্মুখেই তো সে কখনও পাজামা হাঁটু পর্যন্ত তোলেনি আর তো অপরিচিত মেয়েরা। পূর্বাশা আড়ষ্ঠ হলো, মিনমিনে কন্ঠে বলল – যা করার পাজামা নামি করা যায় না?

সেনজেই উত্তর দিল না কোনো। আলতোভাবে সেই আঠালো পদার্থ লাগালো পূর্বাশার পায়ে অতঃপর তার উপরে কেমন কাগজ জাতীয় কিছু লাগিয়ে দিল টান, সাথে সাথেই গগন বিদারক চিৎকার করে উঠলো পূর্বাশা। তার চিৎকারে হকচকিয়ে উঠলো সেনজেই, সুজা আর জেফিও। আশেপাশের রুম থেকেও দৌড়ে এলো মেয়েরা কিছু মেয়েরা। পূর্বাশা উঠে যেতে চাইলো চেয়ার থেকে, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিল জেফি। অভয় দিয়ে বলল – প্রথমবার তো তাই একটু ব্যথা পেয়েছো। একটু কষ্ট করে বসো তোমার ওয়াক্সিং করা হচ্ছে। এটা করলেই দেখবে তোমার ত্বক একদম ঝকঝকে তকতকে হয়ে যাবে।

– আমার ঝকঝকে তকতকে ত্বক লাগবে না তবুও আমি আমাকে ছাড়ো আমি ওসব করবো না।

পূর্বাশার উত্তরের প্রেক্ষিতে সুজা বলল – আহ তুমি বুঝতে পারছো না। জাস্ট একটু তো প্রথম প্রথম একটু এমন হবে তারপর ঠিক হয়ে যাবে। সেনজেই তুই তোর কাজ শুরু কর।

সুজার অভয় পেয়ে সেনজেই আবার ঐ আঠালো পদার্থ পূর্বাশার পায়ে লাগাতে উদ্যত হলো, লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো মেয়েটা, বলল – আমার সুন্দর হওয়ার দরকার নেই তবুও এইসব লাগিয়ে আমাকে জানে মেরে ফেলো না।

সেনজেই, জেফি আর সুজা অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলো পূর্বাশাকে। কিন্তু মেয়েটাকে বুঝাতে সক্ষম হলো না কেউ। মেয়েটা শেষ পর্যন্ত ওদের ওয়াক্সিং নামক অত্যাচার থেকে বাচতে ওয়াশ রুমের দরজা আটকে বসে রইলো। হাল ছেড়ে দিল তারা তিনজন। আর আর ওসব লাগালো না পূর্বাশার হাতে পায়ে।

_____________________________________

সকালের আলো ফুটেছে। সূর্যটা তার তেজ নিয়ে জ্বলে উঠতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। ব্যস্ত শহরাটাও ব্যস্ত হয়ে পড়ছে ক্রমশ। রাতের নিস্তব্ধতার পর ঐ যে যানবাহনের প্যা পো ধ্বনিতে ভরে উঠছে আশপাশটা।সেনজেই সুজা আর জেফি আজ সকাল সকালই ঘুম থেকে উঠেছে। আর উঠেই কোমড় বেঁধে নেমে পড়েছে পূর্বাশাকে সাজাতে। আজ তাদের প্রথম ক্লাস। এই প্রথম দিন এই মেয়েটাকে যেভাবে হোক সুন্দর দেখানো চাই ই চাই। প্রথম দিন অন্তত কারো বাজে কথা শুনে মেয়েটার মনে যেন হীনমন্যতার সৃষ্টি না হয় সে উদ্যেগেই কোমড় বেঁধে নেমেছে তারা। প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগিয়ে মেকআপের আবরনে পূর্বাশার মূল চেহারা ঢেকে সুন্দর করে তুলেছে পূর্বশার মুখশ্রী। সাজিয়ে গুছিয়ে পূর্বাশাকে দেখে যেন অবাক হলো তারা নিজেরাই। এক দৃষ্টিতে হা হয়ে তাকিয়ে রইলো তারা পূর্বাশার পানে। পূর্বাশার ভয় হলো, এত সাজিয়েও নিশ্চই তাকে সুন্দর লাগছে না। লাগবে কিভাবে? যতই সাজাক তাতে কি তার কৃষ্ণ কালো চামড়া ঢেকে ফেলা যাবে কিংবা তা কুশ্রী কি আর সুশ্রীতে পরিবর্তন করা যাবে? পূর্বাশার চেহারা মলিন হলো। মলিন কন্ঠেই সে বলল – আমাকে সুন্দর লাগছে না তাই না? আমি জানতাম যতই সাজাও আমাকে সুন্দর লাগবে না।

সেনজেই চমৎকার হাসলো, বলল – কে বলেছে তোমাকে সুন্দর লাগছে না? ভীষণ সুন্দর লাগছে।

সুজা আর জেফিও যোগ দিল তার সাথে, এক যোগে বলল – সত্যিই ভীষণ সুন্দর লাগছে। চোখের আড়ালে এই মেয়েটি যে এত রূপসী আমরা তো জানতামই না।

সেনজেই আয়না এনে দিল পূর্বাশাকে, আয়নায় নিজের মুখটা দেখলো সে। আবাক হলো পূর্বাশা। আজ আর তাকে কুৎসিত লাগছে না। বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। মনের ভিতরে কেমন একটা আত্মবিশ্বাসের জন্ম নিল তার। নাহ আর কেউ তাকে কুৎসিত কালো বলে অবজ্ঞা করবে না হয়তো। সবাই তাকে আজ সুন্দর বলবে। কেউ কালো, ডার্কি বলে তিরস্কার করবে না।

****

বেলা গড়ালো কিছুটা। কলেজের সময় হতেই তারা কলেজে পৌঁছালো। কলেজের সম্মুখের সিঁড়ি থেকে উঠতে নিতেই তাকে পিছু ডাকলো কেউ। পূর্বাশা তাকালো পিছু ফিরে দেখলো তৃষাম, জায়ান আর চ্যাং দাঁড়িয়ে রয়েছে। পূর্বাশার কলেজের প্রথম দিন আর এতদিন দেখাও হয়নি পূর্বাশার সাথে তাই দেখা করতে এসেছিল আজ। কিন্তু এখানে এসে যেন অবাক বনে গেল সে। এগিয়ে গিয়ে পূর্বাশার চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করলো তাকে, বলল – এ কি সত্যিই পূর্বাশা আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।

তৃষামের অবাকতার মধ্যেই ভেসে এলো জায়ানের তীক্ষ্ম কন্ঠস্বর। তীক্ষ্ম কন্ঠে সে বলল – পানি মার, তাহলেই বিশ্বাস হবে।

তৃষাম ততটা পাত্তা দিল না জায়ানের কথায়, হাসি মুখেই সে বলল – তোকে খুব সুন্দর লাগছে পূর্বা।

চ্যাংও তাল মিলালো তৃষামের সাথে, বলল – সত্যিই দারুন লাগছে তোমাকে।

পূর্বাশা কিছুটা লজ্জাবোধ করলো নিজের প্রশংসা শুনে। সাথে অন্যরকম এক ভালো লাগায় ছেয়ে গেল তার অন্তর। এমনভাবে তার কিংবা তার সৌন্দর্যের প্রশংসা কেউই কখনও করেনি, আজ প্রথম। তবে পূর্বাশার এই আনন্দিত মুহুর্ত বোধহয় সহ্য হলো না জায়ানের। কোথা থেকে বোতলে করে এক বোতল পানি এনে ছুঁড়ে মারলো পূর্বাশার মুখে। চমকে উঠলো পূর্বাশা, চোখ মুখ খিচে তৎক্ষণাৎ বন্ধ করে নিল সে। পূর্বাশার সাথে চমকালো তার সাথে উপস্থিত সবাই। হুট করে জায়ান এমন একটা কাজ করে বসবে ভাবতে পারেনি কেউই। তৃষাম রেগেমেগে বলতে বলতে গেল কিছু কিন্তু জায়ানের অগ্নি দৃষ্টির সম্মুখে পরাস্ত হলো সে। জায়ন এগিয়ে গেল পূর্বাশার পানে, বলল – মুখে রং চং মেখে নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে চাইছেন? কিন্তু এটা বুঝতে পারছেন না যে আপনার অস্বিত্বই আপনার পরিচয়। কি ভাবছেন সামান্য মেকআপ করেই আপনি সুন্দরী হয়ে গেলেন? এটা ভাবলেন না আপনি আপনার সত্ত্বাকে লুকিয়ে ফেলেন মেকআপের আড়ালে?

কথাগুলো বললে একটু থামলো জায়ান, আবার বলল – পৃথিবীর বুকে আমরা নানান জাত, নানান পেশা এবং নানান সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করি। আমরা কোনো মানুষই সয়ংসম্পূর্ণ নয়। আমরা প্রতিটি মানুষই একটা না একটা ঘাটতি নিয়ে জন্মগ্রহন করি। তবে আমরা সয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার চেষ্টা করি, আমাদের ভিতরকার সেই ঘাটতিকে লোক চক্ষুর অন্তরালে নেওয়ার চেষ্টা করি। কেন করি? অন্যকে খুশি করার জন্য। অন্যের দৃষ্টিতে ভালো থাকার জন্য। কেন? আমাদের জন্ম কি অন্যকে খুশি করার জন্য হয়েছে? আপনার জন্ম হয়েছে নিজের জন্য, নিজেকে খুশি রাখার জন্য। তো নিজেকে খুশি রাখুন। অন্য কে কি বলল, কে কি করলো তাতে আপনার কি আসে যায়? অন্য কেউ খেলে কি আপনার পেটের ক্ষুধা মরে যায় নাকি আপনি এক বেলা না খেলে অন্য কেউ এসে খাইয়ে দিয়ে যায়? অন্য কারো জন্য না বেঁচে নিজের জন্য বাঁচুন। নিজের গায়ের রং না লুকিয়ে টেনে হিচরে তাকে পৃথিবীর সম্মুখের আনুন। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুন, দুনিয়ার সম্মুখে প্রমান করে দিন আপনার গায়ের রং, উচ্চতা কিংবা শারীরিক কাঠামো আপনার সফলতার পথে বাঁধা হতে পারেনি। নিজেকে এমন স্থানে নিয়ে যান যেখানে আপনাকে তিরস্কার করা কোনো ব্যক্তি পৌঁছাতে পারবে না। উত্তর মুখে নয় কাজে দিতে শিখুন। নিজের সত্তাকে লুকিয়ে নয় প্রকাশ্যে টেনে বের করে হাসতে শিখুন। নিজেকে ভালোবাসুন, অন্যরা কে কি বলল চিন্তা না করে নিজের মতো বাঁচুন।

কথাটুকু বলেই হনহন করে হেঁটে চলে গেল জায়ান। পিছনে ফেলে গেল কতগুলো অবাক দৃষ্টি। পূর্বাশা অবাক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে রয়েছে জায়ানের চলে যাওয়ার পানে। চোখ দুটো তার অশ্রুসিক্ত। জায়ানের কথাগুলো যেন হৃদয় ছুঁয়ে গেছে তার। সত্যিই তো নিজের সত্তাকে লুকিয়ে চোরের মতো বাঁচতে চেয়েছিল সে? সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে অবজ্ঞা করতে চেয়েছিল সে। মানুষ না হয় তিরস্কার করেছে কিন্তু সেও তো কখনও নিজের সত্ত্বাকে মেনে নিতে পারেনি। নিজের সত্ত্বাকে মেনে একটু ভালো থাকার, নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা তো সে করতে পারতো। যা সে কখনওই করেনি। উল্টো মানুষের তিরস্কার শুনে নিজেকে, নিজের সত্ত্বাকে অবজ্ঞা করতে শুরু করেছিল সে। নিজেকেই তো সে নিজে ভালোবাসতে পারেনি কখনও তাহলে অন্য কারো কাছ থেকে ভালোবাসা আশা করে কিভাবে? সে তো কখনও নিজেই নিজের হয়নি তাহলে অন্য কেউ তার হবে কি করে?

চলবে…….

ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link

[ আহরাব ইশতিয়াদ এবং নিশিতা জুটির উপর লেখা আমার প্রথম উপন্যাস “স্নিগ্ধ প্রেয়শী” পড়ে নিন বইটই অ্যাপে, মাত্র ৪০ টাকা। বইয়ের লিংক এবং কিভাবে কিনবেন পেয়ে যাবেন কমেন্ট বক্সে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here