স্নিগ্ধ_প্রিয়া #সাদিয়া_শওকত_বাবলি #পর্ব_২৬

0
711

#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_২৬

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

কেউ দেখার আগেই নিজের ঠোঁটের হাসিটুকু গিলে বরাবরের মতো গম্ভীর মুখো হয়েই বসে রইলো সে। পূর্বাশাও আর বলল না কিছু। জায়ানের পাশে বসেই মনযোগী হলো বইয়ের ভাঁজে। তবে তাদের এইটুকু প্রেম জর্জরিত আনন্দে যেন নজর লাগলো কারো। একটু আগে এই এই চেয়ারে বসতে চাওয়া মেয়েটার দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। জায়ানের পাশের চেয়ারটা দখল করতে না পেরে তার সম্মুখের টেবিলে বসেছিল মেয়েটি। সেও তো গিয়েছিল ঐ চেয়ারে বসতে কিন্তু জায়ান এক প্রকার অপমান করেই তাকে ওখান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তাহলে কি এই মেয়েটার জন্য তাড়িয়েছে তাকে? এই কৃষ্ণবর্ণের কুৎসিত ভিনদেশী মেয়েটার জন্য অপমানিত হতে হয়েছে তাকে? মনের ভিতরের চাপা ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে এলো মেয়েটার। তীব্র ক্ষোভে জর্জরিত হয়ে পড়লো সে। ব্যাগ থেকে নিজের মোবাইলটা বের করে লুকিয়ে সকলের অগোচরেই পাশাপাশি বসা জায়ান আর পূর্বাশার গোটা কয়েক ছবি তুলে নিল মেয়েটি।

____________________________________

নিশুতি রাত‌। চারদিকে আঁধারের ঘনঘটা। সন্ধ্যা নাগাদ কলেজের মধ্যে জ্বলে ওঠা কৃত্রিম আলো গুলোর অনেকটাই নিভতে শুরু করেছে এখন। শিক্ষার্থীরাও তাদের বহিরাগত সকল কাজ কর্মের পাঠ চুকিয়ে চলে এসেছে হোস্টেলে। হয়তো ইতমধ্যে ঘুমিয়েও পড়েছে অনেকে। সবাই মোটামুটি হোস্টেলে ফিরেছে। জেফি বিছানায় শুয়ে শুয়ে উইচ্যাটে ঘুরছিল। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল একটা ছবিতে। লাফিয়ে উঠলো সে, ডাকলো সেনজেই, সুজা আর পূর্বাশাকে। তারা শুয়েছিল কেবল। জেফির চিৎকারে হুড়োমুড়িয়ে উঠে বসলো। জেফি তাদের তাড়া দিয়ে বলল – উইচ্যাটে ঢোক।

সুজা এবং সেনজেই এর সাথে সাথে পূর্বাশাও ঢুকলো উইচ্যাটে। উইচ্যাটে তাদের কলেজ গ্রুপে একটা ছবি দেখে থম মেরে গেল সবাই। এ তো আজকে সকালে লাইব্রেরীতে পূর্বাশা যে জায়ানের পাশে বসেছিল তখনকার ছবি। কোনো ফেক আইডি থেকে তাদের কলেজ গ্রুপে পোস্ট করা হয়েছে। উন্নত দেশ, উন্নত মানুষ। এদেশের মানুষ অনলাইনে সক্রিয় খুব বেশি, তরুণ সমাজ তো আরও বেশি। তাই ছবিটি ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি ভেশি। তবে ছবিটিতে খুব একটা সমস্যা নেই। জায়ান আর পূর্বাশা বসে রয়েছে পাশাপাশি এখানে তো খারাপ কিছু নেই। যত সমস্যা রয়েছে সব ছবিটির ক্যাপশন ঘিরে। ছবিটির ক্যাপশনে খুব সুন্দর করে লিখে দেওয়া হয়েছে – বিদেশি কুৎসিত শিক্ষার্থীরা চীনে আসেই এদেশীয় সুদর্শন যুবকদের কাবু করে এদেশে স্থায়ী খুঁটি গড়তে।

অনেক বাজে বাজে মন্তব্যে ভরে গেছে পোস্টটা। কেউ কেউ মন্তব্য করেছে – এরা তো আসেই এই কারনে।

অনেকে আবার কমেন্ট করেছে – কি আর করবে এরা? চীন অত্যাধিক ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ার কারনে আমেরিকা, রাশিয়া কিংবা ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো তো আর এখানে নাগরিকত্ব পাওয়া খুব সহজ নয়। দিনের পর দিন এই দেশে বহিরাগত শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেও নাগরিকত্ব লাভ করতে পারে না। পড়াশোনা শেষে তাদের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তারপর যদি এদেশীয় কোনো নাগরিককে বিয়ে করে তাহলে যদি বৈবাহিক সূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার একটু আশা থাকে তাও খুব কম। এই মেয়ে মনে হয় তেমন কিছুই করতে চাইছে।

কেউ কেউ আবার মন্তব্য করেছে – এই চেহারায় আবার কলেজের সবচেয়ে সুদর্শনদের কাতারে থাকা যুবকের পানে হাত বাড়িয়েছে? আসলে কুৎসিতদের সব সময় নজরই থাকে সুদর্শনদের দিকে।

চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো পূর্বাশার। পুরোনো ক্ষত যেন তাজা হয়ে উঠলো আবারও। আবারও তার কুৎসিত চেহারাই কষ্ট বয়ে আনলো তার জন্য। এই কুৎসিত চেহারাই তার সকল সুখের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদেশে তো এসেছিল সে একটু শান্তির জন্য। এখানেও কি শান্তি নেই তার কপালে? তারপরও যতটুকু শান্তি হয়ে উঠছিল তাও বুঝি তার কপালে সইলো না। কোন পাপের শাস্তি তাকে সৃষ্টিকর্তা দিচ্ছে? কি পাপ করেছিল সে? সে তো জায়ানের কাছে যায়নি। জায়ানই এসেছিল তার কাছে। তাদের দা কুমড়ার সম্পর্কটা একটু ভালোর দিকে নিয়ে যেতে। এখানেও তার কপালে দুঃখ বয়ে আনলো আর দোষী সাব্যস্ত করা হলো শুধু মাত্র তাকে। পূর্বাশার গাল বেয়ে টুপ করে এক ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। তার সাথেই কেন এমন হয় সব সময়। জেফি, সেনজেই, আর সুজা হয়তো বুঝলো মেয়েটার মনের অবস্থা। তারা এসে দাঁড়ালো পূর্বাশার পাশে। সেনজেই পূর্বাশার কাঁধে হাত রেখে বলল – তুমি একদম মন খারাপ করো না আমরা তোমার পাশে আছি।

সুজাও সায় জানালো সেনজেই এর কথায়, বলল – এই কাজ যে করেছে অবশ্যই খুঁজে বের করবো আমরা।

জেফি দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে। কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে ভেবে বলল – কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে কালই আবেদন করবো এ বিষয়ে। যেই এই কাজ করেছে তাকে তো খুঁজে বের করতেই হবে।

পূর্বাশা উত্তর দিল না কারো কথার। সকলের শান্তনার মধ্যেই মুর্তির মতো সে বসে রইলো। হঠাৎ তার মোবাইলের মেসেজের টোন বেজে উঠলো, নোটিফিকেশনে ভেসে উঠলো জায়ানের নামটা। জায়ানের তরফ থেকে মেসেজ পাঠানো হয়েছে তাকে। পূর্বশা দেখলো না মেসেজটা। মোবাইলটা সোজা ছুঁড়ে মারলো বিছানার উপরে।

_____________________________________

রাতের আঁধার কেটে সকাল হয়েছে। সূর্যটাও তার তেজদীপ্ত আলো নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে। পূর্বাশা তৈরি হয়ে বেরিয়েছে কলেজে যেতে। তার জীবনের কষ্ট, অঘটন, তিরস্কারের জন্য কি আর সময় থেমে থাকবে? এই কষ্ট তিরস্কার নিয়েই সে সারাজীবন হেঁটে চলেছে সম্মুখের দিকে আজও হেঁটে চলতে হবে। মানুষের বক্র দৃষ্টি আর তিরস্কার এখন যেন দুধভাত হয়ে গেছে। তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো পূর্বাশা। আশেপাশের সবাই একটা অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছে তার পানে। হয়তো কালকের ছবিটার জন্য। ভালো কিছু আর তার ভাগ্যে জুটলো না। সর্বদা সবকিছুর জন্য একমাত্র সেই দোষী সাব্যস্ত হলো আর তিরস্কারের পাত্রী হলো। মাথা নুইয়ে মাটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো পূর্বাশা। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে এলো ক্লাসরুমে। যতই সে পালাতে চাক না কেন তাই বলে কি তার ভাগ্যের নির্ধারিত তার জন্য আয়োজিত তিরস্কার কম পড়বে? মোটেই না। ক্লাসরুমের দরজা থেকে ঢুকতেই যেন তিরস্কারের বন্যা নেমে এলো তার পানে। ঐ যে এখানে আসর পর প্রথম দিক থেকে যে মেয়েগুলো তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো তারা যেন এবার হাসাহাসির চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছে। এমনিই তো পূর্বাশাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে ছাড়তো না তারা এখন আরও পেয়েছে সুযোগ। তাদের মধ্য থেকেই একজন মেয়ে উঠে বলল – নিজের চেহারা আয়নায় দেখেছিস কখনও? এই চেহারায় কিনা আবার কলেজের সবচেয়ে সুদর্শনদের কাতারে পড়া যুবকের পানে দিকে হাত বাড়াস।

অন্য একজন বেশ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল – এসেছেই তো সে জন্য। পড়াশোনা কম এদেশে খুঁটি গাড়া বেশি জরুরী।

বলেই হো হো করে হেসে উঠলো মেয়েগুলো। হাসতে হাসতেই আরেকজন বলল – নিশ্চই জায়ান ভাই পাত্তা দেয়নি তোকে। দিবেই বা কেন? একজন নীগ্রোকে কি আর অত সুন্দর পুরুষ মানুষ পাত্তা দেয়। জায়ান ভাইয়ের পিছনে ঘুরে লাভের লাভ তো কিছু হলো না শুধু শুধু মান সম্মান নষ্ট করলি।

মুখ বাঁকালো আরেকটা মেয়ে। ভেংচি কেটে বলল – কিসের মান সম্মান? নীগ্রোদের আবার মান সম্মান আছে নাকি?

কথাটা শেষ হতে না হতেই ফুঁসে উঠলো সেনজেই, সুজা, আর জেফি। এতক্ষন চুপচাপ শুনছিলো তারা সবটা। এবার আর চুপ থাকতে পারলো না। মুখ খুললো সুজা, ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল – পূর্বাশা নিগ্রো নয়। আর যদি নীগ্রো হয়েও থাকে তাহলে তোদের কাছে আমার প্রশ্ন রইলো নীগ্রোরা কি মানুষ নয়? এই পৃথিবী কি শুধু মাত্র শ্বাঙ্গদের জন্য তৈরি হয়েছে?

সুজা হয়তো বলতে চাইছিল আরও কিছু কিন্তু সে সুযোগ আর হয়ে উঠলো না। শ্রেনীকক্ষে প্রফেসর প্রবেশ করতেই দমে গেল সবাই। সকল ঝগড়া বিবদের অবসান ঘটিয়ে যে যার আসনে গেল। শুরু হলো ক্লাস।

ক্লাসের এক ফাঁকে পূর্বাশা লক্ষ্য করলো জায়ান আবার মেসেজ পাঠিয়েছে তাকে। সে লিখেছে – ক্লাস শেষে দেখা করি?

পূর্বাশা উত্তর দিল না কোনো। এই পুরুষের সাথে আর কথা না বলাই শ্রেয়। সুদর্শনদের সাথে যে কুৎসিতদের মিশতে নেই। আর ঐ লোকটার জন্যই তো আজ এমন একটা পরিস্থিতির স্বীকার হতে হলো তাকে। সে যদি জায়ানের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতো তাহলে হয়তো মানুষের কাছে আজ এতটাও তিরস্কার হতে হতো না তাকে। তাছাড়া এই মুহূর্তে জায়ানের সাথে তাকে কেউ দেখলে বিষয়টা হয়তো আরও খারাপের দিকে যাবে। সকলে ধরে নিবে তাদের ধারনাই সঠিক। ক্লাস শেষে বেরুলো পূর্বাশা। জায়ান দাঁড়িয়ে আছে তার ক্লাসের সম্মুখে। মেয়েটা দেখেও যেন না দেখার ভান করলো তাকে। জায়ানের পাশ কাটিয়ে সম্মুখের দিকে চলে গেল সে। জায়ান পিছু ডাকলো পূর্বাশার। মেয়েটা সাড়া দিল না কোনো। এক প্রকার দৌড়ে চলে গেল সে। ভ্রু কুঁচকালো জায়ান। এর আবার কি হলো? তাকে কি এড়িয়ে গেল মেয়েটা? কিন্তু কেন? কি করেছে সে?

_____________________________________

ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে এগিয়ে চলছে নিজের গতিতে। এই মুহুর্তে জানান দিচ্ছে রাত দশটা। জায়ান লাগাতার কল করে যাচ্ছে পূর্বাশাকে কিন্তু নাম্বারটা বন্ধ বলছে। ইতমধ্যে সে জেনে গেছে সবটা। অনলাইনে দুনিয়ায় ততটা সক্রিয় না থাকার কারনে সবটা জানতে একটু বেশি সময় লেগেছে। কিন্তু জানার পর থেকে মেয়েটাকে কল করেছে, এসএমএস করেছে। প্রথমে নাম্বারটা খোলা থাকলেও একটা কলও ধরেনি বা একটা এসএমএস এরও রিপ্লাই করেনি মেয়েটা। ঐ কেমন কথা? এইটুকু একটা ছোট বিষয়ের জন্য মেয়েটা এমন করছে? তার থেকে মেয়েটা তার সমস্যা নিয়ে আসতো তার কাছে, দুইজন মিলে কথা বলে একটা সমাধানে আসতো তা না তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে, কল ধরছে না, এসএমএস এর উত্তর দিচ্ছে না। এদিকে যে তার এই অবহেলায় জায়ানের হৃদয় অস্থির হয়ে উঠছে ক্ষনে ক্ষনে, কষ্ট হচ্ছে ভীষন। অন্যদের করা কর্যের জন্য মেয়েটা তাকে কেন এভাবে শাস্তি দিচ্ছে? আচ্ছা এই ছোট একটা কারনে মেয়েটা হারিয়ে যাবে না তো তার থেকে? কলিজাটা ধক করে উঠলো জায়ানের। না না কাল সকালেই এর কোনো একটা বিহিত করতে হবে। আর উইচ্যাটে এমন একটা পোস্ট কে করেছে তাও খুঁজে বের করতে হবে অবশ্যই।

_____________________________________

চারদিকে তীব্র আলোর ঝলকানি। ব্যস্ত শহরটা ব্যস্ত হয়ে উঠেছে বেশ। চারদিক থেকে যানবাহনের প্যা পো ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। প্রতিদিনের মতোই পূর্বাশা তৈরি হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। সাথে আছে সেনজেই, জেফি আর সুজা। তবে আজ আর তিরস্কার শুনতে হেঁটে হেঁটে কলেজ অব্দি যেতে হয়নি। মেয়েগুলো নিজেরাই হেঁটে এসেছে পূর্বাশার দিকে। হয়তো তারাও ক্লাসে যাচ্ছে। পূর্বাশাকে দেখেই থমকে দাঁড়ালো তারা। একজন বলল – কি জায়ান ভাইয়ের পাত্তা না পেয়ে এখন আবার নতুন পাখি খুঁজছিস নাকি?

চলবে…….

ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link

[ আহরাব ইশতিয়াদ এবং নিশিতা জুটির উপর লেখা আমার প্রথম উপন্যাস “স্নিগ্ধ প্রেয়শী” পড়ে নিন বইটই অ্যাপে, মাত্র ৪০ টাকা। বইয়ের লিংক এবং কিভাবে কিনবেন পেয়ে যাবেন কমেন্ট বক্সে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here