স্নিগ্ধ_প্রিয়া #সাদিয়া_শওকত_বাবলি #পর্ব_৮

0
779

#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৮

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

সুদীর্ঘ এক রাত কেটে ভোরের দেখা মিলেছে। চারদিকে উজ্জ্বল সোনালী রোদে ভরে উঠেছে। পূর্বাশার এ দেশে আসার পর দিন দুই কেটে গেছে যেন দেখতে দেখতে।সেদিনের পর এই দুদিনে পূর্বাশা আর হোস্টেল থেকে বের হয়নি তেমন। রুমমেটরা অবশ্য বেশ কয়েকবার বাইরে বের হওয়ার কথা বলেছে কিন্তু পূর্বাশা বের হয়নি। সে বারংবারই তাদের বলেছে – এখানে পড়তে যখন এসেছি থাকবো তো অনেকদিন। পরে না হয় বের হওয়া যাবে।

রুমমেটরাও তাই আর জোরাজুরি করেনি বেশি তবে মাঝখানে চারজন মিলে একবার পুরো কলেজ ঘুরে এসেছে। সেখানেও পূর্বাশা যেতে অনীহা প্রকাশ করলেও কেউ মানেনি তার কথা। সেনজেই, জেফি আর সুজা এক প্রকার ধরে বেঁধে তাকে নিয়ে গেছে বাইরে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিগত দিনগুলোর কথাই ভাবছিলো পূর্বশা। যাক এদেশে এসে ভালো কিছু মানুষের সাথে অন্তত দেখা হয়েছে তার। হোক অল্প সময়ের জন্য তবুও জীবনের কিছু ভালো মুহুর্ত তো পেল। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো মেয়েটা, এবার আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো সে। এতক্ষন আয়নার সম্মুখে দাঁড়ানো থাকলেও নানান ভাবনায় বিভোর থাকায় নিজেকে দেখেনি সে। শরীরে আজ সেনাবাহিনীর মতো পোশাক জড়িয়েছে পূর্বাশা। ছোট খাটো উচ্চতায় চাপা গায়ের রঙে এই পোশাকে নিজেকে দেখে নিজেরই যেন হাসি পাচ্ছে পূর্বাশার। এতটা বিশ্রী লাগতে পারে কাউকে? নক্ষত্র তাকে ধোঁকা দিয়ে ভুল কিছু করেনি। অবশ্যই সে এর থেকে ভালো কিছু পাওয়ার যোগ্যতা রাখে, তার মতো কুৎসিত নারী অবশ্যই নক্ষত্রের যোগ্য নয়। নিজের চেহারা আর শারীরিক কাঠামোর প্রতি নিজের এক আকাশ পরিমাণ তিক্ততা পূর্বাশার। ইদানীং নিজেকে দেখলেও কেমন যেন ঘৃনা লাগে, দেখতে ইচ্ছে হয় না। পূর্বাশার ভাবনার মধ্যেই সকলকে তাড়া দিল সুজা, বলল – ওদিকে প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি চলো সবাই দেরীতে গেলে আবার শাস্তি আছে।

পূর্বাশা আর দেরী করলো না। সেনাবাহিনী পোশাকেই রুমমেটদের সাথে বেরিয়ে পড়লো দ্রুত। চীনের নিয়মানুযায়ী, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছরের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে তাদের সেমিস্টার শুরু করা হয় অর্থাৎ ভর্তি নেওয়া হয়। ভার্সিটিতে ভর্তি নেওয়ার পর প্রায় দুই মাস নতুন শিক্ষার্থীদের মিলিটারি ট্রেনিং এর আওতায় রাখা হয়। এই সময়টা তেমনটা ক্লাস বা পড়াশোনা হয় না। এই সময়টায় নিজেদের আত্মরক্ষা, দেশপ্রেম, লড়াই, প্রয়োজনে দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পূর্বাশাদেরও আজ থেকে মিলিটারি প্রশিক্ষণের আওতায় নেওয়া হচ্ছে। কলেজের তরফ থেকে সবাইকে মিলিটারি পোশাকও দেওয়া হয়েছে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে এবং সেই পোশাকেই দলবেঁধে সবাই হাজির হয়েছে বিশাল ভার্সিটি মাঠে। সোজা সুন্দর কিছু লাইন করে দাঁড় করানো হয়েছে শিক্ষার্থীদের। দুজন মূল মিলিটারি প্রশিক্ষকের সাথে এই ভার্সিটিরই চারজন সিনিয়র শিক্ষার্থীদের নেওয়া হয়েছে সকলের দেখাশোনার জন্য। সিনিয়র দুজনকে নেওয়া হয়েছে পরিদর্শনের জন্য।

পূর্বাশা এসে থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। মাথা উঁচু করে কারো দিকে তাকায়নি অব্দি। এত রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে তার খারাপ লাগছে বেশ। কিন্তু করার কিছুই নেই প্রশিক্ষণ তো দিতেই হবে। আশেপাশের মেয়ে শিক্ষার্থীদের গুজুর গুজুর শোনা যাচ্ছে। কোনো এক সুদর্শন সিনিয়রকে নিয়ে বেশ মাতামাতি চলছে সকলের মধ্যে। পূর্বাশার মনে কৌতুহল জাগলো একটু। এমন কোন চোখ ছোট চাইনিজ পুরুষ রয়েছে যার জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে এত মাতামাতি?পূর্বাশা মাতা উঁচু করে তাকালো সামনের দিকে, চোখে পড়লো জায়ানকে। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না কাকে নিয়ে এত মাতামাতি হতে পারে। মেয়েটা ভেবে পায় না এই জায়ান নামক ছেলেটার মধ্যে কি এমন আছে যা নিয়ে সকালের মধ্যে মাতামাতি। একে দেখে তার তো নাক উঁচু ছোট চোখা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। চিরদিকে গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর আওয়াজের মধ্যেই জোড়ালো কন্ঠের আওয়াজ এসে বারি খেল সকলের কর্নে। কেঁপে উঠলো যেন মাঠসহ। হ্যান্ড মাইকে মূল প্রশিক্ষক তার উঁচু কন্ঠে বেশ গম্ভীর্য পূর্ণ কন্ঠে বললেন – স্টুডেন্ট’স সাইলেন্ট।

সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল সবাই। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো যেন। মূল প্রশিক্ষক হাতের একটা হ্যান্ড মাইকটা মুখের কাছে ধরে রেখেই একে একে নিজেদের পরিচয় দিলেন এবং সকল কাজের দিক নির্দেশনা দিতে শুরু করলেন। সকল কথার শেষে তিনি বললেন – শিক্ষার্থীরা ১০০ মিটার দৌড়ের জন্য প্রস্তুত হন।

সবাই দৌড়ের জন্য নিজেদের প্রস্তুতি নিল। প্রশিক্ষকের বাঁশিতে আওয়াজ হতেই দৌড় তীব্র রোদে মাঠ জুড়ে দৌড় শুরু করলো সবাই। একটু দৌড়ে যেন হাঁপিয়ে উঠলো পূর্বাশা। সকলের পিছনে পড়ে গেল সে। এই দৌড় ঝাপের অভ্যাস নেই তার একদম। শেষ কবে দৌড়েছে তারও কোনো হিসাব নেই। বাংলাদেশে মেয়েরা একটু বড় হলেই পরিবার থেকে দৌড় ঝাঁপ বন্ধ করে দেওয়া হয় তাদের। বয়ঃসন্ধিকাল চলে আসলে তো কথাই নেই, তারপরে তাদের বাইরে বের হতে হয় তাও অনেক নিয়ম কানুন মেনে। বয়ঃসন্ধিকালের পরে থেকে এদেশে একটা মেয়ের জোরে হাসা নিষিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়, দৌড়ানো, জোরে কথা বলা, পুরুষদের মধ্যে যাওয়া বিভিন্ন বিষয়ে বাধ্য বাধকতার সৃষ্টি হয়। সেখানে পূর্বাশার জীবনে তো বাধ্য বাধকতার পরিমাণ ছিল আরও বেশি, একটা সময় মেয়েটাও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। ঘরকোনা হয়েই জীবন কাটাতে শুরু করেছিল।

জায়ান মাঠের মধ্যেই দাঁড়িয়ে ছিল। পূর্বাশাদের দৌড়ের বিষয়টা দেখার দায়িত্ব পড়েছিল তার উপর। পূর্বাশা যে শেষে ধীরে ধীরে দৌড়াচ্ছে তা। দৃষ্টি এড়ায়নি ছেলেটার। পূর্বাশার সাথে তার কি এমন শত্রুতা জানা নেই কিন্তু হ্যান্ড মাইকটা হাতে নিল সে, বেশ জোড়ালো কন্ঠে বলল – দুই মিনিট সময় এর মধ্যে যারা এই ১০০ মিটারের লাইন ক্রস করতে পারবে না তাদের আজ দুপুরের খাবার বন্ধ।

জায়ানের কথা শুনে জোরে দৌড়াতে শুরু করলো সবাই। সবার সাথে সাথে পূর্বাশাও জোরে দৌড়াতে শুরু করলো। এইটুকু দৌড়েই তো তার পেটে ক্ষুধা লেগে গেছে। এরপর যদি দুপুরের খাবার না দেওয়া হয় তবে তো মরেই যেতে হবে আজ। কিছুদিন আগে হাত কে’টে আ’ত্ম’হ’ত্যা’র মতো এক পরিস্থিতি থেকে উঠলো পূর্বাশা, এখানে এসেও খাওয়া দাওয়া হচ্ছে না খুব একটা, নিজের দেশ আপন মানুষ সবাইকে ছেড়ে এসেছে সে এখানে সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতেও তো সময় লাগবে একটু। তার উপর এই তীব্র রোদে দৌড়, সব মিলিয়ে মেয়েটার ছোট শরীরটা আর ধকল সামলাতে পারলো না হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে নিতে পড়ে গেল মাঠের মাঝখানেই।

পূর্বাশা পড়ে যেতেই সবাই দৌড় থামিয়ে দিল। সুজা, সেনজেই আর জেফি দৌড়ে এসে ধরলো পূর্বাশাকে। জায়ানও দেখলো মেয়েটাকে মাঠের মধ্যে জ্ঞান হারাতে তবুও বুঝি তার মনে দয়া হলো না। নির্দয়ের মতো হ্যান্ড মাইকে বলল – আপনাদের থেমে যেতে বলা হয়েছে? তাড়াতাড়ি দৌড় শেষ করুন।

জায়ানের তীক্ষ্ম কন্ঠের সম্মুখে দাঁড়াতে পারলো না কেউ। সবাই আবারও দৌড় শুরু করলো। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও পূর্বাশাকে মাটিতে ফেলেই উঠে যেতে হলো সেনজেই, জেফি আর সুজাকে। সবাই সরে যেতেই জায়ান এসে বসলো পূর্বাশার নিথর দেহের পাশে। ভাবলেশহীনভাবে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো মেয়েটার মুখপানে অতঃপর হুট করেই কোলে তুলে নিল তাকে। ধীরে সুস্থে হেঁটে চললো ভার্সিটির চিকিৎসা বিভাগের দিকে। চীনের প্রতিটি স্কুল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্যেক স্থানেই ক্লাস সেক্টরের সাথে সাথে স্কুল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতার মধ্যেই আলাদা চিকিৎসা বিভাগ থাকে এবং সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তারও থাকে যারা সর্বদা নিয়োজিত থাকে শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা দানের জন্য। শিক্ষার্থীদের যেকোনো ছোট খাটো চিকিৎসা দিয়ে থাকে এবং কখনও কখনও ঔষধও দেয়। চিকিৎসা সেক্টরটা অনেকটা একটা ছোট খাটো হাসপাতালের মতো সাজানো হয় যেখানে রোগীদের জন্য বিছানা এবং চিকিৎসার যন্ত্রপাতি থাকে।

পূর্বাশাকে কোলে নিয়ে চিকিৎসা সেক্টরে ঢুকলো জায়ান, একটা বিছানায় শুয়ে দিল তাকে। অচেতন কাউকে নিয়ে এখানে ঢুকতে দেখেই চিকিৎসক এগিয়ে এলেন। পূর্বাশাকে দেখতে দেখতেই চাইনিজ ভাষায় জায়ানকে প্রশ্ন করলো – বাঙালি?

জায়ান ছোট করে উত্তর দিল – হুম।

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললেন মিসেস শীয়াও, বললেন – শরীর দূর্বল। একটু পরই জ্ঞান ফিরে আসবে সমস্যা নেই।

একটু থামলেন মিসেস শীয়াও, বললেন – ও থাকুক আপাতত এখানে। এখন রেস্টের প্রয়োজন ওর।

জায়ান দাঁড়ালো না আর। ওদিকে তার দায়িত্ব ফেলে এসেছে সে। তাই মিসেস শীয়াওয়ের কথা শেষ হতেই দৌড়ে চিকিৎসা সেক্টর থেকে বেরিয়ে পড়লো সে। তবে মিসেস শীয়াও উঠলেন না পূর্বাশার পাশ থেকে। নিজের হাত বাড়িয়ে আলতোভাবে ছুঁয়ে দিতে শুরু করলো মেয়েটার মুখটা, কাতর কন্ঠে বলল – সেই চেনা মুখের আদল। যা আজ থেকে বহুবছর আগে ভীষণ গভীরভাবে চিনেছিলাম আমি।

****

সময় গড়ালো কিছুটা। উজ্জ্বল তেজদীপ্ত সূর্যটাও ঘুরতে ঘুরতে মাথার উপরের দিকে চলে এসেছে প্রায়। পূর্বাশার জ্ঞান ফিরেছে মাত্রই। পিটপিট করে চোখ খুললো মেয়েটা। আশেপাশে তাকাতেই চোখে পড়লো শুভ্র রঙা এপ্রোন শরীরে জড়ানো এক মধ্যবয়স্ক নারীকে। এ দেশের নারী পুরুষের বয়স ধরা আসলে বেজায় মুসকিল। এই যে এই নারীকে এখনও অল্পবয়সীই মনে হচ্ছে। ফর্সা হ্যাংলা পাতা দেহ তার। চুলগুলো এখনও কালো কুচকুচে তবে ছোট করে ঘাড় পর্যন্ত কাটা। চোখের কোন ঘেঁষে যদি এই নারীর চামড়াটা হালকা কুঁচকানো না দেখতো তবে পূর্বাশা বুঝতেই পারতো না যে ইনি মধ্যবয়সী। পূর্বাশাকে চোখ খুলতে দেখে হাসলেন ঐ চিকিৎসক নারীটি, বাংলা ভাষায়ই বললেন – উঠে পড়েছো? শরীর কেমন এখন তোমার?

চীন দেশীয় এই নারীর মুখে হঠাৎ এমন শুদ্ধ বাংলা শুনে চমকালো পূর্বাশা। এ নারীও বাংলা জানেন, তাও এত শুদ্ধভাবে? প্রথমে জায়ান তারপর এই নারী। এখানকার সবাই কি বাংলা ভাষা শেখা শুরু করে দিয়েছে নাকি? চিকিৎসক নারীটি হয়তো বুঝলেন পূর্বাশার অভিমত। পাতলা চিকন ঠোঁট জোড়া প্রসস্ত করে হালকা হাসলেন তিনি, বললেন – কি ভাবছো? বাংলা ভাষা জানলাম কিভাবে সেটাই?

পূর্বাশা অপ্রস্তুত হলো কিছুটা। ইসসস মহিলাটি তার মনের কথা বুঝে ফেললো। আমতা আমতা শুরু করলো পূর্বাশা, বলল – আসলে…

চিকিৎসক নারীটি হাত রাখলেন পূর্বাশার মাথায়, কোমল কন্ঠে বললেন – আমার খুব কাছের কেউ বাংলাদেশী ছিল। তার কাছ থেকেই আমার বাংলা ভাষা রপ্ত করা।

চলবে……

ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link

[ আহরাব ইশতিয়াদ এবং নিশিতা জুটির উপর লেখা আমার প্রথম উপন্যাস “স্নিগ্ধ প্রেয়শী” পড়ে নিন বইটই অ্যাপে, মাত্র ৪০ টাকা। বইয়ের লিংক এবং কিভাবে কিনবেন পেয়ে যাবেন কমেন্ট বক্সে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here