#পদ্মমির
#পর্ব_14
#ইলমা_বেহেরোজ
ততক্ষণে জাদত এসে দাঁড়িয়েছে একপাশে।
তুলা মিয়া সরাসরি বলল, ‘আমি সুন্দর মহিলাদের কথা ফেলতে পারি না। আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে চলো, আমাকে যদি খুশি করতে পারো তাহলে জমি ফিরিয়ে দেব, এখানে থাকতেও দেব।’
ওর লালসা পদ্মজার গায়ে বিস্ফোরণ ছড়িয়ে দেয়।
বাবার বয়সী লোকের মুখে এমন কথা শুনে পদ্মজার গা গুলিয়ে উঠে। সে সজোরে থাপ্পড় মারে লোকটার গালে। চারপাশে গুঞ্জন শুরু হয়।
লোকটি সঙ্গে সঙ্গে পাগলা ষাঁড়ের মতো হয়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে ক্রোধ নিয়ে বলে,’ এতো সাহস! এতো সাহস!’
পদ্মজা অটল হয়ে চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে।
তুলা ‘খানকির ঝি’ বলে তেড়ে যায় ওর দিকে। পদ্মজার গলার চাদর খামচে ধরে টেনে খুলে ফেলার জন্য। পদদ্মজা তুলার কজি চেপে ধরে। তুলা সজোরে ধাক্কা মারে, ভুবন পদ্মজাকে ধরার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। তবে পদ্মজা পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। দ্বিগুণ জোর নিয়ে দাঁড়াল। রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের ফিসফিসানিতে
চারপাশ উষ্ণ হয়ে উঠেছে। এতো রূপ, এতো সাহস – তাও কোনো নারীর! সরাসরি এমন দৃশ্য দেখে তারা বাকহারা।
খালি হাতে এমন শক্তিশালী। পুরুষের সঙ্গে পারা
সম্ভব নয়
তা সম্পর্কে অবগত পদদ্মজা। তবুও লড়াইয়ের জন্য
সাহস নিয়ে অপেক্ষা করছে কখন লোকটি আক্রমণ করবে। তুলা আক্রমণ করতে গেলেই বাহির থেকে তিন জন লোক এসে, জাদভসহ সকলে মিলে পদ্মজার ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। পদ্মজা আকস্মিক প্রতিরোধে অবাক হয়ে যায়। জাদত বলে, ‘আর এক পা এগোলে এখানেই গেঁড়ে ফেলব।’
মোটাসোটা, গাট্টাগোট্টা চারজনকে দেখে তুলা ভড়কে যায়। এরা কোথা থেকে এলো? কাউকেই তো সে চিনে না! এই এলাকায় কখনো দেখেওনি।
পর্ব নয়
তুলা মিয়ার ধনাঢ্য পরিবারে জন্ম। বিলাসবহুল বাড়ি তার। বাড়িতে স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূসহ কয়েকজন
দাসী রয়েছে। মন্দ চরিত্রের কারণে কারো সঙ্গে
তার বনিবনা হয় না। পরিবারের কেউ মূল্য দেয়
তার বনিবনা হয় না। পরিবারের কেউ মূল্য দেয় না, এলাকার কেউ সম্মানের চোখে দেখে না। ছোট ছোট শ্রেণির মানুষেরা তুলার বদমেজাজকে ভয় পায়। বিশেষ করে তার তিনটি বাড়িতে বসবাস করা ভাড়াটিয়ারা সবসময় ভয়ে জবুথবু হয়ে থাকে। স্ত্রী জোহরাও স্বামীকে পছন্দ করে না। যতক্ষণ সম্ভব দূরে দূরে থাকে। তুলা মিয়া প্রতিরাতে মদ্যপান করে বাড়ি ফেরে। নারীর দেহের প্রতি তার বাঁধভাঙা আকর্ষণ। মেয়ের বয়সী নারীদেরও ছাড় দেয় না। তয় দেখিয়ে অথবা লোভ দেখিয়ে যেভাবে হোক প্রতিটি মুহূর্তে তার নিত্য নতুন নারীর সঙ্গ
যেভাবে হোক প্রতিটি মুহূর্তে তার নিত্য নতুন নারীর সঙ্গ প্রয়োজন হয়। সহায়সম্পদ তুলার নামে থাকায়, পুত্র তুমুরও কিছু বলতে পারে না; শুধু সয়ে যায় পিতার উশৃংখল জীবনযাপন। তুলার স্বভাব চরিত্রের জন্য পরিবারের সদস্যদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
তখন মধ্যরাত। তুলা মদ খেয়ে বাড়ি ফিরছিল আর গুনগুনিয়ে হাসন রাজার ‘বাউলা কে বানাইলরে’ গানটি গাইছিল। স্বপ্নের জগতে আছে সে, চারপাশ যেন রঙিন আর আনন্দের। তীব্র ক্ষোভ নিয়ে মদ্যশালায় ঢুকেছিল, বের হয়েছে হালকা হয়ে। মনে হচ্ছে, পিঠে দুটো ডানা লাগিয়ে দিলে পাখির মতো উড়ে চলে যেতে পারবে রাতের কালো অন্তরীক্ষে।
রাস্তা শন্যা বাতাস হচ্ছে জোরালোভাবে। মাঝেমধ্যে পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ ভাসছে। দূরে ডাহুকের ডাক, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক এবং ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর মিলে এক ঐকতানের সৃষ্টি করেছে।
হঠাৎ পিছন থেকে কয়েকজন লোক তুলার হাত মুখ চেপে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে তুলা চৈতন্য হারায়। যখন চোখ খুলে নিজেকে বাঁধা অবস্থায় একটা গুদামঘরে আবিষ্কার করে। চিৎকার করতে গেলে মুখ দিয়ে শুধু ‘উউউ’ শব্দ বের হয়। সে ভড়কে যায়।
পাঁচ-ছয়টা বলিষ্ঠ দেহ তলাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে বিকেলের চারজনও রয়েছে। তুলা চোখ দিয়ে কিছু ইঙ্গিত করছে, ছটফট করছে।
লোকগুলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, কিছু করছে না, বলছেও না। শত চেষ্টা করেও যখন লোকগুলোর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারল না তখন হাল ছেড়ে দিল তুলা। গুদামঘরের এক কোণে হারিকেন জ্বলছে। জানালা দিয়ে রাতের মৃদু প্রবেশ করছে ভেতরে। ধীরে ধীরে সেই আলোও মলিন হয়ে গেল। রাতের নিবিড় অন্ধকার যখন ছেয়ে ফেলল সমস্ত বিশ্বচরাচর তখন একটা দীর্ঘদেহী মানব চাপাতি হাতে নিয়ে গুদামঘরে প্রবেশ করে। তার পরনে লুঙ্গি, শার্ট। লুঙ্গির নিচের অংশ ভাঁজ করে গুটিয়ে তুলে কোমরে বাঁধা। তুলা কিছু বুঝে উঠার আগেই
প্রবল ক্রোধ নিয়ে দীর্ঘদেহটি তেড়ে আসল। তুলার বুকের কাপড় খামচে ধরে বলল, ‘শুয়োরের বাচ্চা।’
শেষ রাত।
সাদিক নদীর পাড়ে এক বাঁশ বাগানের নিচে বসে আছে! পিছনে শ্বশান। ওখানে আধপোড়া কাঠ, মৃতের বস্ত্র, চিতা ধূম, মাচা, ভস্ম, ভাঙ্গা কলসি পড়ে আছে। নাম না জানা কিছু অজানা জীবের ডাক, নিশাচর পাখির হাড় হিম ডাক কানে আসছে। সাদিক মনের অজান্তেই ভয় পাচ্ছে। পুকুরপাড়ে গিয়েছিল কিন্তু ওখানে মুজ্জা কলোনির কিছু ছেলে বসে ফর্তি করছিল।
#চলবে