#মায়াবন_বিহারিনী_হরিণী
(রাজ_বিহারিনী_রুদ্র পর্ব৩)
১০
#writer_Neel_Noor
সকাল বেলা, আড়মোড়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলো বিহারিনী। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো, সে কিভাবে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছে। লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল এগারো টা বাজে। রাতে লেইট করে ঘুমোলে এমনই হয় বুঝি….
দ্রুত উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে আসতেই, বারান্দায় গেল, দেখলো অনেক কাগজের দলা পড়ে আছে। কাগজ গুলো একত্রে করে, নিজের আলমারি তে নিয়ে রাখল। বিহারিনী জানে এগুলো তার ই আঁকা ছবি, এবং বিষাদ মনে সে এঁকেছিল।
খুব খিদে লেগেছে,তাই সে ঢুলতে ঢুলতে নিচে নামছে। এখন ও তার ঘুমের রেশ কাটে নাই। হঠাৎ করেই কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে নিচে বসে পড়লো।
বিহারিনী – উফ্!! মাগো…চাচি গো.. আমাদের বাড়িতে ও কি হঠাৎ করে আমগাছ গজালো কি করে…!!
“আমি আম গাছ না বিহারিনী, তবে তুমি বল্লে তোমায় ছায়া দিতে পারি!!” অবশ্য তুমি তো কাঁচা আমের চেয়ে ও লোভনীয় ”
বিহারিনী চমকে তাকালো। সামনে তাকিয়ে দেখে, মহন (রাজের বড় ভাই) দাঁড়িয়ে আছে। কেবলাকান্ত হাসি দিয়ে। বিহারিনীর কখনো ই তাকে ভালো লাগতো না। সবসময় ই বিশ্রি নজর তার। আজ ও কম নয়। এ বাড়িতে আসার পর থেকে ই এই একটি লোক কে সে সব সময় এড়িয়ে বেড়ায়। বিহারিনীর এখনো মনে আছে, সেদিন এর ঘটনা, যেদিন রাজ তার ভার্সিটির ব্যস্ত থাকার কারনে, তার মাসের খরচের জন্য মহন গিয়েছিল। বিহারিনী তার নানু বাড়ি থাকলেও, সবসময় তার খরচ হাওলাদার বাড়ি থেকে ই দেওয়া হতো। যদিও বিহারিনীর মামারা কম বড়লোক নয়, তবুও এটাই রুলস ছিল। সেদিন বিহারিনী তখন সোফায় ঘুমিয়ে ছিল, একটু এলোমেলো অবস্থায়, মামি বাগানের টুকটাক কাজে করতেছিল, অন্য মামি রান্নাঘরে, আর বাড়ির পুরুষেরা নিজ নিজ কাজে….
বিহারিনীর ঘুম খুব ই পাতলা, বিহারিনীর অজান্তেই তার স্পর্শ কাতর জায়গায় হাতের উষ্ণ পুরুষালী ছোঁয়া, বিহারিনীর ঘুম ভেঙ্গে যায়…উঠেই দেখে মদন দাঁত বের করে হাসছিল…. সেদিন সবে চৌদ্দ বছরের কিশোরী বিহারিনী ঠাস করে আটাশ বছরের পুরুষের গালে থাপ্পড় মেরে বসে…. রাগন্ত শরীর আর কন্ঠে চিৎকার করে বলে উঠে – আপনার সাহস কি করে হলো মহন ভাই, আমাকে ছোঁয়ার!!
সেদিন মহন বিহারিনী কে বলেছিল, এর মাশুল তোকে পেতেই হবে!! কী তোর_কালাম কান্ড গুলো ই না ঘটেছিল দুই বাড়িতে, তারপর থেকে মদন কখনো ই বিহারিনীর নানু বাড়ি যায় নাই, উল্টো ক্ষমা চেয়েছিলো… তবে পশু কি কখনো ই পুরুনো ঘা ভুলে যায়?
আশেপাশে আড়চোখে তাকালো বিহারিনী! কেউ নেই বাড়িতে, মহন খুব ই বিশ্রী নজরে দেখছিল বিহারিনী কে, বিহারিনীর দিকে ঝুঁকতেই_বিহারিনী ভয়ে চোখ বুজে ফেলে, ঠিক তখন ই সিঁড়ির উপর থেকে কারো সুক্ষ রাগী কন্ঠস্বর ভেসে এলো, বলল-” মহন না রে…মদন বেপারি!! বেপারি বংশের মান সম্মান আর কত ক্ষুন্ন করবি!! হাওলাদার বাড়ির কয়লা তে হাত দিলেই ঝলসে যায় মানুষ, তুই তো কহিনূর এ হাত বাড়িয়ে দিতেছিস!! চিন্তা কর…..”
মহন দুই কদম পিছিয়ে গেল। মহন সামনে তাকিয়ে দেখল, রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটো রক্তাক্ত লাল। মহন কেন, হাওলাদার বাড়ির সবাই রুদ্র কে সমীহ করে চলে, এর কারন ও আছে…. তাই মহন ভয়ে দুই ঢুক গিলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল – বি…বিহা… বিহারিনী পর…রে… গেছে…আআমি…উঠাআআআআতে.. সাহায্য কর…
রুদ্র – নিজের কাজে যা। আমি দেখে নিচ্ছি। (মদন চুপচাপ উল্টো দিকে হাঁটা দিল) জোর গলায় রুদ্র আবার ও বলে উঠল – ভবিষ্যতে আমার কোন প্রপার্টির দিকে নজর কেন, মাথা তুলতে যেন না দেখি!! আমাকে তো চিনিস তাই না!!
এতোক্ষণ এ বিহারিনী একবার রুদ্র আরেক বার মহন এর দিকে তাকাচ্ছিলো। আজ বিহারিনীর রুদ্রকে ভালো লাগলো। মনে মনে খুশি হলো। ইংরেজ এর বংশধররা ভালো ও হয় বুঝি। রুদ্র এক পা এক পা এগিয়ে এসে বিহারিনীর সামনে দাঁড়াল…
এখন খুব কাছ থেকেই বিহারিনী রুদ্র কে দেখছে। সাদা রঙের গেঞ্জি আর ট্রাউজার এ রুদ্র কে হলিউড হিরোদের থেকে কম লাগছে না। বিহারিনীর মনই মনে একদফা প্রথম হাওয়া বসন্ত বইছে….আবেগি মনে বসা থেকে রুদ্রের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো….
রুদ্র মনই মনে একদফা হাসল। বুঝতে পারলো তার সজনী পাখি তার উপর একটু ইমপ্রেস হয়েছে। তবে তা সে প্রকাশ করলো না। দু হাত পকেট এ ভরে, অন্যদিকে তাকিয়ে বিহারিনীর উদ্দেশ্য করে বলল – এআর কখনো ই পরাজিত দের হাতে হাত রাখে না, তারপর ও সে মদি রাতে আমার ই আইসক্রিম চুরি করে….(মুখ দিয়ে সিটি বাজাত বাজাতে বাহিরের দিকে চলে গেল…)
বিহারিনী অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে ই রইলো। বিহারিনী এখনো বুঝতে পারতেছে না হলো টা কি!!এটা কি অপমান ছিল, নাকি অন্য কিছু। মনে মনে, নিজেকে নিজেই ধিক্কার জানালো, কেনো যে সে হাত বাড়িয়ে দিলো….
হকুমান, শয়তান, টিকটিকির লেজের পালক, উগান্ডার প্রেসিডেন্ট , না না প্রেসিডেন্ট না, ফকির ( একটু জোরে জোরে) আমার সাথে এরকম করলো। দেখে নিব….
পিছন থেকে দাদী বলে উঠল – কিরে কাকে এগুলো বলতেছিস, হাওয়ায় কি স্বপ্ন দেখতেছিস! নাকি? আর নিচে বসে আসিস কেন, এ বাড়ির মালকিন হয়ে!! রাইটার -নীলনূর
পাশে থেকেই চম্পা(কাজের মেয়ে_ তবে এ বাড়িতে মেয়ের মতো ই থাকে) হি হি করে হাসতে শুরু করলো, আর শুরু থেকে সব কিছু বলল, শুধু মহন এর কথাটা ছাড়া, কারন তখন চম্পা ছিল না….
দাদী ও হাসতে শুরু করলো চম্পার সাথে, বিহারিনীর অগোচরে তার দেবদাস ও মুচকি মুচকি হাসছে…তার সজনী পাখির কর্মকাণ্ডে….
_______
বারোটা বাজিয়ে সকালের নাস্তা খাচ্ছে বিহারিনী। খিদে পেট চু চু করলেও সে রুদ্রের করা কান্ড ভুলতে পারছিল না। মন বলছে, রুদ্র উপহাস করেছে, অপমান করেছে, প্রতিশোধ নিতে হবে। আর মস্তিষ্ক বলতেছে, ঠিক করেছে, তাকে বাঁচিয়েছে, উপদেশ ও দিয়েছে….
এর মধ্যে ই রাজ টপ করে এসে খাবারের টেবিলে বসে পড়লো। রাজের শব্দ করে বসাতে, বিহারিনীর ধ্যান ভাঙল…. সাথে সাথে রাজের দিকে তাকালো… একদিনে মানুষটা কতোটা শুকিয়ে গেছে, চোখের নিচে কালো দাগ কেটে আছে…ফুলে আছে চোখ গুলো….বিহারিনী এবার খাবার খাওয়া বাদ দিয়ে এক ধ্যানে রাজের দিকে তাকিয়ে আছে..
ফুলো ফুলো গাল ভর্তি খাবার নিয়ে চুপ করে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে এক চিন্তারাজ্যের রাজকন্যা। রাজের চোখে চোখ পড়তেই বিহারিনী লজ্জায় নিচে তাকালো, গপ গপ করে মুখের খাবার গিলতে লাগলো, রাজ মুচকি হেসে বলল – কি ভাবছিলি!! অষ্টাদশী হলে কি বিয়ে করবি আমায়!!
বিহারিনীর কাঁশি উঠে গেল। সামনে থাকা পানি গড়গড় করে গিলে, মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বলল – আপনি নেশা কেন করেন রাজ ভাই। নেশা করা পুরুষদের আমি পছন্দ করি না। আপনি বাজে অভ্যাস গুলো কি পাল্টাবেন না….
এটা বলেই বিহারিনী চুপ করে উঠে গেল প্লেট নিয়ে, উত্তরের আশা না করে। রাজ অর্ধেক খাবার খেয়ে ই চিন্তা করতে বসে গেল…. বিহারিনী কি বললো তাকে!!
________
রাজ নিজের রুমে বসে আছে। জলন্ত সিগারেট ধরিয়ে চিন্তা করছে, তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। কি করে ভুলবে সে। ভাবছে সেদিন এর কথা… বিহারিনী ছোট থাকলেও সে তো ছোট ছিল না… সেদিন বিহারিনী একা অনাথ হয় নাই, সে ও তো তার মা কে হারিয়েছে….
হুম, সেদিন বিহারিনীর পাঁচ বছর হলেও সে ছিল দশ বছরের। সেদিন একসাথে তিন টি জীবন যায়। তার ছোট চাচা চাচি(বিহারিনীর মা বাবা) সহ তার মা ঐ দিন মারা যায়। বিহারিনী ছোট ছিল, তাই নানা নানী তাদের কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু সে তো ছিল বড়। অন্যদিকে, তখন মেজ চাচা সহ রুদ্রের পরিবার থাকত লন্ডনে, এতো বড় ঘটনার পর হাওলাদার বাড়িতে তখন শোকের ছায়া। কোনদিন সামলাবে কে…..
ছোট থাকতেই বাবা কে ভালোবসত রাজ, তবে সেই বাবা কে আজ রাজ ঘৃনা করে। মায়ের মৃত্যুর ছয় মাস পর সে বিয়ে করে এক বাচ্চার মা কে…তারপর থেকেই তো রাজের জীবন এ নেমে আসে কালো অন্ধকার….যেই অন্ধকারে যে ডুবেছে…সে কি কখনো বের হয়ে আসতে পেরেছে…. ?
_______
সন্ধ্যা বেলা হাওলাদার বাড়ি তে সবাই বসে আছে। আজ ঘরের পুরুষেরা ও আগেই বাসায় ফিরেছে। বিহারিনী লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছে, আজ তো তার বড় চাচার সাথে কথা বলতে হবে কলেজ নিয়ে….
দৌড়ে আগে ফ্রিজের কাছে গেল, আইসক্রিম বাটিতে নামিয়ে নিল… আইসক্রিম নামিয়ে আসার সময়ই, পিছন থেকে কেউ বলে উঠল – আইসক্রিম কি শুধু তোমার জন্য ই আনা হয়, এসেছো দুদিন হয়নি এ বাড়িতে, সবকিছু তেই ভাগ বসাচ্ছো!!
কথাটা ছোট হলেও গভীর ভাবে আঘাত হানল বিহারিনীর বুকে। সে ছলছল চোখে তাকালো… তাকিয়ে দেখলো বড় চাচি।
ও দিকে মহন তার মাকে আবার ও আজকের ঘটনা ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছে। আগেও এই মেয়ের জন্য মহন কে কত কিছুই শুনতে হয়েছে, তার উপর মোহনার (রাজের মা) বিহারিনী কে পছন্দ না, তাই সে সুযোগ বুঝে এ কথাটা খোঁচা মেরে বলে উঠল…
মোহনা (বড় চাচি)- এ বাড়িতে যেমনে এসেছো, ঠিক তেমনি ই চলে যেতে হবে… এতো সবকিছু ছুঁই ছুঁই করো কেন! লিমিট মতো থাকবা….
ঠিক তখন ই রান্না ঘর দিয়ে যাচ্ছিল রুদ্র। সবকিছু শুনেছে তাই। দাঁত চিপে বলেই ফেলল – বড় চাচি, ঘরের চৌকাঠ দশ বার পাল্টানো যায়, তবে ঘরের জান্নাত আর লক্ষী না। তাছাড়া হাওলাদার সম্পত্তির ৭০ পার্সেন্ট কিন্তু বিহারিনীর নামে, তাই লিমিট টা কিন্তু তোমার থাকা উচিত….
বিহারিনীর চোখ দিয়ে এখন ও পানি ঝরছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না রুদ্রর কথায়। কিন্তু মোহনা ভ্রু কুঁচকে বলল – কিহ? ৭০ পার্সেন্ট? আর তুই রুদ্র বাবা আমাকে এ কথা বলতে পারলি? …. বিহারিনীর দিকে তাকিয়ে বলল – তুই মেয়ে সত্যি ই অপোয়া , অলক্ষী, তোর জন্য ই…(ন্যাকা কান্নার ভাব নিয়ে চলে গেল)
অন্যদিকে বিহারিনী আইসক্রিম খাওয়া বন্ধ করে রেখে দিতে যাচ্ছিল…ঠিক তখন ই রুদ্র বলল-
আইসক্রিম কিন্তু আমি কিনে এনেছি, খেতেই পারো!! শক্ত না হলে কীভাবে চলবে বলো!! সামনেই তো কলেজ এ ভর্তি হবে, মানুষের সাথে চলবে…..(মিষ্টি বাঁকা হেঁসে)
বিহারিনীর মনটা মুহূর্তে ই ভালো হয়ে গেল। আইসক্রিম নিয়ে মাথা নিচু করে মিঠি মিঠি পায়ে রুদ্রের দিকে এগিয়ে এলো। নিচু কন্ঠে বলল- ধন্যবাদ ইংরেজ!!
(বলেই দৌড়…)
বিহারিনীর এই কাজে রুদ্র উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। মনে মনে বলল, সজনী পাখি, আমার সজনী পাখি!!এতো অবুঝ তুমি!! আমি ইংরেজ!! দাঁড়াও, বের করছি ইংরেজ বলা!! ইংরেজদের শাসন তো শুনেছো, তুমি ও না হয় শোষিত হও….(মুচকি বাঁকা হেঁসে)
চলবে….