#মায়াবন_বিহারিনী_হরিণী
২০
#writer_Neel_Noor
হাওলাদার বাড়ি সম্পূর্ণ নীরব। বাসায় আছে মাত্র গুটি কয়েক মানুষ। হাসপাতালের করিডোরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে, এ দাঁড়িয়ে থাকা না থাকার সমান, কেননা, একজন নারীর এই সময়টাতে তার স্বামীর প্রয়োজন সবচেয়ে!! কিন্তু আফসোস, অভাগীর স্বামী ই আজ নিখোঁজ!!
রাজ ছাড়া বাড়ির প্রায় সবাই ই এখানে। রুদ্র ওটি তে আছে, মায়ার দায়িত্ব টা সে ই নিয়েছে। এতোক্ষণ এ তার টিম মায়ার কেসের দায়িত্ব টা নিয়েছে, চিন্তার ভার যেন শেষ ই হচ্ছে না।
কি থেকে কি হয়ে গেল। বিহারিনী এখনো খেয়ালী তে আছে, সে কিছুতেই মানতে পারছে না। উপস্থিত সকলের চোখে জল!! মধ্যে রাতে সবাই হাসপাতালের সামনে, চোখে পানি, কপালে একরাশ চিন্তার ভার!!
কেটে গেল এক দেড় ঘন্টা। এর মাঝে রাজকে শত শত কল দেওয়া হচ্ছে। রাজ কল রিসিভ করছে না। এদিকে, সবাই ওটির লাল বাতি টার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই রুদ্র বের হয়ে আসল। শক্ত মনের রুদ্রের চোখে জল ছল ছল করছে। হঠাৎ সে তার বাবা আর চাচা কে সাথে নিয়ে একটা চেম্বারে গেল। রাইটার -নীলনূর।
এদিকে রুদ্র যাওয়ার পরপরই একজন নার্স বের হয়ে এলো। বলল- এখানে বিহারিনী কে?(বিহারিনী যেন চমকে উঠল_কাপাঁ কাঁপা গলায় বলল-আমি)
বিহারিনী কে নীল ড্রেস পরিয়ে ওটির ভেতরে নিয়ে গেল। চারদিকে যেন রক্ত আর রক্ত। বিহারিনীর মাথাটা চিন চিন ব্যাথায় ভরে উঠলো। এমন রক্তাক্ত অবস্থা সে যেন কোথাও দেখেছে, কিন্তু মনে করতে পারছে না… নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে..এর মধ্যে ই একটা মিহী সুক্ষ কন্ঠ এবং তার হাত টা কেউ স্পর্শ করতেই কেঁপে উঠলো, নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল, মায়া তাকিয়ে আছে, মায়ার মুখটা শুকিয়ে গেছে, ইশ্ গলুমলু মেয়েটা ঘন্টা খানেক ব্যবধানে শুকিয়ে গেছে, বিহারিনী ঢুকরে কেঁদে উঠলো….
বিহারিনীর কান্না দেখে আমার মনে যে সন্দেহ, ক্ষোভ সবকিছু মিহিয়ে গেল। না, এরকম একটা মেয়ের মনে কালো কিছু থাকতে পারে না। আমার মতোই, সে ও এই হাওলাদার বাড়ির রহস্যে মোড়িয়ে গেছে। কি নিষ্পাপ শিশুদের মতো সে…
এমন দুরসময়ে ও আমি বিহারিনী কে নিয়ে ভাবছি। মনেই মনে খিলখিল করে হেসে উঠলাম। বিহারিনী কান্নার ভারে কথা বলতে পারছে না, চোখ গুলো ফুলে গেছে। হাতে রাখা বাজ করা কাগজটা বিহারিনী কে দিলাম, বললাম – বিহারিনীময় হরিনী!!(বিহারিনী অকপটে তাকালো আমার দিকে) এই কাগছটা তুমি রাজ কে দিও। (বিহারিনী মাথা নাড়িয়ে সায় দিল, ঠিক বাচ্চাদের মতো ই)
নার্স তাড়া দিতে শুরু করলো। বেশি কথা বলা যাবে না। সময় শেষ, বিহারিনী কে যেতে বলল। আমি তাদের আরেকটু সময় দিতে বললাম।
বিহারিনীর হাতটা আমার পেটে ছুঁইয়ে বললাম – বিহারিনীময় হরিনী!! যদি আমি না থাকি, আমার সন্তান টাকে দেখবে, মায়ের মতো কথা দাও।(বিহারিনী আরো বেশি ঢুকরে কেঁদে উঠলো, মাথায় না না দুলিয়ে বলল- তোমাকে ফিরতে হবে)
বিহারিনীর হাতটা পেটে আরো মিশিয়ে দিয়ে বললাম – আমি এতিম ছিলাম, মা থেকে ও নেই ছিল আমার জীবন। আমি থাকব না, সময় ফুরিয়ে এসেছে। এই রাস্তা টা এই পর্যন্ত ই… আমার গল্প এখানেই শেষ, তোমার শুরু!! হাওলাদার বাড়িতে জঘন্য অতীত, রহস্যময়, প্রতিশোধ এর খেলা হচ্ছে। আমার সন্তান টাকে এই থেকে রক্ষা করো। আমি তোমাকে অনেক বিশ্বাস করি, আমি হয়তো কেড়ে নিয়েছি তোমার থেকে অনেক কিছু ই, কিন্তু তুমি তার পরিবর্তে আমার সন্তান কে তোমার নাম পরিচয়, মাতৃত্ব, ভালোবাসা দ্বিগুণ দিবে, কথা দাও।(বিহারিনী হু বলে মাথা নাড়িয়ে সায় দিল, বিহারিনীর হাতটা ছেড়ে দিলাম, বিহারিনী দৌড়ে বের হয়ে গেল)
মনে খুব ই ভালোলাগা কাজ করছে, পেটে হাত দিয়ে বললাম – তোর জন্য আমার থেকে ও ভালো মা দিয়ে যাচ্ছি। আমাকে মনে রাখবি তো!! নাকি খেয়ার ছলে ভুলে যাবি। ভুলে যাস না, আমাকে… আমার বাবা ভুলে গিয়েছিল, সে ছেড়ে চলে গেল!!মা ভুলে গেল, বিক্রি করে দিল!! তোর বাবা ভুলে গেল…তুই যাস না…নামের মহিমায় হলেও #মায়াবন_বিহারিনী_হরিনী হলেও মনে রাখিস!!
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে উপরের লাইটার দিকে তাকিয়ে মনেই মন বললাম –
শেষ সময়ে_আপনাকে দেখার এক অতৃপ্ত বাসনা!!
এতো অভাগী কেন আমি…. খুবই সুক্ষ আলিঙ্গনে হারিয়ে যাব_রুক্ষ মন ই জানি!!
______
রুদ্র, রুদ্রের বাবা ও চাচা চিন্তিত। মায়ার অবস্থা অনেক করুন। মায়ার মাথায় ইন্ট্রানাল ব্লিডিং হচ্ছে। আর বাচ্চার পৃথিবীর আসার সময় এখন ও হয় নি, অপরিপক্ক বাচ্চা। কিন্তু বাচ্চাকে এখন ই বের করতে হবে, মায়ার লেবার ব্লিডিং হচ্ছে, যদি অপারেশন না করানো হয় তাহলে মা বাচ্চা দুইজন ই মারা যাবে। তাছাড়া মায়ার মাথায় ইন্ট্রানাল ব্লিডিং না হলে, তারা দুজন কেই বাঁচানোর চেষ্টা করতো, এখন তো মায়ার হাতে ও সময় কম। মাত্র ঘন্টা খানেক সময় আছে, তারপর সে ও দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবে চিরনিদ্রায়!!
রুদ্র এতো এতো কেইস হেন্ড্রেল করেছে, কিন্তু আজ সে থমকে গেছে, সে পারছে না, হাত কেঁপে উঠে, বুক কেঁপে উঠে, মায়ার সুক্ষ মুখটা দেখে। সে যে মায়াকে নিজের ছোট্ট দুই বোন মারিয়া আর মাহিয়ার মতো দেখতো।
এই কয়েকদিন এ তার আর মায়ার বন্ডিং টা ঠিক ভাই বোনের থেকে ও গভীর হয়েছিল। মায়া প্রাই বাবুর যত্ন কিভাবে নিতে হয়, কি করলে ভালো হয়, এই গুলো জানতে চাইতো!! রুদ্র তাকে তার সময়ের মধ্যে, কিছু সময় বের করে উপদেশ দিতো!!
আজ দ্বিতীয় বারের মতো রুদ্র অপারেশন থিয়েটারে যেতে ভয় পাচ্ছে, মনই মন নয় বাহ্যিক দিক থেকে ও ভেঙ্গে পড়ছে, রাজের প্রতি ক্ষোভ বেড়েই চলেছে….
অবশেষে, যা সবার জন্য মঙ্গলজনক তাই ই করার আদেশ পেয়েছে রুদ্র, তার বাবা ও চাচার থেকে….
_____
রুদ্র, রুদ্রের বাবা আর চাচা মায়ার কেবিনের কাছে আসতেই, বিহারিনী দৌড়ে গিয়ে রুদ্র কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিল। কান্নার বেগ এতোই প্রবল যে, বিহারিনী কিছু ই মুখ ফুটে বলতে পারছে না। অন্য সম। হলে হয়তো রুদ্র হাসত, নিজ পাঁজরের প্রিয়তমা সজনী পাখি কে উপভোগ করতো!! আজ সে ও ভেঙ্গে পড়ছে…
বিহারিনী- মায়া ভাবী বলেছে, সে থাকবে না পৃথিবীতে!! খুব অভিমান হয়েছে তার!! কোনদিন আপনার কাছে কিছু চাই নাই, প্রয়োজন হলে কখনো আর আবদার করব না, আজ আমাকে আপনি কথা দিবেন, আমি আপনার কাছে চাইছি, যত যাই কিছু হয়ে যাক, মায়া ভাবী আর বাচ্চা দুজন কেই আমার জীবিত চাই!! (চিল্লিয়ে উঠল) শুনেছেন, ডাক্তার রুদ্র হাওলাদার!! আমি আমার বোন মায়া কে আর তার বাচ্চাকে জীবিত চাই….
রুদ্র যেন থমকে গেছে। বিহারিনীর এমন রুপ সে কখনো দেখিনি। তাছাড়া এই বিহারিনী তো সেই বিহারিনী নয়!! বিহারিনী সর্বদিক থেকে ঠিক থাকলে কি একই ভাবে মায়া আর বাচ্চাকে চাইত?…
কি জবাব ই দেবে রুদ্র !! বিহারিনীকে সরিয়ে সে দ্রুত পায়ে এক প্রকার ওটি তে যেন পালিয়ে গেল…
______
ঠিক ঘন্টা খানেক পর, একজন নার্স একটা ছোট্ট সুন্দর অংশ কে কাপড় এ পেঁচিয়ে নিয়ে আসলো। বাচ্চা টা কান্না করছে, পরিবারের রুদ্রের মা, দাদি, রাজের মা, মোহিনী এগিয়ে গেল। কিন্তু বিহারিনী থমকে দাঁড়িয়ে আছে। ওটির লাল বাতি এখনো নিভে নাই, একবার বাচ্চা আর একবার ওটির বাতির দিকে তাকায়!!
ছোট্ট বাবুটা এক কোল থেকে আরেক কোল যাচ্ছেই, কিন্তু কান্না থামাচ্ছে না, মিনিট পাঁচেক সবাই চেষ্টা করলো, কিন্তু লাভ হলো না। দাদী নার্সের কোলে দিয়ে বলল – ওর মায়ের কাছে দিয়ে এসো, একটু দুধ খাইয়ে দিলেই শান্ত হয়ে যাবে!!
নার্সটা কি বলবে, শুধু বাচ্চা টার দিকে থমকে তাকিয়ে আছে। নার্সের যেন কিছু বলার ও নেই। নার্সটা বিহারিনীর দিকে এগিয়ে গেল, মায়ার কথা মতো, বিহারিনীর হাতে বাবুকে একপ্রকার একটু জোরে ই তুলে দিল!! সৃষ্টিকর্তার লীলা খেলা বড়ই অদ্ভুত, বাচ্চাটার কান্না ও সাথে সাথে থেমে গেল…
ছোট্ট একটা, সদে জন্ম নেওয়া ফুটফুটে বাচ্চা টা যেন, তার মাকে খুঁজে পেল…পরম আবেশে শান্ত হয়ে গেলো…..
দাদী, রুদ্রের মা উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে গেল…নার্সের মুখে মৃদু এক হাসি ফুটলো, মনেই মন বলল- মায়াময় মেয়েটা হয়তো এই দিক দিয়ে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করতেই পারে….
_____
অপারেশন থিয়েটারে সর্ব চেষ্টা করছে রুদ্র আর তার টিম। কেন যেন, আজ সবকিছু ই ব্যার্থতার শিকল এ বন্দিদশায় বিরাজমান। বলে না, সময়, ভাগ্য, জন্ম_মিত্যু সবকিছু ই বিধাতার বিধান মেনে চলে।
মায়া হঠাৎ করেই কেঁপে উঠলো, রুদ্রের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল- ভাই….(রুদ্রের শক্ত বুকটা যেন থর থর করে কেঁপে উঠলো) আমার বাচ্চা টাকে দেখো। আমি চলে যাব, ফিরব না, কথা দেও, আমার বাচ্চা টা যেন তোমাদের পরিচয় এ বড় হয়…(রুদ্র – আমি কথা দিলাম বোন তোকে, হু হু করে কেঁদে উঠলো রুদ্র)
মায়া- ভাইরে….(শ্বাসটা নিতে খুব ই কষ্ট হচ্ছে) একবার তাকে দেখে দিবে, একবার!! একটিবার!! আমার শেষ ইচ্ছা টা পূর্ণ করে দে না ভাই!! রাজ কে একটি বার ডেকে দে না ভাই!! এই দেখার আকুল আকাঙ্ক্ষা কেন মিঠছে না আমার… আমি….
রুদ্রের হাতেই মায়া তার অতৃপ্ত , অর্ধ আশা, না বলা কথা ব্যক্ত করেই চলে গেল না ফিরার দেশে। উপস্থিত সবার চোখে যেন জল গড়িয়ে পড়ছে.. মূহুর্তে ই ফজরের আযানের ধ্বনি ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে, যেন মায়ার সাথে সাথে এক কালো, অতৃপ্ত রাত শেষ হলো, নতুন এক বিষাদময় দিনের শুরু হলো…. বসন্তের প্রথম দিন….
যেন প্রতিটি রন্দ্র রন্দ্রে মায়াময় বসন্তের এক বাসনা খিলে উঠলো……
চলবে……
(মায়াকে নিয়ে কিছু লাইন…. আপনাদের ভাষায়_ব্যক্ত করবেন!! আমার প্রিয় এক চরিত্রের অবসান হলো আজ!!)