#মায়াবন_বিহারিনী_হরিণী
১৭
#writer_Neel_Noor
পরিবারের সদস্যদের মাঝে পরিস্থিতি কেমন বিচিত্রময় লাগছে। লাগবেই তো। কেননা, বিহারিনী!! যেই বিহারিনী কে নিয়ে এতো সমাগম, এতো কিছু, আজ দুই বছর পর তার দেখা মিলল। ষোড়শী বয়সের কিশোরী আজ অষ্টাদশী যুবতী। অদ্ভুত হলেও সত্যি, সে যেন মায়াময় কোন রাজকন্যা, আরো বেশি সুন্দরী হয়ে উঠেছে।
সবাই সাদোরে গ্রহন করলেও, মনে মনে প্রশ্নের উঁকি কিন্তু এখন ও কম নয়। বিহারিনীর সাথে সেদিন কী হয়েছিল? এতোদিন বিহারিনী কোথায় ছিল? রুদ্র আর বিহারিনী বিয়ে করে নিল, অথচ পরিবার কে জানালে কি হতো!!
রুদ্র_বিহারিনী বাড়িতে এসেছেই মাত্র কয়েক ঘণ্টা খানেক!! কিন্তু বিহারিনী কে যেন চোখে হারায়! রুদ্র সবাইকে বলে দিয়েছে, এতোদিন যা হয়েছে, না হয়েছে, সে সব কিছু সবাইকে বলবে, তবে বিহারিনী কে যেন কেউ প্রশ্নের উপর প্রশ্ন করে বিরক্ত না করে!! সত্যি ই পুরুষের ভালোবাসা কি সুন্দর!!
রুদ্র কে যে ঘরের সবাই সমীহ করে চলে, আমার বুঝতে বাকী রইল না। রাজ যে বাহিরে বেড়িয়ে গেল, রাত নয়টার উপরে বাজে, চিন্তা মাথায় থেকে যাচ্ছেই না। কি করব!! রাজের ফোনে শ এর উপর কল দিয়েছি, প্রতিবার ই মোবাইল বন্ধ!! ইদানিং পেটটা খুব ই বেশি ভারী আর একটু একটু ব্যাথা করে। আজ যেন সবকিছু ই বিষিয়ে উঠেছে। মন ব্যাথা, আমার পেটের অংশ টা ওই যেন তা হারে হারে বুঝতে পারছে।
কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। খাবারের টেবিলে ও যাই নাই। ঘরে বসে আছি, খুব করেই আজ বাবাকে মনে পড়ছে। আজ পূর্ণ হয়ে ও আমার নিজেকে অপূর্ন লাগছে, পূর্ণ হওয়ার বাসনা থেকে আজ অপরাধবোধ কাজ করছে, সেদিন রাজ ভালো হওয়ার সাথে সাথে যদি শর্ত অনুযায়ী আমি চলে যেতাম!! রাজের মাথায় হয়তো বোঝা হতাম না….
এগুলো ই ভাবছিলাম, আর চোখের পানি ধর ধর কইয়া পরছিলো…. হঠাৎ করেই দরজায় করো ভেতরে আসার শব্দ শোনতে পেলাম। আমি রাজ আসছে মনে করে ব্যাকুলতায় উঠে দাঁড়ালাম… কিন্তু আশা ভঙ্গ হলেও চমকের শেষ ছিল না।
চাচি শাশুড়ির সাথে বিহারিনী ও দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। চাচি শাশুড়ির হাতে খাবার, কিন্তু বিহারিনীর চোখে হাজার ও হৃদয় হরনের দুঃখ, কিছু হারানোর ব্যাথা, চোখে মনে জল টলমল করছে…..
বিহারিনীর চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। যতই হোক, প্রথম ভালোবাসা কেউ ই হারাতে চায় না!! প্রথম ভালোবাসার টান সারাজীবন ই থেকে যায়, এক অদৃশ্য অনুভবের মাধ্যমে….
আমি যেমন বিহারিনীর আশাটা জেনে ও সহ্য করতে পারছি না….ও তো আমার মতো ই এতিম!! ওর আকাঙ্ক্ষা!! ভালোবাসা!! যাকে ঘিরে সব কিছু বুনেছিল, এ বাড়িতে এসেছিল, আজ সে ই তার হলোনা, আমি কি ছিনিয়ে নিয়েছি?
মন চোখ পড়তে জানি না, তবে বিহারিনীর চোখ দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা উক্তি মনে পড়ে গেল….
নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস,
ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে;
কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে।
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চাচি শাশুড়ি আর বিহারিনী রুমের ভেতরে ঢুকলো। বিহারিনী ছল ছল চোখে এদিকে সেদিকে তাকায়, সবকিছুর গোপনে চোখের পানি ও আড়ালে লুকিয়ে মুছে, যা আমার দৃষ্টির আড়াল হলো না!!
চাচি শাশুড়ি আমাকে জোর করে খাওয়াই দিল। খেতে ইচ্ছে করছে না, তবুও খাচ্ছি। খেতে হবে। আমি তো আর একলা নই। আরেকজন আমার মাঝে বড় হচ্ছে… সৃষ্টির কি অদ্ভুত লীলা খেলা… মূহুর্তের সুখ দুঃখে পরিনত হতে সেকেন্ড সময় লাগে না।
খাওয়া শেষ। হঠাৎ বিহারিনীময় হরিনী পাখি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল – তুমি রাজ ভাইয়ার বউ!! (আমি শুধু মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম) কি সুন্দর তুমি। তোমার গর্বে তার অস্তিত্ব রাজত্ব করছে তাই না!! কয় মাসের তুমি, ভাবী….
কি উত্তর দিব, ভুল না করা হরিনী কে। যায় শাস্তি সে পাচ্ছে… আচ্ছা এই গল্প কি এখানেই শুরু নাকি শেষ _ নাকি ইতিহাসের সূচনা মাত্র ….
বিহারিনীর কিছু প্রতিক্রিয়া না করেই, উত্তরের আশা না রেখেই আমার পেটে হাত দিল… সাথে সাথে ই রাজের অংশ টা নড়ে উঠলো!! আজই প্রথম, আমার পেটের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে, সে আছে, সে এই ছোঁয়ায় উত্তেজিত!!
এর আগে সে নড়াচড়া করতো, তবে আজকের মতো না!! অদ্ভুত এই বিহারিনী সুখ পেল কি জানি না, তবে আমি অদ্ভুত অনুভূতির সম্মুখীন হচ্ছি…. বিহারিনীর ছোঁয়া বড্ড ই মায়াময়….
বিহারিনী কে কিছু বলব তার আগেই দরজার সামনে থেকে একটা সুক্ষ পুরুষালী কন্ঠ ভেসে এলো, বললো- বাবুটা অন্যের, অস্তিত্ব টা ও অন্যের, আর তুই অন্যের সবকিছু অনুভব করছিস!! আমি রুদ্র কি করে মেনে নেই? এই অনুভূতি আমার তোকে দিতে অসুবিধা নেই, একদিন চেষ্টা করলেই, আট মাস পর তুই ও পেয়ে যাবি নিজের মধ্যে…..
বিহারিনী সহ চাচি শাশুড়ি আর আমি ও চমকে উঠলাম। নিমিষেই বিহারিনী হাতটা সরিয়ে ফেলল, চোখ মুখে ভয় ও ব্যাকুলতার ছোঁয়া স্পস্ট!!
আমি দরজায় উঁকি দিতেই দেখি রুদ্র দরজার সামনে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে রুদ্র আবার ও বলল – ভাবি আমার বউটা কে ছাড়ো!! তাকে ছাড়া থাকতে আমার খুবই অসুবিধা হয়…..
রুদ্রের মা নিজেই হতভম্ব!! ছেলে মায়ের সামনেই… রুদ্রের দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে চাচি শাশুড়ি বলল- ঠোঁট কাটা , বেয়াদব ছেলে কোথাকার। (চাচি শাশুড়ি হন হন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল)
অদ্ভুত এই বিহারিনী ফিক করে হেসে উঠলো। রুদ্র আপন মনে তাকিয়ে আছে, ইশ্ রুদ্রের কি চাহনি!!
______
রুদ্র বিহারিনী তো চলেই গেল। বিহারিনী সত্যি ই ভাগ্যবান, রুদ্রের মতো মানুষ পেয়েছে। মধ্য রাত, আমার ঘুম আসছে না। যার স্বামী এখন ও বাহিরে কি করে আসবে।
হঠাৎ করেই রাজের আগমন। মনেই মনে বলে উঠল, আপনি বাঁচবেন অনেক বছর!! আমি আস্তে আস্তে রাজের দিকে এগিয়ে গেলাম, কি বিশ্রী গন্ধ!! রাজ আজ নিশ্চিত কিছু খেয়ে এসেছে।
আমি কখনো ই রাজকে এতো দিন এমন ভয়ংকর ভাবে দেখি নাই। কি অগোছালো রাজ!!আজ রাজকে আবার ও সেই আগের রাজ দেখা যাচ্ছে…
রাজ আমাকে দেখে বলল – তুমি এখনো ঘুমাও নাই মায়াবিনী!!(ইশ্ পুরোই হৃদয়ে ধাক্কা দিল), আজ আর জেগে থেকো না, তুমি!! আজ আমি ঠিক নেই, বড্ড অগোছালো আমি, আমি চাই না, তুমি আমার এই অধ্যায় আর অবস্থার ভাগীদার হও।
তাছাড়া আমি এটাও চাই না, আমার জন্য তোমার আর আমাদের অস্তিত্বটার ক্ষতি হোক!!
(রাজের দুচোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে, নিজেকে সামলানোর হাজারো চেষ্টা, আকুল আবেদন, প্রচেষ্টা….)
হাতের উলটো পৃষ্ঠা দিয়ে মুছে আবার ও বলল – আমাকে ক্ষমা করে দিও…. আমি কেন পাড়ি না…(বলেই সে রুম ছেড়ে চলে গেল…)
আমি জানি সে সেই অন্ধকার রুমে যাবে, স্মৃতির নদীগুলোকে আলিঙ্গন করবে, আর হাহাকার আর আফসোস করবে।।
আজ এতো শক্ত মানুষ হয়েও আমি নিজেকে শক্ত করতে পারছি না!! পরিশেষে দোষ কার, ভবিষ্যৎ কি? কেমন গোলক ধাঁধা এটা….
চলবে….