উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৪০(১ম ভাগ)||

0
534

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪০(১ম ভাগ)||

৭৯।
আফিফকে রুম থেকে বের হতে দেখে আহি তার কাছে এসে বলল,
“কোথায় যাচ্ছ? তুমি তো অসুস্থ। তোমার এক্স-রে করা হয় নি এখনো।”

আফিফ সেকেন্ড খানিক আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমি নিজের খেয়াল রাখতে পারি।”

আহি অবাক দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকালো। রাদও সেই সময় বেরিয়ে এলো। সে আহির পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“একা যেতে পারবেন? আমি আপনাকে গাড়ি ঠিক করে দেই?”

আফিফ বলল,
“না, এর প্রয়োজন নেই। আমি একাই যেতে পারবো।”

আহি বলল,
“রাদ যাক না হয়। আর তুমি পদ্মকে কি বলবে? ও যদি তোমার মুখে আঘাতের চিহ্ন দেখে কিছু জিজ্ঞেস করে?”

আফিফ ক্ষীণ হেসে বলল,
“পদ্ম আমার ওয়াইফ। দেখি কি বলতে পারি।”

আফিফের খাপছাড়া উত্তর আর শীতল ব্যবহার আহির মনে আঘাত করলো। আহি মনে মনে ভাবলো,
“কি করলাম আমি? হঠাৎ আফিফ এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন আমার সাথে?”

এদিকে সালমা ফাওজিয়া রুম থেকে বের হতেই আফিফ তাকে সালাম দিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ আন্টি, আমাকে সাহায্য করার জন্য। আপনাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি। ভুল কিছু করলে ক্ষমা করবেন।”

সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“ধন্যবাদ দিতে হবে না। আর এখানে কষ্টের কি হলো? আহি যেমন, পদ্মও আমার কাছে তেমনই। আর পদ্মের স্বামী তো আমার মেয়ের জামাই হলো, তাই না।”

সালমা ফাওজিয়া খুব স্বাভাবিকভাবেই কথাটা বললেন। কিন্তু এই একটি বাক্যে আহির বুকটা কেঁপে উঠলো। সে আফিফের দিকে একনজর তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। আফিফ সালমা ফাওজিয়া আর রোকেয়া ফাওজিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো।

(***)

উত্তরের মৃদুমন্দ বাতাসে শরীর কাঁপছে আফিফের। কিন্তু সে উদ্দেশ্যহীন পথে হেঁটে যাচ্ছে। মনটা ভারী হয়ে আছে তার। মনে হচ্ছে সব হাত থেকে ছুটে যাচ্ছে। অনেক কিছুই তো ছুটে গেছে। বাধ্য হয়েই অনেক স্বপ্ন অতীতের পাতায় ফেলে আসতে হয়েছে। বর্তমানের জন্যই অনেক মানুষকে জোর করে স্মৃতি থেকে বের করে ফেলতে হয়েছে। আজ যদি অন্য কারো ভালোর জন্য আফিফকে কিছু করতে হয়, তাহলে সে অবশ্যই করবে।

ঘন্টাখানেক আগেই রাদ আর আফিফের কথোপকথন হয়েছিল। কিছু জমানো কথা আফিফ অনেক বছর পর কারো সাথে ভাগ করে নিতে পেরেছে। এতো বছর ধরে চয়নের মৃত্যুর মূল কারণটা সে একাই নিজের মনে দাফন করে রেখেছিল। তাজওয়ার খানকে সামনে পেয়েও সে কিছু করতে পারে নি। কারণ তার হাতে কোনো প্রমাণ নেই, আর তার বোন রেনুর জীবনটা সে এসব জটের মধ্যে ফেলতে চায় না। যে চলে গেছে তার জন্য, যে আছে তার কথা ভুলে যেতে পারবে না আফিফ। কিন্তু আজ তাকে কেউ আবদার করেছে, তার জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। আফিফের সাধ্যের বাইরে কিছু চায় নি মানুষটা। তাহলে তো সে মানুষটির এতোটুকু ইচ্ছে পূরণ করতেই পারে।
শূণ্য রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই আফিফের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। রাদের মলিন মুখটি ভেসে এলো চোখের সামনে। রাদ ঘন্টা খানেক আগে তার হাত ধরে বলেছিল,
“আপনি আহিকে পছন্দ করতেন, আপনার ওর প্রতি একটুও আগ্রহ ছিল, এই কথা যাতে ও কোনোদিনই জানতে না পারে। আর তাজওয়ার আহির জন্য আপনার বোনের ক্ষতি করেছে, এটা যদি আহি জানতে পারে, তাহলে ও আরো ভেঙে পড়বে। হয়তো আপনার কেউ একজন আছে, যাকে আপনি আগলে রাখতে পারছেন। আহি নেই তো কি হয়েছে, আপনি পদ্মকে পেয়েছেন। দিনশেষে আপনি হারেন নি। হেরেছে আহি। সে তো আপনাকে পায় নি। আর এখন, আমি হেরে যাচ্ছি। কারণ আহি আপনাকে ভুলতে পারে নি। আপনি আমাকে শুধু একটা সাহায্য করুন। মাস্টার্স শেষ না হওয়া অব্ধি আপনি আহির সাথে কোনো যোগাযোগ রাখবেন না। যদি পরিস্থিতি এমন হয়, আপনাকে আহির মুখোমুখি হতে হয়েছে, আপনি অবশ্যই ওকে ইগনোর করবেন। কষ্ট দিবেন। যেভাবে পারেন, ওকে বোঝাবেন, আহি কোনোদিনই আপনার কাছে স্পেশাল ছিল না। আমি জানি, আপনি এমন কিছু করলে আহি কষ্ট পাবে। কিন্তু ও আপনাকে অন্তত ভুলে যাক। যদি আপনার উপেক্ষা পেয়ে, আহি আপনাকে ভুলতে পারে, তাহলে আপনার সেটাই করা উচিত। আমি আহিকে ভীষণ ভালোবাসি। আমি আহির মনে সেই জায়গাটা নিতে চাই, যেই জায়গাটা সে আপনাকে দিয়েছিল। আমি আপনার মতো আহিকে ছেড়ে যাবো না। আমি ওকে খুব ভালোবাসবো। যেই ভালোবাসা আহি ডিজার্ভ করে, এর চেয়ে বেশি ভালোবাসবো।”

আফিফ প্রতিত্তোরে মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিয়েছিলো শুধু। উপেক্ষা শব্দটা সেই মুহূর্তে এতো ভারী কেন মনে হয়েছিল, আফিফ নিজেও জানে না। আর সেই উপেক্ষার প্রয়োগে আহির সেই শুকনো মুখের গভীর চাহনি আফিফকে কেন এতো কষ্ট দিচ্ছে, এটাও সে বুঝতে পারছে না। আফিফ হাঁটতে হাঁটতে ফুটপাতে বসে পড়লো। মিনিট খানিক পর ফোন হাতে নিয়ে পদ্মকে কল করলো। পদ্ম কল ধরতেই আফিফ বলল,
“পদ্মফুল, ভালোবাসি।”

পদ্ম অবাক কন্ঠে বলল, “হঠাৎ!”

“এমনিতেই।”

পদ্ম হেসে বলল,
“নিশ্চয় কোনো মেয়ে আমার স্বামীকে আকর্ষণ করতে চায়ছে, তাই তিনি আমাকে ভালোবাসি বলে নিজেকে বোঝাচ্ছেন, আমার একটা পদ্মফুল আছে, তাই না?”

আফিফ হাসলো। বলল,
“তুমি থাকতে, আমাকে আর কেউ আকর্ষণ করতে পারবে না।”

“আর যদি আমি না থাকি?”

“তুমি কোথায় যাচ্ছো!”

“যদি কোথাও চলে যাই?”

“আমাকে ফেলে চলে যাবে?”

“এমন কোথাও, যেখান থেকে ফিরে আসা যায় না। আর গেলে একাই যেতে হয়!”

“এভাবে বলছো কেন, পদ্ম?”

“এমন হলে!”

“এসব কথা রাখো। আমি আসছি বাসায়। আমার অপেক্ষায় থেকো।”

(***)

আহি মলিন মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আফিফের হুট করে এমন শীতল ব্যবহার আহিকে অস্থির করে তুলছে। রাদ আহির পাশে এসে দাঁড়াতেই আহি চমকে উঠলো। আহি কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল,
“তুই আমাকে কি যেন বলবি বলেছিস!”

রাদ মনে মনে বলল,
“বলবো ভেবেছিলাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমার অন্তত আফিফের যাওয়ার অপেক্ষায় থাকতে হবে। আফিফ বলেছে, মাস্টার্স শেষ করেই সে তোর জীবন থেকে হারিয়ে যাবে। তুই আর কখনোই ওকে খুঁজে পাবি না। আর যেদিন সত্যিই আফিফ হারিয়ে যাবে, আমি সেদিনই তোকে আমার মনের কথা জানাবো। অন্তত সেই মুহূর্তে আমার ভালোবাসা যাতে তোর কাছে বোঝা মনে না হয়।”

আহি রাদের দিকে তাকালো। রাদ মুচকি হেসে বলল,
“তেমন কিছু না। আমার একমাত্র বান্ধবীর জন্য তাজওয়ার খানকে আমার উপযুক্ত মনে হচ্ছে না, তাই চিন্তায় ছিলাম।”

“তো এখন কি চিন্তা শেষ?”

“না। এখন ভাবছি চিন্তা না করে কিছু একটা করবো।”

“কি করবি?”

“তাজওয়ারকে একটা গণপিটুনি খাওয়াতে পারলে ভালো হতো।”

“এতো সাহস!”

“শোন না। আইডিয়া আছে একটা। মনটা শান্তি হবে।”

“কি আইডয়া?”

“কয়েক মাস পর তো ইলেকশন। এখন তো মিছিল-মিটিং কম হচ্ছে না। এমন একটা মিছিলে তাজওয়ারকে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে আসবো। ব্যস, এরপর একটা মারামারি লাগিয়ে দেবো। মার-টার খেয়ে একেবারে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে।”

আহি হাসলো। রাদ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“হাসছিস কেন?”

“তুই কি ভেবেছিস, তাজওয়ার তোর মতো বিন্দাস ঘুরে? ওর আগে-পিছে কিছু নাগ ফণা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ মারতে আসলেই সেই নাগগুলো দংশন করে দেবে।”

হঠাৎ সালমা ফাওজিয়া বারান্দায় এসে বললেন,
“আহি তোমার ফোনে লাবণির কল আসছে।”

আহি বিরক্ত মুখে ফোন হাতে নিয়ে বলল,
“বললাম আজকে পুষ্পের বাসায় থাকবো, তবুও শান্তি দিচ্ছে না।”

আহি কল রিসিভ করতেই লাবণি অস্থির কন্ঠে বলল,
“কোথায় তুমি? নিউজ দেখেছো?”

“কেন আপনাকে দেখাচ্ছে নিউজে?”

“তোমার ফিয়োন্সেকে দেখাচ্ছে।”

“তাজওয়ার!”

“এক্সিডেন্ট হয়েছে তাজওয়ারের। গাড়ি খাদে পড়ে আগুন ধরে গেছে।”

আহি মুখে হাত চেপে রাদের হাত ঝাঁকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তাজওয়ার শেষ।”

রাদ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “মানে?”

“মানে তাজওয়ার মারা গেছে।”

রাদ খুশি হয়ে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ।”

আহি এক গাল হেসে ফোন কানের কাছে আনতেই লাবণি বলল,
“হ্যালো, আহি। শুনছো?”

“হ্যাঁ, শুনে খারাপ লাগলো। দাফন কখন হবে?”

“ওর দাফনে যাবে তুমি? লাশই তো পুড়ে গেছে। ওটা বাদ দাও। তাজওয়ারকে একবার দেখে এসো।”

“পুড়ে যাওয়া লাশ দেখতে দেয়?”

“কি, বলছো এসব? তাজওয়ার কেন পুড়ে যাবে?”

“এই মাত্রই তো বললেন আপনি।”

“আমি তাজওয়ারের বন্ধু অর্ণবের কথা বলছি। তাজওয়ার তো হাসপাতালে। জ্ঞান ফিরেছে ওর। হালকা ব্যথা পেয়েছে।”

আহি হাঁ করে রাদের দিকে তাকালো। রাদ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আবার কি!”

আহি লাবণিকে বলল, “আচ্ছা, আমি আসছি।”

আহি কল কাটতেই রাদ বলল,
“তুই বেঁচে গেলি, আহি।”

“জ্বি না, তাজওয়ার বেঁচে গেছে। একটু আগে আমার কল্পনায় মারা গিয়েছিল।”

“মানে?”

“মানে কি! এক্সিডেন্টে ওর বন্ধু মারা গেছে, আর ওর তো কৈ মাছের প্রাণ।”

“কীভাবে ভাই?”

সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“আহি এভাবে বলে না। যার হায়াত যতোটুকু, আল্লাহ এসব নির্ধারণ করে রেখেছেন। কারো মৃত্যু কামনা করা উচিত না। তার হেদায়েতের জন্য দোয়া করা যায়।”

আহি বলল,
“তাজওয়ার যেদিন হেদায়েত পাবে, সেদিন পৃথিবীর অর্ধেক পাপ কমে যাবে।”

এদিকে আহি রিজওয়ান কবিরের জোরাজুরিতে রাতে হাসপাতালে এলো তাজওয়ারকে দেখতে৷ তাজওয়ারের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে মনে হচ্ছে, সে এখনো বেঁচে আছে কীভাবে? আর তার চোখ-মুখের উজ্জ্বল চাহনি দেখে আহির সন্দেহ হচ্ছে, এই ছেলের কি আদৌ এক্সিডেন্ট হয়েছে? তাজওয়ারকে দেখতে কেমন ফুরফুরে লাগছে! এক্সিডেন্ট করে মানুষের চেহারায় এতো সতেজতা আসে, তা তাজওয়ারকে না দেখলে কখনোই বিশ্বাস করতো না আহি।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here