#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪১||
৮১।
ভাংচুরের শব্দে আহির ঘুম ভেঙে গেলো। ঘড়িতে বিকেল তিনটা। দুপুরে নামাজ পড়েই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছিল সে। বেশিক্ষণ ঘুমোতেই পারলো না। মেঝেতে পা রাখতেই ভয়ংকর চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেলো।
“আল্লাহ গো, ও আল্লাহ গো,” বলতে বলতে চুনি আহির রুমের কাছে দৌঁড়ে এলো। আহির বুক কেঁপে উঠলো। সে দ্রুত দরজা খুলে দিতেই চুনি এসে আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহি চুনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? এমন করছো কেন?”
“আফা, বাঁচান স্যার রে। খুন কইরা ফেলবো তারা। দুই জনের মাথায় গরম হইয়া আছে।”
আহি চুনিকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “নিচে হচ্ছেটা কি?”
চুনি কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“তাজওয়ার ভাইজান আর স্যারের মধ্যে মারামারি লাগছে। ম্যাডাম, ইস, কি বিচ্ছিরি কামডাই না কইরলো। স্যারের মাথাটা গরম হইয়া আছে। তাজওয়ার ভাইজান রে মারতাছে। আর ভাইজান কি কম? হে-ও স্যারের মাথা ফাটাইয়া দিছে। রক্ত বাইর হইতাছে। তবুও কেউ কাউরে ছাড়ে না। আম্মাও ঘরে নাই। বাজার করতে গেছে চাচার লগে। ঘরে কেউ নাই, আফা। আমার ভয় করতাছে।”
আহি শান্ত কন্ঠে বলল,
“তুমি আমার রুমে বসে থাকো। কিছু হবে না। এদের কাজই মারামারি করা। এরা কি আমাদের মতো ভালো? সবগুলোই হিংস্র পশু।”
আহি চুনিকে নিজের ঘরে রেখে নিচে নামতেই দেখলো মিসেস লাবণি অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে কেউ তাকে বেধড়ক পিটিয়েছে। এলোমেলো চুল, শার্টের বোতামগুলোও খোলা। ভেতরের গেঞ্জিতে রক্তের দাগ। আহি নিচে নেমে মিসেস লাবণিকে আপাদমস্তক দেখে বলল,
“কি হয়েছে? শার্ট-প্যান্ট পরে ইফতারের আগে কোথায় যাচ্ছিলেন? আর আপনার এমন অবস্থা কি করে হলো?”
লাবণির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে আহির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। কারণ শব্দগুলো ওই রুম থেকেই আসছিল। আহি দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই দেখলো তাজওয়ার আর তার বাবা দু’জন দুই সোফায় বসে আছে। তাজওয়ারের হাতে টিস্যু। সে নাক থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত পরিষ্কার করছে। এদিকে তার বাবা রিজওয়ান কবিরের কপাল ফুলে গেছে। গালটাও লাল হয়ে আছে। আহি খুব শান্ত ভঙ্গিতে মাঝখানের সোফায় গিয়ে বসলো। তাজওয়ার আহির দিকে একনজর তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। আহি বুঝতে পারছে তাজওয়ার এখনো বেশ রেগে আছে। এবার আহি রিজওয়ান কবিরের দিকে তাকালো। তাকে বেশ শান্ত দেখাচ্ছে। কিন্তু চোখে-মুখে ভেসে উঠেছে অপমানবোধ। আহি বলল,
“কি হলো, তোমরা মারামারি করলে কেন? বাবা যদি বিয়ের আগেই মেয়ের জামাইয়ের গায়ে হাত তুলে, তাহলে কি বিষয়টা সুন্দর দেখায়?”
তাজওয়ার আহির দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালো। আহি তার পক্ষ নিয়েছে, তাই তার বেশ ভালোই লাগলো। কিন্তু রিজওয়ান কবির ক্ষেপে গেলেন। রাগী স্বরে বললেন,
“তোমার ফিয়োন্সে আমার গায়ে হাত তুলেছে। তোমার বাবার গায়ে হাত তুলেছে। আর তুমি আমাকে এই প্রশ্ন করছো?”
“ছেলেটা তো তোমার পছন্দের। আমাকে কেন এই প্রশ্ন করছ? সব জেনে-শুনেই তুমি আমাকে তার হাতে তুলে দিচ্ছো। মার খাওয়ার মতো অধিকার নিজেই আদায় করে নিচ্ছো।”
তাজওয়ার আহির পাশে এসে বসলো। রিজওয়ান কবির তা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন,
“তুমি আমার মেয়ের কাছে আসবে না। আমি আর এই বিয়ে হতে দেবো না।”
তাজওয়ার রাগী দৃষ্টিতে রিজওয়ান কবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আহি আর আমার বিয়েতে কেউ বাঁধা দিলে, আমি তাকেই আমার পথ থেকে সরিয়ে দেবো।”
আহি তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বেশ তো। মেরে ফেলো। আমার বাবাকে মারতে চাও তো? কিন্তু তার আগে আমাকে মেরে ফেলো। তোমাকে আমি ভালোবাসি না। তাও মনে হচ্ছিলো, অন্তত আমার ব্যাপারে তুমি সিরিয়াস, সেই বিশ্বাস থেকেই তোমাকে এই কয়েক সপ্তাহ ধরে বোঝার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তুমি বার-বার আমাকে ভুল প্রমাণ করেছো। আর এখন তুমি আমার বাবার গায়ে হাত তুলে, আমার পাশে এসে বসার সাহস দেখাচ্ছো কীভাবে?”
“আহি, লিসেন।”
“এখনি আমার বাবার কাছে ক্ষমা চায়বে। এরপর আমি শুনবো, কি হয়েছে, আর কার কতোটা অপরাধ।”
“আগে শোনো। কারণ এখানে আমার কোনো দোষ নেই।”
আহি শীতল কন্ঠে বলল,
“আমারও কোনো দোষ ছিল না, তবুও বাবা অনেক বার আমার গায়ে হাত তুলেছে। আমার মায়েরও কোনো দোষ ছিল না, তবুও এই মানুষটাই আমার মাকে পিটিয়েছে। কিন্তু আমি তো কখনো আমার বাবার গায়ে হাত তুলি নি। এতো এতো অপরাধ করার পরও কখনো গলা উঁচু করে তাকে কিছু বলি নি। তাহলে তুমি কে, আমার বাবার গায়ে হাত তোলার?”
তাজওয়ার রিজওয়ান কবিরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“সরি। আমার কোনো অপরাধ ছিল না। আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন।”
রিজওয়ান কবির মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তাজওয়ার আহির কাছে এসে তার হাত ধরে বলল,
“আমার কিছুই আসে যাই না, তোমার বাবা আমাকে বিশ্বাস করলো, কি করলো না। কিন্তু তোমার আমাকে বিশ্বাস করতেই হবে।”
“কি হয়েছে, সেটা বলো।”
তাজওয়ার পুরো ঘটনা আহিকে বলতে লাগলো।
(***)
দুপুরে আহির সাথে দেখা করার জন্য বাসায় এলো তাজওয়ার। বেল দিতেই চুনি দরজা খুলে দিয়ে ভেতরে চলে গেলো। তাজওয়ার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো। এরপর আহির রুমের দিকে পা বাড়াতেই তার সামনে এসে দাঁড়ালো মিসেস লাবণি। লাবণিকে দেখে তাজওয়ার কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,
“আমার মিসেস এর সাথে দেখা করতে এসেছি। নিশ্চয় এর জন্য অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই!”
লাবণি খুব অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এনি প্রবলেম?”
লাবণি তাজওয়ারের হাত ধরে তাকে নিজের রুমে নিয়ে গেলো। তাজওয়ারও বিনাবাক্যে লাবণির সাথে চলে গেলো। রুমে ঢুকেই লাবণি তাজওয়ারকে তার বিছানায় বসিয়ে দিয়ে তার সামনে চেয়ার টেনে বসে বলল,
“আহি তো তোমাকে পছন্দ করে না। হয়তো তোমার এমন কাউকে বেছে নেওয়া উচিত, যে তোমাকে পছন্দ করে।”
তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“যে আমাকে পছন্দ করে, আমার তাকেই পছন্দ হয় না। তাজওয়ার খান ইউনিক জিনিস খুব পছন্দ করে। আর আমার কাছে আমাকে পছন্দ না করাটাই সবচেয়ে ইউনিক। কারণ সবাই আমাকে ভালোবাসতে চায়, আর আমি শুধু আহিকে ভালোবাসতে চায়।”
লাবণি তার শার্টের কয়েকটা বোতাম খুলে দিয়ে বলল,
“তোমার কি মনে হয়, আমি তোমাকে পছন্দ করি?”
তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এক্সকিউজ মি। আপনাকে নিয়ে আমি এমন কিছুই ভাবি নি।”
তাজওয়ার কথাটি বলেই উঠে চলে যেতে নেবে তখনই লাবণি তাজওয়ারকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুমি আহিকে বিয়ে করো, আমার তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমি চাই, আমাদেরও একটা সম্পর্ক হোক।”
তাজওয়ার লাবণির দিকে ফিরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমি মানুষকে দেখেই বুঝে যায়, সে কেমন। আপনাকে দেখেও আমার এমন একটা ধারণা হয়েছিল। কিন্তু এতো বছর পর সেই ধারণা প্রমাণিত হবে, তা আমি ভাবি নি।”
“দেখো, তুমি চাও আহিকে। আর আমি চাই তোমাকে। তোমার আর আমার এখানে কোনো ক্ষতি নেই। আহির সাথে তোমার বিয়ে হলে, তুমি এমনিতেই আহিকে পাচ্ছো। আর তোমার বাবাও দু’টো বিয়ে করেছে। তুমিও চাইলে করতে পারো।”
“আপনি আহির মা।”
“আমি আহির আপন মা নই। আর আমি রিজওয়ানকে তালাক দিয়ে দেবো। ওর সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখবো না।”
তাজওয়ার হেসে বলল,
“আমার রুচি এতোটাও খারাপ নয়। আমি কারো স্পর্শ করা জিনিসে হাত দেই না। আমার জীবনে আসা সব কিছুই নতুন।”
লাবণি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আহি কোনো নতুন মানুষ নয়। তুমি কি জানো, আহি অন্য একজনকে ভালোবাসে?”
তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“জানি। কিন্তু আমার তো আহির ভালোবাসার প্রয়োজন নেই। আমিই ওকে ভালোবাসবো।”
লাবণি তাজওয়ারের কথায় বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুমি এতোটা ইমোশনাল হবে, সেটা আমি ভাবি নি।”
“লিসেন, মিসেস লাবণি। আহি সম্পর্কে আমাকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করবেন না। আর আপনার সম্পর্কে তো কিছু জানারই বাকি নেই। আজ সবটাই খোলাসা হয়ে গেছে। আপনি আগ্রহী হলে আমি আমার বন্ধু হ্যারি, সজিব আর জিলানের সাথে কথা বলতে পারি। কিন্তু আমি আপনার ব্যাপারে সীমা লঙ্ঘন করতে পারবো না।”
লাবণি তাজওয়ারের হাত ধরতেই তাজওয়ার তাকে সরিয়ে দিলো। এরপর দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে নিবে তখনই লাবণি তাকে আবার পেছন থেকে আঁকড়ে ধরলো। আর তখনই রিজওয়ান কবির তাদের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো।
রিজওয়ান কবির ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকিয়ে আছে। লাবণি তাকে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই রিজওয়ান কবির তাজওয়ারের কলার ধরে তাকে রুম থেকে টেনে বের করে আনলো। তাজওয়ার কবির সাহেবের এমন ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়ে গেলো। সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আহিকে ডাকতে যাবে, তখনই রিজওয়ান কবির তাকে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ি থেকে নিচে ফেলে দিলো। তাজওয়ার ভারসাম্য হারিয়ে একদম নিচে গিয়ে পড়লো। রিজওয়ান কবির এবার নিচে নেমে তাজওয়ারকে মারার জন্য এগিয়ে যেতেই লাবণি তার হাত ধরে বলল,
“আমাদের ভুল বুঝছো তুমি?”
রিজওয়ান কবির সশব্দে লাবণির গালে চড় বসিয়ে দিলেন। লাবণিও ভারসাম্য হারিয়ে মেঝেতে বসে পড়লেন। রিজওয়ান কবির এবার তাজওয়ারকে ইচ্ছেমতো ঘুষি মারলেন। তাজওয়ারের রাগ এবার সীমা ছাড়িয়ে গেলো। সে পালটা আক্রমণ করে বসলো রিজওয়ান কবিরের উপর। দু’জন কেউ কাউকে ছাড়ছে না। লাবণি আটকাতে গেলে দু’জনই তার উপর চড়াও হয়ে যায়। তাই ভয়ে লাবণি সরে দাঁড়ালো। এদিকে চুনি এমন দৃশ্য দেখে ভয়ে আহিকে ডাকতে চলে গেলো।
(***)
আহি তাজওয়ারের মুখে এমন কথা শুনে রিজওয়ান কবিরের দিকে তাকালো। তিনি চুপ করে বসে আছেন। ভালোবেসেই তো লাবণিকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। যেই নারীর প্রেমে অন্ধ হয়ে প্রথম স্ত্রী, সালমা ফাওজিয়াকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। আহির ইচ্ছে করছে বাবার উপর পরিহাস করতে। কিন্তু আহি করলো না। সে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“বাবা, তোমার কি মনে হয়, তাজওয়ার মিথ্যে বলছে? তোমার সামনেই তো সব বললো। তুমি কি অন্য কিছু দেখেছিলে?”
রিজওয়ান কবির চুপ করে আছেন। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“বাবার তো এখানে কোনো দোষ নেই। স্ত্রীর এমন কীর্তি-কাণ্ড দেখে কোনো স্বামীই স্বাভাবিক থাকতে পারে না। আর এর জন্য তাজওয়ারকে ভুল বুঝে তার গায়ে হাত তোলাও রাগেরই প্রকাশ ছিল। কিন্তু তাজওয়ার, তুমি বাবার গায়ে হাত তুলে ভুল করেছো।”
তাজওয়ার রিজওয়ান কবিরের কাছে ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে পড়লো। রিজওয়ান কবিরও চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন। আহি ধীর পায়ে হেঁটে সিঁড়িতে বসে পড়লো। তার চোখে অশ্রু ভীড় করলো। সে সিঁড়ির হাতলে হাত রেখে বলল,
“কিছু বছর আগে, তোমাকে বাবা এভাবেই মেরেছিলো। জানো মা, আমি এতোটাই অবুঝ ছিলাম, এতোটাই দুর্বল ছিলাম যে তোমাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসতে পারি নি৷ মানুষটা তোমাকে মেরে কি সুন্দর আবার স্যুট-কোট পরে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতো। কখনো তার গায়ে কেউ হাত তুলতে পারে নি। কিন্তু আজ তাজওয়ার আমার মনটা শান্ত করে দিয়েছে। আমার আজ এতো ভালো লাগছে! মনে হচ্ছে, আমি আমার মায়ের উপর অত্যাচার করার একটুখানি শোধ তো তুলতে পেরেছি। তাজওয়ারও শাস্তি পেয়েছে। সেদিন আফিফকে বিনা অপরাধে মারার শাস্তি। এভাবে পাপীগুলো নিজেদেরই যদি শেষ করে দেয়, তাহলে কোনো পাপীই আমার জীবনে থাকবে না।”
(***)
লাবণি থম মেরে রিজওয়ান কবিরের পাশে বসে আছে। রিজওয়ান কবির চুপচাপ বিছানায় শুয়ে আছেন। আজকের দৃশ্যটা ভুলতেই পারছেন না তিনি। লাবণি নিরবতা ভেঙে বলল,
“আমার নিয়ত খারাপ ছিল না। কিন্তু এই মুহূর্তে তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না। এমন কিছু হয়ে যাবে আমি নিজেও ভাবতে পারি নি। আগে জানলে তোমাকে আগে থেকেই জানিয়ে এমন কিছু করতাম। ভেবেছি, আমার প্ল্যানটা তোমাকে রেজাল্ট আসার পর বলবো।”
রিজওয়ান কবির ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকালেন। লাবণি বলল,
“আহি একদিন আমাকে এসে বলেছিল, তাজওয়ার না-কি সব মেয়েদের সাথেই অবৈধ সম্পর্ক রাখে। মনে আছে, সরওয়ার বাসায় এসে চুনির সাথে কেমন ব্যবহার করেছিল? আহিই বললো, বিয়ের পর তাজওয়ার যদি চুনি বা আমার সাথে এমন কিছু করতে চায়? তোমার এক সময় বয়স বাড়বে। তখন কি তুমি আর আমাকে প্রটেক্ট করতে পারবে? তাই আমি শিউর হওয়ার জন্য এই নাটক সাজিয়েছি। দেখতে চেয়েছি, আমাকে একা পেলে তাজওয়ার খারাপ কিছু করে কি-না।”
রিজওয়ান কবির উঠে বসলেন। লাবণি চোখের পানি মুছে বলল,
“আমার বুদ্ধিটা হয়তো খারাপ ছিল। কিন্তু ইন্টেনশন খারাপ ছিল না।”
রিজওয়ান কবির লাবণির হাত ধরে বললেন,
“তুমি আমাকে আগে বলো নি কেন?”
“তুমি আমার কথা শুনছিলে? আমাকে চড় মারলে। তাজওয়ারকেও মারলে। ছেলেটা আমাকে এখন কি ভাববে? আমি ভেবেছি, ওর পরীক্ষা নেওয়ার পর, সত্যটা ওকে জানিয়ে দেবো। তোমার জন্য, ও আহির চোখে আরো খারাপ হয়ে গেলো। সাথে আমিও।”
রিজওয়ান কবির শান্ত কন্ঠে বললেন,
“সরি, লাবণি। তোমাকে ভুল বুঝেছি। আমি এক্ষুণি তাজওয়ারকে ফোন করে সত্যটা জানাচ্ছি।”
“জানাতে হবে না। পরে দেখা হলে বলো। এখন ওর মাথাটা খারাপই থাকবে। এসব শুনলে আরো রেগে যাবে। বলবে আহি ওকে বিশ্বাস করে না। আমাকে যা ভাবার ভাবুক, অন্তত আহির সাথে তাজওয়ারের সম্পর্ক ঠিক থাকুক।”
রিজওয়ান কবির লাবণিকে জড়িয়ে ধরলেন। লাবণি মনে মনে হাসলো আর বলল,
“অন্তত এই ওল্ড ফুলকে হাতে রাখা সহজ। কিন্তু তাজওয়ার যে এতোটা অনেস্ট হবে, এটা আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।”
(***)
আহি লিনাশাকে ফোন করে আজকের পুরো ঘটনা বলার পর বললো,
“লিনু, আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না তাজওয়ার এতোটা লয়াল হবে।”
“আমারও। আমার মনে হচ্ছে, ওর প্ল্যান তোকে বিয়ে করা। তাই হয়তো লাবণিকে পাত্তা দেয় নি। কারণ আর যাই হোক, তোর বাবার ওয়াইফ।”
আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“কি ভেবেছি, আর কি হয়ে গেলো। ভেবেছি লাবণি যদি তাজওয়ারকে ফাঁসিয়ে ফেলে। দু’জনই আমার পথ থেকে সরে যাবে। কিন্তু এই তাজওয়ার তো আমার পিছুই ছাড়ছে না। আমি না, তাজওয়ারকে বুঝতেই পারছি না। ওর এতোগুলো মুখোশ? কোনটা রিয়েল, কোনটা ফেইক, কীভাবে বুঝবো?”
“এসব বাদ দে। ফেইক আর রিয়েল যাই হোক, আমার সাজেশন, ওই ছেলেকে কোনোভাবেই বিয়ে করা যাবে না। ফার্জিয়া নামের যেই মেয়েটা তোকে তাজওয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছিলো, ওই মেয়েটাই এর সবচেয়ে বড় কারণ। যে ছেলে নিজের স্বার্থের জন্য মেয়েদের জীবন নিয়ে খেলছে, সে কখনোই পারফেক্ট লাইফ পার্টনার হতে পারে না।”
“এখন কি করবো?”
“আপতত চুপ থাক। দেখ কি হয়। মিসেস লাবণি ভীষণ চালাক। তোর বাবাকে এতোক্ষণে ভংচং বুঝিয়ে দিয়েছে। তোর বাবাও দেখবি সব গিলে ফেলবে।”
“যাহ, হাতেনাতে ধরা খাওয়ার পর, বাবা উনাকে বিশ্বাসই করবে না!”
“শোন, সবাইকে নিজের মতো ভাবিস না। যারা ধূর্ত হয়, তারা যে-কোনো মূল্যে নিজের কথার জালে অন্যকে ফাঁসিয়ে ফেলতে পারে। যেটা লাবণির দ্বারা সম্ভব।”
লিনাশার কথায় আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। যদি এবার পরিকল্পনাটা সফল না হয়, তাহলে অন্য কিছু করতে হবে তাকে।
(***)
দেখতে দেখতে ইদ চলে গেলো। ইদের এক সপ্তাহ পর থেকেই শুরু হলো লিনাশা আর নায়ীবের বিয়ের প্রস্তুতি। বিয়ের কার্ড পছন্দ করে এসেছিলো দুই পক্ষই। ছাপানো শেষ। কয়েকদিনের মধ্যে কার্ডও বিলি করা শেষ। দুই সপ্তাহ পর আনুষ্ঠানিকভাবে লিনাশাকে উঠিয়ে নেওয়া হবে। আজ তাদের আনুষ্ঠানিক এনগেজমেন্ট। একটা রেস্টুরেন্টে সব আয়োজন করা হয়েছে। দায়িত্ব আহি আর রাদ নিয়েছে। সন্ধ্যায় এনগেজমেন্ট৷ ডেকোরেশনের কাজ দেখে আহি একপাশে এসে বসলো। তার পাশে এসে বসলো রাদ।
খোলা ছাদ, অন্ধকার আকাশ, সাদা মেঘ, শীতল হাওয়া, মুহূর্তটা বেশ ভালো লাগছিল আহির। আহি চোখ বন্ধ করে কৃত্রিম সাজসজ্জার ভীড়ে প্রাকৃতিক স্নিগ্ধতা অনুভব করতে লাগলো। তখনই তার কাঁধে মাথা রাখলো রাদ। আহি পাশ ফিরতেই দেখলো রাদের চোখ বন্ধ। আহি বলল,
“ঘুমিয়ে গেলি না-কি!”
রাদ চুপ করে আছে। কিছু বলছে না। এভাবেই সে শান্তি পাচ্ছে। আহির সাথে এমন মুহূর্ত কাটানো যদি তার ভাগ্যে বাকি জীবনের জন্যও লেখা হয়ে যেতো, তাহলে মন্দ হতো না।
চলবে-