উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৪২(১ম ভাগ)||

0
591

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪২(১ম ভাগ)||

৮৪।
আহি হাতে মেহেদি লাগিয়ে এক কোণায় বসে নাচ দেখছে। নায়ীব আর লিনাশা পাশাপাশি বসে আছে। দু’জনকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। আহি মনে মনে ভাবলো,
“ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাওয়ার মতো আনন্দ হয়তো অন্য কিছুতে নেই। লিনু আজ কতো খুশি!”

আহি এবার পাশ ফিরে পদ্ম আর আফিফের দিকে তাকালো। তাদের দেখে সে মুচকি হেসে আপন মনে বলল,
“ওরাও কতো সুখী! তাহলে আমি কেন সুখী হতে পারছি না? ইদানীং আফিফকে হারানোর কষ্ট আমাকে ওভাবে কাঁদায় না। তবুও নতুন করে সুখ খুঁজতে পারছি না কেন? আমি কি তাহলে ভয় পাচ্ছি? আবার কাউকে ভালোবেসে কষ্ট পাওয়ার ভয় কি আমাকে নতুন স্বপ্ন দেখতে বাঁধা দিচ্ছে? না-কি এখনো মনের কোথাও না কোথাও অতীতটাই বসে আছে!”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তখনই তার পাশে এসে বসলো উজ্জ্বল। আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকাতেই উজ্জ্বল গাঢ় হাসি দিলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কিছু হয়েছে?”

উজ্জ্বল মাথা নেড়ে বলল, “অনেক কিছু হয়েছে।”

“কি!”

“তুমি খুব বোরিং, আহি।”

আহি চোখ সরিয়ে নিয়ে হালকা হাসলো। উজ্জ্বল গভীর দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহি আবার উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল বলল,
“তুমি কি জানো, মানুষের চেহারা আর তার আত্মার চেহারা একই থাকা উচিত।”

“আত্মার আবার চেহারা আছে?”

“হুম, কখনো খুব সুন্দর, কখনো বা খুব কুৎসিত।”

“কীভাবে বোঝা যায় সেটা?”

“মানুষের চেহারায় আত্মার চেহারা ফুটে উঠে।”

“যেমন!”

“এই যে তুমি মেয়েটা, মাশাল্লাহ। কিন্তু তোমার আত্মাটা এতো নির্জীব হয়ে আছে যে, তোমার সৌন্দর্যটাই দাবিয়ে রেখেছে।”

আহি হাসলো। এবারের হাসিতে প্রাণ ছিল। উজ্জ্বল বলল,
“এই তো এটাই। আমি এটাই দেখতে চেয়েছি। মিষ্টি মেয়ের মিষ্টি হাসি।”

আহি লাজুক হেসে মাথা নামিয়ে ফেললো। উজ্জ্বল আবার বলল,
“তোমাকে দেখে কেউ বিশ্বাস করবে না, তুমি রিজওয়ান কবিরের মেয়ে।”

“কেন?”

“তোমার মধ্যে সেই ঐশ্বর্যের অহংকার নেই। তোমার মনোভাব, আচরণ একদম সাধারণ মেয়েদের মতোই। এই জন্য বোধহয় তুমি অনেক স্পেশাল।”

“সাধারণ মেয়ে, আবার স্পেশাল?”

“সাধারণ পরিবারে জন্ম নিয়ে সাধারণ হওয়াটা বেশ স্বাভাবিক। ধনীর দুলালিদের উৎশৃঙ্খল হওয়াটাও স্বাভাবিক। কিন্তু আহি হওয়াটাই অস্বাভাবিক। তাই তো তুমি স্পেশাল।”

আহি আবারও লাজুক হেসে মাথা নামালো। উজ্জ্বলের এই হাসিটাই বেশ সুন্দর লাগছে। মেয়েদের প্রশংসা করলে, মেয়েরা যে কতোটা খুশি হয়, তা আহির লাজুক হাসিতেই প্রকাশ পাচ্ছে। উজ্জ্বল আবার কিছু বলতে যাবে তখনই একটা হাত আহির দিকে এগিয়ে এলো। আহি মাথা তুলে দেখলো রাদ দাঁড়িয়ে আছে। আহি রাদকে বলল,
“এখানে এসে বস।”

“চল ডান্স করি।”

আহি হাত দেখিয়ে বলল,
“হাতে মেহেদি। তোর পাঞ্জাবিটা নষ্ট হয়ে যাবে।”

রাদ আহির বাহু ধরে ওকে টেনে উঠালো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কি হয়েছে, রাদ?”

“কিছু না। চল অন্যদিকে গিয়ে বসি।”

“তুই ঠিক আছিস তো?”

উজ্জ্বল উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমরা বসো আমি আসছি।”

উজ্জ্বল চলে যেতেই আহি রাদের দিকে তাকালো। রাদ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আহি বলল,
“আজকাল বেশ অদ্ভুত আচরণ করছিস?”

তখনই একটা টেবিলের উপর দুইটা চামচ নিয়ে গানের ধুন সৃষ্টি করলো উজ্জ্বল। আর সুরের সাথে গেয়ে উঠলো।

“লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা ।।”

সবার দৃষ্টি স্টেজের সামনে গেলো। সবাই মনোযোগ দিয়ে উজ্জ্বলকে দেখছে। আর উজ্জ্বলের দৃষ্টি আহির দিকে। উজ্জ্বল চামচ দু’টি টুলটির উপর রেখে একটা মাইক নিয়ে আহির দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে আসতে গাইতে লাগলো,

“যদি বারেবারে একই সুরে
প্রেম তোমায় কাঁদায়,
তবে প্রেমিকা কোথায়
আর প্রেমই বা কোথায়?
যদি দিশেহারা ইশারাতে
প্রেমই ডেকে যায়,
তবে ইশারা কোথায়
আর আশারা কোথায়?
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়!
.
লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।”

এবার উজ্জ্বল আহির দিকে হাত এগিয়ে দিলো। আহি এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। উজ্জ্বল মুচকি হেসে নিজেই আহির যেই হাতের মেহেদি শুকিয়ে গেছে, সেই হাতটি আলতোভাবে ধরে তাকে সবার সামনে নিয়ে এলো। এরপর আহির পাশে দাঁড়িয়ে গাইতে লাগল,

“যদি প্রতিদিন সেই রঙিন
হাসি ব্যথা দেয়,
যদি সত্যগুলো স্বপ্ন হয়ে
শুধু কথা দেয়,
তবে শুনে দেখো প্রেমিকের
গানও অসহায়।
লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।”

আহি পেছন ফিরে লিনাশার দিকে তাকালো। লিনাশা বেশ খুশি। সে নায়ীবকে বলল,
“ওদের বেশ মানিয়েছে, তাই না?”

নায়ীব কোনো উত্তর দিলো না। সে রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। এদিকে উজ্জ্বল হাতের ইশারায় সবাইকে গানের সাথে যোগ দিতে বলল আর নিজেও গাইতে লাগলো,

“যদি অভিযোগ কেড়ে
নেয় সব অধিকার,
তবে অভিনয় হয়
সবগুলো অভিসার।
যদি ঝিলমিল নীল আলো কে
ঢেকে দেয় আঁধার,
তবে কি থাকে তোমার
বলো কি থাকে আমার?
যদি ভালোবাসা সরে গেলে
মরে যেতে হয়,
ক্যানো সেই প্রেম ফিরে এলে
হেরে যেতে ভয়?
শেষে কবিতারা দায়সারা
গান হয়ে যায়।
.
লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।”

লিনাশা নায়ীবের হাত ধরে স্টেজ থেকে নেমে এলো। তারাও যোগ দিলো উজ্জ্বলের গানে। উজ্জ্বল আহির দিকে তাকিয়ে গেয়ে যেতে লাগলো,

“যদি বারেবারে একই সুরে
প্রেম তোমায় কাঁদায়,
তবে প্রেমিকা কোথায়
আর প্রেমই বা কোথায়?
যদি দিশেহারা ইশারাতে
প্রেমই ডেকে যায়,
তবে ইশারা কোথায়
আর আশারা কোথায়?
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়!
.
লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।”

আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে আছে। গান গাওয়া শেষে করতালি মুখর পরিবেশে সবার দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে আহি আর উজ্জ্বল। কিন্তু কারো দৃষ্টি আটকালো না রাদ আর আফিফের দিকে। রাদের হাত মুঠো হয়ে আছে, চোখে অশ্রু জমবে এমন অবস্থা। অন্যদিকে আফিফকে দেখে বেশ অস্থির মনে হচ্ছে। সে নিজেও বুঝতে পারছে না, তার খারাপ লাগার কারণ কি। সে পদ্মের হাত শক্ত করে ধরলো। পদ্ম আফিফের স্পর্শ পেয়ে তার দিকে তাকালো। ইশারায় জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে?”

আফিফ পদ্মের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি ফেরত দিলো। পদ্ম বুঝলো না সেই হাসির অর্থ। সে আফিফের হাত আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। এদিকে রাদ ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে লাগলো। কিছুদূর পিছিয়ে সে পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছে নিতেই তার কাঁধে কারো স্পর্শ পেলো। রাদ পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো লাবীব দাঁড়িয়ে আছে। লাবীব কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে, তার আগেই রাদ বেরিয়ে গেলো। লাবীব এবার আহির দিকে তাকালো। আহির চোখে হাসি। অনেক বছর পর আহিকে এমন ভাবে হাসতে দেখছে। দেখে মনে হচ্ছে আহি মুগ্ধ হচ্ছে উজ্জ্বলের গানের সুরে। এই মুগ্ধতা কি রাদের অনুভূতির জন্য থামিয়ে দেওয়া উচিত? যেই মেয়েটা এতো বছর পর কারো দৃষ্টিতে নিজেকে হারানোর সুযোগ পেয়েছে, তাকে কি সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা উচিত?

৮৫।

রাত বাড়তেই অতিথিরা বিদায় নিতে লাগলো। উজ্জ্বলের মা মিসেস আমিনা আহির গাল টেনে দিয়ে বললেন,
“পুষ্পের সাথে বাসায় এসো। তোমাকে কতো বছর পর দেখলাম।”

কথাটি বলেই তিনি উজ্জ্বলের দিকে তাকালেন। উজ্জ্বলের ঠোঁটে মৃদু হাসি। তা দেখে পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে ফিসফিস করে উজ্জ্বলকে জিজ্ঞেস করলো,
“হাসছিস কেন এতো?”

উজ্জ্বল হাসি গিলে ফেললো। বাঁকা চোখে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই তোর কাজ কর।”

উজ্জ্বল ও মিসেস আমিনা চলে যেতেই পুষ্প আহির হাত ধরে বলল,
“কি হলো এটা আজকে?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি হলো?”

“উজ্জ্বল ভাইয়া আর তুই প্রেম-টেম করছিস না-কি?”

রাদ আর লাবীব তখনই আহি আর পুষ্পের সামনে এসে দাঁড়ালো। পুষ্পের প্রশ্নটা রাদ আর লাবীব দু’জনেই শুনেছে। লাবীবও এবার পুষ্পের কথায় যোগ দিয়ে বলল,
“আহি, সত্যি না-কি?”

আহি অবাক কণ্ঠে বলল,
“পাগল তোরা! একদমই না। আমি প্রেম করবো, আর তোরা জানবি না?”

পুষ্প বলল,
“নাও জানাতে পারিস। আমাকে তো কিছুই জানাস না। লিনাশাকে হয়তো জানিয়েছিস।”

“যা, গিয়ে জিজ্ঞেস করে আয়। ওকেও এমন কিছু বলি নি৷ কারণ এই মুহূর্তে আমার জীবনে কিছুই নেই।”

“হবে হয়তো।”

“তুই জানিস তাজওয়ারের সাথে আমার এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে।”

“তুই তো উনাকে পছন্দ করিস না। আর বিয়ে তো এখনো হয় নি।”

“হ্যাঁ, তাও এমন একটা সিচুয়েশনে আমি প্রেম করবো, এমন পাগল পাগল চিন্তা-ভাবনা তোদের মাথায় কীভাবে আসে?”

লাবীব জিজ্ঞেস করলো,
“তাহলে তোকে দেখে যে অন্য কিছু মনে হলো!”

“কি মনে হলো?”

এবার রাদ বলল,
“তাকিয়ে ছিলি পুষ্পের সেই কাজিনের দিকে। হাসছিলি তাকে দেখে।”

আহি রাদের কথায় হালকা হেসে বলল,
“ধুর, কারো দিকে তাকিয়ে থাকলে আর হাসলে কি প্রেম শুরু হয়ে যায়? আসলে উনার গানের গলা বেশ ভালোই ছিল। আর গানটার অর্থটা আমার অনেক ভালো লেগেছিল। তাই শুনছিলাম। আর এভাবে সবার সামনে টেনে নিয়ে যাওয়াতে ভীষণ লজ্জা পেয়েছি। মনে হয়েছিল, গানটা উনি আমার জন্য গেয়েছেন। নিজেকে ইম্পোরটেন্ট মানুষ হচ্ছিলো। তাই হাসি পেয়েছে। কেউ কখনো আমার জন্য গান গায় নি তো, তাই। এই প্রথম কেউ গেয়েছে।”

রাদ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমি কখনো গান গাই নি?”

“তুই আর বাকিরা তো আলাদা!”

রাদ আহির কথায় অবাক হলো। বিষ্ময়ভরা কন্ঠে বলল,
“আলাদা মানে?”

“তুই আমার ফ্রেন্ড।”

লাবীব রাদকে থামিয়ে দিলো। রাদের ভীষণ অস্থির লাগছে। আহির বন্ধু হয়ে সে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এখন এর মাশুল কি আহিকে হারিয়েই দিতে হবে?

(***)

রাদ বেরুতেই আহিও তার পিছু পিছু এলো। রাদ আহিকে আসতে দেখে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আহি তার মুখে একটা সন্দেশ পুরে দিলো। রাদ সন্দেশটা খেয়ে আহিকে বলল,
“আমাকে বিদায় দিতে এসেছিস?”

আহি মাথা নেড়ে বলল,
“উহুম, তোকে সন্দেশ খাওয়াতে এসেছি। ভেতরে শুধু দু’টো প্যাকেটে সন্দেশ ছিল। তুই তো অন্য মিষ্টি খাস না। তাই তোর জন্য নিয়ে এসেছি।”

রাদ আহির গালে হাত রেখে বলল,
“কিছু জিনিস ভালো লাগলেও সহজে পাওয়া যায় না। খুব করে চাইলেও, তা আমাদের স্পর্শের বাইরে থাকে।”

আহি হেসে বলল,
“সন্দেশ নিয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করছিস?”

রাদ মৃদু হেসে মনে মনে বলল,
“তুই তো আমার কাছে সন্দেশই। সন্দেশ যেমন মিষ্টি। তুইও তেমন।”

আহি বলল, “কি হলো?”

“বলছি সন্দেশ যদি নিজ থেকেই আমার কাছে ধরা দেয়, তাহলে আমি তাকে যেতে দেবো না।”

আহি হেসে বলল,
“হ্যাঁ ধরা দিয়েছে তো। তাই তো খেয়ে ফেলেছিস।”

রাদ ঠোঁটে দুষ্টু হাসি টেনে আহির দিকে তাকালো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এভাবে হাসছিস কেন?”

রাদ বলল,
“তুই নতুন করে কাউকে ভালোবাসবি না?”

“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

“বল না।”

“দেখা যাক।”

“যদি কেউ তোকে ভালোবাসে। তখন?”

“তখন কি?”

“ধর, কেউ একজন তোকে ভালোবাসে। কিন্তু সাহসের অভাবে বলতে পারছে না। কি করবি? সে যদি সাহস করে জানিয়ে দেয়, তখন কি না করে দিবি?”

“তাজওয়ার খানের ঝামেলা মিটলে ভেবে দেখবো।”

রাদ এক গাল হেসে বলল, “সত্যি?”

আহি রাদের হাতে ঘুষি মেরে বলল,
“পাগল না-কি তুই? কে সেই প্রেমিকটা শুনি?”

“আমি তো অনুমান করছি। থাকতেও পারে। আমি শিউর হচ্ছিলাম। তুই কতোটুকু মুভ অন করেছিস ওটা জানার জন্য এমন প্রশ্ন করেছি।”

আহি মলিন হেসে বলল,
“মুভ অন তো আমি সেদিনই করেছি, যেদিন সমুদ্র তীরে নিজ হাতে পদ্ম আর সেই মানুষটার বাসর সাজিয়েছিলাম। কিন্তু মুভ অন বলতে কি বোঝায়, রাদ? নতুন কাউকে আসতে দেওয়া? পুরোনো মানুষটাকে স্মরণ না করা? আমি চাই এমন কেউ আসুক, যে অন্তত আমার মানুষ হোক। কিন্তু সেই মানুষটা চোখের সামনে থাকলে কীভাবে আমি মুভ অন করবো?”

“আফিফ তো এই শহরেই থাকবে। তাহলে কি করবি?”

“একবার মাস্টার্স শেষ হোক। এরপর তাজওয়ারের থেকে মুক্তি নেবো। বাবার কাছ থেকে মুক্তি নেবো। এরপর নতুন শহরে যাবো। নতুন স্বপ্ন দেখবো। এমন কিছু করবো, যাতে আফিফ মানুষটা কোনোদিনই আমার চোখের সামনে না আসে। মানুষ কতো সহজে বলে ফেলে মুভ অন করে ফেলেছি। আমার কাছে মুভ অন শব্দটার অর্থ, তাকে নিয়ে অশ্রু না ফেলা, রাত জেগে বালিশ না ভেজানো, তাকে চোখের সামনে কল্পনা না করা আর তার সাথে একা একা কথা না বলা। এতোটুকুতেই আমার মুভ অন। কিন্তু একা থাকলে ঠিকই অতীত নাড়া দেয়। তাই আমি মুভ অন নয়, আমি ভুলে থাকবো। আর এটা একদিনে হবে না। কিন্তু খুব শীঘ্রই হবে।”

“আর আমি সেই দিনটার অপেক্ষায় থাকবো।”

(***)

কমলা রঙের লেহেঙ্গা পরে আয়নায় নিজেকে দেখছে আহি। তখনই পেছন থেকে তাজওয়ার এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। আহি তাজওয়ারকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি এখানে?”

“কেন তোমাকে দেখতে আসতে পারি না?”

“আমি ব্যস্ত আছি। আমাকে একটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে।”

“আমিই তোমাকে নিয়ে যাবো।”

“তোমাকে কে বলেছে নিয়ে যেতে?”

“আহি, কি হয়েছে তোমার? তুমি তো আমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছো! তাহলে এখন এভাবে কথা বলছো কেন?”

তখনই লাবণি আহির রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। তাজওয়ার লাবণির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“আমার হবু শাশুড়ী মা সেদিন আমাকে পরীক্ষা করছিলেন। আমি না-কি তার পরীক্ষায় পাশ করেছি। তাই আমাকে ফোন করে বললো তোমার পাশের ফলস্বরূপ তোমার রানীকে নিয়ে বাইরে থেকে ঘুরে এসো। সে না-কি বান্ধবীর বিয়েতে যাচ্ছে। দু’জন একসাথে বিয়েও এটেন্ড করবে, এরপর একটা ভালো মুহূর্তও কাটাবে।”

আহি রাগী দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকালো। লাবণি রহস্যময় হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“মাই ডিয়ার প্রিন্সেস, তোমার মিস্টার খানের সাথেই লিনাশার বিয়েতে যাওয়া উচিত। তাদেরও তোমার হবুও বরের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেতে হবে। আফটার অল বেস্ট ফ্রেন্ড এর হাসবেন্ডরা অন্তত গুড ফ্রেন্ড তো হতেই পারে।”

আহি তাজওয়ারকে বলল,
“প্লিজ, তুমি যেও না। আমি বিয়ের প্রোগ্রাম শেষে তোমার সাথে দেখা করবো।”

তাজওয়ার বলল,
“আমি তো যাবোই। এমনকি সবাইকে জানাবো, তুমি আমার কে হও!”

তাজওয়ার কথাটি বলেই বেরিয়ে পড়লো। এবার লাবণি আহির মুখোমুখি এসে বলল,
“তোমার বাবা আর তাজওয়ার খানের মধ্যে ঝামেলা বাঁধিয়ে নিজের পথ পরিস্কার করতে চেয়েছিলে, তাই না?”

আহি অবাক দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকালো। লাবণি হেসে বলল,
“তোমার প্ল্যান ফ্লপ। তোমার বাবাকে তো আমি একটা বুঝিয়ে দিয়েছি। তাজওয়ারকেও তোমার প্ল্যান সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়ে দিয়েছি। তুমি যে তাকে বিশ্বাস করার অভিনয় করে তাকেই ধোঁকা দেওয়ার পরিকল্পনা করছো, এই সত্যটা তাজওয়ার জেনে গেছে। এখন যতোদিন তোমাদের বিয়ে হবে না, তুমি আর ইমোশনালি তাজওয়ারকে ফাঁসাতে পারবে না।”

“আপনাকে কে বলেছে, আমি তাজওয়ারকে বিশ্বাস করার অভিনয় করছি?”

“তুমি হুট করে তাজওয়ারকে এতো সম্মান দিচ্ছো! যাকে সহ্য করতে পারতে না, তাকে এতো সময় দিচ্ছো! তাহলে কে বিশ্বাস করবে তুমি তাকে বিশ্বাস করছো?”

আহি দমে গেলো। লাবণি আহির গাল টেনে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তোমার পরিকল্পনা মোটেও খারাপ ছিল না। কিন্তু এই মস্তিষ্কের মাঠে তুমি নতুন খেলোয়াড়। আমি অনেক আগেই নেমেছি। যাই হোক, আমাকে একটা ভালো আইডিয়া দিয়েছো তুমি। এখন তোমার বাবাও মন্ত্রী হয়ে যাবে। আমিও অনেক ক্ষমতা পাবো। আর তাজওয়ার আমার জন্য অপশনাল হয়েই থাকবে। কেমন হবে, যখন নিজের স্বামীকে আমার সাথে দেখবে?”

“তাজওয়ার আর আমার এখনো বিয়ে হয় নি। হবেও না।”

“মিস আহি, তোমাকে হারানোর জন্য তাজওয়ার আর তোমার বিয়ে না দেওয়া অব্ধি আমি শান্তি পাবো না। এরপর তুমি যে ধোঁকা খাবে, সেই ধোঁকা থেকে তুমি চাইলেও মুক্তি পাবে না। এর জন্য যদি আমাকে সব সীমা অতিক্রম করতে হয়, আমি করবো।”

“মিসেস লাবণি মেহেরা, চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্টেড। তাজওয়ার আর আমার যদি বিয়ে হয়, তাহলে আমি সেদিনই নিজ হাতে নিজেকে শেষ করে দেবো। এতোটুকু কনফিডেন্স আমার আছে যে আমি তাজওয়ার খানের নাম শুনে কবুল না বলতে চাইলে, বিয়ের রেজিস্ট্রার পেপারে স্বাক্ষর না করতে চাইলে কেউ বাধ্য করে আমার কন্ঠে সে কবুল শব্দটা আনতে আর আমার সিগনেচার কাগজে জোর করতে তুলতে পারবে না।”

“এতোটা ডেস্পারেট তুমি?”

“আপনাকে চ্যালেঞ্জে হারানোর জন্য এটা আমার জীবনের শেষ সংগ্রাম। এই যুদ্ধে আমি যদি জিতে যাই, আল্লাহর কাছে আমার ওয়াদা আমি জীবনের সব বিলাসিতা ত্যাগ করবো। সৃষ্টিকর্তা আমার জীবনে শান্তি এনে দিলে, আমি জগতের সব মোহ ত্যাগ করতে রাজি। তাহলে আমার নামে থাকা সম্পত্তি, আর তাজওয়ারের প্রাসাদে রানী হওয়ার মতো ঠুনকো ইচ্ছে আমার থাকার কথা নয়। আমার ইচ্ছে, আমি রানী হবো। কিন্তু তার রানী হবো, যে আমার রাজা হওয়ার যোগ্য। না থাকুক তার বাড়ি। আসল রাজাদের বাড়ি নয়, মন থাকতে হয়। আর সেই মনে আমি সম্রাজ্ঞী হয়ে বাস করবো। আর সেদিন আপনার জায়গাটা কোথাও থাকবে না। এই কয়েকদিনের সুখ নিয়ে সুখী হয়ে যান। সামনে চরম দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে। কষ্টের পরেই তো স্বস্তি। আল্লাহ যেই কথাটা জানিয়েছেন, সেটা অবিশ্বাস করা যায় না। তাহলে আমার এতো বছরের কষ্টের পর আমি কেন স্বস্তি পাবো না? অবশ্যই পাবো। আপনি নিজ চোখে আমার জয় দেখবেন। আর নিজেকে হারতে দেখবেন।”

লাবণি হেসে বলল, “কি করতে পারবে তুমি?”

“সময় বলে দেবে।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here