#মায়াবন_বিহারিনী_হরিণী
২২
#writer_Neel_Noor
রাজ কাগজ টা নিয়ে বারান্দায় দোলনায় বসল। এই স্থান টা তার মায়াবিনীর খুব ই পছন্দের একটা জায়গা ছিল। রাতের জোৎস্নার আলোতে শিউলি গাছটা কেও যেন তার কাছে মায়াবিনীর অংশ মনে হচ্ছে। এই গাছটির নিচে ই তার বাম পাজরের অংশ সায়িত আছে। চোখ থেকে হঠাৎ নোনাজল গড়িয়ে পড়লো হাতের কাগজটা তে….
ছেলেদের নাকি কান্না করতে মানা, কিন্তু কে বোঝাবে এই পাষান্ড হৃদয়কে, যে মায়াতেই আটকে আছে, আসলেই কি!! বিধাতার খেলা এত্তো নির্মম, যাকে দেয় চারদিক থেকে দেয়, যাকে দেয় না কোন দিক থেকে ই দেয় না!!
কি দরকার ছিল, সেদিন তাঁরই হাতে তার মায়াবিনীর মৃত্যুর লেখা টা লিখানোর!! কি দরকার ছিল? কেউ কি একটু উত্তর দিবে_যাতে সর্ব হারানো রাজ একটু শান্তি খুঁজে পায়। তার মনে তো বিশাল দুর্বিষহ!!
মনই মন আবার ও প্রশ্ন, কেন ই বা, সেদিন ই তার গাড়ি এক্সিডেন্ট করতে হবে, হাতের মোবাইল টা হারাতে হবে!! সারারাত হাসপাতালে বেহুঁশ অবস্থায় পড়ে থাকতে হবে!! কেন? বিধাতার এতো নিষ্ঠুর খেলা…..
মা হারালো, বাবা থেকে ও থাকল না। সৎ মায়ের কম অত্যাচারে তো বড় হলো না….কতো নিরবে সহ্য করেছে!! যাকে ভালোবাসল, তাকে ও পেল না, কিন্তু কি সুন্দর গোলক ধাঁধা, ভালোবাসার মানুষ টি আজ তার চাচাতো ভাইয়ের বউ!! যে তাকে তাঁর মায়ের মতো আগলে রাখল, ভালো রাখার জন্য বিশ্বজয়ী হলো, সমস্ত বাঁধা পারি দিল, সে ও মায়ের মতো, ভালোবাসার মতো তাকে ছেড়ে চলে গেল!! সে কি এতোই খারাপ? সে কি একটু সুযোগ পাওয়ার যোগ্য ছিল না? তার কি একটু ও সময় পাওয়ার অধিকার ছিল না… একটু সময় আর সুযোগ দিলে কি হতো!! সবশেষে তারো ও তো অন্য আর কয়টা মানুষের মতো সুখে থাকার ইচ্ছে জাগে…সুখ পেতেও কপাল লাগে…তার কি তাও নেই!! কি করে বাঁচবে সে?…
দীর্ঘশ্বাস আর হাহাকার জুড়ে রয়েছে দক্ষিণা শিউলি গাছের পাশের দোতলা কক্ষ টা, যার মাটিতে সয়িত আছে এক অভাগিনী, আর তারই মতো আরেকটা অভাগা তার জন্য ই অপেক্ষার প্রহর গুনছে, এক শিশু মা_হারা হয়ে সয়িত আছে, প্রহর গুনছে _দেখছে নিয়তির পুনঃ খেলা….
হাল্কা ধমকা কনকনে ঠান্ডা বাতাসে রাজের হুঁশ ফিরে, হাতে থাকা কাগজের ভাঁজটা খুলল, হাতের লেখাগুলো খুব ই পরিচিত… কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা, ইশ্ কি হৃদয়হরন যন্ত্রনা নিয়ে ই না লিখেছিল তার অর্ধাঙ্গিনী ….. দুচোখ ভরে অশ্র, তবুও চিঠিপত্র টা পড়িবার এক আকুল বাসনা….
প্রিয়,
আমায় হৃদ_মাজারে রেখো!!
ভুলো যেও না….
তোমার অংশ টাকে দিয়ে গেলাম। যত্ন করে রেখো। তুমি আজও অবুঝ শিশুর ন্যায় রয়ে গেলে। কীভাবে থাকব আমি তোমাকে ছাড়া, একলা, ঐ অন্ধকার কুঠুরিতে!!
সৃষ্টিকর্তার লীলা খেলায় কার দোষ!! না তোমার_না আমার!! কারো নয়!! তবুও আমাদের অগোচরে হাওলাদার বাড়ির কেউ কেউ এই মৃত্যু খেলা সজ্জিত করেছে!! আমি সর্ব শেষে তোমায় রক্ষা করতে পারলাম না!!
নিজের যত্ন নিও, আমার অংশ টাকে দেখে রেখো, আমাকে তোমার হৃদয়ে জায়গা দিতে না পারলেও, মস্তিষ্কের স্মৃতিতে স্মরনে রেখ….
মায়াবিনী!!
রাজ চিঠিপত্র টা পড়ে ই মাথায় হাত রাখল!! এখন রাজের কিছুই ভালো লাগছে না। বার বার চিঠিপত্র টা পড়ছে, আর একটা লাইনে ই থমকে যাচ্ছে। “আমাদের অগোচরে হাওলাদার বাড়ির কেউ কেউ এই মৃত্যু খেলা সজ্জিত করেছে” কথাটা যেন মাথার সুচের মতো বিধল। রাইটার -নীলনূর।
রাজ আর কিছু তেই নিজেকে সামলাতে পারছিল না। তাই তড়িঘড়ি করে উঠে গেল, রুমের ভেতরে প্রবেশ করতে ই সে ফ্লোরে থাকা কাপড়ে পিছল খেয়ে খাটে বারি খেতে যেয়ে ও না খেয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো।
রাজ এক পলকের জন্য থমকে গেল। সে এখন হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছে, মায়াবিনী ছাড়া তার রাজ অসহায়!! বিহারিনীর প্রতি তার বাহ্যিক ভালোবাসা থেকে ও মায়াবিনীর প্রতি মায়া, অনুভব, আন্তরিক সবকিছু ই যেন বেশি। কিন্তু এ সবকিছু ই সে তার মায়াবিনীকে হারিয়ে বুঝতে পারছে….কি লাভ এখন!!
থমকে বসে থাকা রাজ নিজ পায়ে দাঁড়াতে গিয়ে ও যেন পারল না, হাত পা ছড়িয়ে আবার ও ফ্লোরে বসে পড়লো। হঠাৎ করেই রাজের হাতে শক্ত কিছু লাগতেই, রাজের নজর কাড়ে বস্তুটা। বস্তুটা আর কিছু নয়, মায়ার মোবাইল টা।
মোবাইলটার উপর এখন ও রক্ত লেগে আছে। রক্তে কালচে ভাব, তবুও নিজেকে শান্ত করে মোবাইল টা হাতে নিলো। অন বাটনে ক্লিক করতেই মোবাইল টা চালু হয়ে গেল, সেদিন মায়াবিনী এই মোবাইল টা সামনে ধরে কিছু দেখাতে চেয়ে উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল!! তারপর ই তো এতো সোরগোল, সবকিছুর নিস্তার!!
রাজ যেন মোবাইলটার উপর নির্ভর হয়ে পড়েছে, এমন ভাবে মোবাইল টা চাপছে। এখান তো সেখান। হঠাৎ, করেই তার একটা ছবি নজরে পড়ে, ছবিটা দেখেই রাজের ভ্রু_জুগলদ্বয় চমকে উঠে!!
রাজ বুঝতে পারছে না, এমন একটা ছবি এখানে কেন? তাও বিহারিনী আর তার নিকটতম ছবি!! যেন অশ্লীলতায় দুজন, কিন্তু আজ পর্যন্ত রাজ কখনো বিহারিনীকে খারাপ ভাবে ছুঁয়ে দেখা দূরে থাক খারাপ নজরে দেখে নাই!!
সাথে সাথে ই রাজের মায়ার চিঠিপত্র টা তে লিখা কথাটা মনে পড়ে গেল ” আমাদের অগোচরে হাওলাদার বাড়ির কেউ কেউ এই মৃত্যু খেলা সজ্জিত করেছে” ….কে সে? আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ!! আর কিছু পেল না।
রাজ মোবাইল টা আরেক বার তন্নতন্ন করে খুঁজতে গিয়ে একটা ভিডিও তে আটকে গেল!! ভিডিও টা কেউ দেয় নাই, বরং মায়াবিনীর মোবাইল থেকে সরাসরি করা, …..
ভিডিও তে মায়াবিনীর দুর্বিষহ মুহুর্তে তার সৎ মা ও তার ভাবীর কথোপকথন সম্পূর্ণ ধারন করা। বিহারিনী আসতেই তাদের লুকিয়ে পড়া, বিহারিনীর চিৎকার সব ই রেকর্ড করা হয়েছে….
তারপরের ঘটনা গুলো ও দেখল। তার মায়াবিনীর কষ্ট পাওয়া, কাতরানো!! সবকিছুর ভিডিও!! তারপর তড়িঘড়ি করে মায়াবিনীর সাহায্য করার সময় ই মোবাইল টার ভিডিও বন্ধ হয়ে যায়….
রাজ তার অর্ধাঙ্গিনীর এমন অবস্থায় সাথে ছিল না, তবে এই অবস্থা টা দেখে সে নিজেকে সামলাতে পারল না, গণবিরোধী চিৎকার করে মায়াবিনী বলে ডেকে উঠল!!
রাজের চিৎকার এ ছোট্ট বাচ্চা টা ঘুম থেকে ধরফরিয়ে উঠলো। চিৎকার করে কান্না শুরু করলো!! রাজ ফ্লোরে শুয়ে মোবাইল আর চিঠিপত্র টা বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো….
রাজের পাশের রুমেই বিহারিনী, রাজের এমন ভয়ংকর গগনবিদারী চিৎকার শুনে ভয় পেয়ে ও বাচ্চাটার কান্না শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না, রুম থেকে এক দৌড়ে সে রাজের রুমে ঢুকে গেল….
বিছানায় এলোমেলো হয়ে বাচ্চাটা কান্না করছে, আর রাজ ফ্লোরে অঝোর কাঁদছে!! বিহারিনী তার জীবনে এমন করুনাময় সময় পার কখনো করেছে বলে মনে হচ্ছে না!! এ যেন এক মৃত্যু কান্না, সবকিছু হারিয়ে সর্বহারা হয়ে যাওয়ার খুব গভীরের কান্না…..
অদ্ভুত এই বিহারিনী রাজের দিকে ছুটে না গিয়ে বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। এর মধ্যে ই রাজের মা, চাচি, মোহিনী হাজির হলো…. ঘরের পুরুষেরা নেই, এখন ই এসে হাজির হবে অফিস থেকে!!
রাজ কে ফ্লোরে এরকম করে শুয়ে কাঁদতে দেখে রুদ্রের মা দৌড়ে এসে রাজ কে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু রাজের মা আর মোহিনী দূরে ই দাঁড়িয়ে থাকল। তারা মনই মন প্রশান্তি পাচ্ছে, তাদের মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে….
রাজ তার চাচি মার হাতের পরশ পেয়ে চাচিমা কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকল। ছেলেদের কান্না করতে নেই। কিন্তু রাজের ক্ষেত্রে এ কথাটাই উল্টো, যেন তার জীবনের সূত্রপাত ই হয়েছে, আমৃত্যু পর্যন্ত কান্না করার জন্য!!
রাজ নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছে, তার চাচি মায়ের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে, চাচি মা কে উদ্দেশ্য করে বলল – চাচি মা!! কেউ যদি তোমার আপন কারোর ক্ষতি করে, তাহলে তুমি কি করবে!!
রুদ্রের মা বুঝতে পারল না। তবে রাজের দুচোখের পানি পরম সযত্নে মুছে দিতে দিতে বলল – তুই কান্না করিস না বাপ আমার!! তুই…
রাজ এবার তার সৎ মা আর মোহিনীর দিকে রক্তমাখা চোখে তাকালো, একটু রাগী কন্ঠে বলল- চাচি মা, কেউ যদি রুদ্র কে মেরে ফেলে, তাহলে কি করবে…
কথাটা বিহারিনীর অগোচরে ই তার মস্তিষ্কে পৌঁছায়, আনমনে বলেই ফেলল – খুন করে রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠব!!
রাজ বিহারিনীর দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত মুচকি হাসল। এদিকে রাজের মা আর মোহিনীর প্ররান যায় যায় অবস্থা। মনই মন তাদের কু কু করছে, কোথাও রাজ কিছু জেনে ফেলল না তো?
________
ফ্লোরে রক্তের চকচকা দাগ, কেটে যাওয়া মাথাগুলো বডি থেকে দূরে পরে আছে, আরেকজন শরীরে আঁচর আর আঁচর!! ফিকনি দিয়ে রক্ত পড়ছে, সেই রক্তে একজন যুবক নিজেকে মাতাচ্ছে, আরেকজন, খুব সযত্নে অন্যদের দেখাচ্ছে, কীভাবে মানবদেহের চোখ, কিডনি, হৃদপিন্ড সুন্দর করে কাটতে হয়, তা আবার বিনামূল্যে ডোনেটগারে পাঠানো হবে…. সামনে থাকা দুজন পুরুষ ই তা দেখে চিৎকার করছে, আর বার বার রক্ত, মানবদেহের বিশ্রী রক্তের গন্ধে বমি করছে…..জ্ঞান হারাচ্ছে…. নিজেদের জীবন ভিক্ষা চাচ্ছে…..
চলবে…