দোলনচাঁপার_সুবাস #পর্বঃ২৯ (২য়) #লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

0
310

#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ২৯ (২য়)
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

বাংলায় একটি প্রবাদ আছে-
“যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়”
আজ দোলার বাসায় নিশীথকে দেখে রাকিব মনেপ্রাণে এই প্রবাদে বিশ্বাস করে নিলো। একদিকে নিশীথ যেমন নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে, অপরদিকে ধরা পড়ার ভয়ে রাকিবের অবস্থা ঠিক ততটাই খারাপ! শায়লা ছেলের এমন আচরণে বিরক্ত হলেন। বাসায় এত বড়মুখে কথা বলা তার ছেলে কিনা নিশীথকে সামনে দেখেই এমন চুপসে যাবে? এটা তিনি মানতে পারলেন না। যে করেই হোক, এখানে আসার উদ্দেশ্য সফল করতে হবে। পারভীন ও দোলাকে নিচু করতে হবে!
তাই রাকিবের থেকে আশা বাদ দিয়ে উনি নিজেই কথা বলা শুরু করলেন।

—ওরে বাবা! দেখো কান্ড তাহলে! এখন বুঝলি রাকিব, কেন ওরা সবাই এতক্ষণ সবকিছু শুনেও চুপ ছিলো? আরে আমরা তো দেখছি মায়ের কাছে মামাবাড়ির গল্প করছিলাম! যাকে নিয়ে কথা শুনাতে এলাম ওরা তাকেই মেহমান বানিয়ে খাতিরদারি করছে!

শায়লার কথায় এবার পারভীন বেগম রেগে গেলেন। এতক্ষণ তো চুপ করে অনেককিছুই শুনলেন, কিন্তু এবার যখন তাদের সাথে নিশীথকেও অপমান করা হচ্ছে সেটা পারভীন বেগম সইতে পারলেন না। যে তার মেয়ের দুঃসময়ে এত বড় উপকার করেছে, তাকে যখন তারই বাসায় তাদেরই সামনে কথা শুনানো হচ্ছে তখন কিছু একটা না বললে উনি নিজের নজরে নিজেই ছোট হয়ে যাবেন! নিশীথ তে’ড়ে এসে কিছু বলতে যাবে এমন সময় পারভীন ওকে থামিয়ে দিলেন। নিশীথ কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাঝপথে থেমে গেলো! অতঃপর, কখনো শায়লার সামনে বড় গলায় কথা না বলা পারভীন বেগম রা’গের সহিত উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন,

—ভাবি, আব্বা-আম্মার পর সবসময় ভাইসাহেব ও আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করে এসেছি। কখনো আপনাদের মুখের উপর কিচ্ছু বলিনি, কিন্তু আজকে যখন আপনি নিজের ছেলের দোষ ঢাকতে আমার নির্দোষ মেয়ের উপর এত বড় অপবাদ দিচ্ছেন, ওর পাশাপাশি যে ছেলেটা ওকে সাহায্য করেছে তার চরিত্রেও দাগ লাগাচ্ছেন তখন আমি কিছু কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি!

উনার কথায় শায়লা নড়েচড়ে উঠলেন। সচারাচর, পারভীন এভাবে তার সাথে কথা বলেনি কভু। আজ যখন বলছে তখন কি এমন বলবে যার কারণে এতকিছু বললো সে? শায়লার ভাবনার মাঝেই পারভীন ঘৃণা সহিত দৃষ্টিতে রাকিবের দিক চেয়ে বললেন,

—রাকিবকে আমি সবসময় স্নেহ করে এসেছি। ওর চরিত্র সম্পর্কে টুকটাক আন্দাজা থাকলেও ওকে নিয়ে কোনোদিন কারও কাছে কিছু বলিনি! এমনকি যখন সে আমার নিজের মেয়ের সাথেও অন্ধকারে একাকি সুযোগ উঠানোর চেষ্টা করে তখনও আমি শুধুমাত্র আমার ভাইসাহেব ও আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর বিরুদ্ধে কিছু না বলে চুপচাপ বিয়েটা ভেঙে দিয়েছি। তারপরেও আপনার ছেলে সঠিক পথে এলোনা, বরং আজকে তো সব সীমা অতিক্রম করে আমার মেয়ের উপরেই দোষ দিতে এসেছে! কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয়না, আজকে প্রমাণ পেলা…

—পারভীন!

শায়লা উনাকে থামিয়ে দিয়ে ধমকে উঠলেন। নিজের ছেলের ব্যাপারে এসব শুনতে দুনিয়ার কোনো মায়েরই ভালো লাগবেনা, শায়লাও ব্যতিক্রম নন। উপরন্তু, রাকিবের চরিত্রদোষ এর ব্যাপারে আগে থেকে জ্ঞাত না হওয়ায় উনার কাছে এসব শোনা চরম বিস্ময়েরই বটে!

অন্যদিকে, মামাবাড়িতে দোলার সাথে করা রাকিবের কাণ্ডের কথা জেনে নিশীথের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে। কপালের রগ ইষত ফেপে উঠে। দোলা ওকে এতদিন এসব কিছু বলেনি কেন? শক্ত চোয়ালে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ও দোলার দিকে তাকায়, যে আপাতত ভীত নজরে মায়ের দিক চেয়ে আছে। নয়তো নিশীথের এ চাহনি দেখলে মেয়েটা ইতিমধ্যে ঘাবড়ে যেতো! এরই মাঝে শায়লা উচ্চস্বরে চেচিয়ে বললেন,

—তোমার এত বড় স্পর্ধা, আমার ছেলের নামে এত জঘন্য অপবাদ দেওয়ার? শুধুমাত্র তোমার মেয়ের গোপন প্রেম ফাস করানোর কারণে তুমি আমার ছেলের চরিত্রের দিকে আংগুল তুলছো? আরে, আমার ছেলের পেছনে মেয়ের অভাব আছে নাকি যে তোমার মেয়ের সাথে ও এরকম কিছু করবে? আমি কখনো তোমার কথা বিশ্বাস করবোনা। আমার রাকিব কোনোদিন এতটা নিকৃষ্ট কিছু করতে পারেনা! তবু, তোমাদের মা-মেয়ের সাহস দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছিনা!

শায়লার কথায় পারভীন বেগম তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলেন। তিনি জানতেন তার ভাবি কখনোই বিশ্বাস করবেনা, এজন্যই তিনি রাকিবের ব্যাপারে কিছু বলেননি শায়লাকে। আজকালকার যুগে মানুষ প্রমাণ দেখেই স্বীকার করতে চায়না সেখানে তো কোনো প্রমাণ ছাড়া উনার বিশ্বাস করার প্রশ্নও উঠেনা। কিন্তু পারভীন বেগম মনে মনে আফসোস করলেন আজকের এ দিনের জন্য। একিসাথে তার মনে হলো, এতদিন মেয়ের মুখে সব জেনেও কোনোকিছু না বলার জন্য হয়তো এমন মাসুল দিতে হচ্ছে আজকে! তাই আর রাখঢাক না করে তিনি বললেন,

—এখনও আমার সাহসের আপনি দেখলেনই বা কি, ভাবি? এতদিন সব জেনেশুনেও আপনাদের থেকে রাকিবের সত্যটা লুকোনোর ফল আজকে পেলাম বোধহয়। এজন্যই লোকে বলে, দুনিয়ায় ভালোমানুষের দাম নেই! কিন্তু যার জন্য করলাম চুরি তারাই যদি চোর বলে, তবে তো আমার সত্যি বলা ছাড়া আর কোনো উপায় অবশিষ্ট থাকেনা তাইনা! আপনি যেমন আপনার আদরের ছেলে সম্পর্কে কোনো উল্টাপাল্টা কিছু শুনতে রাজি নন, ঠিক তেমনি আমিও আমার মেয়ে সম্পর্কে কোনো আজেবাজে কথা সহ্য করবোনা। আল্লাহ দিলে আপনাদের চেয়ে আমাদের অবস্থা কম হতে পারে কিন্তু আমার দোলা কিরকম, ও কার সাথে কি করছে না করছে তার সবটাই আমার ভালো করে জানা আছে! নিশীথের সাথে ওর কোনোরকম সম্পর্ক নেই, সেদিনেও আপনার ছেলে দোলাকে রেস্টুরেন্টে ডেকে ওর সাথে কুকাজ করতে চেয়েছিলো বলেই দোলা বাধ্য হয়ে নিশীথের সাহায্য চায়। কিন্তু নিজের কুকর্মকে ঢাকা দিতে রাকিব সব দোষ আমার মেয়ের উপর চাপিয়ে দেয়! ভালো চালাকি করেছে আপনার রাকিব! তবু আমার উপর ওর চালাকি খাটবেনা। কারণ, আমি আমার মেয়েকে পুরোপুরি বিশ্বাস করি। ও বাসায় এসেই সবটা আমায় বলে দিয়েছে। সুতরাং, আমার ও আমার মেয়ের ব্যাপারে আপনি এবং আপনার ছেলে নাক না গলালেই ভালো!

এক দমে এতকিছু বলে ক্ষণিকের জন্য থেমে গেলেন পারভীন বেগম। দম নিয়ে আবারো বললেন,

—আরেকটা কথা আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি, ভাবি। এই যে আপনি সবসময় মানুষের পেছনে পড়ে থাকেন, কখনো যদি এগুলো বাদ দিয়ে নিজের ছেলের দিকে একটু নজর দিতেন তবে রাকিব আজ এমন বিপথে যেতোনা। আপনি আজ আমাদের কথা বিশ্বাস করলেন না, আমি জানতাম এমন কিছু হবে। বরং, আপনি সবসময় রাকিবের দোষ ঢাকতে ওর এমন অনেক ভুল অদেখা করেছেন। যার ফলে ওর অনৈতিক কাজে সাহস হয়েছে। আপনার এই অতিরিক্ত প্রশ্রয়ের জন্য ও এমন লাগামহীন হয়েছে। তাই ছেলের উচ্ছন্নে যাওয়ার পেছনে কিছুটা হলেও আপনার হাতও রয়েছে। সম্ভব হলে এখন থেকে ছেলের গতিবিধির উপর নজর রেখেন, কিছুদিন পর তো ওরও বিয়ে হবে। কেউ একজন খুব ভরসা করে নিজের মেয়ে আপনার ছেলের ঘরে পাঠাবে অন্তত তখন যেন ও ভালোভাবে সংসার করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখেন!

উনার মুখে কথাগুলো শুনে দোলা মায়ের দিক তাকায়। ওর যে মা সদা নিজের ভাই-ভাবিকে সম্মান করে তাদের সাথে নম্রতা বজায় রেখে কথা বলতেন, আজ তিনিই শুধুমাত্র ওর জন্য তাদের সাথে এভাবে এত কড়া গলায় কথা বলছেন। ওর পক্ষ নিচ্ছেন, ওকে এতটা বিশ্বাস করছেন! দোলার চোখদুটো অশ্রুতে টলমল করে, মায়ের প্রতি সম্মানে ও ভালোবাসায় দোলার মন ভরে যায়। কিন্তু দোলার মন যতটা খুশি হয়, পারভীন বেগমের তীক্ষ্ণ কথার বাণে শায়লার মন-মস্তিষ্ক ততটাই ক্ষ’ত-বিক্ষ’ত হয়! তীব্র অপমানবোধে টলমল করে উঠে শরীরের রক্ত। প্রচন্ড বিস্ময়েই হোক কিংবা তীব্র অপমানবোধে, কিছুক্ষণের জন্য শায়লা কথা বলতে ভুলে গেলেন। কি বলবেন না বলবেন ভাবলেন মিনিট কয়েক। অতঃপর ধীরপায়ে এগিয়ে এসে এক পলক দোলার দিক চেয়ে পুনরায় পারভীনের দিক ফিরে বললেন,

—আজকে তোমার মেয়ের জন্য তুমি আমাকে আর আমার ছেলেকে যে অপমানটা করলে তা আমি কোনোদিনও ভুলবোনা, পারভীন। যেহেতু তুমি এতটাই জোর দিয়ে বলছো যে, এ ছেলের সঙ্গে দোলার কিছু নেই। তবে আমি না হয় তোমার কথা আমি বিশ্বাস করলাম! কিন্তু, আমাদের অপমান করে আজ তুমি যে কত বড় একটা ভুল করলে তা আমি তোমাকে বুঝিয়েই ছাড়বো। দোলার নামে গুষ্ঠির মধ্যে এতটা বদনাম ছড়াবো যে দূর-দূর পর্যন্ত কোনো ভালো ছেলে তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবেনা! আমার কথাগুলো মনে রেখো!

শায়লা ভেবেছিলেন উনার কথায় পারভীন বেগম বিচলিত হবেন অথবা ভয় পাবেন। কিন্তু এর কিছুই হলোনা। উল্টো মুখে হাসি নিয়ে তিনি বেশ শান্ত গলায় বললেন,

—জন্ম, মৃত্যু, রিজিক, বিয়ে এসব তো আল্লাহর হাতে মাত্র। যদি আমার মেয়ের ভাগ্যে লেখা থাকে, তবে আপনি আমি যতই চেষ্টা করিনা কেন কেউই তা আটকাতে পারবোনা। অতএব, এসব ভয় আমায় দেখিয়ে লাভ নেই। আপনি নিজের ছেলের চিন্তা করুন।

পারভীন বেগমের কথায় মা-ছেলে বাদে সকলের মুখে হাসি ফুটে উঠে। এমনকি নিশীথও অবাক হয় তার সুন্দর মন-মানসিকতা ও ব্যক্তিত্ব দেখে। দোলা কেন এমন ব্যক্তিত্বের হয়েছে, এখন বুঝতে মোটেও বাকি রয়না ওর! নিশীথ এগিয়ে এসে বলে,

—একদম উচিত জবাব দিয়েছেন, আন্টি। আপনার মতো মা ঘরে ঘরে দরকার। তবেই সন্তানগুলো মানুষ হবে। আর প্রসঙ্গ যখন উঠলোই দোলার বিয়ের তখন আমারও কিছু কথা বলার ছিলো!

শায়লা বেগম ও রাকিব ততক্ষণে অপমানে ফোসফোস করতে করতে প্রস্থান করছিলো। নিশীথ তাদের থামিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলে,

—আরে, কোথায় যাচ্ছেন আপনারা? আসল কথা না শুনেই চলে যাবেন? থামুন থামুন! পাঁচ মিনিট দেরি করুন! একটা জরুরি ঘোষণা বাকি আছে!

নিশীথের কথায় বাকিরা ভ্রু কুচকে তাকালেও দোলার বুকে ধ্বক করে উঠে! যেন সে বুঝতে পেরেছে নিশীথ কিসের কথা বলবে, তাই ওকে থামানোর জন্য দোলা বলতে নেয়,

—নিশীথ ভাই, অনেক কথা হয়েছে অলরেডি আজকে। আপনি…

—অনেক কথা হয়েছে দেখেই তো এখন আসল কথায় আসছি, দোলনচাঁপা। এই, তুমি এতক্ষণ চুপ ছিলেনা? এখন কথা বলছো কেন? ডোন্ট ডিস্টার্ব মি, ওকে? লেট মি স্পিক!

শেষের দিকে কিছুটা চাপা ধমকে দোলাকে চুপ করায় নিশীথ। সে জানে দোলা ওকে কথা বলতে না দেওয়ার জন্য এমন করছে। কিন্তু আজকে ওর কথা বলতেই হবে। অনেক হয়েছে লুকোচুরি খেলা। তাই নিশীথ শায়লা বেগমের দিকে চেয়ে বললো,

—আপনি বলছিলেন না দোলনচাঁপাকে এতটা বদনাম করবেন যে কেউ ওকে বিয়ে করতে চাইবেনা? তবে আমিও বলছি, যান গিয়ে করুন বদনাম। আমিও দেখছি আপনারা কতদূর পারেন! কারণ, নিশীথ বেঁচে থাকতে অন্য কেউ দোলাকে বিয়ে করতে পারবেও না!

নিশীথের কথায় লজ্জায় অক্ষিজোড়া বুজে আসে দোলার। সে যেটার ভয় করছিলো, ঠিক সেটাই হলো! এদিকে, নিশীথের কথায় সকলের চোখ যখন চড়কগাছ তখন ও হঠাৎ পারভীন বেগমের সামনে চলে আসে। আলতো করে উনার হাত বাড়িয়ে নম্র স্বরে বলে,

—আন্টি, আপনি আমার মায়ের মতোন। আমার বিশ্বাস, আপনি আমায় ভুল বুঝবেন না! এটা সত্যি যে দোলা ও আমার মাঝে এখনো কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এর পাশাপাশি আরেকটা সত্যও আছে।

পারভীন বেগমসহ সকলে খুব আগ্রহ নিয়ে নিশীথের দিকে তাকিয়ে থাকলেও দোলা শ্বাস আটকে ওর কথা শোনার প্রস্তুতি নেয়। ও বুঝেছে, আজকে এ ছেলেকে থামানো যাবেনা! নিশীথ একটা বড় শ্বাস নিয়ে সবার সামনে স্পষ্ট কণ্ঠে বললো,

—আমি দোলনচাঁপাকে খুব পছন্দ করি। অনেক আগে থেকেই। যদি আপনার অনুমতি থাকে, আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই!

নিশীথের কথায় প্রচণ্ড লজ্জায় দোলার শুভ্র মুখমণ্ডল লালচে হয়ে এলো! ও আর ওখানে দাঁড়িয়ে নিশীথের মুখোমুখি থাকতে পারলোনা! দ্রুতপায়ে নিজের রুমে চলে গেলো! ওকে এভাবে চলে যেতে দেখে নিশীথ ঠোঁট বাকিয়ে সামান্য হাসলো। এদিকে পারভীন বেগম ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে রইলেন নিশীথের দিকে। শিমুল-কামিনি নিশীথের প্রস্তাবে খুশি হলেও, রাকিব-শায়লা হতভম্বের ন্যায় চেয়ে রইলো। নিশীথ সেদিক চেয়ে বললো,

—কি হলো? এভাবে চেয়ে আছেন কেন আপনারা? বিয়ের কথা বললাম, খালি মুখেই চলে যাবেন? আমি মিষ্টি এনেছি, মিষ্টিমুখ করেই বাসায় যান!

বিনিময়ে শায়লা ও রাকিব ঘৃণাভরা চাহনিতে তাকালে নিশীথ ওদিকে এগিয়ে যায়। রাকিবের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ খানিকটা বল প্রয়োগ করে ওর কাধ চাপড়ে গলা নামিয়ে বললো,

—ভালো করে খাওয়াদাওয়া করো, রাকিব! গায়ে তো কিছু নেই তেমন। সামনের দিনগুলোয় খুব কষ্ট হবে!

নিশীথের ওভাবে ধরায় ব্যাথায় রাকিব ওর হাত সরিয়ে নেয় নিজের থেকে। দুজনের মাঝে দূরত্ব বজায় রেখে বোকার ন্যায় শুধায়, “কেন?”

নিশীথ উত্তর না দিয়ে সরে আসে। পেছন ফিরে রহস্যময় এক হাসি দেয়। সব দেখে, শায়লা আর কথা বাড়াতে দেন না। ছেলেকে টেনে নিয়ে চলে আসেন বাড়ির বাহিরে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন, উনি বেচে থাকতে আর কোনোদিনও এ বাড়ির সামনে আসবেন না। এমনকি আমজাদ সাহেব সিলেট থেকে ফিরে এলেই উনার কান ভড়বেন এই মা-মেয়ের বিরুদ্ধে! এ বাড়ির সাথে সমস্ত সম্পর্ক ভেঙে দিবেন তিনি!

_________________

বেশ কিছুক্ষণ যাবত পারভীন বেগম চেয়ে আছেন নিশীথের দিকে। ছেলেটা এত সাবলীলভাবে স্পষ্ট গলায় বিয়ের প্রস্তাব দিলো যে উনি সাথে সাথেই কোনো কথা বলতে পারলেন না। নিশীথের মধ্যে যথেষ্ট পুরুষত্ব ও সৎ সাহস আছে বলেই এমনটা সম্ভব হয়েছে যা তিনি উপেক্ষা করতে পারলেন না!
শুধু উনার সামনে সোফায় বসে থাকা নিশীথের উদ্দেশ্যে বললেন,

—দেখো বাবা, বিয়েশাদি তো মুখের কথা নয়! যে তুমি প্রস্তাব দিলে আর আমি হ্যাঁ বলে দিলাম? বিয়ে দুটো পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে। তোমার পরিবার কি তোমার ও দোলার ব্যাপারে জানে?

পরিবারের কথায় নিশীথ চোখমুখ শক্ত হয়। বাবার কথা মনে হতেই ও সটান হয়ে মাথা দু’পাশে নাড়ে অর্থাৎ “ওর পরিবার জানেনা!”
পারভীন বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। শান্ত গলায় বললেন,

—তবে এখানে তাড়াহুড়োর কিছুই নেই। তুমি নিজের পরিবারকে জানাও, তারা কি বলে মতামত নাও। এদিকে আমিও দোলার সাথে কথা বলে দেখি।

—আপনি বললেই ও শুনবে, আন্টি! আমি অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু আপনার মেয়ে শুনেনি। আপনি প্লিজ ওকে বুঝাবেন?

নিশীথ এর অস্থিরতায় পারভীন বেগমের হাসি পায়। এ ছেলেটা যে তার মেয়ের জন্য কতটা পাগল উনার বুঝতে বাকি রয়না! তবু তিনি নিশীথকে বুঝ দিতে বললেন,

—আচ্ছা, আমি ভেবে দেখবো। তুমি আগে তোমার পরিবারকে জানাও। উনাদের মতামত নাও, এরপর সবাই কোনো একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে। তোমার কথা আমি মাথায় রাখছি!

নিশীথ কৃতজ্ঞতাস্বরুপ মাথা নাড়ে। ঘড়িতে সময় দেখে বুঝে বিকেল গড়িয়ে গেছে, এখন উঠতে হবে। অনেক সময় ধরেই এখানে আছে এবং ওর অনেক কাজ বাকি আছে! অতঃপর, নিশীথ পারভীন বেগমের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়!

____________________

রাত ১০টা বাজবে প্রায়। দোলা সেই যে বিকেলে নিজের রুমে ঢুকেছিলো। এরপর আর লজ্জায় বের হয়নি তখন থেকে। মায়ের নির্দেশে বাসার কেউ ওকে ডাকেওনি! কিন্তু, রাতের খাবারের সময় হওয়ায় ক্ষিদের চোটে যখন রুমে থাকা আর সম্ভব হলোনা তখন ও চোরের ন্যায় খাবার নেওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলো চুপিসারে! রান্নাঘরে আসতেই চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মা-কে দেখে থমকে গেলো সেখানেই। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—কি হয়েছে, মা? এমন মুখ করে আছো কেন?

—তোর মামাকে ফোন দিয়েছিলাম রে, দোলন। আমি জানতাম ভাবি নিশ্চয়ই ভাইসাহেবের কাছে আমাদের বিরুদ্ধে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলবেন, তাই আগেভাগেই তার সাথে কথা বলতে ফোন দিয়েছিলাম!

দোলা বুঝে। মাথা নাড়িয়ে শুধায়,

—কি হয়েছে তবে? মামাও তোমার উপর রাগ করেছে মামির কথায়?

—কথা বলার সুযোগ আর পেলাম কোথায়! অনেক তাড়াহুড়োর মধ্যে আছেন, ভাইসাহেব। এর মাঝে কি কথা বলা যায়?

—কেন? মামা না সিলেটে ছিলো? কিসের তাড়াহুড়ো আবার?

—আর বলিস না! রাকিব নাকি এখান থেকে যেয়ে রাতে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার জন্য বেরিয়েছিলো। কলাবাগানের ওইদিকে যেতেই ছিন’তাই’কারীর মুখে পড়ে। ওদের সাথে হা’তাহাতি হয়। ও তো হ্যাংলা ছেলে, অতগুলো দামড়া লোকদের সাথে পারতো নাকি? মা’ইর খেয়ে নাকি এলাকার স’রকারি হসপিটালে পৌঁছে গেছে! ভাবির কাছে হসপিটাল থেকে ফোন এলে উনি কাদতে কাদতে ভাইসাহেবকে ফোন করে জানিয়েছে। তাই উনি আজ রাতেই সিলেট থেকে ঢাকায় ফিরছেন! কিসব যে হচ্ছে ক’দিন ধরে! আমার তো মাথাতেই ঢুকছেনা কিছু রে, দোলন!

পারভীন বেগম হতাশার সাথে কথাগুলো বল্লেও দোলা রোবটের ন্যায় চেয়ে থাকে! কিছু একটা ভেবে ও মাথা নাড়িয়ে দ্রুত রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে! আপাতত ওর ক্ষিদে মিটে গেছে!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here