শুধু_তোমাকেই_চাই #শারমিন_হোসেন #পর্ব৩৯

0
541

#শুধু_তোমাকেই_চাই
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব৩৯

অনেকক্ষণ হবে ভোরের আলো ফুটেছে।ভোরের আলো সবচেয়ে বেশি স্নিগ্ধ হয়।দক্ষিণা বাতাসে অল্পবিস্তর জানালার সফেদ পর্দা উড়াউড়ি করছে। পর্দার ফাঁকে ফাঁকে সোনালী এক ফালি রোদ্দুর রুমে খেলা করছে।লিয়া রোদ্দুরের দিকে তাকিয়েই রিনরিনিয়ে স্বরে বলে,,
“প্লিজ,এবার ছাড়ুন।সত্যি অনেক বেলা হয়েছে।”

লিয়ার কথাটা শেষ হতেই জারিফ শান্ত কন্ঠে বলে,,
“কথায় আছে না ফুলের যেমন সূর্যের আলোর প্রয়োজন।ভোরের যেমন প্রয়োজন শিশির।ঠিক তেমনি আমার সব সময় তোমাকে প্রয়োজন।বুঝলে আমার প্রিটি এন্ড হটি বিবিজান।সো ছাড়ার প্রশ্নই আসে না।”

কথাটা শুনে লিয়ার কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পরে।লিয়া মনে মনে আওড়ায়,একে বুঝিয়ে লাভ নেই।এর সাথে কথা বলাই বেকার।

লিয়ার এসব ভাবনার মাঝেই জারিফ লিয়াকে ছেড়ে দেয়।জারিফের হাতের বাঁধন আলগা হতেই লিয়া বেড ছেড়ে নেমে ওয়াশরুমে যায়।লিয়া শাওয়ার নিয়ে বের হয়। বেগুনী কালারের একটা সুতি শাড়ি কোনো রকমে গাঁয়ের সাথে জড়িয়ে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়।রুমে এসে বিছানায় চোখ যায় লিয়ার।জারিফকে বিছানায় না দেখে লিয়া ভাবতে থাকে, এরমধ্যে উঠে কোথায় গেলো?লিয়ার ভাবনার মাঝেই ব্যালকনি থেকে রুমে আসে জারিফ।লিয়া টাওয়েল দিয়ে চুলগুলো মুড়িয়ে রাখে। তারপর শাড়ি ঠিক করতে যাবে তখন জারিফের সাথে চোখাচোখি হয়।জারিফকে দেখে লিয়া চুপচাপ থমথমে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

জারিফ একনজর লিয়াকে দেখে নিয়ে শুধায়,,”হেল্প লাগবে?”

লিয়া দুদিকে ঘাড় নাড়িয়ে বলে,,”উহুম।আমি একাই পারবো।”

“ওকে।”

কথাটা শেষ করে জারিফ সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে।লিয়া শাড়ি ঠিক করতে থাকে।একে তো লিয়ার অভ্যাস নেই শাড়ি পরার।আবার নতুন সুতি শাড়ি হওয়ায় কুঁচি গুলো এলোমেলো হচ্ছিলো।লিয়া বিরক্তিকর ফেস করে বারবার কুঁচি দিতে থাকে।তাও মন মতো কুঁচি না হওয়ায় লিয়ার নিজের উপরই রা’গ হতে থাকে। প্রায় ফিফটিন মিনিটস ধরে লিয়া ট্রাই করতে থাকে।

জারিফ ওয়াশরুম থেকে বের হয়। হোয়াইট এর মাঝে ব্লাক কালারের দাগকাটা ট্রিশার্ট গায়ে,আর ব্লাক টাউজার।ঘন কালো চুলগুলো ভেজা।লিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে চুলের মধ্যে হাত চালনা করে ঝাড়ি দিতেই লিয়ার চোখে মুখে বিন্দু বিন্দু পানি ছিটে পড়ে।লিয়া চোখ তুলে জারিফের দিকে তাকায়।জারিফের স্নিগ্ধ ফেসের দিকে লিয়া নিষ্পলক চাহুনিতে চেয়ে থাকে।জারিফকে খুব সুন্দর লাগছিলো।

জারিফ লিয়ার চোখে চোখ রেখে নেশাতুর কন্ঠে বলে,,”এভাবে তাকিয়ো না জান।তোমার চোখে চোখ রেখে অলরেডি খু’ন হয়েছি আমি।”

কথাটা কর্ণগোচর হতেই লিয়া নিজেকে তটস্থ করে।সাথে সাথেই দৃষ্টি নিচু করে ফেলে।জারিফ একহাতে লিয়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে দু’জনের মাঝের দূরত্ব ঘুচিয়ে নিয়ে মুচকি হেসে বলে,,”মজা করে বলেছি আমি।তোমারই তো বর আমি।আমি মানুষটা ষোলো আনাই তোমার।তোমার পার্সোনাল প্রোপার্টি।তাই তুমি চাইলে সব সময়ই আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারো।নিভু নিভু চোখে নয় একদম ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে পারো।”

লিয়া স্মিত হেসে বলে,,”ধ্যাত।আজে বাজে কথা রাখুন।কে বলেছে আমি আপনাকে দেখছি?”

জারিফ নির্বিকার ভঙ্গিতে সোজাসুজি স্পষ্টভাবে বলে,,”কেউ বলেনি?আমি জানি।ইভেন আমি নিজ চোখে দেখেছি।”

লিয়া ঠোঁট উল্টে বলে,,”এতই যখন দৃষ্টি শক্তি প্রখর।তাহলে দেখতে পাননি আমি কখন থেকে শাড়িটা ঠিকঠাক করে পড়তে পারছি না। কোথায় আমাকে হেল্প করবেন।সেসব না করে।শুধু তো আপনার নজর থাকে কিভাবে কথার জালে ফাঁসিয়ে।আমাকে লজ্জায় ফেলবেন সেই ধান্দায় থাকেন সবসময়।”

“অবশ্য কথাটা তুমি ভুল বলোনি। লজ্জা পেলে তোমাকে খুব কিউট লাগে। তোমার কিউট ফেসটা বারবার দেখার জন্য।আমি ইচ্ছাকৃতভাবে তোমাকে লজ্জায় ফেলি।”

“হয়েছে হয়েছে।এখন কথা রাখুন।আর আমাকে হেল্প করুন।”

লিয়া ধীরে ধীরে একটা একটা করে কুঁচি দিতে থাকে।জারিফ হাঁটু ভেঙ্গে লিয়ার সামনে বসে কুঁচি গুলো ধরতে থাকে। অবশেষে লিয়ার শাড়ি পড়া কমপ্লিট হয়।খুব সুন্দর না হলেও মোটামুটি ভালোই হয়েছে।জারিফ উঠে দাঁড়িয়ে লিয়াকে স্ক্যান করে বলে,,
“এবার পার্ফেক্ট লাগছে তোমাকে বউ বউ।আয়মান জারিফের বউ হিসেবে একদম পার্ফেক্ট তুমি।”

লিয়ার গলার দিকে নজর যেতেই জারিফ মিটমিট করে হেসে ইশারা করতে থাকে। লিয়া বুঝতে না পেরে ইশারায় বোঝায় “কি বোঝাতে চাইছেন?”

জারিফ লিয়ার গলায় আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়।জারিফের স্পর্শে লিয়া দু’চোখ বন্ধ করে নেয়।জারিফ অপরাধীর স্বরে বলে,,”সরি ফর দ্যাট।”

লিয়া বিষয়টা আন্দাজ করতে পেরে আর কোনো বাক্য প্রয়োগ করে না।জারিফ ওর চুলগুলো সেট করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।লিয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।গলায় লালচে দাগগুলো দেখে লজ্জায় রেইনবোর সেভেন কালার হতে থাকে। লিয়া চুলগুলো আঁচড়ে নেয়।এরমধ্যে দরজার সামনে থেকে জারা “ভাবী”বলে হাঁক ছেড়ে ডাকতে থাকে। লিয়া দ্রুত চুলগুলো দুইপাশ দিয়ে সামনে রেখে দেয়।আর মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে দেয়।লিয়া জারাকে ভেতরে আসতে বলে।

জারা কফির মগ হাতে রুমে আসে।জারা মিষ্টি হেসে বলে,,”শুভ সকাল,ভাবী।”

লিয়াও মিষ্টি করে হেসে বলে,,”শুভ সকাল।আমার ছোট ননদিনী।”

জারা একটা কফির মগ লিয়ার দিকে বাড়িয়ে দেয়।লিয়া কফির মগটা নিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে,,”থেংকিউ।”

জারা কফির মগে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলতে থাকে,,”ভাইয়াকে দেখলাম বাইরে যেতে।কফি খাওয়ার কথা বলতেই বললো।কাজ আছে এখন খাবে না। আচ্ছা এসব কথা থাক।আগে তুমি বলো,এখানে তোমার কেমন লাগছে?তোমার বুঝি মনটা খা’রাপ করছে।তোমাদের বাসার মতো অতটা ভালো লাগছে না,তাইনা?”

জারার বোকা বোকা চাহুনিতে চেয়ে করা বোকা বোকা প্রশ্নে,লিয়ার হাসি পাচ্ছে।তবে আপাতত হাসিটাকে চেপে রেখে লিয়া স্বাভাবিক ভাবেই বলে,,”বাসার মতো অতটা ভালো লাগছে কি-না?তা জানিনা।তবে নতুন জীবন,নতুন পরিবেশ, নতুন অনুভূতি। সব মিলিয়ে একটা অন্যরকম প্রশান্তি বিরাজ করছে মনের মধ্যে।আর তোমার প্রশ্নের উত্তর গুলো না হয় তোলাই থাক।তুমি তো ছোট বড় হয়ে যখন শ্বশুর বাড়ি যাবে।তখন নিজেই এসব প্রশ্নের আনসার পেয়ে যাবে।”

জারা মুগ্ধ নয়নে লিয়ার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলে,,”আমার মিষ্টি ভাবী।তুমি দেখতে যেমন মিষ্টি।ঠিক তেমনি তোমার কথাগুলোও মিষ্টি।”

লিয়া ঠোঁট উল্টে বলে,,”এতো মিষ্টি তো ভালো নয় ননদিনী।বেশি মিষ্টি তো আবার সুগার বাড়িয়ে দিবে।কি বলো?”

লিয়ার কথাটা শেষ হতেই জারা হাসির ঝংকার তুলে।আরো কিছুক্ষণ ভালো-মন্দ গল্প করে জারা রুম থেকে প্রস্থান করে।লিয়া বাড়িতে ফোন করে আব্বু আম্মুর সাথে কথা বলে।ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় লিয়ার দৃষ্টি যায় ব্যালকনিতে থাকা কয়েকটা মাটির টবের দিকে।টবে গোলাপ গাছ আরো দুইটা ক্যাকটাস গাছ।ক্যাকটাস গাছের দিকে তাকিয়ে লিয়া কয়েকবার ঘন পলক ঝাপটায়।কল কে’টে মোবাইল টা রুমে এসে রাখতেই জারিফ আসে রুমে।জারিফ লিয়ার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে মৃদু আওয়াজে বলে,,
“পেইন কিলার আছে।খাবার খেয়ে মেডিসিন টা খেয়ো নিও কেমন।”

লিয়া ঘাড় নাড়িয়ে হ্যা সূচক উত্তর দেয়।জারিফের কেয়ার দেখে লিয়া মুগ্ধ হয়।লিয়া মনে মনে আওড়ায়,সত্যি আমার নিজেকে লাকী মনে হচ্ছে।মুখ ফুটে কোনো কিছু বলার আগেই সব কিছু বুঝে নেয়।হাউ পসিবেল?কতটা ভালোবাসলে এটা সম্ভব।আমার অসুবিধার কথা বলার আগেই সলভিং নিয়ে হাজির হয়। প্রথমে আমি ছিলাম স্যারের জন্য পাগল।এখন তো আমার সাথে স্যারও জয়েন করে আমার জন্য বেশি পা’গল হয়েছে।এসব ভেবে আনমনেই লিয়া হাসে।

ঐবাড়িতে সবাই রেডি হতে থাকে।জামাই-মেয়েকে আনতে যেতে হবে।বাড়ির মেয়েরা সাজতে ব্যস্ত।বাড়ির সামনে বেশ কয়েকটা গাড়ি দাঁড় করানো।বাড়ির বড়রা কখন থেকে তাড়া দিয়ে আসছে।তবে মেয়েদের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।তারা তো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মেকআপ করতে বিভোর আছে।

তাসনিম গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আসফি কে কোলে নিয়ে তুষার দাঁড়িয়ে আছে।তুষার বিরক্তিকর কন্ঠে বলে,,”এই তুলি শাকচুন্নীর আটা ময়দা মাখা ইহ-জিন্দেগীতে শেষ হবে না।তুলিকে রেখেই কিন্তু আমি গাড়ি স্টার্ট দিলাম।”

কথাটা বলে তুষার গাড়ির দিকে কয়েক পা এগিয়ে আসে। তখন তাসনিম কপাল কুঁচকে শান্ত গলায় বলে,,
”আরেকটু ওয়েট কর।এতক্ষণ ওয়েট করলি।আর ফাইভ মিনিটস দেখ।”

তুষার দাঁতে দাঁত পিষে বলে,,”ফাইভ মিনিটস এর ভেতর না আসলে।সত্যি কিন্তু আমার গাড়িতে শাকচুন্নী টাকে নিবো না বলে রাখলাম।আর আলিফ ভাইয়া কখন আসবে?”

আলিফের ইমার্জেন্সি কল আসায়।কালকে বিয়ে শেষেই বাসায় যায়।আজকে সরাসরি ময়মনসিংহে রিসেপশনে এটেন্ড করার কথা আছে। তাসনিম নখ কামড়ে ধরে বলে,,”বিকেল হয়ে যাবে ওর আসতে আসতে।”

অরিন আর ফিহা একসাথে বের হয়।রাজিয়া সুলতানা এগিয়ে এসে তাসনিম আর তুষার কে উদ্দেশ্য করে বলে,,”অরিন আর ফিহা তোমাদের গাড়িতে যাবে।ঠিক আছে।কোনো সমস্যা হবে কি?”

তাসনিম বলে,,”সমস্যা হবে কেনো?ঠিক আছে মেজো চাচিমা।তুমি টেনশন করো না।আমরা কয়জন একসাথেই যাবো।আবার একসাথেই ফিরবো।”

এরমধ্যে অরিন রাজিয়া সুলতানাকে হাগ করে বলে,,
“আন্টি আমি আর ফিহা ভেবেছি।ওখান থেকে আর এখানে ব্যাক করবো না।ওখান থেকেই বাসায় চলে যাবো।তুমি টেনশন করবে তাই আগে ভাগেই বলে রাখলাম।”

অরিনের কথাকে সমর্থন জানিয়ে ফিহাও একই সুরে বলে,,”হ্যা আন্টি।অরিন ঠিকই বলেছে।আবার ব্যাক করার থেকে আমরা দু’জনে বাসায় চলে যাবো।সেটাই বেটার হবে।”

রাজিয়া সুলতানা কাটকাট গলায় বলেন,,”একদম নয়।লিয়ার সাথে তোমরা আসবে।আর তোমাদের পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।পরশু তোমাদের আঙ্কেল তোমাদের কে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবে।আর কথা বাড়িয়ো না কেমন।”

রাজিয়া সুলতানার কথাকে অমান্য করে আর কিছু বলতে মন সায় দিলো না অরিনের।অরিন মুখে হাসি ফুটিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,,”ঠিক আছে আন্টি।”

তুলি আসতেই তাসনিম তুষারের কাছ থেকে আসফি কে কোলে নিয়ে গাড়িতে বসে।তারপর তুলিকে উদ্দেশ্য করে বলে,,”তুলি তুই সামনে বস।ফিহা আর অরিন আমার সাথে বসবে।ঠিক আছে।”

ফিহা গাড়িতে উঠে বসে।অরিন বসতে যাবে সেই মূহূর্তে তুলি মিষ্টি হেসে ঠোঁট মেলে বলে,,”অরিন কিছু মনে না করলে বলছি যে তুমি সামনে বসবে, প্লিজ।আসলে ভাইয়া উইন্ডো ওপেন রাখে।আর বাতাসে আমার হেয়ার গুলো উড়তে থাকবে।এক ঘন্টার-ও বেশী সময় ধরে স্টাইলিশ হেয়ার বাঁধতে লেগেছে।সো বিয়ে বাড়ি পৌঁছানোর আগেই সেটাকে ন’ষ্ট করতে চাচ্ছি না।”

অরিন হাসি মুখে বলে,,”ওকে ইয়ার।ব্যাপার নয়।আমি সামনে বসছি।”

কথাটা শেষ করে অরিন ডোর খুলে সামনে গিয়ে আয়েশ করে বসে পড়ে।সিট বেল্ট বাঁধতে থাকে।তুষার গাড়ি স্টার্ট দেয়।শহরের পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে গাড়ি যেতে থাকে।অরিন জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিয়ে রাস্তার পাশের দালানকোঠা দেখতে থাকে। কিছুক্ষণ পর অরিন বিরক্তিকর ফেস করে তুষারের দিকে বারবার তাকাতে থাকে।অরিনের এভাবে তাকানোতে তুষারের আনইজি ফিল হতে থাকে।গাড়ির স্পিড পূর্বের থেকে আরো খানিকটা কমিয়ে দেয়।এতে যেনো অরিনের উসখুস নড়াচড়া ভাবটা আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। হঠাৎ করেই অরিন ভ্রু যুগল কুঁচকে বলে,,
“এই স্টপ স্পট।গাড়ি থামান।”

কথাটা কর্ণগোচর হয়ে নিউরনে সাড়া জাগাতেই তুষার সাথে সাথেই ব্রেক চাপে।তুষার মনে মনে আওড়ায়,এইজন্য মেয়েদের সাথে কোথাও যেতে নেই।এখন আবার কি প্রবলেম এর কথা বলে আল্লাহ মালুম।গাড়িতে উঠে থেকেই তো উসখুস করছিলো।এরজন্য আমি ঠিকঠাক ড্রাইভ করতে পারছিলাম না।

তুষারের ভাবনার মাঝেই পেছন থেকে তাসনিম চিন্তিত গলায় শুধায়,,”কি হয়েছে?তুষার গাড়ি ব্রেক করলি যে?কোনো সমস্যা?”

তুষার তাসনিমের কথার উত্তর না দিয়ে পাশে বসা অরিনের দিকে তাকিয়ে বলে,,”হোয়াট হ্যাপেন্স?এনি প্রবলেম?”

অরিন ডোর খুলে নামতে থাকে।আর তুষারকে উদ্দেশ্য করে বলে,,”নামুন।পাজেরো গাড়ি তো নয় মনে হচ্ছে গরুর গাড়ি চালাচ্ছেন।”

তুষার কথাটা শুনে বেশ অবাক হয়।তারপরেও নিচে নেমে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অরিন গাড়িতে উঠে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ে।গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত দিয়ে অরিন ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলে,,
“ভাইয়া আপনি বসে থাকুন আমি ড্রাইভ করছি।এত স্লো স্পিডে গেলে দুই ঘন্টার রাস্তা চার ঘন্টা লাগবে।”

কথাটা শেষ করেই অরিন গাড়ি স্টার্ট দেয়।তুষার মনে মনে ভাবে,কি ডেঞ্জারাস মেয়েরে বাবা।এতো ইনডাইরেক্টলি আমাকে অপমান করলো।আমি নাকি গরুর গাড়ি চালাচ্ছি।আজ লিয়ার ফ্রেন্ড বলে কিছু বলতেও পারছি না। দাঁতে দাঁত চেপে সবটা হজম করতে হচ্ছে।

পার্লারের আর্টিস্ট এসে লিয়াকে সাজায়। স্কিন কালারের স্টোন বসানো শাড়ি পড়েছে লিয়া।শাড়িটা সফট আর লাইট ওয়েট হওয়ায় লিয়া কমফোর্টেবল ফিল করছে।মাথার উপর স্কিন কালারের পাতলা জর্জেট ওড়না দেওয়া।হালকা গহনা আর হালকা সাজানো হয় আজ লিয়াকে।জেরিন লিয়ার রুমে এসে মিষ্টি হেসে বলে,,
“ওয়াও। ভাবী তোমাকে দারুন লাগছে।আমার ভাইয়া তো তোমার থেকে দৃষ্টি সরাতেই পারবে না।”

লিয়া লাজুক হেসে শান্ত গলায় বলে,,”আমার ননদিনীকেও দারুন লাগছে।রোহান ভাইয়া তো আর এমনি এমনি পা’গল হয়নি।তোমাকে ফাস্ট দেখেই সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।তাহলে ভাবো তুমি দেখতে কতটা প্রিটি।”

জেরিন লজ্জা রাঙা মুখ নিয়ে প্রসঙ্গ এড়িয়ে মৃদু কন্ঠে বলে,,”ভাবী চলো। নিমন্ত্রিত অতিথিরা সবাই আসতে শুরু করেছে।তোমাকে এবার স্টেজে যেতে হবে।তোমাদের বাড়ির সবাই কতদূর। নাহ্, মানে ফোনে শোনোনি কখন রওনা দিয়েছে?”

লিয়া মোবাইলে সময় দেখে নিয়ে ঠোঁট প্রসারিত করে বলে,,”এই তো একটু আগেই কথা বলেছি। কাছাকাছি চলে এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে মে বি।”

লিয়াকে স্টেজের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।জারিফ আগে থেকেই ওখানে ছিলো। গেস্টদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করছিলো জারিফ।লিয়ার শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে জারিফ স্কিন কালারের পাঞ্জাবি পড়েছে। পাঞ্জাবির হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা।বাম হাতে ব্লাক রিচওয়াচ। স্লিকি স্ট্রেইট চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করা।লিয়াকে দেখতে পেয়ে জারিফ লিয়ার সামনে এগিয়ে আসে।

জারিফ লিয়ার দিকে শীতল চাহুনিতে চেয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে ইশারায় লিয়াকে সজ্জিত আসনে বসতে বলে।লিয়া মিষ্টি হেসে স্টেজে বসে।এক এক করে গেস্টরা আসতে থাকে।আর নতুন বউয়ের সাথে পরিচিত হতে থাকে।লিয়া ঠোঁটের কোণে হাঁসির রেখা ফুটিয়ে রেখে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে। জারিফ ওর কয়েকজন কলিগ আর ফ্রেন্ডদের সাথে লিয়াকে পরিচয় করায়।

এরমধ্যে লিয়ার দৃষ্টি যায় তাসনিমদের দিকে।ভাইবোন ফ্রেন্ডদের কে দেখে লিয়ার ঠোঁটের কোণের হাসিটা চওড়া হয়।লিয়া বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ওদের সাথে কথা বলতে থাকে।আসফিকে কোলে নিয়ে গালে চুমু খেয়ে লিয়া বলে,,”আপু বাকি সবাই কোথায়?রাহবার, আব্বু, ছোটো চাচ্চু তাদের দেখছি না যে।”

তাসনিম একহাত দিয়ে আসফির চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলে,,”সবাই আসছে। চাচ্চু সহ বাকি গাড়ি পেছনে আছে।আর আমরা আসাতে ফাস্ট হয়েছি।”

লিয়া ছোট করে বলে,,”ওহ্।”

অরিন ভাব নিয়ে বলে,,”ফাস্ট হবে না।দেখতে হবে না ড্রাইভিং টা করেছে কে?”

তুষার মনে মনে বলে,গাড়িতে থাকাকালীন পুরোটা সময় আমি দোয়া দরুদ পড়েছি।মনে হয়েছে এই বুঝি সোজা উপরের টিকিট কা’টা হয়ে গেলো। আল্লাহ সহায় ছিলো তাইতো এখনো স্বশরীরে হাত,পা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সব ঠিকঠাক নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছি।না হলে সোজা উপরে চলে যেতাম আর নয় হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকতে হতো।এসব কিছু মনে মনে ভেবে নিয়ে মাথা ঝাড়ল তুষার।তুষার মুখে হাসি টেনে নিয়ে জারিফের সাথে কথা বলে।কিছু কথাবার্তা বলে তুষার ওখান থেকে প্রস্থান করে। এরমধ্যে তাসনিমের মোবাইল বেজে উঠে। স্ক্রিনে আলিফের নম্বর দেখে তাসনিম মোবাইল নিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় যায় কথা বলার জন্য।আসফি কান্না করায় তুলি আসফিকে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে থাকে।

অরিন আর ফিহাকে লিয়ার সাথে গল্প করার জন্য স্পেস দিতে জারিফ বলে,,”তোমরা তোমার ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলো।ওদিকটায় দেখি সব ঠিকঠাক আছে কিনা। খোঁজ খবর নিয়ে আসি।”

জারিফের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই অরিন ব্যতিব্যস্ত গলায় বলে,,”জিজু এত পালাই পালাই করছেন কেনো?এখন তো আমাদের বান্ধবী একা নয়।আপনি আমাদের বান্ধবীর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন।তাই আপনি থাকতেই পারেন।আমরা মাইন্ড করবো না।আপনিও আমাদের গল্পে থাকুন।”

জারিফ আর কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।অরিন জুহুরির নজরে লিয়াকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।অরিনের এভাবে তাকানোতে লিয়া চোখে মুখে একরাশ বি’রক্ত নিয়ে বলে,,”এই অরিন তোর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে।এই প্রথম তুই আমাকে দেখছিস।বাকি গেস্টদের মতো নতুন বউ দেখতে এসেছিস।আগে কখনো দেখিসনি আমাকে? আশ্চর্য।”

অরিন কপাল কুঁচকে বলে,,”ঠিকই বলেছিস।তোকে প্রথমই দেখছি।এই হালে তোকে আগে কখনো দেখেনি। ঠোঁট দুইটা বেশ ফোলা।গলায় লালচে দাগ।এসব আগে কখনো দেখিছি?তুই-ই বল দোস্ত।জিজুকে দেখে সভ্য-ভদ্রের ডিব্বা মনে হলেও।এখন মনে হচ্ছে অতটাও নয়।আমার অবলা ফ্রেন্ডের উপর ভালই অত্যাচার চালিয়েছে।সারারাত মনে হয় নির্ঘুমে কাটিয়েছিস।”

লিয়া চোখ বড়বড় করে অরিনের দিকে তাকায়।লিয়ার অস্বস্তি আকাশ ছুঁই ছুঁই হয়।জারিফের শুকনো কাশি হতে থাকে।জারিফ মনে মনে আওড়ায়,নিজের বিয়ে করা বউয়ের সাথে রোমান্স করেছি।তাতেই এই মেয়ে আমাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, স্ট্রেইন্জ।

ফিহা অরিনের হাতে চিমটি কে’টে ইশারায় থামতে বলে।ফিহা অরিনের কানের পাশে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,,”মুখে একটু লাগাম টেনে ধর বোইন।কার সামনে কি বলতে হয় তোর কোনো কমন সেন্স নেই।তোকে দেখে আমার মনে হয়।তোর বয়স বাড়ছে বাট বুদ্ধি কমছে। বুদ্ধি শুদ্ধি দিন দিন লোপ পাচ্ছে।আগে তো পেট পাতলা ছিলি আর এখন তো মুখও পাতলা হয়েছে।”

জারিফ হালকা কেশে নিয়ে ফোন হাতে করে ইম্পর্ট্যান্ট কল করার আছে বলে দ্রুত ওখান থেকে প্রস্থান করে।জারিফ ওখান থেকে সরে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

অরিন ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে লিয়ার দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,,”কনগ্রাচুলেশন লিয়া।”

লিয়া ভ্রু কুঁচকিয়ে ইশারায় বোঝায়,,”হুয়াই?”

অরিন একগাল হেসে বলে,,”খুব দ্রুতই আমাদেরকে খালামনি হওয়ার সুযোগ করার জন্য।”

লিয়া এক হাত কপালে রেখে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে।তারপর দাঁতে দাঁত পিষে বলে,,”তোর এসব জোকস্ কবে কমবে বলতো? স্থান, পাত্র বিবেচনা না করে এসব জোকস্ কবে বন্ধ করবি শুনি?”

অরিন গাল ফুলিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,,”তোর জোকস্ মনে হচ্ছে লিয়া।আমি কিন্তু সিরিয়াসলি বলছি।”

লিয়া অরিনকে আলিঙ্গন করে।কানের পাশে মুখটা রেখে পাতলা ওষ্ঠদ্বয় নেড়ে বলে,,”আমিও সিরিয়াসলি বলছি, দোয়া করিস সুখবরটা যেনো দ্রুতই দিতে পারি।”

অরিন এক্সাইটেড হয়ে বলে,,”রিয়েলি?কালকে রাতের কাহিনী এখন এ টু জেড বল।না শুনলে শিখবো কিকরে ইয়ার।”

লিয়া অরিনকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,,
“এমনিতেই অনেক কিছু বলে ফেলেছি সো আর কিছু বলা সম্ভব নয়।”

এরমধ্যে রাহবার এসে হাসি মুখে লিয়াকে ডাকে,,
“আপু।আ্যই আপু।”

রাহবার কে দেখে আনন্দে লিয়ার দুচোখ চিকচিক করতে থাকে।লিয়া আনন্দিত কন্ঠে বলে,,”ভাই।তোদের এত লেইট হলো কেনো?আমি কখন থেকে তোর জন্য ওয়েট করছি।আমার ভাইয়ের মিষ্টি মুখটা দেখার জন্য।আমার ভাইয়ের মুখ থেকে আপু ডাকটা শোনার জন্য আমার মনটা ছটফট করছিলো।”

রাহবার লিয়াকে জড়িয়ে ধরে।লিয়া একহাতে রাহবারের চুলগুলো ঠিক করতে থাকে। লিয়া দুইহাতে রাহবারের মুখটা আঁজলা করে ধরে। রাহবার ম্লান স্বরে বলে,,”জানিস আপু।বাড়িতে অনেক লোকজন।ছোট বড় অনেক অতিথি থাকা সত্ত্বেও আমার মোটেও ভালো লাগছিলো না।আমার সব সময় তোর কথা মনে হচ্ছিলো।কাল থেকে মনটা ভীষণ খা’রাপ ছিলো আমার।তবে এখন তোকে দেখে সব মন খা’রাপ শেষ হয়ে গিয়েছে।”

“তাই।আমারও সেইম অবস্থা।আমার ভাইয়েকে দেখতে পেয়ে এখন আমার এত্ত এত্ত ভালো লাগছে।”

লিয়ার আব্বু চাচ্চু আসতেই জারিফ সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে।লিয়ার সাথে দেখা করে আইনাল হোসেনের সাথে কথা বলতে থাকেন ওনারা।পরিবারের অনেককে কাছে পেয়ে লিয়ার খুব ভালো লাগছে।আর কিছুক্ষণ পরেই বাড়ি যাবে লিয়া। মমতাময়ী মায়ের কোলে মাথা রাখতে পারবে।চোখে মুখে আনন্দের স্রোত বইছে লিয়ার।

জারা এসে জারিফ লিয়ার কাপল পিক তুলতে থাকে। বিভিন্ন স্টাইলে ছবি তুলেই চলছে জারা।খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষে। কিছুক্ষণ পরে লিয়ার আব্বু ফেরার জন্য তাড়া দিতে থাকে।লিয়া জারা,জেরিন,রোহান, কে সাথে যাওয়ার জন্য বলে।রোহানের অফিসে কাজ আছে বিধায় কালকেই রোহানকে চলে যেতে হবে। তাই যাওয়া সম্ভব নয়।জেরিন কথাটা বলে।জেরিন নিজেও না করে।তবে জারা কে সাথে যেতে ইন্সপায়ার করে।লিয়া বারকয়েক জারাকে বলে। জারিফ ইশারায় বলে। অবশেষে জারা রাজি হয় যেতে।লিয়া শ্বশুর, শাশুড়ির থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে। লিয়া মাঝে বসেছে।একপাশে জারিফ অন্যপাশে জারা। রাহবার সামনে বসেছে।তুষার ড্রাইভ করছে।আলিফের গাড়িতে তাসনিমের সাথে অরিন,ফিহা তুলি আছে।আলিফ আধা ঘন্টা খানেক আগেই এসেছিলো।

বাড়িতে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। বাসায় গিয়ে লিয়া ওর দাদিমনির সাথে প্রথমে দেখা করে। জান্নাত বেগম সোফায় বসে নাতনি নাত জামাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।জান্নাত বেগম লিয়াকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে কান্না শুরু করেন। লিভিং রুমে জারিফকে বসতে দেওয়া হয়।জারিফের পাশে জারা বসে আছে।বাকি সবাই রুমে যায় ফ্রেশ হতে।রাজিয়া সুলতানা প্রথমে জারিফ আর জারার সাথে কথা বলেন।জারিফের বাবা-মা কেমন আছে।ভালো মন্দ জিগ্গেস করেন।

জান্নাত বেগমের সাথে কথা শেষ করে লিয়া রাজিয়া সুলতানাকে জড়িয়ে ধরে।রাজিয়া সুলতানা লিয়ার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,,”লিয়া আম্মু আমার।জারিফকে রুমে নিয়ে যাও। জারিফ ফ্রেশ হবে।আর তুমিও ফ্রেশ হয়ে নাও।”

লিয়া টুপ করে রাজিয়া সুলতানার গালে চুমু খেয়ে বলে,”ওকে আম্মু।”

নিচে সবার সাথে আলাপ শেষে লিয়া জারিফকে ইশারা করে উপরে যাওয়ার জন্য।লিয়ার রুমে গিয়ে পুরো রুমে একনজর বুলিয়ে নেয় জারিফ।লিয়া ব্যাগ থেকে জারিফের জন্য পোশাক বের করে রাখে। অতঃপর নিজে প্লাজু আর কুর্তি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে।

হাত মুখ ধোয়ার ফলে লিয়ার মুখে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে।লিয়া টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে জারিফকে বলে,,”যান ফ্রেশ হয়ে নিন।”

জারিফ ফোন স্ক্রল করছিলো।কথাটা কর্ণগোচর হতেই ফোনটা রেখে দেয়। অতঃপর লিয়ার ঠিক করে রাখা টিশার্ট আর টাউজারের দিকে একপলক তাকিয়ে লিয়ার সামনে দাঁড়ায়।একহাতে পাঞ্জাবির বোতাম খুলতে থাকে।তারপর আচমকা লিয়ার গালে টুপ করে একটা চুমু দিয়ে বলে,,”থেংকিউ জান।এইভাবেই আমার সবকিছুতেই তোমার ছোঁয়া চাই।”

লিয়া জারিফের কাজে আর কথায় ঠোঁট চেপে শব্দহীন হাসে।জারিফ লিয়ার আরেকটু কাছে আগাতেই। লিয়া বলে,,”ফ্রেশ হয়ে নিন।আর নিচে সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।”

জারিফ কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে। লিয়া ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে নিচে নেমে সবার সাথে গল্পে জয়েন করে।জারিফ আলিফ আর তুষারের সাথে বসে বিভিন্ন কথা বলছে।রাতে সবাই একসাথে বসে ডিনার করে।ডিনার শেষে সবার আড়ালে লিয়া জারিফকে ফিসফিস করে বলে,,”আপনি রুমে গিয়ে বিশ্রাম করুন।আমি সবার সাথে আরো কিছু সময় কাটাতে চাই। কিছুক্ষণ পরেই আমি আসছি।”

ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে রাত সাড়ে বারোটা বাজতে চললো।লিয়া তুলি,ফিহা অরিনের সাথে গল্প করছে।এরমধ্যে রাজিয়া সুলতানা লিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন,,”লিয়া অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ো।আর জারিফ নতুন জায়গায় একা আছে।কখন কি প্রয়োজন পড়ে। লজ্জায় বলতে নাও পারে।তাই বলছি খোঁজ নেওয়াটা জরুরী।”

লিয়া বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ওদেরকে”গুড নাইট”বলে।তারপর রাজিয়া সুলতানা কে বলে,,”আম্মু জারা ঘুমিয়ে পড়েছে?”

“হুম।জারা তো ডিনার শেষ করেই বলছিলো ওর ঘুম পাচ্ছে। তুলির রুমে ঘুমিয়েছে জারা।”

“আচ্ছা।ঠিক আছে।”

তুলির হবু বর কল করায়।তুলি কানে হেডফোন গুঁজে কথা বলতে থাকে।লিয়া অরিন,ফিহা একসাথে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে।লিয়া আর ফিহা পেছনে অরিন সামনে।সেই সময় অরিন হতাশ স্বরে বলে,,”এই বাড়ির সবাই কাঁপল।একজন বাচ্চা বর নিয়ে রুমে।অন্যজন বরের কাছে যাচ্ছে।আরেকজন হবু বরের সাথে ফোনালাপে বিজি।মাঝখানে আমি সিঙ্গেল মানুষটার করুণ দশা হয়েছে।এতো এতো কাপলদের মাঝে নিজেকে এতিম এতিম লাগছে।”

কথাটা বলতে বলতেই হঠাৎ অরিনের সাথে কারো ধাক্কা লাগে। ধাক্কা লাগার সাথে সাথেই কিছু পড়ার শব্দ হয়।অরিন সামনে তাকিয়ে দেখে তুষার দাঁড়িয়ে।নিচে কয়েক টুকরো হয়ে আছে তুষারের মোবাইল টা। তুষার মোবাইল চাপতে চাপতে নামছিলো।আর অরিন কথা বলতে মশগুল ছিলো। দু’জনেরই বেখেয়াল বশত ধাক্কা লেগে যায়।

তুষার দ্রুত “সরি সরি” বলে দূরে সরে দাঁড়ায়।অরিনও সরি বলে।অরিন হাঁটু ভেঙ্গে নিচে বসে মোবাইলের ভাঙ্গা অংশ গুলো তুলতে যায়। তুষার ও বসে তুলতে যায়।সেইসময় অরিন বলে,,”ভাইয়া আমি হেল্প করছি তো।আপনি আবার কষ্ট করে খুঁটতে গেলেন কেনো।”

“খুঁটতে যে কিজন্য যাই।তা আমিই জানি। তুমি আমাকে হেল্প করতে গিয়ে একদম হেল্পলেস করে ছাড়বে।তোমার উপর চুল পরিমানও বিশ্বাস আমার নেই। অলরেডি দিয়েছে তো বড়সড় একটা অঘটন ঘটিয়ে।আমার এত দামী ফোনটার জানটা বের করে ছেড়েছে।এই মেয়ের আশে পাশে থাকলে কখন যেনো আমারই জান বের হয়ে যাবে।”

কথাগুলো মনে মনেই ভাবে তুষার।তবে মুখে কিছুই বলে না। মোবাইলের অংশ গুলো তুলে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।পেছন থেকে লিয়া আর ফিহা বিস্ময়কর চাহনিতে চেয়ে নির্বাক থাকে।তুষার জোর করে মুখে হাসি টেনে এনে বলে,,”সমস্যা নেই।মেকারের কাছে নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।গুড নাইট এভরিওয়ান।”

কথাটা শেষ করে তুষার দ্রুত কে’টে পড়ে। ফিহা রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিরক্তিকর কন্ঠে বলে,,”এই অরিন।একটু দেখে শুনে চলতে পারিস না।যেমন তোর মুখ চলে ঠিক তেমনি হাত পা চলে।দিলি তো একটা এক্সিডেন্ট বাঁধিয়ে।”

লিয়া বলে,,”আচ্ছা।ব্যাপার না। এটা একটা এক্সিডেন্ট ছিলো।এতে অরিনের কিবা দোষ।”

রুমে গিয়ে লিয়ার নজর যায় বিছানায়।জারিফ বিছানার হেডের সাথে হেলান দিয়ে একটা বালিশ কোলের উপর নিয়ে ফোন স্ক্রল করছে।কারো পায়ের শব্দ পেয়ে জারিফ মাথাটা তুলে একনজর লিয়াকে দেখে আবার ফোনে দৃষ্টি দেয়।লিয়া লাইট নিভিয়ে সবুজ রঙের ডিম লাইট টা জ্বালিয়ে দেয়।লিয়া জারিফের এটেনশন পাওয়ার জন্য হালকা কাঁশতে থাকে।তবুও জারিফ ভাবলেশহীন থাকে।লিয়া আহত দৃষ্টিতে জারিফের দিকে তাকিয়ে বলে,,”আপনি মুড অফ করে রেখেছেন কেনো?আর সরি।”

জারিফ ফোনটা বালিশের পাশে রেখে লিয়ার দিকে কিছুটা ঝুঁকে নির্বিকার ভাবে বলে,,”সরি ফর হোয়াট?”

লিয়া জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলে,,”ইয়ে আসলে। নাহ্ মানে রুমে আসতে অনেক লেইট হয়েছে।সেইজন্য আপনি রা’গ করেননি তো?”

জারিফ ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,,”শ্বশুর বাড়ি এসে তো বউ আমাকে ভুলেই গিয়েছে। নিজেকে আমার অরফান বয় মনে হচ্ছে।বউ ছাড়া অরফান।আসার পর থেকে তোমার দেখাই মিলছে না।কাছে পাওয়া তো দূর স্বপ্নের ব্যাপার।”

লিয়া ম্লান স্বরে বলে,,”সরি।আসলে সবার সাথে কথা বলতে বলতে।”

লিয়াকে অবাক করে জারিফ নিঃশব্দে হেসে লিয়ার গালে একহাত রেখে লিয়ার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। প্রায় ফাইভ মিনিটস পরে ছেড়ে দিয়ে কয়েকবার শ্বাস টেনে নেয়।লিয়াও জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে।জারিফ লিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে গলায় মুখ ডুবিয়ে দিয়ে বলে,,”ব্যাপার না।তুমি বাড়িতে এসেছো। সবার সাথে সময় কাটাবে এটাই স্বাভাবিক।এতে আমার রা’গ হওয়া বেমানান বা পাগলামী।”

লিয়া শব্দহীন হেসে। আলতোভাবে জারিফ কে জড়িয়ে ধরে।জারিফের গরম নিঃশ্বাস লিয়ার গলায় আছড়ে পড়ছে।লিয়ার বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়।জারিফ লিয়ার গলায় ঠোঁট স্পর্শ করায়।লিয়া নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে রিনরিনে স্বরে বলে,,
“আমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে।”

জারিফ ভাবলেশহীন ভাবে শান্ত গলায় বলে,,”ঘুমাও।আমি কি বারণ করেছি ঘুমাতে?তুমিই বলো।একবারো বলেছি।”

[চলবে…ইন শা আল্লাহ]

(বিশেষ দ্রষ্টব্য:ভাবিপু শব্দের জায়গায় শুধু ভাবী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।

যখনই গল্প লিখতে যাই, বোনের বাচ্চারা ঘাড়ের পাশে গিয়ে চেঁচামেচি করতে থাকে।আজ আবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে পাশের বাসার নিউ ইয়ারের সাউন্ড বক্স 😐যাইহোক হ্যাপি রিডিং। সাথে সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা রইলো💞)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here