#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ৩৪ (২য়)
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
ঢাকার গুলশানের একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টে তালুকদারদের পক্ষ থেকে খন্দকারদের জন্য ক্যাজুয়াল ডিনারের আয়োজন করা হয়েছে। আমন্ত্রিত অতিথিরা সপরিবারে এসেছেন। ফরমাল আলাপের গন্ডি পেরিয়ে আজ কিছু বাহিরের আলাপও হলো। নিশীথও বাপ-চাচার সাথে স্যুট পড়ে হাজির হয়েছে। ও নিজের রেগুলার গেটাপে যেতে চাইলেও পারেনি। কেননা, নতুন ডিলারদের সামনে একটা ইম্প্রেশনের ব্যাপার আছে। সবমিলিয়ে ডিনারটা বেশ ভালোভাবেই সম্পন্ন হলো। দুই পরিবার একে-অপরের সাথে পরিচিত হলো। খন্দকার সাহেব ও নিশীথের বাবা নানারকম আলাপে মশগুল। নিশীথ এর ফোন আসায় ও উঠে গিয়েছিলো খাওয়া শেষে। পরে আর টেবিলে ফিরে না গিয়ে নিজের মতোন এককোণে দাঁড়িয়ে সবাইকে দেখছিলো চুপচাপ। ওয়েটার সবাইকেই সফট ড্রিংক সার্ভ করে অবশিষ্ট একটি গ্লাস নিয়ে নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলো। তা দেখে নিশীথ ড্রিংকটা নেওয়ার জন্য ওয়েটারকে ডাকে। ওয়েটার ঘুরে নিশীথকে ড্রিংক দিতে যাবে একিসময়ে, একটি মেয়েলি ওয়েটারকে ডেকে উঠে “এক্সকিউজ মি”।
ওয়েটারের সাথে নিশীথ সামনে তাকিয়ে দেখে মেয়েটিকে। ওকে চিনতে পেরে ভ্রু কুচকায়। ওটা খন্দকার সাহেবের ছোট মেয়ে, লিরা। হয়তো ওর সমবয়সীই হবে! আজকেই এখানে এসে পরিচয় পর্বের সময় দেখেছে ওকে। এদিকে, ওয়েটার দু’পাশ থেকে ডাক পাওয়ায় একবার নিশীথের দিকে তো একবার লিরার দিকে তাকায়। নিশীথ ওয়েটারকে হাত দিয়ে লিরার কথা শুনতে ইশারা করলেই ওয়েটার বলে,
—ম্যাম, কিছু বলবেন?
—ইয়েস। আপনি টেবিল সেভেন থেকে এ ড্রিংক নিয়ে আসছেন, রাইট? আমি ওয়াশরুমে ছিলাম। দিস ইজ মাই ড্রিংক।
মেয়েটা হাত বাড়িয়ে ড্রিংক নিতে গেলেই ওয়েটার বললো,
—ম্যাম, স্যার আমাকে আগে ডেকেছিলেন।
মেয়েটা মাথা ঘুরিয়ে নিশীথের দিকে তাকাতেই চমকে যায়। ওকে চিনতে পেরে বিব্রত স্বরে বলে,
—ওহ সরি। আপনি নিন। আমি টেবিলে গিয়ে বসছি, আমাকে আরেকটি ড্রিংক এনে দিন!
ওয়েটারকে কথাটি বলে লিরা কেটে পড়তে ধরলে নিশীথ ওকে থামিয়ে বলে,
—নো ইটস ওকে। আপনিই নিন। আমি এমনিতেও নিজেরটা খেয়েছি। দিস ওয়াজ ফর ইউ। ইউ টেক দিস প্লিজ।
—না না ইটস ওকে। ইউ ক্যান হ্যাভ দিস!
—আই ইনসিস্ট! আপনি নিয়ে নেন। ওয়েটার ড্রিংকটা উনাকে দাও। এক্সকিউজ মি!
ভদ্রতার খাতিরে কথাগুলো বলে নিশীথ ইতস্তত হেসে ওখান থেকে চলে যায়। লিরা গ্লাস হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নিশীথের প্রস্থানের দিক তাকিয়ে টেবিলে ফিরে আসে। নিশীথ সেই যে গেলো, সোজা চলে এলো আরেফিন সাহেবের নিকট। চাচার কাছে এসে চোখমুখে কিছুটা বিরক্ত ভাব ফুটিয়ে বলে,
—চাচ্চু, আর কতক্ষণ থাকবে তোমরা এখানে? ডিনার তো শেষ। রাত ১০টা পার হয়ে গেছে। বাসায় যাবেনা?
—যাবো তো, নিশীথ। মাত্র ডিনার শেষ হলো। এখনি উঠে চলে যাওয়াটা কেমন দেখায় না? আর কিছুক্ষণ ওয়েট কর। বেশি দেরি হবেনা আমাদের!
নিশীথ ভোতা মুখে বললো,
—আমার একটু কাজ আছে। আমি তবে বেরিয়ে যাই? তুমি একটু ম্যানেজ করে নিও, কেমন?
ভাতিজার কথায় আরেফিন সাহেব ভ্রু কুচকান। যার জন্য এ ডিল হলো সেই কি-না ডিনার শেষ হতেই চলে গেলে, ব্যাপারটা কেমন দেখাবে না? আর এই রাত-বিরেতে আবার কিসের কাজ? তাই উনি প্রশ্ন করলেন,
—কিসের এত তাড়া তোর? একসাথেই তো এলাম সবাই। একসাথেই বাসায় ফিরবো। একটু সময় দে না, বাপ! এ সময় কি এমন কাজ আছে তোর শুনি?
—তোমরা বুঝলে তো নিজেরাই যেতে দিতে।
নিশীথ বিড়বিড়িয়ে বললো। আরেফিন সাহেব তেমন কিছু বললেন না আর। কিন্তু নিশীথকে যেতেও দিলেন না। অগত্যা নিশীথকে আরও কিছুক্ষণ থাকতে হলো সেখানে। সবমিলিয়ে সবার বেরোতে বেরোতে রাত ১১টার মতোন বেজে গেলো!
বাসায় পৌঁছে ফ্রেশ হতেই সারাদিনের ব্যস্ততায় নিশীথের দু’চোখে ভর করলো রাজ্যের ঘুম। ঘুমের চোটে পকেট হাতড়ে ফোন বের করার সুযোগ অব্দি সে পেলোনা। তলিয়ে পড়লো ঘুমের সাগরে। অথচ ওর পকেটের তলে পড়ে থাকা ফোনে দোলনচাঁপার দেওয়া কয়েকটা মেসেজ জমে রইলো।
নিশীথ জানতেও পারলোনা!
___________________
পরদিন সকালে নিশীথ জিমে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলো। আজ একটু দেরি করেই অফিসে যাবে সে। আয়মান সাহেবও এটা জানেন তাই নিশীথ নিজের মতোন ঘুম থেকে উঠে সব সেড়ে বেরিয়ে পড়লো নিজের বাইক নিয়ে। এলাকা পেরিয়ে বাজারের সামনে সামান্য জ্যাম লেগে আছে। মেইনরোডের আগে সরু রাস্তা হওয়ায় দুটো গাড়ির একসাথে আটকে আছে। লোকজন মিলে কিভাবে রাস্তা ক্লিয়ার করা যায় তা নিয়ে ঝগড়া করছে। জ্যাম ছাড়তে বেশ ভালোই সময় লাগবে মনে হচ্ছে!
এরই মাঝে বাইকে বসে বসে নিশীথ লক্ষ্য করলো রাস্তার পাশ দিয়ে বাজারের ব্যাগ হাতে পারভীন বেগম হেটে যাচ্ছেন। নিশীথের তাকানোর কিছুক্ষণের মাঝেই হঠাৎ পারভীন বেগম ওকে খেয়াল করলেন! নিশীথ খানিকটা হেসে তাকে সালাম দিলো। উনি সালামের জবাব দিলেন। নিশীথ ভেবেছিলো, পারভীন বেগম সালামের উত্তর দিয়ে বাড়ির পথে চলে যাবেন। অথচ দেখা গেলো, উনি নিশীথের দিকে এগিয়ে আসছেন। নিশীথ কিছুটা বিস্মিত হলেও চোখেমুখে তা প্রকাশ করলোনা। ভাবলো, হবু শাশুড়ি নিজ থেকে এগিয়ে আসছে? ভালোই তো। ওর নিশ্চয়ই একটা ভালো ইমেজ আছে উনার নজরে!
পারভীন বেগম বাজারের বাগ মাটিতে রেখে নিশীথের উদ্দেশ্যে বললেন,
—সকাল সকাল কই যাও, বাবা?
—জিমে যাচ্ছি, আন্টি। ওখান থেকে ফিরে রেডি হয়ে অফিসে যাবো! এ মাসেই জয়েন করেছি।
নিশীথ ইচ্ছে করেই উনার সামনে অফিসের কথাটা বললো। যাতে পারভীন বেগম বুঝেন, সে কাজে জয়েন হয়েছে, তার মেয়েকে নিজের টাকায় খাওয়ানো-পরানোর যোগ্যতা নিশীথের আছে! ওর কথায় পারভীন হেসে বললেন,
—আমি জানি তো!
—জি? কিভাবে জানলেন?
নিশীথ বোকার ন্যায় প্রশ্ন করে। ওর মুখের দিক তাকিয়ে পারভীন বেগম মিহি হেসে বললেন,
—তোমার দোলনচাঁপাই বলেছে আমাকে এসব কথা!
নিশীথের মন প্রফুল্ল হলো! “তোমার দোলনচাঁপা” কথাটা কানে সুরের ন্যায় বাজতে লাগলো কয়েকবার! ও বুঝেনি দোলনচাঁপা ওকে নিয়ে মায়ের সাথে গল্প করবে কখনো! তাইতো এ বিস্ময়।
কিন্তু দোলার মা ওকে এভাবে বলেছে, তার মানে একপক্ষ থেকে বিয়েটা পাকাপোক্ত প্রায়! এখন শুধু ওর পরিবার রাজি হলেই হয়ে যাবে। নিশীথ ঠোঁট কামড়ে ভাবলো। এরই মাঝে পারভীন বেগম বললেন,
—তোমার পরিবারে কি দোলার সাথে তোমার ব্যাপারে কথা বলেছো, নিশীথ?
এবার নিশীথের হাসি হাসি মুখটা কিঞ্চিৎ কালো হয়ে এলো। তা নিরবে ঠিকি লক্ষ্য করলেন পারভীন বেগম। উনি রাখঢাক না করে সরাসরি বললেন,
—এসব কথা হঠাৎ কেন বলছি জানো?
নিশীথ এবারো চুপচাপ মাথা নাড়ায়। অর্থাৎ সে জানেনা। শুধু প্রশ্ন করে,
—কেন?
পারভীন বেগম এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
—জোয়ান মেয়ে ঘরে বসে থাকলে ওর বিয়ে নিয়ে নানারকম ঝামেলা পোহাতে হয়। তার মধ্যে মেয়েটার যদি বাবা না থাকে, তবে তো কথাই নেই কোনো। আমার দোলার ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই!
—মানে? কি বলছেন, আন্টি? একটু সরাসরি বলুন। আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছিনা।
—দোলার আগের সম্বন্ধের কথা তো জানোই। ওটায় কত কাহিনি হলো! আমার ভুলেই বিয়ের কথা ঠিক হয়েছিলো যদিও। তাই একটা বিয়ে প্রায় ভেঙে যাওয়ায় আমাদের পরিবারে ওর বিয়ে নিয়ে সবাই অনেক কাহিনি শুরু করেছে। যে যেখান থেকে পারছে, ইচ্ছে মতোন ছেলের সম্বন্ধ আনছে। বয়স অধিক হোক, কিংবা আগের বিয়ে হওয়া হোক না কেন, সেগুলো দেখার কেউ প্রয়োজন মনে করছেনা। অথচ, আমার এত ভালো মেয়ের ভুল কি জানো? ওর একটা বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে গেছে। এদিকে রাকিব যে কতটা খারাপ ছিলো সেটা কেউ দেখবেনা। সমাজ শুধু মেয়েদের দোষটাই আগে খুজে!
পারভীন বেগমের কথায় নিশীথের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে রাগে। মাথায় আ’গুন ধরে যায়। এবার সে বুঝে, কাল অত রাতে দোলনচাপা কেন ওকে সেই মেসেজগুলো পাঠিয়েছিলো। নিশীথ ভাবনায় পড়ে যায়। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে ফোন হাতে নিয়ে দেখে রাত পৌনে বারোটার দিকে দোলা ওকে মেসেজ পাঠিয়েছে। যা কিছুটা এমন ছিলো-
“একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? রাগ করবেন না তো? আচ্ছা, আপনি কি বাসায় আমার কথা বলেছেন?”
মিনিট পাঁচেক পর আরেকটি মেসেজ,
“আমি জানি আপনি অফিসে জয়েন করেছেন বেশিদিন হয়নি। এখনি বাসায় বিয়ের কথা তোলা হয়তো অত সুবিধার হবেনা। কিন্তু…”
দশ মিনিট পর আরেকটি মেসেজ,
“ঘুমিয়ে পড়েছেন? এত তাড়াতাড়ি তো আপনি ঘুমোন না! আচ্ছা, আমি ঝোকের বশে আগের মেসেজগুলো দিয়েছি। কিছু মনে করবেন না। সরি।গুড নাইট!”
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে দোলার এমন মেসেজগুলো পড়ে নিশীথ বেশ অনেকক্ষণ হেসেছিলো। সে ভেবেছিলো, ওর বোকা দোলনচাঁপা হয়তো সরাসরি ওকে বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে লজ্জা পাচ্ছে তাই এভাবে ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলছে কথাগুলো! অথচ, সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি ওর লাজুক দোলনচাঁপা কতগুলো দুশ্চিন্তা বুকে চেপে ওকে মেসেজগুলো পাঠিয়েছিলো!
পেছন থেকে হর্ণের নিশীথ বাস্তবে ফিরে আসে। হাতের মুঠো পাকিয়ে চোখমুখ শক্ত করে পারভীন বেগমের উদ্দেশ্যে বলে,
—আপনি চিন্তা করবেন না, আন্টি। আমি দোলার ব্যাপারে সিরিয়াস। আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করে ঘরে আনতে চাই। এখনো বাসায় এ ব্যাপারে কথাগুলো বলার সুযোগ হয়নি। তবে জলদিই বলবো। বলে আমি নিজে আপনাকে জানাবো! আপনি প্লিজ ততদিনে কোনো আজেবাজে প্রস্তাবে সাড়া দিবেন না। দোলনচাঁপাকে আমার ছাড়া অন্য কারও হতে দিবেন না। কথা দেন?
অস্থির নিশীথের পাগল পাগল কথায় পারভীন বেগম শত পেরেশানির মধ্যেও হেসে ফেললেন! এই ছেলের হাতে মেয়ে দেবেন না তো কার হাতে মেয়ে দেবেন? তার আদরের দোলাকে নিশীথের চেয়ে বেশি ভালো কেউ বাসতে পারবে আদৌ? পারভীন বেগম মানেন না! তাই তিনি বাজারের ব্যাগটা হাতে তুলে বললেন,
—মেয়েকে অন্য কারও হাতে দেবোনা বলেই তো তোমাকে আজ এতকিছু বলা! মেয়ে জামাই হিসেবে আমারও তোমাকেই পছন্দ! ভালো থেকো, বাবা। জ্যাম ছেড়েছে মনে হয়। আসছি?
নিশীথ মৃদু হেসে তাকে বিদায় জানায়। বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিবে কিনা জানতে চাইলে পারভীন বেগম মানা করে দেন। নিজেই হেটে চলে যান এলাকার গলির ভেতর। পেছনে রয়ে যায় নিশীথ। বাইক স্টার্ট করে সামনে এগোলেও ওর মন থেকে যায় পেছনেই। যে মনে ঘুরছে নানারকম চিন্তা। এবার বাসায় ফিরে পাকাপোক্ত ভাবে বিয়ের কথা বলতেই হবে। বাবা যতকিছুই বলুক সব শুনবে। দোলনচাঁপার জন্য নিশীথ সব শুনতে রাজি। তবুও দোলনচাঁপা ওর হোক। তবুও মন মানতে চায়না। মস্তিষ্ক ঠিকি প্রশ্ন করে বসে, ও কি আসলেই পরিবারকে মানাতে পারবে? নাকি এর মাঝে অন্যকোনো ঝামেলা তৈরি হবে ওর জীবনে?
#চলবে
পরের পর্ব সোমবার রাতে পাবেন ইন শা আল্লাহ।