#শুধু_তোমাকেই_চাই
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব_৪১
সন্ধ্যার পর লিয়া কিচেনে যায়। সন্ধ্যার হালকা নাস্তা বানাতে ব্যস্ত লিয়া।মুগলাই তৈরি করছে।গতকাল বিকেলেই ওরা ময়মনসিংহে চলে এসেছে। শ্বশুর – শ্বাশুড়ি ননদ বর নিয়ে লিয়ার নতুন সংসার জীবন। প্রত্যেকটা মেয়েরই একান্ত চাওয়া থাকে সাজানো গুছানো সুন্দর একটা সংসারের। লিয়ার চাওয়া-ও এর ব্যতিক্রম নয়।তার উপরে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাশে পেয়েছে।এর থেকে বড় আনন্দের বিষয় আর কিছু হতে পারে না লিয়ার কাছে।ভালোবাসা সত্যিই সুন্দর।যদি ভালোবাসার মানুষটা সঠিক হয়।এমনই একজন হাই পার্সোনালিটি সম্পন্ন ভালো মনের মানুষকে বর হিসেবে পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার।জারিফকে পেয়ে লিয়া নিজেকে লাকী মনে করে।জারিফের পুরো পরিবারের আচার – ব্যবহার লিয়াকে মুগ্ধ করছে ক্ষণে ক্ষণে।
হঠাৎ জারা এসে লিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে কপাল কুঁচকে বলে,,”ভাবী তুমি এখন কষ্ট করে এসব বানাতে গেলে কেনো? আম্মু কে বললে, আম্মুই করে দিতো তো। এই গরমের মধ্যে এখন সবার জন্য নাস্তা বানাচ্ছো।”
লিয়া নিভু নিভু চোখে জারার দিকে এক নজর তাকায়।তারপর মিষ্টি করে হেসে বলে,,”প্রবলেম নেই জারা।আমার ইচ্ছে করলো সবার জন্য নাস্তা বানাতে।আর সত্যি বলতে সারাক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগছিলো না।তাই ভাবলাম একটু কাজের মধ্য দিয়ে সময় কাটাই।এই আরকি।”
জারা ঠোঁট প্রসারিত করে বলে,,”আচ্ছা।ঠিক আছে।তবে দাও আমি তোমাকে হেল্প করি।কি করতে হবে বলো ।নির্দ্বিধায় আমাকে বলতে পারো।নো হেজিটেশন।”
লিয়া ইশারায় সামনের দিকে দেখিয়ে ঠোঁট নেড়ে বলে,,”থেংকিউ।তবে সমস্যা নেই।এইতো আটা মাখিয়ে নিয়েছি।বাকি উপকরণও তৈরি করা কমপ্লিট।এখন ভেজে নিলেই হবে।তারপরেও প্রয়োজন হলে,আমি তোমাকে ডাকবো কেমন।”
“ওকে।”
কিয়ৎক্ষন থেমে।ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু একটা ভাবে জারা। অতঃপর উৎসুক কন্ঠে বলে,,”আচ্ছা ভাবী।ভাইয়াকে দেখছি না অনেকক্ষণ হবে।দুপুরে খাবার টেবিলে দেখেছি।আর একবারো দেখেনি।সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।এখনো দেখছি না যে।কোথাও গিয়েছে?”
লিয়া কাজ করতে করতেই উত্তরে বলে,,”তোমার ভাইয়া তো লাঞ্চ করেই বেড়িয়েছে।বললো টাউনহলে যাবে।দরকার আছে।বিকেলেই তো চলে আসার কথা। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।কই এখনো আসছে না।চলে আসবে হয়তো এখনি।এখন অব্দি একটা ফোন করেও তো কিছু বলেনি।”
জারা মৃদু কন্ঠে বলে,,”ওহ্। আচ্ছা ভাবী বলছি যে, শুনলাম পরশুদিন তোমরা বগুড়া চলে যাবে।”
“তোমার ভাইয়ার ছুটি তো শেষ হয়ে আসছে।তাই ফিরতে তো হবেই।”
জারা মুখটা মলিন করে ভার গলায় বলে,,”ইশশ্!তোমরা চলে যাবে। আমার ভীষণ মন খা’রাপ করবে।ভাবী তুমি না হয় থেকে যাও এখানে আমাদের সাথে।তুমি এখানে আমাদের সাথে থাকবে।আর ভাইয়া মাঝে মাঝে ছুটি নিয়ে আসবে।আর দ্রুত বদলি হয়ে এখানে চলে আসার জন্য ট্রায় করবে।এরকম হলে কেমন হবে?আমার কাছে তো খুবই ভালো হবে। উফ্!যদি সত্যি এরকম হতো।”
লিয়া মৃদু হেসে শান্ত স্বরে বলে,,”এরকম হলে মন্দ হয়না জারা।তবে আমার কলেজ-ও তো আছে বলো। পড়াশুনার জন্য হলেও তো যেতে হবে।”
জারা মুখটা বাংলা পাঁচের মতো করে নিরস স্বরে বলে,,”কি আর করার।তবে ভাবী তোমাকে খুব মিস করবো। এত্ত এত্ত মিস করবো।”
শেষের কথাটা দুই হাত দিয়ে দেখিয়ে ঠোঁট উল্টে বলে।লিয়া একহাত দিয়ে আলতোভাবে জারার সফট গালটা ছুঁয়ে দেয়। তারপর স্মিত হেসে বলে,,”মন খা’রাপ করো না।ছুটি হলেই আমি তোমার ভাইয়া আসবো। আব্বু আম্মুর সাথে তুমিও বেড়াতে যাবে।আর ফোনে তো সব সময় কথা হবেই।”
জারা কিছু ভেবে নিয়ে বলে,,”আচ্ছা ভাবী। আন্টিরা কবে যাবে।না মানে আন্টিরাও তো ওখানেই থাকে।”
“আম্মুরা কাল সকালেই চলে যাবে।রাহবারের স্কুল, প্রাইভেট মিস যাচ্ছে তো।তাই দ্রুতই বাসায় ফিরবে।”
আরো ভালো-মন্দ কথা বলে দু’জনে।তারপর লিয়া জারাকে উদ্দেশ্য করে মৃদু কন্ঠে বলে,,”জারা তোমার সামনে তো টেস্ট পরীক্ষা।তাই বলছি তুমি গিয়ে পড়তে বসতে পারো।কোনো হেল্প লাগলে আমি ডেকে নিবো।”
“ওকে,ভাবী।”
মিষ্টি গলায় কথাটা বলে জারা কিচেন থেকে প্রস্থান করে।এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠে।বেল বাজার সাথে সাথেই জারা গিয়ে দরজা খুলে দেয়।জারা দরজা খুলতেই জারিফকে দেখতে পায়।
জারিফ জারাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর গলায় বলে,,”পড়াশোনা না করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস যে।দুইদিন পর থেকে তোর টেস্ট পরীক্ষা না।আর পড়তে না বসে।”
জারিফের কথার মাঝেই জারা নাক মুখ কুঁচকে বলে,,”এই ভাইয়া।আমি কোথায় ঘুরে বেড়ালাম শুনি। আমি তো বাসায়ই আছি।আমি নয় বরং তুই নিজে ঘুরে বেড়িয়ে আসলি।পুরো শহর টইটই করে ঘুরে এখন বাসায় ফিরলি।ঠিক বলেছি না?”
জারিফ মৃদু ধমকের সুরে বলে,,”থামবি তুই।এই শহরটা আমার কাছে নতুন না-কি। সেইজন্য আমাকে আজ নতুন করে ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে।তোর বোকা বোকা কথা শুনে আমার দমফাটানো হাসি পাচ্ছে।তবে হাসিটাকে আপাতত চেপে রাখলাম।”
জারা সজোরে দরজাটা লাগিয়ে দেয়।তারপর দাঁত কটমট করে ভ্রু যুগল উঁচিয়ে বলে,,”কে বলেছে কষ্ট করে হাসিটাকে চেপে রাখতে?”
জারিফ ভেতরে যেতে যেতে বলে,,”কেউ না।আজ বাদে কাল তোর এক্সাম।এইসময় তো তোর পড়ার টেবিলে বই সামনে নিয়ে বসে থাকার কথা। পড়ার টেবিলে না থেকে এরুম থেকে ওরুমে থাকা মানেই তোর জন্য বেড়ানো এখন।বুঝলি ছুটকি।”
জারা মুখ ভেংচি কে’টে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।জারিফ নিজের রুমের দিকে যেতে থাকে।জারিফ রুমে গিয়ে লিয়াকে না দেখতে পেয়ে কিছুটা হতাশ হয়।হাতে থাকা প্যাকেট বিছানার উপর রাখে।তারপর সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নেয়। নেভিব্লু কালারের ট্রিশার্ট আর ছাই রঙা টাউজার পড়ে। চুলগুলো হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে দিয়ে ব্রাশ করতে থাকে।।আয়নাতে নিজেকে একবার দেখে নিয়ে রুম থেকে বের হয়।রুম থেকে বের হওয়ার সময় জারিফ মনে মনে ভাবে,কপাল আমার।আমি বাসায় আসছি।অথচ বউয়ের দেখা নেই।লিয়া বোধহয় মায়ের রুমে আছে।এখন লিয়াকে ডাকার জন্য সরাসরি মায়ের রুমে যাওয়া তো পসিবেল নয়। লজ্জার-ও ব্যাপার স্যাপার আছে তো।তাই আপাতত জারাকে বলে দেখি।জারা ডেকে দিবে।গুড আইডিয়া এটাই বেটার হবে।
কথাগুলো মনে মনেই ভেবে নিয়ে জারিফ জারার রুমের দিকে যায়।দরজার দাড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে জারিফ হালকা কেশে বলে,,”ছুটকি তোর ভাবী কোথায়?”
কথাটা শ্রবণ হতেই জারা ঘাড় ঘুরিয়ে জারিফের দিকে তাকিয়ে গলা ছেড়ে বলে,,”ভাবী তো রান্নারুমে।”
“রান্নারুমে এখন।”
জারিফ কপাল কুঞ্চিত করে কথাটা বলে।জারা গমগমে স্বরে বলে,,”হুম।ভাবী মুগলাই তৈরি করছে।আমি ডেকে দেবো ভাবী কে?”
জারিফ কিছুটা জড়তা নিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,,”ওহ্। নাহ্ থাক।তুই পড়ছিস পড়।আমি নিজেই কিচেনে যাবো। ইয়ে মানে আই নীড কোল্ড ওয়াটার।সো আমি ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানি নিতে যাচ্ছিলাম।”
কথাটা শেষ করে জারিফ দ্রুত ওখান থেকে প্রস্থান করে বড় করে শ্বাস টেনে নেয়।কিচেনে গিয়ে দেখেতে পায়।শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে এক হাত দিয়ে লিয়া কড়াইয়ে কিছু মনোযোগ দিয়ে ভাঁজতে ব্যস্ত। ব্লাক আর রেড কালারের মেশানো সুতি শাড়ি পড়েছে লিয়া। চুলগুলো হাত খোঁপা করা। খোঁপা টা কাঠের কাঠি দিয়ে আটকানো।কারো পায়ের শব্দ শুনে লিয়া কিচেনের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে,দরজার সাথে এক পা ঠেস দিয়ে দুই হাত বুকে ভাঁজ করে জারিফ দাঁড়িয়ে।জারিফের মুখে মুচকি হাঁসি লেগে আছে।লিয়ার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে।জারিফ এক পা দু পা করে লিয়ার দিকে এগিয়ে আসে।লিয়া একহাত দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছে ফেলার চেষ্টা করে।জারিফের মুখের হাসিটা যেনো এবার আরো চওড়া হয়।
লিয়া জারিফের হাসি দেখে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলে,,
“সমস্যা কি আপনার?কোনো কথা নেই বার্তা নেই শুধু হাসছেন।আর আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে। ক্লোজআপ এর এ্যড দিচ্ছেন। পরিপাটি ঝকঝকে তকতকে বত্রিশটি দাঁত বের করে হেসে যাচ্ছেন।”
জারিফ দুই হাত টাউজারের পকেটে গুঁজে নেয়। অতঃপর হাসি মুখেই বলে,,”ক্লোজআপ নয়। পেপসোডেন্ট বললে তোমার কথা কিছুটা হলেও রাইট হতো।কারন তুমি তো জানো আমি ক্লোজআপ নয় পেপসোডেন্ট ইউস করি।”
লিয়া নিরস গলায় বলে,,”হুম,জানি তো।আর এইতো কিছুক্ষণ আগে আমি শুনতে পেলাম।জারাকে ডেকে বলছেন। আপনার নাকি ঠান্ডা পানির তৃষ্ণা পেয়েছে। কিচেনে আসার কারন ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানির জন্য।তা আমার দিকে এইভাবে তাকিয়ে থাকলেই কি আপনার তৃষ্ণা মিটে যাবে না-কি? ফ্রিজ ঐদিকে।”
শেষের কথাটা ইশারায় ফ্রিজ দেখিয়ে বলে লিয়া।লিয়ার কথা আর ফেস দেখে জারিফ কিছুটা আন্দাজ করতে পারে।লিয়া হয়তো রেগে আছে।একে তো বিকেলেই বাসায় আসার কথা বলেছিলো।আসছে সন্ধ্যা পার করে।তার উপরে কোনো ফোন কল নেই।এতে লিয়ার মনে নিশ্চয় অভিমান জমেছে।মেয়েদের মনটা যেমন খুব নরম হয়।আবার ঠিক তেমনি মেয়েরা খুব অভিমানি-ও হয়।খুব সহজেই মেয়েদের মনে অভিমান বিষয়টা ভর করে ফেলে।তেমনি লিয়ার মনেও অভিমান জমেছে।জারিফের মন মস্তিষ্ক জুড়ে এখন শুধু একটাই চিন্তা বইছে।লিয়ার অভিমান কিভাবে ভাঙ্গাবে?মিনিট খানেক আপন মনে এসব ভেবে যায় জারিফ।
জারিফ পিছন দিক হতে লিয়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে থুতনি রাখে।কোমল গলায় বলে,,”ছিলাম তো তৃষ্ণার্ত।যেমন তেমন নয়।একদম হাই লেভেলের তৃষ্ণার্ত ছিলাম।তোমাকে দেখার জন্য।তোমাকে দেখে আমার মন-প্রাণ,দুই নয়ন জুড়িয়ে গিয়েছে।তুমি হলো আমার তৃষ্ণা নিবারণের ফাস্ট আর লাস্ট পাথেয়।”
লিয়া নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে মুচড়ামুচড়ি করতে থাকে।জারিফের ঠান্ডা হাত শাড়ির আঁচল ভেদ করে পেট স্পর্শ করতেই লিয়া জমে যায়।লিয়া বারকয়েক ঢুক গিলে নিয়ে ঠোঁট নেড়ে বলে,,”একদম মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবেন না।বলা চলে সারাদিন আমি নতুন পরিবেশে একা একা আছি। আপনার কোনো খবর নেই।ফোন করে একবার জানানোর প্রয়োজন বোধ-ও করেননি।আর এখন আসছেন মিষ্টি কথায় মন ভুলাতে।”
লিয়ার কথা মনে হয়না জারিফের কানে ঢুকেছে।কারন জারিফের কোনো হেলদোল নেই।জারিফ ভাবলেশহীন ভাবেই আছে।লিয়ার নড়াচড়াতে জারিফ হাতের বাঁধন টা আরেকটু শক্ত করে।এবার লিয়া মৃদু রা’গ দেখিয়ে শক্ত গলায় বলে,,”এটা আপনার বেড রুম নয়।এটা কিচেন।এটা মাথায় আছে আপনার। যখন-তখন যে কেউ চলে আসতে পারে।তাই দূরে সরুন।আমার থেকে দুই ফুট দূরত্ব বজায় রেখে চলুন,হুহ।”
“আমি তো অনেক ভদ্র একটা ছেলে ছিলাম। কিন্তু কি করবো বলো? তোমাকে দেখলে পরেই আমার মনটা রোমান্টিক হয়ে যায়।এখানে আমার দো’ষ কোথায়?তুমি পাশে থাকলে আমার মনটা আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে যায়।”
কথাটা শেষ করে জারিফ এক হাত দিয়ে লিয়ার এক বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।অন্যহাত লিয়ার শাড়ির আঁচলে দেয়।হাত দিয়ে শাড়ির আঁচল ধরতেই।লিয়া বেশ অবাক হয়।লিয়া ওষ্ঠদ্বয় নেড়ে বলে,,” ক কি করছেন?আমি কাজ করছি তো।”
লিয়াকে আরো অবাক করে দিয়ে জারিফ শাড়ির আঁচল একহাতে কোমড় হতে ছাড়িয়ে নেয়। অতঃপর আঁচল টা হাতে নেয়।হাতটা উঁচু করে লিয়ার কপাল থেকে ঘসে কিছু মুছতে থাকে।এসব কিছু যেনো লিয়ার মাথার দুই ইঞ্চি উপর দিয়ে যায়।লিয়া নির্বাক হয়ে থাকে।
জারিফ লিয়ার কপালে মুছতে মুছতে বলে,,”তোমার কপালে মনে হচ্ছে সব আটা মেখেছো।এটা দেখেই আমার হাসি পাচ্ছিলো।তবে এইভাবে আমার কাছে তোমাকে একটু বেশিই কিউট লাগছিলো।একদম বাচ্চা বাচ্চা ফেস লাগছে।কয়দিন পরে নিজেই একজনের বাচ্চার মা হবে।আর বাচ্চাদের মতো কিনা মুখে আটা মাখিয়ে বসে আছো।”
লিয়া আর কথা না বাড়িয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে শব্দহীন হেসে কাজ করতে থাকে।জারিফ নাইফটা নিয়ে বলে,,
“তোমাকে হেল্প করছি।ওয়েট।”
জারিফ নাইফ দিয়ে ভাঁজা মুগলাই পিস করতে থাকে।লিয়া শীতল কন্ঠে জারিফকে প্রশ্ন করে,,”টাউনহলে এত সময় কি করলেন শুনি?”
“কাজ ছিলো।আম্মুর মেডিসিন নিলাম। আর রুমে গেলেই দেখতে পারবে।তবে দ্রুতই ফিরছিলাম। হঠাৎ কাকতালীয়ভাবে পুরোনো দু’জন ফ্রেন্ডের সাথে দেখা হলো।ওরা আবদার করলো আমার বিয়ের জন্য ট্রিট দিতে।সো ট্রিট দিতে মটকা আঁচ এ গিয়েছিলাম।”
লিয়া ঠোঁট প্রসারিত করে বলে,,”ওহ্। নাস্তা তো করেই আসছেন।তাহলে তো আমার বানানো খাবার আর খাবেন না।”
“কে বলেছে খাবো না।একবারো আমি বলেছি?তোমার বানানো খাবার আমি টেস্ট করবো না।আর আমি শুধু ওখানকার চা খেয়েছি।বুঝলে এবার।আমার পুরো পেটটাই খালি আছে।তোমার হাতের খাবার খাওয়ার জন্য আমার পেট ফাঁকাই আছে।বাই দ্যা ওয়ে,তুমি মটকা আঁচের চা খেয়েছো কখনো?ভাবছি তোমাকে সাথে নিয়ে কালকে ওখানকার চা খাওয়াবো।”
লিয়া জবাবে বলে,,”আমি গিয়েছিলাম ওখানে। আম্মুর সাথে। তখনই মটকা আঁচের চা খেয়েছি।”
জারিফ ঠোঁট গোল করে লিয়ার মুখে ফু দিয়ে কপালের উপরের এলোমেলো ছোটো ছোটো চুলগুলো সরিয়ে দেয়। কিয়ৎক্ষন পরেই নির্বিকার ভঙ্গিতে দৃঢ় কন্ঠে বলে,,”ব্যাপার না।আমার সাথে তো আর যাওনি।তাই কালকে আমার সাথে যাচ্ছো। অগ্রিম বলে রাখলাম। কালকে সন্ধ্যায় রেডি হয়ে থেকো।তুমি তোমার বরের সাথে মটকা আঁচে যাচ্ছো।নো এসকিউজ। নো মোর ওয়ার্ডস।”
জারিফ কেবিনেট এর উপর থেকে সসের বোতলটা হাতে নেয়।মুগলাই এর উপর সস ঢেলে নেয়। অতঃপর এক টুকরো হাতে নিয়ে মুখে পুড়ে দেয়।চিবুতে চিবুতে আরেক টুকরো নিয়ে লিয়ার মুখের সামনে ধরে।লিয়া হাঁ করে মুখে নেয়।লিয়া ইচ্ছে করে জারিফের আঙ্গুলে কামুড় দেয়।জারিফ মৃদু আওয়াজে আহ্ শব্দ করে।এটা দেখে লিয়া স্মিত হাসে।জারিফ অন্য হাত দিয়ে আঙ্গুলটা ধরে অসহায় ফেস করে করুণ গলায় বলে,,”একে তো কামুড় দিয়ে দাঁত বসিয়ে দিয়েছো।তার উপরে আবার হাসছো।কোনো প্রকারের রিপেন্ট না করে। ইটস্ নট ফেয়ার লিয়া।”
লিয়া বেসিন থেকে হাতটা ধুয়ে নেয়। অতঃপর টাওয়েল দিয়ে মুছে নেয়।একহাতে জারিফের আঙ্গুল টা ধরে ফুঁ দেয়।দুই সেকেন্ড খানেক পরেই লিয়া জারিফের আঙ্গুলে ঠোঁট ছোঁয়ায়।মৃদু আওয়াজে বলে,,”সরি।মজা করেছিলাম বুঝতে পারিনি এতটা জোরে লেগে যাবে।”
“ব্যাপার না।আমি তো মজা করছিলাম।আর বিষয়টা আমি বেশ ইনজয় করেছি।”
লিয়া চা বানানোর জন্য চুলায় গরম পানি বসাতে বসাতে বলে,,”এইতো চা টা বানানো হলেই কাজ কমপ্লিট।আপনি রুমে যান।আমি আব্বু – আম্মু কে চা নাস্তা দিয়ে আসছি।”
।
।
।
ঋতুতে গ্রীষ্মকাল চলছে।আজ তিনদিন হবে লিয়ারা বগুড়াতে ফিরেছে।জারিফের ফ্লাটে লিয়া আছে। ফ্লাটটা বেশ সুন্দর পরিপাটি সাজানো – গোছানো।তিনটা বেডরুম আর একটা ড্রয়িং রুম। ড্রয়িং রুমের সাথেই ডায়নিং এর স্পেস।আজ তিনদিন ধরে লিয়া ফ্লাটটা মনের মতো করে সাজানো গুছানোয় ব্যস্ত ছিলো।একটা কাজের মেয়ে ঠিক করা হয়েছে।এসে সব কিছু পরিষ্কার করে দিবে,কাপড় ধুয়ে দেবে,ময়লা ফেলে দেবে।সকালে আর দুপুরে দুইবার আসবে।
লিয়ার অনেকদিন কলেজে যাওয়া হয়না।আজকে কলেজে যাবে ঠিক করেছে লিয়া।রাতে ঘুমানোর আগেই মোবাইলে এলার্ম দিয়ে রেখেছিলো।এলার্মের শব্দে লিয়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। লিয়া চোখ বন্ধ করেই বালিশের পাশ থেকে এক হাত দিয়ে হাতড়িয়ে মোবাইল টা নেয়।টেনে টুনে চোখের পাতা খুলে এলার্ম অফ করে।আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিয়ে বিছানা থেকে নামতে যাবে।সেই মূহূর্তে লিয়ার হাতে টান পড়ে।লিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে জারিফ হাত ধরে আছে।লিয়া ইশারায় ছাড়তে বলে।জারিফ নির্বিকার থাকে।এটা দেখে লিয়া ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে ঠোঁট আওড়িয়ে বলে,,
“ছাড়ুন।কাজ আছে ।উঠতে হবে। লেইট হয়ে যাবে। ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে হবে তো। নাহলে আপনার অফিসে যেতে লেইট হয়ে যাবে।”
জারিফ লিয়ার হাত ধরে টান দেয়।আচমকা টানে লিয়া জারিফের বুকের উপর পড়ে।জারিফ লিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে,,”লেইট হলে হবে।আর তোমাকে এতো সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে হবে না।বুয়া এসে করবে।তুমি ঘুমাও কেমন।এত সকাল সকাল উঠে তুমি কাজ করছো এটা তোমার আব্বু – আম্মু শুনলে।ভাববে তাদের জামাই খুব খা’রাপ।তাদের আদরের মেয়েকে দিয়ে সব সময় কাজ করাই।কোনো খেয়াল রাখি না।কেয়ার করি না।বদনাম তোমার বরের হবে।”
লিয়া ঠোঁট মেলে বলে,,”আমার সংসারের কাজ আমি স্বইচ্ছায় করছি।এতে আপনার বদনামের কি আছে? আশ্চর্য! আপনার কথা শুনে আমি আশ্চর্যান্বিত হচ্ছি।এসব কথা রাখুন।আর আমাকে আজ কলেজে যেতে হবে।সো এখন আর্লি উঠা প্রয়োজন।”
জারিফ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,,”আমার আরো ঘুম প্রয়োজন।সো এইজন্য হলেও আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ গুড গার্ল হয়ে শুয়ে থাকো।”
“আমার ঘুম পাচ্ছে না।সো চুপচাপ শুয়ে থাকা আমার পক্ষে পসিবেল নয়।”
জারিফ শান্ত গলায় বলে,,”চুপচাপ থাকতে না পারো। গল্প করো। গল্প করতে না পারো।বরকে আদর তো অন্তত করতে পারো।তিনটা অপশন আছে তোমার কাছে।কোনটা বেছে নেবে।নিজেই চুজ করে নাও।”
লিয়া ইন্নোসেন্ট ফেস করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,,”একটাও অপশন আমার মন মতো নয় বর্তমানে।শুনতে পেয়েছেন?”
জারিফ নিশ্চুপ রয়।লিয়াকে পাশে শুয়ে দিয়ে গলায় মুখ ডুবিয়ে নিশ্চুপ থাকে।লিয়া ছোট করে শ্বাস টেনে নেয়। কিয়ৎক্ষন পরে ইন্নোসেন্ট মুখাবয়ব করে সফট ভয়েজে বলে,,”শুনুন না।”
জবাবে জারিফ নরম কন্ঠে বলে,,”বলো না।”
“কলেজে যেতে হবে তো। সামনে আমার ইনকোর্সের পরীক্ষা আছে।তাই আজকে গিয়ে নোটগুলো কালেক্ট করতে হবে ।”
“হুম।যাবে সমস্যা কোথায়?”
কিছু সময় পর জারিফ একহাত দিয়ে লিয়ার গাল ছুঁইয়ে সফট ভয়েজে বলে,,”এই গ্রীষ্ম ঋতুটা আমার কাছে খুব স্পেশাল।এই ঋতুতেই তোমার সাথে ফাস্ট দেখা হয়েছিলো।আবার এই ঋতুতেই তোমাকে একান্তভাবে নিজের করে পেয়েছি।”
লিয়া আনন্দিত কন্ঠে বলে,,”হুম।ঠিক বলেছেন। আপনার মতো আমার কাছেও এই ঋতুটা একটু বেশিই স্পেশাল।কারন সেইম।”
জারিফ নির্বিকার গলায় বলে,,”এই ঋতুটা আরো স্পেশাল যাতে হয়।আমি মনে প্রাণে সেটা যাচ্ছি।আমার অস্তিত্ব তোমার মধ্যে যেনো বেড়ে উঠে।এই সুখবর-ও আমি খুব দ্রুতই পেতে চাই।”
লিয়া মৃদু হাসে। ঠোঁট কামড়ে ধরে বলে,,”এতো তাড়াহুড়ো কিসের।”
“তাড়াহুড়া কিনা জানিনা।তবে আমি ছোট্ট একটা লিয়াকে পেতে চাই।আমার ইচ্ছে মিষ্টি দেখতে ছোট্ট একটা লিয়াকে।”
লিয়া জারিফের কথার বিরোধিতা করে বসে।লিয়া কাঠকাঠ গলায় বলে,,”আমার ইচ্ছে কিউট দেখতে ছোট্ট জারিফ কে।”
জারিফ সমঝোতা করতে বলে,,”ছেলে বা মেয়ে যেকোনো একটা হলেই আমি হ্যাপি।”
এরমধ্যে হঠাৎ কলিং বেল বাজতে থাকে।লিয়া ঠোঁট আওড়িয়ে বলে,,”রিতু (কাজের মেয়ে)চলে এসেছে হয়তো।”
লিয়া গিয়ে দরজা খুলে দেয়।লিয়া ফ্রেশ হয়ে এসে কিচেনে যায় ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে।রিতু মেয়েটা কিশোরী।দেখতে হ্যাংলা পাতলা।লিয়া রান্না করতে থাকে।আর রিতু হেল্প করে।
জারিফ রেডি হয়ে ফর্মাল গেটআপে বসে আছে।বিছানার উপর পা ঝুলিয়ে বসে ফোন স্ক্রল করছে জারিফ।আর লিয়া ড্রেসি়ং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হিজাব বাঁধছে।সেদিন টাউনহল থেকে ফিরার সময় জারিফ লিয়ার জন্য বেশ কয়েকটা হিজাব ওড়না কিনে এনেছিলো।জারিফের আদেশ এখন থেকে কলেজে বা বাইরে কোথাও যেতে হলে হিজাব পড়তে হবে।ঘন বড় চুলগুলো খোলা রেখে বাইরে যাওয়া যাবে না। প্রায় টেন মিনিটস এর বেশি হবে লিয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হিজাব বাঁধছে।লিয়া পিন গুলো আটকাতে থাকে আর আড়চোখে জারিফের দিকে বারবার তাকাচ্ছে।লিয়া মনে মনে আওড়ায়,,দিন যাচ্ছে আর জনাবের ডিমান্ড আর আদেশ তরতর করে আকাশ ছুঁইয়ে যাচ্ছে।এদিকে আমি কখন থেকে বলে যাচ্ছি। প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে যাচ্ছে। আব্বু-আম্মু , রাহবার কে দেখি না।আজকে বিকেলে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যাবেন।বাসায় গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসবো।সেই কথাটা যেনো উনার কানেই ঢুকছে না।
এসব কথা মনে মনেই ভেবে নিয়ে লিয়া মুখটা ম্লান করে ঠোঁট উল্টে বলে,,”শুনুন না।”
জারিফ ফোন স্ক্রল করতে করতে দৃষ্টি ফোনে রেখেই বলে,,”বলো না।”
লিয়া জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলে,,”আজকে বিকেলে ক্যান্টনমেন্ট যাবো।আপনি না নিয়ে যান না নিবেন।কলেজ থেকে আমি একাই যেতে পারব।না করবেন না, প্লিজ।”
জারিফ কাঠকাঠ গলায় বলে,,”একদম নয়। তাড়াতাড়ি তৈরি হও।তোমাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে আমি অফিসে যাবো।আর আজ নয় দু-তিন দিন পর আমি নিজেই নিয়ে যাবো।”
লিয়া হিজাবটা বেঁধে নিয়ে।একসাইডে কাঁধের উপর ওড়নাটা দিয়ে পিনআপ করে নেয়। তারপর ঠোঁটে গোলাপি কালারের হালকা লিপস্টিক দেয়।ব্যাগটা নিয়ে বলে,,”আমি রেডি।চলুন।তবে বলছি যে,আমি একাই যেতে পারবো। শুধু শুধু আপনাকে কলেজ পর্যন্ত যেতে হবে না।আপনি অফিসে যেতে পারেন।”
জারিফ উঠে দাঁড়িয়ে মোবাইল টা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নেয়।দৃঢ় স্বরে বলে,,”এখান থেকে আজকে ফাস্ট কলেজে যাচ্ছো।তাই আমি নামিয়ে দিয়ে আসছি।এরপর থেকে ভেবে দেখব।আর ক্লাস শেষ হলে কল দিও আমি নিয়ে আসবো।”
“আমি একাই পারবো তো।সমস্যা হবে না।”
“জানি তুমি পারবে।তবে প্রথম কিছুদিন এভাবে যাও।এরপর থেকে না হয়।একাই আসা-যাওয়া করবে।”
লিয়া ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে,,”ওকে।”
জারিফ লিয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,,”মন খা’রাপ করো না।আই প্রমিজ।তোমাকে তোমাদের বাসায় নিয়ে যাবো।দু-তিন দিনের মধ্যে।আর ইউ হ্যাপি?”
লিয়া মৃদু হেসে বলে,,”হুম।”
এবার আমাকে হ্যাপি করো।কথাটা শেষ করেই জারিফ লিয়াকে লিপ কিস করে।লিয়ার ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে বড় করে শ্বাস নেয় জারিফ।তারপর বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ঠোঁট মুছে নেয়।লিয়া বার কয়েক শ্বাস টেনে নেয়।লিয়া কপাল কুঁচকে মৃদু রা’গ দেখিয়ে বলে,,”মাত্রই ঠোঁটে লিপস্টিক নিয়েছিলাম।দিলেন তো সব শেষ করে।আপনার কাজ-কর্ম দেখে আমি ক্ষণে ক্ষণে অবাক হচ্ছি।”
জারিফ ভাবলেশহীন ভাবে বলে,,”লিপিস্টিক পরা যদি তোমার বিউটি হয়।তবে তা টেস্ট করাটা আমার ডিউটি।”
লিয়া আর জারিফ দু’জনে একসাথে বাসা থেকে বের হয়।ওদের ফ্লাটটা পাঁচ তলায়।লিফটে করে নিচে নামে।নিচে নেমে বাসার সামনে মিনিট তিনেক দাঁড়িয়ে থাকতেই রিকশার দেখে মেলে। রিকশা করে লিয়াকে নামিয়ে দেয় জারিফ।লিয়া জারিফকে বাই বলে কলেজের ভেতরে চলে যায়।জারিফ রিকশাওয়ালা কে ব্যাক করতে বলে।দশটা বেজে যায় জারিফের অফিসে পৌঁছাতে।
[চলবে…ইন শা আল্লাহ]
(শব্দ সংখ্যা:২৭০০+
জারিফ লিয়ার মেয়ে বেবির জন্য একটা নাম বলেন।আমি অবশ্য একটা নাম ভেবে রেখেছি।দেখি কো-ইন্সিডেন্সলি আমার সাথে কারো মিল হয় কি-না। হ্যাপি রিডিং।ধন্যবাদ সবাইকে।)