শুধু_তোমাকেই_চাই #শারমিন_হোসেন #পর্ব৪৩

0
436

#শুধু_তোমাকেই_চাই
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব৪৩

সারাদিনের ব্যস্ততা আর যানবাহনের কোলাহলময় নগরীর পরিবেশটা।রাতের অন্ধকার শুনশান নীরবতা নিস্তব্ধতার চাদরে মুড়ে গিয়েছে। রাস্তার দুই পাশের সোডিয়ামের হালকা বাতি গুলো নিভু নিভু আলো ছড়াচ্ছে।বড় বড় দালান কোঠাতেও জ্বলছে বৈদ্যুতিক বাতি।কেউ কেউ আবার হয়তো আলো নিভিয়ে অতল নিদ্রায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে।ঘড়ির কাঁটা রাত এগারোটার ঘর ছুঁই ছুঁই। আজকের আকাশে থালার মত চাঁদ দেখা যাচ্ছে। চাঁদের রুপালি আলোতে চতুর্দিক মৃদু আলোকিত। চাঁদ কে ঘিরে আকাশের বুক চিরে অসংখ্য তারকারাজি মিটমিট করে জ্বলছে।ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দুইহাত রেলিংয়ের ওপর রেখে দাঁড়িয়ে আছে লিয়া। দৃষ্টি জ্বলজ্বল করে জ্বলে থাকা তারকারাজির দিকে।জারিফ রুমে বসে ল্যাপটপে কিছু করছে। ঘন্টা খানেক আগেই হবে ওরা বাসায় ফিরেছে।জারিফ ল্যাপটপে কিছু কাজ করতে ব্যস্ত।লিয়া রাতের সুন্দর পরিবেশটা উপভোগ করতে ব্যালকনিতে আসে।হালকা বাতাস বইছে।হালকা দক্ষিণা বাতাসে লিয়ার শাড়ির আঁচলটা মৃদু উড়ছে। বাতাসে দোল খাচ্ছে লিয়ার পিঠ জুড়ে থাকা স্লিকি স্ট্রেইট ঘন চুলগুলো।মৃদু শীতল বাতাসে লিয়ার সারা শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে যায়। এই সুন্দর শীতল পরিবেশে চাঁদনী রাতে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে লিয়ার মন্দ লাগছে না। বরং লিয়ার ভীষণ ভালো লাগছে। সুন্দর সুন্দর ফিলিংস হচ্ছে হৃদমাঝারে।

হঠাৎ-ই লিয়া মৃদু আওয়াজে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠে,,”ইয়ে রাতে ইয়ে মসম নদীকা কিনারা এ চঞ্চল হাওয়া।”

কারো পায়ের শব্দ পেয়ে লিয়া থেমে যায়। দৃষ্টি সামনের দিকে রেখেই নিশ্চুপ রয়।জারিফ লিয়ার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়।লিয়ার পেছন হয়ে দাঁড়িয়ে,লিয়ার দুই হাতের পাশ দিয়ে নিজের দুইহাত রেলিংয়ের উপর রাখে।

জারিফ নরম গলায় বলে,,”থেমে গেলে কেনো?গানটা বেশ লাগছিলো তোমার কন্ঠে।”

লিয়া জারিফের দিকে ঘুরে তাকায় না। দৃষ্টি সামনের দিকে রেখেই সুক্ষ ভাবে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়। কথার উত্তর না দিয়ে লিয়া সোজা প্রশ্ন করে বসে জারিফকে।লিয়া মিনমিনে স্বরে বলে,,”কাজ শেষ আপনার?চা বা কফি কিছু লাগবে কি?”

জারিফ লিয়ার দুইহাতের উপর নিজের দুইহাত আলতোভাবে রাখে।লিয়ার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করতে থাকে।জারিফের প্রতিটা নিঃশ্বাস লিয়া শুনতে পাচ্ছে।জারিফ লিয়ার চুলের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিতে থাকে। কিয়ৎক্ষন পরেই মাদকতা মেশানো কন্ঠস্বরে বলে,,”উঁহুম! নো চা,নো কফি।এখন এসব কিছু লাগবে না।তবে অন্যকিছু চাই আমার।এই সুন্দর রোমান্টিক ওয়েদারে আমার কি চাই?সেটা নিশ্চয় মুখ ফুটে বলতে হবে না।আমি যতটা তোমাকে চিনি-জানি।ইউ আর দ্য মোস্ট ইনটিলিজেন্ট গার্ল।আই হোপ ইউ আর রিলাইজ দ্যাট।”

লিয়া জারিফের দিকে ঘুরে তাকায়।এক ফালি রূপালি আলো ব্যালকনিতে এসে পড়ছে। রুপালি আলোতে জারিফকে দারুন মোহনীয় লাগছে।লিয়া একদৃষ্টে জারিফের মুখায়ব পানে শীতল চাহনিতে চেয়ে থাকে।জারিফ লিয়ার পাশে রেলিংয়ের সাথে এক পা ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়।দুইহাতে ট্রিশার্ট এর কলার ঠিক করে নেয়। অতঃপর লিয়াকে লজ্জায় ফেলতে এক ভ্রু নাচিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,,
“কি দেখছো?আই নো।আ’ম মোস্ট এট্রাক্টিভ বয়।এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে সেটা প্রুভ করার কিছু নেই।”

লিয়া ছোট করে শ্বাস টেনে নেয়।এক আঙ্গুলে শাড়ির আঁচলের কোণা পেচাতে পেচাতে বলে,,”মোটেও আমি আপনার দিকে তাকিয়ে নেই।তবে বলতে পারেন আমি আমার বরের দিকে তাকিয়ে আছি।আর আমার বরের দিকে শুধু ড্যাবড্যাব করে কেনো? যেকোনো নজরেই আমার তাকানোর রাইট আছে।”

জারিফ এক হাত টাউজারের পকেটে গুঁজে ঠোঁট গোল করে শিষ বাজায়। অতঃপর একহাত চুলের মধ্যে চালনা করে নির্বিকার ভাবে শান্ত গলায় বলে,,”হুম।একদম ঠিক বলেছো।আমি স্যাটিসফাইড তোমার কথায়।তবে আরো বেশি সন্তুষ্ট হতাম যদি বলতে, শুধু তাকিয়ে থাকাই নয়।আদর করার-ও তোমার রাইট আছে।উমম!বলার থেকেও আরো আরো বেশি যদি প্রাকটিক্যালি ”

লিয়ার কর্ণদ্বয় উষ্ণ হতে থাকে।লিয়ার ফর্সা মুখটা লালাভ বর্ণ ধারণ করে।জারিফকে থামিয়ে দিতে।লিয়া জারিফের কথা শেষ করতে না দিয়ে ধমকের স্বরে বলে,,”থামবেন আপনি।এই এর থেকেও বেশি বেশি বলা এবার বন্ধ করুন, প্লিজ।এসব শুনতে আ’ম নট ইন্টারেস্টড।আমার ভীষণ ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।আর দিন দিন আমাকে নিয়ে আপনার পা’গ’লামি বেড়েই যাচ্ছে।যা আপনার আগের চরিত্রের সাথে টোটালি বিপরীত।”

জারিফ একটু নড়েচড়ে ভালো করে রেলিং এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে গমগমে কন্ঠে বলে ,,”ভালোবাসায় পা’গল হয়ে যাওয়া নরমাল ব্যাপার।তবে সেই একই মানুষটার জন্য পা’গল হয়ে থাকা স্পেশাল ব্যাপার স্যাপার।আর আগে তো তুমি আমার বউ ছিলে না।সবাই কে সাক্ষী রেখে বিয়ে করা বউ তুমি আমার।তাই আগের সাথে এখনকার চরিত্রের ডিফারেন্স তো একশো আশি ডিগ্রি হবেই।”
কিয়ৎক্ষন থেমে লম্বা শ্বাস টেনে নেয় জারিফ।লিয়ার চোখে চোখ রেখে স্লো ভয়েজে বলে,,”সুন্দর একটা রাত, আকাশের বুকে হিরের মতো জ্বলতে থাকা তারকারাজি, এই ভরা পূর্ণিমা,এই মৃদু শীতল বাতাস সব কিছুই আমাদেরকে ভালোবাসার স্রোতে ভেসে যেতে ইন্সপায়ার করছে।আজকের পৃথিবীটা শুধু তোমার আর আমার।এই সুন্দর উপভোগ্য ওয়েদারটা আমাকে বারংবার এই কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।এখন এটলিস্ট ঘুম ঘুম বলো না, প্লিজ।”

লিয়া জারিফের কাঁধে মাথাটা এলিয়ে দেয়।জারিফ এক হাতে জড়িয়ে নেয় লিয়াকে।জারিফের কাঁধে মাথা রেখে লিয়া বলে,,”শুধু শুধু ওয়েদারকে দোষারোপ করবেন না।একদম অন্যকিছুকে দায়ী করবেন না।ওয়েদার নয় বলুন আপনার মধ্যে থাকা দুষ্টু সত্ত্বা আপনাকে খুঁচিয়ে যাচ্ছে।আ’ম আই রাইট? মিস্টার আয়মান জারিফ।”

জারিফ মুচকি হেসে বলে,,”ইউ রঙ না রাইট চলো প্রুভ করছি। প্রাকটিক্যালি।”

কয়েকদিন পর,,,,
আজ সারাদিন রাজিয়া সুলতানা ব্যস্ত।দিনের বেশি সময়ই কিচেনে কাটছে।বিয়ের পর আজকে প্রথম মেয়ে -জামাই বাসায় আসছে।মেয়ে জামাইয়ের ফেবরিট খাবার রাঁধতে ব্যস্ত।এই রান্না করছেন আর ঘড়ির কাঁটায় সময় গুনছেন।বিকেলের দিকে লিয়া আর জারিফের আসার কথা।ঘড়ির কাঁটা বিকেল চারটার ঘর ছুঁইয়েছে।এইতো কিছুক্ষণ আগে লিয়া ফোন করে বলেছে।রেডি হয়ে বেরোবে। এরমধ্যে কলিং বেলের শব্দ শুনে রাহবার দরজা খুলে দেয়।দরজা খুলে লিয়াকে দেখে রাহবারের চোখ মুখ খুশিতে চকচক করে।রাহবার একগাল হেসে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,,”আ্যই আপু।কেমন আছিস তুই?ভাইয়াকে দেখছি না।ভাইয়া কই?ভাইয়া আসেনি না-কি?তুই একাই আসছিস আপু?”

লিয়া একহাতে রাহবারের চুলগুলো এলোমেলো করে হাস্যজ্বল মুখে বলে,,”এই ভাই একটু আস্তে আস্তে প্রশ্ন কর। আমি মাত্রই আসছি।এখনো বাসায় ঢুকিনি।এমন না যে,আমি চলে যাচ্ছি। সেইজন্য তোকে ফটফট দ্রুত স্পিডে ফাস্ট একসাথে একই প্রশ্ন করতে হবে। আশ্চর্য!আর তোর প্রশ্নের আনসার দিতে হবে না।দুই সেকেন্ড ওয়েট কর তাই আনসার পেয়ে যাবি।”

লিয়ার কথাটা শেষ হতে না হতেই রাহবার জারিফ কে লিয়ার পেছনে দেখতে পায়।জারিফের দুইহাত ভর্তি ফলমূল আর মিষ্টির প্যাকেটে ।জারিফকে দেখে রাহবার সালাম দেয়।সালামের উত্তর দিয়ে জারিফ রাহবার কে বলে,,”কি খবর রাহবার?কেমন আছো তুমি?পড়াশোনা কেমন চলছে?”

রাহবার জবাবে বলে,,”আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন স্যার না মানে ভাইয়া।”

রাহবারের সম্মোধন শুনে লিয়া ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসে।জারিফ স্মিত হেসে বলে,,”আলহামদুলিল্লাহ।আমিও ভালো আছি।”

লিয়া ভেতরে যেতে যেতে বলে,,”এই তোমরা বাইরে দাঁড়িয়েই থাকবে না-কি?ভেতরে চলো।আর ভাই আম্মু কোথায়? আব্বু বাসায় আছে কি?”

“আম্মু কিচেনে। রান্না করছে হয়ত। আব্বু বাসায় নেই। অফিসে আছে।রাতে আসবে হয়তো।”

লিয়ারা চলে এসেছে বুঝতে পেরেছেন রাজিয়া সুলতানা। রাহবার এর সাথে বলা লিয়ার কথাগুলো শুনে শিয়র হন লিয়া এসেছে।তাই তো ফট করে বেসিন থেকে হাত ধুয়ে নেন।তোয়ালে দিয়ে হাত মুছছেন।এমন সময় কিচেনে লিয়া আসে।লিয়া কিচেনে এসে ওর আম্মু কে দেখেই জড়িয়ে ধরে।মা মানেই পরম শান্তি।মা মানেই এক আকাশ সমান ভালোলাগা।মা মানেই সকল দুশ্চিন্তা মুক্ত হওয়া।মায়ের কাছেই সন্তানরা নিজেকে সব সময় ছোটো মনে করে।আর মায়ের কাছেই সন্তানরা সব সময় ছোটই থেকে যায়।মায়ের আদর স্নেহ কখনো বয়স মানে না।

রাজিয়া সুলতানা একহাত লিয়ার পিঠে বুলিয়ে বলেন,,”আজকে সকাল থেকে আমি পথ চেয়ে আছি।ভাবছি কখন আসবে আমার ছোট্ট পাগলি মেয়েটা।অনেকদিন হলো সরাসরি দেখা হয়না আমার আদরের মেয়ের সাথে।আমার কলিজার টুকরো কে কখন দেখতে পাবো।এইভেবে আমার মনটা হাঁসফাঁস করছিলো।আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?”

লিয়া রাজিয়া সুলতানাকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে ম্লান গলায় বলে,,”নাহ্।সমস্যা হয়নি।তোমাদের সবার কথা খুব করে মনে পড়ে। তোমাদের সবাইকে এত্ত এত্ত মিস করেছি। হুটহাট তোমার কথা, আব্বুর কথা, রাহবারের কথা মনে হতেই প্রচন্ড মন খা’রাপ হতো।”

রাজিয়া সুলতানা ধরে আসা গলায় বলেন,,”দেখবি সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রথম প্রথম এরকম একটু আধটু হয়। সময় গেলে নিজের সংসারের প্রতি টান ভালোবাসা বাড়তে থাকে।আর তখন আপনা আপনি এরকম মন খা’রাপও কমে যায়।আমিও তো তোর মতো এই সময়টা পেরিয়ে এসেছি।আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই তোকে বলছি।”

কিয়ৎক্ষন থেমে।রাজিয়া সুলতানা নাক টেনে নিয়ে ঠোঁট আওড়িয়ে বলেন,,”জারিফকে বসতে দিয়েছিস? আচ্ছা পরে কথা বলি।আগে ফ্রেশ হয়ে আয় কেমন। ততক্ষণে আমি নাস্তা রেডি করছি। জারিফকে নাস্তা দিতে হবে।”

লিয়া রাজিয়া সুলতানাকে ছেড়ে দুই হাত কোমড়ে দিয়ে আশে পাশে চোখ বুলিয়ে নেয়।তারপর এক এক করে ঢাকনা খুলে খাবার গুলো দেখে কপাল কুঁচকে বলে,,”এতো আয়োজন করার কি দরকার ছিলো আম্মু?কই আগে আমি যখন তিনমাস,চারমাস পর ক্যাডেট থেকে বাসায় ফিরতাম।তখন-ও তো একসাথে এতো পদ রাঁধতে না।আর এই মাত্র দুই সপ্তাহ খানেক হবে।দুই সপ্তাহ পর বাসায় আসছি তাই এতো পদ।ব্যাপারটা কি আম্মু? উঁমম!এবার বুঝতে পেরেছি।এবার জামাইয়ের জন্য এতো রান্না করেছো।ঠিক বলেছি না। তারমানে এই দাঁড়ালো নিজের মেয়ের থেকে জামাই-ই বড়।দিস ইজ ভেরি ব্যাড।”

রাজিয়া সুলতানা মেকি চোখ রাঙিয়ে ঠোঁট প্রসারিত করে বলেন,,”আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র জামাই। শ্বাশুড়ি হিসেবে জামাইয়ের জন্য যদি এতটুকু নাই করি।তাহলে বিষয়টা খুব বাজে হবে না।আর এখন কথা না বাড়িয়ে ফাস্ট ফ্রেশ হয়ে আয়।”

জারিফ সোফায় বসে আছে।রাহবার সিঙ্গেল সোফায় বসে।জারিফ রাহবারের সাথে পড়াশুনা নিয়ে বিভিন্ন কথা বলছে। রাহবার মনযোগ দিয়ে জারিফের প্রতিটা কথা শুনছে। এরমধ্যে রাজিয়া সুলতানা আসতেই জারিফ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়।রাজিয়া সুলতানা সালামের উত্তর দিয়ে শান্ত কন্ঠে বলেন,,”বসো বাবা। কেমন আছো?”

জারিফ অমায়িক হেসে ভদ্রভাবে বলে,,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।”

রাজিয়া সুলতানা নরম স্বরে বলেন,,”তোমার বাবা মা কেমন আছেন?ওনাদেরকে তোমার সাথে বাসায় আনতে পারতে।তোমাদের সাথেই থাকলে,বেশ ভালো হতো।”

জারিফ মাথাটা নুইয়ে বিনয়ের সহিত বলে,,”সবাই ভালো আছে।আসলে আব্বুর চাকরি এখনো কয়েক বছর আছে।আর জারারও সামনে এইচএসসি এক্সাম। আম্মু কে বলেছিলাম আমাদের সাথে থাকতে। আম্মু বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও এসে থাকতে রাজি হয়না। আম্মুর সাফ সাফ কথা মাঝে মাঝে ছেলের বাসায় এসে ঘুরে যাবে।ছেলে ছেলের বউকে দেখে যাবে।তবুও বাড়ি ছাড়া কোথাও এসে মাসের পর মাস থাকা সম্ভব নয় আম্মুর জন্য।”

আরো ভালো-মন্দ কথাবার্তা বলেন রাজিয়া সুলতানা।এরমধ্যে ট্রে হাতে লিয়া আসে। ট্রেটা সামনের টেবিলের উপর নামিয়ে রাখে।রাজিয়া সুলতানা হাসি মুখে বলেন,,”তোমরা নাস্তা করো।”

কথাটা শেষ করে রাজিয়া সুলতানা ওখান থেকে প্রস্থান করেন। ট্রেতে তেলে ভাজা কয়েক রকমের পিঠা রয়েছে।লিয়া একটা পিঠা হাতে তুলে নেয়।পিঠাটা মুখে পুরে চিবুতে চিবুতেই বলে,,”আপনার শ্বাশুড়ি আম্মার হাতে বানানো পিঠা। টেস্ট করুন।এই ভাই তুই বসে আছিস যে।তুই-ও কি বাড়ির গেস্ট না-কি যে, ইনভাইটেশন কার্ড দিয়ে খাওয়ার কথা বলতে হবে।”

রাহবার চোখ মুখ কুঁচকে বলে,,”আপু গেস্ট যদি হতে হয় তবে আমি নয়।তুই এ বাসার গেস্ট, বুঝলি?এই ধর যেমন কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে আসছিস। অতিথিদের মতো দিনক্ষণ বাঁধা তোর।আর আমার বেলায় দেখ।নো দিনক্ষণ।এবার বুঝতে পারলি কে গেস্ট?আমি না তুই?”

যদিও কথাগুলো রাহবার মজার ছলে বলেছে। তবুও বিয়ের পর একটা মেয়ের জন্য রাহবারের বলা কথাগুলো একদম বাস্তব। কথাগুলো যুক্তিযত।বিয়ের পর একটা মেয়ের বাবার বাড়ি আসা যেনো অতিথির ন্যায়। কথাগুলো নিজ মনে মনেই ভেবে মাথা ঝাড়ল লিয়া। অতঃপর জারিফের দিকে তাকিয়ে পিঠা খেতে ইশারা করলো।জারিফ সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে,,”রেখে দাও পরে খাবো।এখন কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।”

লিয়া ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। পাঁচ সেকেন্ড পর ট্রে থেকে ছোট্ট একটা বোল হাতে তুলে নেয়। বোলটা জারিফের সামনে ধরে বলে,,”আপনার শ্বাশুড়ির হাতে তৈরি মিষ্টি জর্দা।আমার ফেবরিট একটা খাবার এটা।না খেলে একদম মিস করবেন।তাই বলছি মিষ্টি জর্দা টা অন্তত খান।আর পুরোনো স্মৃতিচারণ করুন।”

এরমধ্যে রাহবার খাবার মুখে পুরে উঠে রুমে চলে যায়।জারিফ বোলটা হাতে নেয়।তারপর আড়চোখে লিয়ার দিকে তাকায়।আজ থেকে চার বছর আগের পুরোনো স্মৃতিগুলো জারিফের মন মস্তিষ্কে দৃশ্যপট হতে থাকে।জারিফ এক চামুচ মুখে দেয়। চিবুতে চিবুতে বলে,,
“টেস্ট টা মনে না থাকলেও স্মৃতিগুলো মনে আছে।আমার মেমোরিতে জমা হয়ে আছে।জমা হয়ে আছে তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি মূহুর্ত।তোমাকে পড়াতে আসার ফাস্ট ডে তে নাস্তা হিসেবে মিষ্টি জর্দা দেওয়া হয়েছিলো।”

লিয়া চামুচ করে মুখে দিতে দিতে বলে,,”আচ্ছা এতই যখন আপনার মেমোরি সার্ভ।তাই বলছি প্রথম দিনের অনুভূতির কথা শেয়ার করুন।”

জারিফ নির্বিকার ভঙ্গিতে সোজাসুজি স্পষ্টভাবে বলে,,”প্রথমে তোমার দাদিমনি পরে তুমি।দুজনেরই ইনন্টেশন ছিলো আমাকে অস্বস্তিতে ফেলতে।ঠিক বলেছিনা?”

লিয়া দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,,”উহুম!ঠিক হয়নি।দাদিমনি আপনাকে পরখ করতে ছিলেন। আপনার ক্যারেক্টার কেমন হবে।এসব হাবিজাবি।আর অন্যদিকে আমার ফাস্ট এন্ড লাস্ট ইনন্টেশন ছিলো,আই ওয়ান্ট অনলি ইউ।তবে কি জানেন,দাদিমনির গোয়েন্দা গিরি করাটা ভুল ছিলো।আপনাকে ঠিক চিনতে পারেননি। আপনি সম্পর্কে যেমনটা ভদ্র -সভ্য,ভালো চরিত্রের ছেলে ট্যাগ আমার দাদিমনি লাগিয়ে ছিলেন।এসব ট্যাগের উল্টো আপনি।”

জারিফ কপাল কুঁচকে বলে,,”হোয়াট? বুঝলাম না। ক্লিয়ার করে বলো।”

লিয়া আয়েশ করে বসে বলতে থাকে,,”এই যেমন ধরেন। যেসব ছেলে-মেয়েরা প্রেমে টেমে সহজে পড়ে না। তাদের ট্যাগ ভদ্র -সভ্য ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আপনি কি করলেন?ঠিকই ছিলিপ কে’টে পড়ে গেলেন।আমার প্রেমে।”

“তাহলে তোমার প্রেমে না পড়লেই ভালো হতো বুঝি।এখন তো তাই-ই মনে হচ্ছে।এখন ইচ্ছে হচ্ছে টাইম মেশিন থাকলে, চার বছর পূর্বে ফিরে যেতাম।আর তোমার মাঝে মন ভাসাতাম না।”

লিয়া দাঁত কটমট করে বলে,,”আমি তো জাস্ট ফান করে বলছিলাম।আর আপনি বিষয়টা সিরিয়াসলি নিয়ে,এসব ভেবে চলছেন।”

জারিফ ভাবলেশহীন ভাবে বলে,,”আমি কি একবারো বলেছি যে,আমি সিরিয়াসলি বলছি।আ’ম জোকিং।”

কয়েক চামুচ খেয়ে বোলটা জারিফ টেবিলের উপর রাখে ।এক গ্লাস পানি নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নেয়। গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে বলে,,”লিয়া আমি এখন আসছি।”

কথাটা শুনে লিয়ার কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ে।লিয়া কপাল কুঁচকে বলে,,”আসছি মানে?কোথায় যাবেন এখন?”

জারিফ উত্তরে বলে,,”অনেকদিন পর আসছো।সবার সাথে নিজের মতো করে সময় কাটাও।কালকে এসে আমি নিয়ে যাবো।”

লিয়া কথার বিরোধিতা করে বলে,,”কালকে নিয়ে যাবেন?হাউ পসিবেল।আমি তো অন্তত পক্ষে এক সপ্তাহ থাকার প্লান করে এসেছি।”

জারিফ উঠে দাঁড়িয়ে মুখ টানটান করে বলে,,”আমি এখন আসছি।আর তোমার প্লানের কথা পরে ভেবে দেখবো।”

লিয়া উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে বলে,,”সত্যি এখন বাসায় ফিরে যাবেন।আজকে অন্তত থাকতে পারতেন। আব্বুর সাথে দেখা হলো না তো আপনার।”

জারিফ মুচকি হেসে শান্ত গলায় বলে,,”ওকে।আজকে থাকবো।তবে এখন একটু আসছি।রাতে ফিরবো।এখন সাত মাথায় যেতে হবে।কাজ আছে।”

লিয়া ঠোঁট উল্টে বলে,,”কাজ না কি।আমি ঠিক জানি। ক্লাবে গিয়ে আড্ডা দিবেন।এই টেবিল টেনিস।তো ক্যারাম হাবিজাবি খেলবেন।”

লিয়া দরজাটা খুলে দেয়।জারিফ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে বলে,,”তোমাকে স্পেস দিলাম।পরিবারের সবার সাথে সময় কাটানোর জন্য।আমার আসতে আসতে হয়তো রাত নয়টা বেজে যেতে পারে।বায়।”

লিয়া দরজাটা বন্ধ করে ভেতরে চলে আসে।রাজিয়া সুলতানা রুম থেকে বের হয়ে কপাল কুঁচকে বলে,,”লিয়া জারিফকে দেখছি না।”

লিয়া ঠোঁট মেলে বলে,,”চলে গিয়েছে তো।”

রাজিয়া সুলতানা অবাক গলায় বলেন,,”চলে গিয়েছে।তোর আব্বু এখনো আসলো না।তোর আব্বুর সাথে দেখা না করেই। খাবার না খেয়েই চলে গিয়েছে।কোনো সমস্যা হয়েছে কি?”

“ওহ্ আম্মু।আমার পুরো কথাটা তো শুনবে।আর তুমি যেরকম ভাবছো।সেরকম কিছুই না।এখন একটু ঘুরতে গিয়েছে। রাতে আসবে বলেছে। আব্বুর সাথে দেখা করার জন্য জিগ্গেস করলো, আব্বু কখন আসবে। রাহবার তো বললো রাত হয়ে যাবে আব্বুর আসতে।”

রাজিয়া সুলতানা ছোটো করে বলেন,,”ওহ্।”

প্রায় তিন মাস পর,,,
পড়ন্ত বিকেল।বিকেলের নরম রোদটা ব্যালকনিতে পড়ছে।ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে লিয়া মিষ্টি মিষ্টি রোদটা উপভোগ করছে। হঠাৎ মন মস্তিষ্কে কিছু স্মরণ হতেই।লিয়া রুমে চলে আসে।রুমে এসে ব্যাগ থেকে কিছু বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে।জারিফ দুপুরে লাঞ্চ করে অফিসে গিয়েছে আবার।বিকেলের দিকেই জারিফের আসার কথা।রুমে একা একা ভালো লাগছিলো না বিধায় ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে জারিফের পথ চেয়ে অপেক্ষা করতে থাকে লিয়া।আর মনে মনে ভাবে,জারিফকে আগেই বলবে? না-কি শিওর হয়ে নেবে।কিছুক্ষণ দোটানায় থেকে দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটিকে প্রায়োরিটি দেয় লিয়া।

লিয়া ওয়াশরুম থেকে বের হয়।লিয়ার বাম হাতের মুঠোয় কিছু একটা আছে।হাতের মুঠোটা শক্ত করে ধরে খুশিতে লিয়ার দুইচোখ চিকচিক করতে থাকে। প্রথমে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে।লিয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পরখ করতে থাকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখতে থাকে।লিয়া খুঁজতে থাকে নিজের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসছে কিনা।খুশিতে লিয়া দুই হাত মেলে ঘুরতে থাকে।জারিফের কাছে লক খোলার এক্সট্রা চাবি থাকে।জারিফ সেই চাবি দিয়ে লকড খুলে ভেতরে আসতে থাকে।জারিফের পরনে সাদা শার্ট,সাদা প্যান্ট আর হাতে কালো ব্লেজার।জারিফ রুমে এসে লিয়ার ঘোরা দেখে অবাক চোখে চেয়ে থাকে। কিয়ৎক্ষন পরেই হালকা কেশে বলে,,
“কি ব্যাপার লিয়া।তোমাকে হঠাৎ এত খুশি দেখাচ্ছে।ব্যাপার স্যাপার কি?একাই নাচছো যে।আবার নিশ্চয় বাড়ি যাওয়ার প্লান করেছো।বাড়িতে যাওয়ার সময়ই তো তুমি এতটা উৎফুল্ল থাকো।”

জারিফের কথা শুনে লিয়া থেমে যায়।ঘোরার ফলে সব কিছু লিয়ার কাছে ঘুরতে থাকে।লিয়া দুইহাতে মাথা চেপে ধরে।ব্যালেন্স সামলাতে না পেরে পরে যেতে নিলে জারিফ লিয়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে।লিয়া জারিফের বুকে মাথা রেখে।ঘনঘন বার কয়েক জোড়ে শ্বাস টেনে নেয়।জারিফ কপাল কুঁচকে বলে,,”ঠিক আছো তুমি।খুশির কারনটা বললে না যে।বাড়ি যাওয়া যদি হয় তোমার খুশির কারন তাহলে না বলাই ভালো।কারন তোমার বাড়ি যাওয়ার কথা শুনলে মন খা’রাপেরা আমাকে ছেয়ে ধরে।”

লিয়া মাথাটা তুলে জারিফের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,,”আপনার জন্যও খুশির খবর আছে। সারপ্রাইজ আছে আপনার জন্য।আমি জানি আমার থেকেও আপনি বেশি খুশি হবেন।”

জারিফ বাম ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় বোঝায়,,”স্পষ্ট করে বলো।”

লিয়া লাজুক হাসে।অনেক কথাই জমে আছে লিয়ার পেটে।তবে কথাগুলো যেনো কন্ঠ নালী দিয়ে বেরুতো চাচ্ছে না। লজ্জায় লিয়ার গলা ভার হয়ে আসছে।লিয়া একহাত দিয়ে জারিফের একটা হাত ধরে। অতঃপর জারিফের ধরা হাতটা নিজের পেটের উপর রাখে।

[চলবে…ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here