দোলনচাঁপার_সুবাস #পর্বঃ২৮ #লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

0
352

#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ২৮
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

পারভীন বেগম দরজা খুলতেই বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলেন। উনার সামনে লম্বা-চওড়া সুঠামদেহী নিশীথকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। মূলত এর আগে কখনো ওকে না দেখায় পারভীন বেগম এভাবে তাকিয়ে থাকলেন। কালো লেদারের জ্যাকেট, নেভিব্লু ডেনিম, হাতে ব্রা’ন্ডেড ঘড়ি- সবমিলিয়ে ছেলেটার আপাদমস্তক পুরোটাতেই আভিজাত্যের ছাপ! এক দেখাতেই বুঝা যায় কোনো বড়ঘরের সন্তান। এরই মাঝে নিশীথ সালাম দিলো। পারভীন বেগম নিজ ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলেন। সালামের উত্তর দিতেই নিশীথ বললো,

—আন্টি, এটা কি শিমুলদের বাসা? আমি যদি ভুল না হই তবে এটাই হওয়ার কথা!

—হ্যাঁ, বাবা। এটাই শিমুলদের বাসা। আমি ওর মা। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম এতক্ষণ! বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো না, ভেতরে এসো!

নিশীথ ধীরেসুস্থে উনার পেছন পেছন বাড়িতে ঢুকে। চোখ আশেপাশে ঘুরাতেই কাংক্ষিত মানুষকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পায়। দুই ভাইবোনের পিছে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দোলা। যেন ওকে দেখে লজ্জা পাচ্ছে সেভাবে লুকিয়ে আছে! ওর কর্মকাণ্ডের আগাগোড়া নিশীথ খুঁজে পায়না। ও এগিয়ে এসে শিমুলের সাথে কথা বলে। শিমুল হাসিমুখে একেরপর এক কথার ঝুড়ি মেলে বসেছে ওর সাথে। একেতো শুরু থেকেই শিমুল নিশীথকে অনেক পছন্দ করতো, তার মধ্যে যবে থেকে জেনেছে ওর বোনের উপকার করার কথা, তখন থেকে আর দশটা ভাইয়ের মতো সে-ও শ্রদ্ধায় চোখে হারায় নিশীথকে। এদিকে কামিনি কিছুক্ষণ অবাক চোখে চেয়ে থাকে। বলাবাহুল্য, একই এলাকায় এতদিন থাকলেও এর আগে কখনো নিশীথকে সরাসরি দেখেনি ও। শুধু শিমুলের মুখে এর আগে নাম শুনেছিলো, পরে সেদিন দোলার কাছে গল্প শুনলো। তাই আজ সরাসরি দেখে ওর চোখেমুখে নিশীথের প্রতি মুগ্ধতা স্পষ্ট! মায়ের গলা খ্যাকারিতে কামিনির ধ্যান ফিরে এলো। পারভীন বেগম নিশীথের উদ্দেশ্যে বললেন,

—এসো বাবা, টেবিলে বসো। খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, খেতে ভালো লাগবেনা!

শিমুল বেসিন কোথায় দেখিয়ে দেয়। নিশীথ আর কথা না বাড়িয়ে হাত ধুতে যায়। যেতে যেতে পাশ ফিরে সবার আড়ালে দোলার দিক চেয়ে চোখ টিপ দেয়। দোলা এতক্ষণ ওকেই দেখছিলো, আচমকা চোখে চোখ পড়ায় দৃষ্টি সরিয়ে নিতেও পারেনি। তার আগেই নিশীথ দুষ্টুমি করলো! মেয়েটা ভড়কায়। চমকে উঠে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ দেখলো কিনা! নাহ, কেউ কিছু দেখেনি। বরং, নিশীথ তো চোখ টিপ দিয়েই গায়েব হয়ে গেছে। ওর দিকে আর তাকাচ্ছেনা অব্দি! এতক্ষণে ভদ্র ছেলের ন্যায় টেবিলে বসে দোলার মায়ের সাথে হাসিমুখে কথা বলছে, যেন এ জগতে ওর মতোন সরল ছেলে আর দুটো নেই! দোলা একা একাই মুখ ভেংচায়। সবটাই ওর মা-কে পটানোর ধান্ধা বুঝতে বাকি রয়না!

—ব্যস! আন্টি, আর দিয়েন না। দুপুরে এত বেশি খেতে আমি অভ্যস্ত নই!

নিশীথ মানা করে পারভীন বেগমকে যিনি আপাতত ওর পাতে দুটো ইলিশের টুকরো তুলে দিয়েছেন। উনি যেন নিশীথের কথা শুনলেন না সেভাবেই ওর পাতে বেগুনভাজা ও কাবাব তুলে দিয়ে বললেন,

—মেহমানদের কম খেতে নেই। যদিও খুব বেশি রান্না করতে পারিনি, একা মানুষ আর কতই করবো?

—কেন, আন্টি? এত বড় দুই মেয়ে থাকতে একা কাজ করবেন কেন? ওরা নিশ্চয়ই হেল্প করে?

আড়চোখে দোলার দিক চেয়ে খেতে খেতে নিশীথ প্রশ্ন করলো। পারভীন বেগম আর দশটা বাঙালি মায়ের মতোন বললেন,

—কি আর হেল্প করবে? ওদের হেল্প করতে আসতে আসতে আমার সব কাজ শেষ হয়ে যায়! বড়টা তাও একটু করে, মেজোটা তো না-ই বলি!

নিশীথের সামনে এভাবে বলায় কামিনি চটে যায় মায়ের উপর। চোখমুখ পাকিয়ে চেয়ে রয় মায়ের দিকে। দোলা পানি খেতে খেতে এসব দেখছিলো। কিন্তু, পারভীন বেগম ওদেরকে কোনোপ্রকার পাত্তা না দিয়ে বলতে থাকেন,

—তোমাকে তো খাতিরযত্ন করতেই হবে, বাবা। আমার মেয়েকে যে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছো, আমরা তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ! আল্লাহ তোমার সকল ইচ্ছে পূরণ করুক!

—আমার ইচ্ছে তো আপনিই পূরণ করতে পারবেন, আন্টি।

নিশীথ এর কথার মর্ম অন্য কেউ না বুঝলেও দোলার বুঝতে ভুল হলোনা। আর তখনি, ওর গলায় পানি আটকে গেলো! খুক খুক করে কেশে উঠলো মেয়েটা! কামিনি পাশ থেকে বোনের পিঠ চাপড়ে দিলো। নিশীথ অগোচরে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো!

—আস্তে খা না, দোলন। এত তাড়াহুড়ো করে খাওয়ার কি আছে? নিজের বাসাতেই আছিস!

মায়ের ধমকে দোলা খানিকবাদে শান্ত হতেই পারভীন বেগম ওর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিশীথের দিকে তাকালেন। প্রশ্ন করলেন,

—হ্যাঁ তখন কি যেন বলছিলে, নিশীথ? বুঝতে পারিনি তোমার কথা‌!

দোলা দুরুদুরু বুকে নিশীথের দিক তাকায়। এই বুঝি ও বলে দেয়, সে ভয়ে খাওয়া বাদে শ্বাসরোধ করে বসে থাকে। নিশীথ আড়চোখে ওর মুখভঙ্গি লক্ষ্য করে। স্বর পাল্টিয়ে পারভীন বেগমকে বলে,

—বলছিলাম যে আমাকে আর খাবার দিয়েন না, আন্টি। এই যে এতগুলো মাংস দিলেন এগুলো আগে শেষ করি। আমি আর খেতে পারবোনা সত্যি!

—আচ্ছা, আর দিচ্ছিনা আপাতত। ধীরেসুস্থেই খাও তুমি!

নিশীথ কিছু না বলায় দোলা স্বস্তির শ্বাস ফেলে নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। খানিক বাদে শিমুল আবারো পোলাও চাইলে কামিনি বলে,

—এই তুই কয়বার নিবি? তোকে না দিলাম দু’বার। এত পেটুক হলি কবে থেকে?

শিমুল কোনো জবাব দেওয়ার আগে পারভীন বেগম বললেন,

—ওর তো শুধু খাওয়াই প্রধান কাজ। পড়ালেখা চা’ঙে উঠেছে সে হিসেব কি আছে? আরে তোর বন্ধু সুহাসকে দেখে কিছু শিখলেও পারিস! কত ভালো ছেলেটা। সবসময় টপ করে। আর নিজেকে দেখ, টপ টেনেও আসতে পারিস না তুই!

—থাক না, আন্টি। একটু খেতেই তো চাইছে ছেলেটা। বকা দিয়েন না ওকে!

শিমুলের কাদো কাদো মুখ দেখে নিশীথ ওর হয়ে কথা বলে। শিমুল প্রায় কেদে দিবে সেভাবেই বলে উঠলো,

—আমি ম্যাথে একটু কাচা। ওর জন্যই রেজাল্টে বরাবর পিছিয়ে পড়ি। তবু আমি চেষ্টা তো করিই। তারপরও যদি না হয় তবে কি ওটা আমার দোষ? কেউ কি ইচ্ছে করে খারাপ রেজাল্ট করে?

—আচ্ছা, তোকে আর কেউ কিছু বলবেনা। এখন কথা না বলে চুপচাপ খা!

দোলা অবশেষে মুখ খুললো।

—আমার খিদে মিটে গেছে, দোলাপু। মা সবসময় এমন করে সবার সামনে। তোমরাই খাও!

শিমুল মনের দুঃখে টেবিল ছেড়ে উঠে হাত ধুয়ে চোখমুখ ফুলিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। দোলা উঠতে ধরলেও মায়ের ইশারায় আর গেলোনা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো চুপচাপ। মাঝখানে আর কোনো কথা হলোনা। খাওয়া শেষে কামিনি মায়ের কথামতোন উনার সাথে প্লেট নিয়ে রান্নাঘরে যেতেই দোলাও তাড়াতাড়ি করে উঠে গেলো টেবিল থেকে। নিশীথ এতক্ষণে হাত ধুয়ে এসে টেবিলে বসেই পানি খাচ্ছে। তাই সে দ্রুত বেসিনে যেয়ে হাত ধোয়া শুরু করে, এরই মাঝে এক সময় হঠাৎ আয়নায় তাকাতেই ওর পেছনে নিশীথকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয় পায়! চোখ দুটো নিজ থেকেই বড় বড় হয়ে যায়। ওদিকে নিশীথ শান্তচোখে ওর দিকে চেয়ে আছে। দোলা নিচু আওয়াজে দ্রুত বলে,

—কি করছেন, নিশীথ ভাই? সরে দাঁড়ান। কেউ এসে যাবে!

—ওহ! তুমি আমাকে চেনো? আমি তো এতক্ষণ ভাবছিলাম তোমার স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে। মায়ের সামনে আমায় চিনতে পারছিলেনা!

নিশীথের কণ্ঠে তাচ্ছিল্য। দোলা বিব্রত মুখে বলে,

—সবার সামনে আর কি কথা বলবো আপনার সাথে? এটা আমার বাসা। এলাকার মোড় বা রাস্তা নয়। তাই প্লিজ সরে দাড়ান।

নিশীথ কিছু বলেনা। তবে সামান্য সরে দাঁড়ায়। দোলা স্বস্তির শ্বাস ফেলে দ্রুত বেগে ওখান থেকে চলে যেতে নেয়। এরই মাঝে ওর মাথা হতে ওড়না পড়ে যায়৷ তখনই পেছন থেকে নিশীথের ডাক আসে,

—দোলনচাঁপা!

বরাবরের ন্যায় এই ডাক দোলা উপেক্ষা করতে পারেনা। সামান্য পাশ ফিরে আড়চোখে তাকাতেই নিশীথ নিঃশব্দে এগিয়ে আসে। ওকে এগিয়ে আসতে দেখে দোলা আবারো সরে যেতে লাগে। ঠিক এমন সময় চুলে টান পড়ায় ব্যথায়, বিস্ময়ে ওর পা নিজের জায়গায় থেমে যায়। পেছন ফিরতেই দোলা টের পেলো ওর খোপার কাটা নিশীথের হাতে, মূলত ছেলেটা ওটাই খুলে নিয়েছে মাত্র ওর চুল হতে! বিস্মিত দোলা নিজের চুলে হাত দেয়। মাথা থেকে কাপড় কখন পড়েছে সে তো টেরই পায়নি। এদিকে ওর কোমড় ছড়ানো চুলের দিক নিশীথ গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। ওর দৃষ্টিতে মুগ্ধতা থাকলেও, মেয়েটার দৃষ্টিতে ভয়। শিমুল আসবেনা ও জানে কিন্তু মা বা কামিনি কেউ যদি এখানে চলে আসে? তবে কি হবে? দোলা চোরাচোখে রান্নাঘরের দিকে উকি দিতেই নিশীথ গম্ভীর স্বরে বলে,

—এত ভয় পেয়ে লাভ কি, দোলনচাঁপা? আজ নয়তো কাল ওরা তো সব জেনেই যাবে!

লজ্জায় দোলার গাল গরম হয়ে আসে। এই ছেলেটা এমন নির্লজ্জ কেন? মনে যা থাকে মুখে বলেই দেয়! দোলা শক্তমুখে বলে,

—আ,আমি ভয় পাচ্ছিনা।

—ওহ তাই? তবে পালাচ্ছো কেন? কাছে আসো!

—ছিঃ! ধীরে বলেন! আর এসব কি বলছেন? এগুলো বাদ দিয়ে আমার কাটা ফেরত দিন! ওটা খুলে নিলেন কেন?

নিশীথ হাসলো ওর চেহারা দেখে। বোকা মেয়েটা একবার রান্নাঘরের দিক তাকাচ্ছে একবার ওর দিক। ওর চোখেমুখে স্পষ্ট ভয় অথচ স্বীকার করবেনা!
রান্নাঘর থেকে পারভীন বেগম ও কামিনির গলার শব্দ আসছে এখনো। সুতরাং, নিশীথ নিশ্চিন্তে এগিয়ে আসে দোলার দিকে। খানিকটা ঝুঁকে ধমকের সুরে বলে,

—ভেজা চুল বেধে রেখে নষ্ট করছো কেন? আর কখনো ভেজা চুল বাধবেনা। তোমাকে খোলা চুলেই মানায়।

ওর কাছে আসায় দোলার হার্টবিট দ্রুত গতিতে উঠানামা করে। নিশীথ কি তা বুঝলো? দোলা জানেনা। তবে কিছুক্ষণের মাঝেই নিশীথ সরে এলো৷ অতঃপর শিমুলের রুমের দিকে যেতে যেতে বলে,

—এই কাটা এখন আমার। এটা ফেরত পাওয়ার আশা বাদ দেও! আর শুনো, তোমার এত ভয় পেতে হবেনা। আমি আর কিছু করছিনা। আপাতত শালাবাবুকে দেখতে যাচ্ছি!

দোলা বোকার ন্যায় চেয়ে থাকে ওদিকে। শিমুলের রুমে ঢুকে নিশীথ দরজা টেনে দেয়। তা দেখে সে নিজেও রান্নাঘরে চলে আসে। এতক্ষণে বাসন-পত্র সব পরিষ্কার করে রাখা শেষ মা-মেয়ের। দোলাকে দেখে পারভীন বেগম জিজ্ঞেস করলেন,

—কিরে, তুই এখানে? নিশীথ একা কি করছে? আমি তো ভাবলাম গল্প করছিলো তোর সাথে!

মায়ের কথায় জবাব না দিয়ে দোলা বলল,

—ওনি তো শিমুলের রুমে গেছেন। ওর মন খারাপ, হয়তো চিয়ার-আপ করবেন। আমি দেখতে এলাম তোমাদের কোনো হেল্প লাগবে নাকি!

—আমাদের প্রায় শেষ, আপু..

কামিনির কথার মাঝে কলিংবেল বেজে উঠলো। তিন মা-মেয়ে অবাক হয়ে একে-অপরকে দেখতে লাগলো। কামিনি জিজ্ঞেস করলো,

—এখন আবার কে এলো? আর কাকে দাওয়াত দিয়েছো, মা?

—আর তো কাউকেই দিইনি। এ সময় কে আসতে পারে? মাথায় আসছেনা তো!

—হবে কেউ। আচ্ছা, আমি গেট খুলছি! তোমরা হাত মুছে আসো।

মা-বোনের উদ্দেশ্যে বলে দোলা গেটের দিকে অগ্রসর হয়। যদি ও জানতো ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here