#শুধু_তোমাকেই_চাই
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব৪৪ (প্রথম অংশ)
জারিফের দুই ভ্রুয়ের মাঝে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ে। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবতে থাকে।লিয়া একচুয়েলি কি বোঝাতে চাইছে জারিফের বোধগম্য হলো না।জারিফের মন মস্তিষ্ক জুড়ে একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে।হোয়াট ফর সারপ্রাইজ?জারিফের ক্লান্ত মস্তিষ্ক বিষয়টা বুঝতে ব্যর্থ হয়।লিয়া জারিফের মুখের এক্সপ্রেশন দেখে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে।দুই সেকেন্ড খানেক পড়ে লিয়া মুঠো পাকিয়ে রাখা বাম হাতটা জারিফের সামনে ধরে। অতঃপর ধীরে ধীরে মুঠ-টা মেলে ধরে।লিয়ার ধবধবে সাদা হাতের তালুতে এক নজর তাকাতেই জারিফ বিস্মিত হয়।জারিফ বারকয়েক চোখের পলক ফেলে। বিস্ময়কর চাহনিতে চেয়ে থাকে।লিয়ার হাতে প্রেগনেন্সি কিট।যেখানে পরপর দুইটা গোলাপী দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।পরপর দুইটা গোলাপী দাগ যা বার্তা দিচ্ছে প্রেগনেন্সি টেস্ট পজেটিভ। মূহুর্তের মধ্যেই জারিফের চোখে মুখে পরম শান্তিময়, আনন্দের হাসির রেখা ফুটে উঠে।
জারিফ লিয়াকে জড়িয়ে ধরে আনন্দিত কন্ঠে বলে,,”আ’ম সো হ্যাপি লিয়া। অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।সুখবর বয়ে আনার জন্য। শুধু ধন্যবাদ নয়,অনেক বেশি ভালোবাসা আমার বেবির মাম্মামের জন্য।আমার নিজেকে এতো এতো হ্যাপিয়েস্ট ম্যান মনে হচ্ছে।যা তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না।নতুন দায়িত্ব আসতে যাচ্ছে আমার উপর।নাউ আ’ম সো এক্সাইটেড লিয়া।আমি বাবা হবো।কেউ আমাকে আধো আধো গলায় বাবা বলে ডাকবে।আর তোমাকে মাম্মাম। ইটস্ ইমাজিন।এটা ভাবতেই আমার মনে পাহাড়সম শান্তির অনুভূতি হচ্ছে। অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি মহান রবের প্রতি। আলহামদুলিল্লাহ।এত সুন্দর একটা গুড নিউজ দিয়ে মনটা ভালো করার জন্য থেংকিউ। থেংকিউ ভেরি ম্যাচ লিয়া।”
লিয়া নিঃশব্দে হাসে। কিয়ৎক্ষন পরে ঠোঁট মেলে বলে,,”হয়েছে হয়েছে।এবার একটু কুল হোন।এত এক্সাইটেড হওয়ার কিছু নেই। আপনার-আমার মানে আমাদের স্বপ্নগুলো পূরণ হতে আরো অনেক স্টেপ বাকি আছে।”
জারিফ লিয়াকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।কিছু মনে হতেই মুখ টানটান করে গম্ভীর কন্ঠে বলে,,”বাই দ্যা ওয়ে।লিয়া তুমি প্রেগন্যান্সি টেস্টের কিট কোথায় পেলে?না মানে কখন এটা নিয়েছো?আর আগে থেকেই কি তুমি গেইজ করেছিলে বা জানতে?আমাকে তো বলোনি কিছুই এ ব্যাপারে।”
লিয়া দুই হাত জারিফের শার্টের কলারের পাশে রাখে।টাইটা প্রথমে খোলে।তারপর শার্টের বোতাম গুলো খুলতে থাকে। জবাবে লিয়া শান্ত স্বরে বলে,,”কলেজ থেকে ফেরার সময় ফার্মেসী শপে গিয়েছিলাম।আর আজ প্রায় পনের দিনের মতো হবে পিরিয়ড মিস গিয়েছে। সেইজন্য কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম।বাট শিওর ছিলাম না। ভাবলাম আগে শিওর হয়ে নেই।তারপর নাহয় আপনাকে জানাই।আর পজেটিভ না হয়ে নেগেটিভ হলে তো আপনি মন খা’রাপ করতেন নিশ্চয়।তাই শিওর না হয়ে জানাতে আমার মনটা কেনো জানি সায় দিলো না।তবে আপনি আবার এরজন্য আমার উপর রা’গ টাগ করে বসেননি তো?”
জারিফ ঠোঁটে বিস্তৃত হাঁসি রেখে জবাবে বলে,,”উঁহুম!এমন একটা নিউজ তুমি দিলে আমায়। এরপরেও কি তোমার উপর রা’গ করে থাকা যায় ।আমার পক্ষে তো সম্ভব নয়।একদম ইম্পসিবল। তোমাকে তো এখন থেকে আরো বেশি বেশি আদর করতে হবে।তোমার জন্য এক্সট্রা কেয়ার নিতে হবে।আর এই ফাস্ট টাইম বাবা হচ্ছি তো।তাই কোনো অভিজ্ঞতা নেই।কিভাবে কিকরে তোমার কেয়ার করতে হবে।তুমি শুধু মুখ ফুটে বলবে।তোমার কখন কি চাই।সাথে সাথেই ”
জারিফকে থামিয়ে দিয়ে লিয়া দৃষ্টি সরু করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,,”এই ওয়েট ওয়েট।কি বললেন যেনো।এই ফাস্ট টাইম বাবা হচ্ছেন। আপনার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আপনার কথাটা শুনে তো আমার দমফাটানো হাসি পাচ্ছে।তবে শুধু হাসি নয়।সাথে রা’গ-ও পাচ্ছে বটে। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমার বোধহয় এসব ব্যাপারে খুব অভিজ্ঞতা আছে।এর আগে আমি যেনো আরো পাঁচ – দশটা বাচ্চার জন্ম দিয়েছি। অদ্ভুত কথাবার্তা আপনার।”
জারিফের হাতে থাকা কালো ব্লেজার টা লিয়ার হাতে ধরিয়ে দেয়।লিয়ার দুই কাঁধের উপর নিজের দুই হাত রাখে।লিয়ার কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে ভরাট গলায় বলে,,
“এসব কি বলছো তুমি?তুমি যদি পাঁচ দশটা বাচ্চার জন্ম দিতে।তাহলে তো আমি অলরেডি বাবা হয়ে যেতাম সেই পাঁচ দশটা বাচ্চার।কারন অন্যকারো বাচ্চার মা হওয়ার অধিকার তোমার ছিলো না কোনো কালেই।।কারন তুমি তো শুধু আমার।আমার বাচ্চা কাচ্চাদের কে পৃথিবীতে আসার জন্য তোমাকেই চাই।আমার বেবির মাম্মাম হিসেবে আমার শুধু তোমাকেই চাই।”
লিয়া ঠোঁট প্রসারিত করে বলে,,”লাইফে কখনো কি ভেবেছিলেন আমার মতো একটা মেয়ের প্রেমে পড়বেন আপনি?বেটার হাফ হিসেবে এমন একটা স্পষ্টভাষী, চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে পাবেন। কল্পনা করেছিলেন কি কখনো?”
জারিফ লিয়ার কপালে আলতোভাবে ঠোঁট ছোঁয়ায়।নরম স্বরে বলে,,”তুমি যেমনই হও।আমার কাছে তুমিই সেরার সেরা।আমি তোমাকেই ভালোবাসি।তুমি হয়তো জানোনা। প্রতিটা মুহূর্তে যার কথা মনে পড়ে,যার ছবি হৃদয়ে ভাসতেই সুখ অনুভব হয়।সেই মানুষটা আর অন্যকেউ নয়।সেই মানুষটা তুমি। শুধু তুমি।আর আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি বেটার হাফ হিসেবে তোমাকে পেয়ে।”
লিয়া জারিফের কথা শুনে মনে মনে ভীষণ সন্তুষ্ট হয়।লিয়া মৃদুস্বরে ঠোঁট আওড়িয়ে বলে,,”ফ্রেশ হয়ে নিন। ততক্ষণে আমি কফি বানিয়ে আনছি।”
“ওকে “বলে জারিফ ওয়াশরুমে ঢুকে।লিয়া হাতে থাকা জারিফের ব্লেজার টা যথাযত স্থানে রাখে।তারপর কিচেনের দিকে পা পাড়ায়।
কয়েকদিন পরে,,,,
সুখবরটা যেনো বাতাসের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।লিয়া কনসিভ করেছে এই খুশির খবরটা সবাই জানতেই একে একে সবাই ফোন করে লিয়াকে কনগ্রাচুলেট করে।সাথে থাকে একগাদা উপদেশমূলক বাণী।এই সময় গুলোতে কিভাবে চলাচল করতে হয়।কি কি খাবার খেলে ভালো- মন্দ হয়।তেল চর্বি, ভাজা পুড়া,বাইরের খাবার এভয়েড করতে হয়। বিশ্রামে থাকতে হয়। প্রত্যেকের কাছ থেকে এইসকল কথা শুনতে শুনতে লিয়া বোর ফিল করছে।তবে মুখে সেটা প্রকাশ না করে ভদ্রভাবে সবার সাথে ফোনকলে কথা বলছে।
এই তো কিছুক্ষণ আগে লিয়ার চাচিমারা ফোন করে ভালো – মন্দ অনেক কথাই বললো।সাথে লিয়ার দাদিমনি জান্নাত বেগম হাজারো নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন লিয়ার উপর।এখন যেনো কলেজে না যায়।গাড়ি টাড়িতে বেশি না উঠে।বাইরে ঘুরাঘুরি একদম করা যাবে না।লোকজনের নজর লেগে যেতে পারে।তাই প্রয়োজনে বাইরে গেলেও যেনো হিজাব – নেকাব পড়েই যায়। হেনতেন আরো অনেক কিছুই বললেন।লিয়া বিনিময়ে হা হু বলেছে।জারিফ নিজেও লিয়াকে কলেজে যেতে বারণ করেছে।জারিফ কাঠকাঠ গলায় বলেছে,”এখন থেকে রেগুলার কলেজ যাওয়ার দরকার নেই। শুধু এক্সামের সময় গিয়ে এক্সাম দিয়ে আসলেই হবে।আর যত নোটস লাগবে আমি কালেক্ট করে এনে দেওয়ার দায়িত্ব আমার থাকবে।আমার এসিসট্যান্টকে বলে রাখবো।সে গিয়ে তোমার কলেজ থেকে নোটস গুলো এনে দেবে।সো এক্সাম ছাড়া কলেজে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।”
সবার কথাতো আর ফেলা যায়না।তাই লিয়া কলেজে যায়নি।নতুন একটা কাজের মেয়ে রেখেছে। সার্বক্ষণিক সব কাজের জন্য।সারাদিন থাকে আর সন্ধ্যার পর বাড়িতে চলে যায়।মেয়েটার বাড়ি বেশি দূর নয়।লিয়াদের ফ্লাট থেকে পায়ে হেঁটে দশ মিনিটের পথ। লিয়ার কোন সময় কি প্রয়োজন সেসব দেখা শোনার জন্য।তবুও লিয়া নিজের কাজ নিজেই করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। রান্না টা লিয়া নিজেই করে।কাজের মেয়েটা রান্নার সময় হেল্প করে।আর সব কিছু ধোঁয়া – মুছা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে।
ঘড়ির কাঁটা বিকেল চারটার ঘর ছুঁইয়েছে।লিয়া ব্যালকনিতে ইজি চেয়ারে বসে ফোন স্ক্রল করছিলো।এমন সময় কাজের মেয়েটা এসে গলা ছেড়ে ডেকে বলে,,”আপামনি।রাতের জন্য কি রান্না করতে হবে?না মানে আজকে একটু তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরতে হবে তো।মা অসুস্থ সেইজন্য আরকি।”
কাজের মেয়েটা কথা-বার্তায়,চালচলনে বেশ স্মার্ট। নাম চারুলতা। শর্ট ফর্মে চারু বলে ডাকে সবাই।যতক্ষণ থাকে কাজ শেষ করেই টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল দেখতে থাকে। একের পর এক সিরিয়াল দেখতেই থাকে।মেয়েটার বয়স খুব বেশি নয়। চব্বিশ – পঁচিশ হবে হয়তো। সময় পেলেই সুখ দুঃখের গল্প লিয়ার কাছে করে ।চারু লিয়ার কাছে তার নির্মম কষ্টের জীবনের গল্প করেছে। অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিলো।দশ বছর সংসার করেছে বাচ্চা না হওয়ার জন্য স্বামী আবার বিয়ে করেছে। আর তাকে ডিভোর্স দিয়েছে।বাবা নেই।মা অসুস্থ।ভাইয়েরা তাকে দেখে না।মাকেও দেখে না।সে কাজ করে যা আয় করে তা দিয়ে মা সহ নিজে খেয়ে পড়ে জীবন ধারন করছে।আমাদের এই ভদ্র সমাজে চারুর ভাইয়ের মতো অনেক ভাই আছে। শুধু নিরক্ষর বা বস্তিতেই নয়। নামধারী শিক্ষিত, উচ্চ সোসাইটিতেও আছে এরকম কুলাঙ্গার সন্তান।যারা নিজেরা বিলাশ বহুল বাড়ি গাড়িতে উঠবস করে।অথচ জন্মদাত্রী মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। ধিক্কার জানাই এসব সন্তানদেরকে।
লিয়া ফোনটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে শান্ত গলায় বলে,,”ওকে।ব্যাপার না।তুমি বাসায় যেতে পারো।তোমার মা যেহেতু অসুস্থ ,তাই দেরি না করে এখনই যাও নাহয়।”
চারু ইতস্তত বোধ করে মিনমিনে স্বরে বলে,,”নাহ্ মানে আপামনি।আপনিও তো অসুস্থ।রাতের রান্নার জন্য কি কি করতে হবে। একটু বলেন শুধু।আমি সব মশলা পাতি বেঁটে রেখে যাচ্ছি।”
লিয়া মিষ্টি করে হেসে বলে,,”আজকে রাতে রান্না করা লাগবে না।আমার আম্মু রান্না করে ড্রাইভার আঙ্কেল
কে দিয়ে সকালে যে খাবার গুলো দিয়েছে।ওগুলো তো আছেই ফ্রিজে।রাতে আমি ওভেনে গরম করে নেবো।তাই রাতের জন্য আলাদা করে কিছু রান্না করতে হবে না।”
লিয়া কথাগুলো বলতে বলতে রুমে আসে।লিয়া কিছু টাকা বের করে চারুর হাতে দিয়ে বলে,,”এটা দিয়ে তোমার মায়ের জন্য কিছু ফলমূল কিনে নিও।আর যখন যেটা প্রয়োজন পড়ে।আমাকে বলো কেমন। হেজিটেট ফিল করো না,ওকে। নির্দ্বিধায় আমাকে বলতে পারো।”
পারু কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে থাকায় লিয়ার দিকে।একগাল হেসে বলে,,”ঠিক আছে আপামনি।আমি এখন আসছি।সাবধানে থাকবেন।”
পারু চলে যায়।লিয়া মেইন ডোর লকড করে রুমে আসে।এমন সময় লিয়ার ফোনটা বেজে উঠে।ফোনটা একহাতে নিয়ে লিয়ার মুখে হাসি ফোটে। ফোনের স্ক্রিনে Apu ওয়ার্ডটা জ্বলজ্বল করছে।হটস আ্যপে ভিডিও কল দিয়েছে তাসনিম।
লিয়া রিসিভ করে হাসি মুখে আনন্দিত কন্ঠে বলে,,
“আপু কেমন আছো?আমার বাবাই টা কেমন আছে?তাকে দেখছি না যে কই সে?”
ফোনের স্ক্রিনে তাসনিমের টোলপড়া হাসি মুখটা ভেসে আছে। তাসনিম ব্যাক ক্যামেরা অন করে।যেখানে দেখা যাচ্ছে আসফি খেলনা ট্রেন গাড়ি হাতে নিয়ে এলোমেলো পা ফেলে হাঁটছে।
তাসনিম ঠোঁট মেলে বলে,,”ঐযে দেখ তোর বাবাইকে।তার যে কাজ।সেই কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছে। অন্যান্য বাচ্চারা গাড়ি টাড়ি এটা সেটা নিয়ে খেলাধুলা করে।আর আসফি কি করে?আসফি খেলা বাদ দিয়ে খেলনা গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। তারপর সেগুলো
থেকে নাট খুলে, ভেঙ্গে দেখতে চায় ভিতরে কি আছে।”
লিয়া কপাল কুঁচকে বলে,,”ভালো তো।বাবা ডক্টর আর ছেলে ইন্জিনিয়ার হবে।বাবা মানুষের পার্স পাতি খোলে।আর ছেলে খেলনার যন্ত্রপাতি । ”
তাসনিম ঠোঁটে ঠোঁট চেপে শব্দহীন হাসে।তারপর চঞ্চল গলায় বলে,,”একদম ঠিক বলেছিস বোন।”
“আসফি অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। অনেক দিন হলো আসফিকে দেখি না।কাছ থেকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।আমার কি ইচ্ছে করছে জানো আপু?আমার ইচ্ছে করছে আসফির ফর্সা নরম তুলতুলে গাল দুটো টিপে দিতে।ফোনে তো আর সম্ভব নয়।তাই তোমরা আসো আমাদের এখানে ঘুরতে।আমার ইচ্ছে-ও পূরণ হবে।সাথে তোমাদের বেড়ানো-ও হবে। দারুণ আইডিয়া না,আপু?”
লিয়ার কথা শুনে তাসনিম ছোট করে শ্বাস টেনে নেয়। দৃষ্টি সরু করে ভরাট গলায় বলে,,”হুম।ঠিক বলেছিস বোন।আইডিয়া দারুণ।তবে এই বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে জার্নি করতে মোটেও ভালো লাগে না।এক পরিবেশ থেকে অন্য পরিবেশে গেলেই আসফির অসুখ বেঁধে যায়।তাই সচরাচর কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠে না।”
লিয়া মুখটা ভার করে ম্লান স্বরে বলে,,”আসবে না তাই বলো। এতোশত উজুহাত দিতে হবে না।”
তাসনিম মিষ্টি কন্ঠস্বরে বলে,,”আমার ছোটো বোনটা আজ-ও বাচ্চাদের মতো অভিমানী রয়েই গেলো।অথচ যেকিনা নিজেই বাচ্চার মা হতে চলেছে। ওহ্ শিট।কথায় কথায় আসল কথাই তো বলা হয়নি এখনো।যেজন্য ফোন করা। কনগ্রাচুলেশন বোন। সুখবরটা শুনে খুব খুশি হয়েছি।জারিফকে জানিয়ে দিস আমার পক্ষ থেকে অনেক অনেক শুভ কামনা রইলো।বাই দ্যা ওয়ে,জারিফ কি বাসায়?”
লিয়া ঠোঁট উল্টে বলে,,”নাহ্।বাসায় নেই।ও তো অফিসে।এখনো আসেনি।তবে চলে আসবে হয়তো এখনি।আলিফ ভাইয়া কেমন আছেন?”
তাসনিম আসফির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে।আসফির হাত থেকে এক টুকরো কাগজ নিয়ে বাস্কেটের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।যেটা আসফি মুখে দিতে যাচ্ছিলো।আসফিকে ধমকের সুরে বলেই,,”ছি:আসফি বাবা এগুলো ময়লা মুখে দেয়না সোনা।মুখে দিলে পেটে অসুখ করবে।”
তাসনিমের কথাটা আসফি কতটা বুঝলো সেটা বোঝা মুশকিল।তবে আসফির মুখের এক্সপ্রেশন দেখে মনে হচ্ছে।আসফি যথেষ্ট বিরক্ত কাগজের টুকরো টা কেড়ে নেওয়াতে। আসফি চোখ ছোট ছোট করে ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর মুখায়ব করে আছে।
লিয়া ফোনের ওপাশ থেকে বিচক্ষণতার সহিত সবটা পর্যবেক্ষণ করে বলে উঠলো,,”আসফি বাবাই তো মনে হয় বেজায় চটেছে।তার কাজে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য।”
তাসনিম একহাতে আসফির চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলে,,”হুম।তা আর বলতে।আর হয়েছে ঠিক বাবার মতো। অল্পভাষী হবে হয়ত।চোখে মুখে সবসময় গম্ভীরতার ছাপ ফুটিয়ে রাখে।”
লিয়া কপাল কুঁচকে শান্ত কন্ঠে শুধায়,,”আপু আলিফ ভাইয়া কোথায়?ভাইয়া কেমন আছে? ফুপ্পি কেমন আছে?কি করে?”
তাসনিম মৃদুস্বরে জবাবে বলে,,”আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছে।আলিফ হসটপিটালে । সন্ধ্যার পর ওর রাউন্ড আছে।রাত নয়টার পর ফিরবে।আর ফুপ্পি বোধহয় রুমেই আছে।”
এরমধ্যে আসফি একটা খেলনা গাড়ি হাতে নিয়ে সেটা খোলার চেষ্টা করে।গাড়িটা খুলতে ব্যর্থ হওয়ায় আসফি ঠোঁট উল্টে শব্দ করে কান্না শুরু করে দেয়। তাসনিম বিরক্তিকর ফেস করে করুণ গলায় বলে,,”ঐতো আবার ওর পাকনামি শুরু হলো।নিজে পারলো না।এখন কান্না নামক অস্ত্রটা হাতে নিলো। বাচ্চাদের শক্তি হলো কান্না।কারন কান্না করলেই সব পাওয়া যাবে।আর বাচ্চার বাবার কড়া আদেশ বাচ্চা কে বকা যাবে না। কাঁদানো যাবে না।দরকার পড়লে যা বলবে তাই করতে হবে।”
লিয়া ঠোঁট কামড়ে ধরে সোজাসুজি স্পষ্টভাবে বলে উঠে,,”আপু আসফি তো কান্না করছে। তুমি আগে আসফিকে সামলাও।ওর কান্না থামাও।আবার পরে কথা বলবো কেমন।বাই।”
তাসনিম”ঠিক আছে”বলতেই লিয়া কল কে’টে দেয়।আসফির ক্রন্দনরত ফেসটা লিয়ার চোখের সামনে ভেসে উঠছে বারবার। বাচ্চারা তো ফুলের মতো নিষ্পাপ হয়। কন্দনরত ফেসটা আরো বেশিই ইন্নোসেন্ট আর মায়াবী লাগছিলো।আসফির কথা ভাবতে ভাবতেই লিয়ার নিজের পেটের উপর দৃষ্টি যায়।একহাত পেটের উপর রেখে লিয়া মনে মনে ভাবে,,এরকম একটা বাচ্চা আমাদের ঘর আলো করে আসতে যাচ্ছে।যার মিষ্টি মুখটা দেখলে নিমিষেই মন খা’রাপ,যেকেনো দুঃখ কষ্ট মূহূর্তেই উড়ে যাবে।যার নিষ্পাপ মিষ্টি মুখটা দেখলে অনাবিল প্রশান্তি বয়ে যাবে মনেতে।আমাদের ভালোবাসার ছোট্ট কুঠিরটিতে আলো হয়ে জ্বলে থাকবে।”
লিয়ার ভাবনা ভাঙ্গে পুরুষালী কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই।জারিফ রুমে এসে লিয়াকে না দেখতে পেয়ে প্রথমে ব্যালকনিতে যায়।ব্যালকনিতে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে লিয়া।জারিফ শার্টের হাতার কাছের বোতাম খুলতে খুলতে বলে,,”লিয়া শরীর খা’রাপ লাগছে কি?এখানে এভাবে আছো যে।”
কথাগুলো শুনে লিয়া চোখ মেলে তাকিয়ে সোজা হয়ে বসে।তারপর দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,,”উঁহুম।ঠিক আছি তো।এমনি বিকেলের নরম রোদটা গায়ে মাখছিলাম।এখানে এভাবে থাকতে বেশ ভালো লাগছিলো।”
জারিফ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,,”উফ্! বাঁচা গেলো।আমি আরো ভাবছিলাম তোমার হয়তো শরীর – টরীর খা’রাপ লাগছে।ভেতরে আসার সময় চারুকেও দেখতে পেলাম না।আর টিভির শব্দ-ও নেই।”
লিয়া উঠে দাঁড়ায়। চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিয়ে বলে,,”চারুর মা অসুস্থ।তাই বাসায় গিয়েছে।”
জারিফ ছোট করে বলে,,”ওহ্।”
সন্ধ্যার পর লিয়া সোফায় বসে আছে।জারিফ লিয়ার কোলের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে টিভিতে স্পোর্টস দেখছে ।লিয়া মাঝে মাঝে কাজুবাদাম আর কিশমিশ খাচ্ছে।সামনের টেবিলের উপর কয়েক রকম ফল রাখা।জারিফের আদেশ অল্প করে হলেও কিছু কিছু খেতে হবে।জারিফ ফলের ঝুড়ি থেকে একহাতে একটা আপেল তুলে নিয়ে তাতে বাইট দেয়।
এরমধ্যে সামনের ট্রি টেবিলের উপর থাকা জারিফের ফোনটা বাজতে থাকে।লিয়া ফোনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পায় ছুটকি লেখা।এক সেকেন্ড খানেক পরেই লিয়া বলে,,”জারা কল করেছে।”
জারিফ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে,,”রিসিভ করো।”
লিয়া রিসিভ করে হ্যালো বলতেই জারা উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,,”ভাবী কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।তুমি কেমন আছো? আব্বু আম্মু কেমন আছেন? আম্মুর শরীর স্বাস্থ্য কেমন আছে?”
উত্তরে জারা চঞ্চল গলায় বলে,,”আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছে।তোমরা কবে আসছো? আম্মু তোমাদের কথা বারবার বলছে।ভাইয়া কোথায়?”
লিয়া ঠোঁট মেলে বলে,,”তোমার ভাইয়া এখানেই আছে।কবে যাবো।সেটা আমি জানিনা গো।সেটা নাহয় তোমার ভাইয়ার কাছ থেকেই জেনে নাও।কারন আমি তো বাড়িতে যাওয়ার জন্য খুব এক্সাইটেড হয়ে আছি।কাল বললে আমি কালই যেতে রাজি।”
কথাটা শেষ করেই লিয়া জারিফের কাছে ফোন দিয়ে দেয়।জারিফ ফোনটা নিয়ে বলে,,”হ্যা ছুটকি বল। আব্বু আম্মু কেমন আছে? কোনো সমস্যা নেই তো?”
জারা গমগমে স্বরে বলে,,”নাহ্ ভাইয়া।আপাতত কোনো সমস্যা নেই। আব্বু আম্মু সবাই ভালো আছে।আগে বল তোরা বাসায় আসছিস কবে?অনেকদিন হলো তোদের কে দেখি না। আব্বু আম্মু দু’জনেই তোদের আসার কথা বারবার বলছে।”
জারিফ নির্বিকার ভাবে শান্ত গলায় বলে,,”এই মাসেই তো আমাদের বাড়ি যাওয়ার কথা ছিলো।তবে তোর ভাবী তো অসুস্থ। ডক্টর বলেছেন বিশ্রামে থাকতে। আর এই সময় লং জার্নি না করাই বেটার।সেইজন্য বলছি আব্বু-আম্মু তুই এসে ঘুরে যা।”
জারা কিছুটা আহত হয়। অতঃপর ভারী কন্ঠস্বরে বলে,,”ওহ্। আচ্ছা।”
কিয়ৎক্ষন থেমে চঞ্চল গলায় বলে,,ভাইয়া জানিস, আম্মু এখন থেকেই তোদের বাচ্চার জন্য কাঁথা সেলাই করছে।আর আমি তো ছেলে মেয়ে উভয়ের জন্যই সুন্দর সুন্দর নাম কালেক্ট করে রাখছি।ছেলে বেবি হলে কি নাম রাখবো আর মেয়ে বেবি হলে কি নাম।এইসবই আমার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু।”
আরো কিছুক্ষণ ফোনালাপ চলে।
দেখতে দেখতে কে’টে গিয়েছে আরো কয়েকটা মাস।লিয়া ফাইনাল ইয়ারে উঠেছে।সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছুই।লিয়া দেখতে অনেকটা গুলুমুলু হয়েছে। স্বাভাবিকের তুলনায় লিয়ার পেটটা একটু বেশিই উঁচু।ছয়মাসে আল্ট্রাসনোগ্রাম করেছিলো।তখন ডক্টর বলেছে টুইন বেবি হবে।একটা বেবি মেয়ে আর অন্যটা বোঝা যায়নি।মেয়ে বেবিটা সেফালিক পজিশনে ছিলো আর অপর বেবি ব্রেচ পজিশনে থাকায় বোঝা যায়নি।জারিফ তবুও খুব খুশি।জারিফ সবসময় বলে,আমার টুইন রাজকন্যা হবে।লিয়া ঠোঁট উল্টে বিরোধীতা করে বলে,উহুম অন্যটা ছেলেই হবে ইন শা আল্লাহ।টুইন বেবি হবে এটা শোনার পর থেকে জারিফ বেশ চিন্তিত।এমনিতে কোনো জটিলতা নেই।তারপরেও টুইনের ক্ষেত্রে কিছুটা রিস্ক থাকে। ডেলিভারী ডেট যতো ঘনিয়ে আসছে সবার দুশ্চিন্তা তত বেড়েই চলেছে।
আর দশদিন বাকি আছে লিয়ার ডেলিভারির।রাজিয়া সুলতানা আজ সন্ধ্যায়-ও ফোন করে লিয়াকে তাদের কাছে নিয়ে আসার কথা বলেছে।এদিকে জারিফ লিয়াকে বলেছে এতো আগেই যাওয়ার কি আছে।ডেটের দুইদিন আগে যেয়ো।জারিফের কথামতো লিয়া ওর আম্মু কে আরো এক সপ্তাহ পরে বাসায় যাওয়ার কথা বলে।রাত আটটা বাজে জারিফ রুমে বসে ল্যাপটপে অফিসিয়াল মেইল সেন্ট করছিলো।লিয়ার পানি পিপাসা পায়।লিয়া বিছানা ছেড়ে নেমে রুমে থাকা ওয়াটারবোটলের দিকে এক পলক তাকিয়ে দেখে বোটলটা শুণ্য।লিয়া ছোট করে শ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে ডায়নিং এ যায়।জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালে। সন্ধ্যা থেকে লিয়ার হালকা পেইন হচ্ছিলো।লিয়া ভাবে আ্যসিডিটির জন্য হবে হয়তো। এমনিতেই প্রেগন্যান্সির পুরো সময়টা ধরে লিয়ার আ্যসিডিটির সমস্যাটা ব্যাপক হয়েছিলো।আ্যসিডিটির জন্য হেডেক টা বেশি হতো।সাথে ভমিটিং এর প্রবলেম।পেশারটাও একটু বেশি।তবে গাইনি ডক্টর বলেছেন,এই সময় পেশারটা স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি থাকেই।এতে চিন্তার কিছু নেই।পানির গ্লাস টা লিয়া হাতে করে হঠাৎই লিয়ার পেইনটা বেড়ে যায়। মূহুর্তেই লিয়ার কাছে মনে হয়।পায়ের তলা থেকে যেনো মাটি সরে গিয়েছে।লিয়ার হাত কাঁপতে থাকায় গ্লাসটা হাত থেকে ফ্লোরে পড়ে যায়।বিকট শব্দে কাঁচের গ্লাস টা কয়েক টুকরো হয়ে যায়। শব্দ শুনে জারিফ চিন্তিত হয়ে হন্তদন্ত পায়ে ডায়নিং এ ছুটে আসে।লিয়া একহাত পেটে রেখে মৃদু আর্তনাদ করে।
অতি দ্রুত লিয়াকে পপুলার হসটপিটালে এডমিট করা হয়।লিয়াকে হসটপিটালে নেওয়ার সাথে সাথেই লিয়ার আব্বু আম্মুও হসটপিটালে ছুটে আসেন।ডিউটিরত ডক্টর চেকআপ করে সিজারের কথা বলে।গাইনি ডক্টর আসতেই লিয়াকে ওটিতে নেওয়া হয়।
রাত দশটা বাজতে চললো।ওটির সামনে করিডোরে রাখা চেয়ারে বসে আছেন রাজিয়া সুলতানা,লিয়ার আব্বু সাথে রাহবার।সবারই চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।জারিফ ওটির দরজার দিকে তাকিয়ে দুই আঙ্গুল দিয়ে কপালে স্লাইড করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জারিফ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কে বেশি বেশি স্মরণ করছে।যাতে সবকিছু ঠিক থাকে।জারিফ দুই হাত পকেটে গুঁজে চোখ বন্ধ করতেই লিয়ার ফেসটা বারবার ভেসে আসছে। স্মৃতি পটে ভেসে আসছে এইতো সন্ধ্যায় লিয়ার পেটের উপর কান দিয়ে বেবিদের হার্টবিট শোনার চেষ্টা করছিলো।সেই সময় বেবি কিক মা”রে।জারিফ আলতোভাবে পেটে চুমু খেয়ে বলেছিলো,,”প্রিন্সেসেরা একদম পিকেটিং করে না। মাম্মাম কে কষ্ট দেয়না সোনা প্রিন্সেসরা।”জারিফের কথা শুনে লিয়া শব্দ করে খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে।লিয়ার সেই হাসি মাখা মুখটা জারিফের মনে উঠতেই।জারিফের দুচোখের কোণে নোনাজল ছলছল করে।কেনো জানি না চাইতেও জারিফের মনটা কুডাকছে।জারিফ যতই সব কিছু যেনো ভালো হয় ভাবছে। মস্তিষ্ক টা তার উল্টো ভাবছে।টুইন বেবি নিয়ে অনেকের করা নেগেটিভ মন্তব্য গুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।টুইন বেবির ফলে মায়ের লাইফ রিস্ক-ও হতে পারে।এসব কিছু মনে হতেই জারিফের মন অন্ধকারের কালো মেঘে ছেয়ে যেতে থাকে।
এরমধ্যেই বাচ্চার কান্নার শব্দ শোনা যায়। কিছুক্ষণ পরেই একজন সিস্টার ওটির দরজা খুলে বের হয়।জারিফ সাথে সাথে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।বাকি সবাইও বসা থেকে এগিয়ে আসে সবারই চোখে মুখে একই প্রশ্ন লিয়া কেমন আছে?।পিছনে আরেকটা সিস্টার। দু’জনের কোলেই টাওয়ালে মুড়ানো সদ্য জন্ম নেওয়া দুইটা শিশু।
সামনের সিস্টার বাচ্চা টাকে জারিফের কোলে ধরিয়ে দিতে দিতে বলে,,”আপনার টুইন বেবি হয়েছে।একটা মেয়ে আরেকটা ছেলে।”
জারিফের কোলে মেয়ে বেবিকে দেওয়া হয়।অপর সিস্টারের কাছে থাকা ছেলে বাচ্চাকে রাজিয়া সুলতানার কোলে দেওয়া হয়।জারিফ বাচ্চা কে কোলে নিয়ে চিন্তিত ফেস করে রাশভারী গলায় বলে,,”সিস্টার লিয়া মানে আমার ওয়াইফ কেমন আছে?ও ভালো আছে তো।ডেনঞ্জার ফ্রি আছে তো।”
সিস্টার ইনশিয়র দিয়ে মৃদুস্বরে বলে,,”পেসেন্ট এখন সেন্সলেস হয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পেশেন্ট কে কেবিনে শিফট করা হবে।আমার মনে হয় সী ইজ আউট অফ ডেনঞ্জার।তবুও আপনি চাইলে গাইনী ম্যামের থেকে জেনে শিয়র হতে পারেন।”
জারিফ অস্ফুট স্বরে”আলহামদুলিল্লাহ “বলে তারপর দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিয়ে ঠোঁট আওড়িয়ে বলে,,”শিয়র। থেংকিউ । থেংকিউ সো মাচ অল অফ ইউ।”
জারিফের দুই বাহুর মধ্যে থাকা বাচ্চাটা কালো মিচমিচে চোখের মনি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে জারিফের অন্তরে শীতলতা বয়ে যায়।দুচোখের কার্নিশ বেঁয়ে একফোঁটা আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।আধা ঘন্টা খানেক পড়ে লিয়াকে কেবিনে শিফট করা হয়।কিছুক্ষণের মধ্যে লিয়ার জ্ঞান ফেরে।জ্ঞান ফিরেই লিয়া সর্বপ্রথম বাচ্চাদের কথা জিগ্গেস করে।একটা বাচ্চা রাজিয়া সুলতানার কোলে ছিলো অন্যটা একজন সিস্টারের কাছে।রাজিয়া সুলতানা লিয়ার একহাতের উপর ছেলে বেবিকে শুয়ে দিলো।অন্যহাতের উপর মেয়ে বেবিকে শুয়ে দিয়ে বলেন,,”আল্লাহর রহমতে সবাই ভালো আছে। চিন্তার কিছু নেই।একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে বেবি হয়েছে।বেবিরা ভালো আছে।”
লিয়া একবার ঘাড় ঘুরিয়ে একপাশে তাকায় আবার ঘাড় ঘুরিয়ে অপর পাশে তাকায়।মা হওয়ার পরম আনন্দে লিয়ার গাল বেয়ে টসটসে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।জারিফ কয়েক পা এগিয়ে আসতেই লিয়ার সাথে চোখাচোখি হয়।লিয়া নিষ্পলক চাহনিতে নির্বিকার ভাবে জারিফের দিকে তাকিয়ে থাকে। লিয়ার ইচ্ছে করছে অনেক কিছুই বলতে তবে লোকজনের জন্য ইচ্ছে টাকে আপাতত দমিয়ে রাখে লিয়া।জারিফ লিয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। কিয়ৎক্ষন পরেই নরম কন্ঠে শুধালো,,”বলোতো লিয়া বাচ্চারা কার মতো দেখতে হয়েছে।”
লিয়া কপাল কুঞ্চিত করে কয়েকবার বেবিদের কে দেখে নিয়ে ঠোঁট উল্টে বলে,,”এত ছোট কিকরে বুঝবো বলুন।তবে আমার মনে হচ্ছে, মেয়ে আপনার কার্বন কপি হয়েছে।আর ছেলে আমাদের দু’জনের মতোই।”
লিয়ার কথার মাঝেই জারিফের ফোনটা ভো ভো শব্দে কেঁপে উঠে।লিয়াকে হসটপিটালে এডমিট করা হয়েছে।এরপর থেকে একের পর এক আত্বীয় স্বজনের কল আসতেই চলছে।
তিনদিনের দিন লিয়াকে হসটপিটাল থেকে বাসায় আনা হয়।জারিফের বাবা মা সেদিন রাতেই ময়মনসিংহ থেকে রওনা হয়েছিলো।ভোরে বগুড়ায় এসে পৌঁছায়।
সাতদিনে আকিকা দিয়ে বাচ্চাদের নাম রাখা হয়।জারিফের বাবা-মা জারিফের ফ্ল্যাটে আছে।মেয়ের নাম মুসাররাত জাহারা।ছেলের নাম আয়লান জয়।
দুইটা বেবি নার্সিং করতে গিয়ে জারিফ লিয়া দুজনেই হিমসিম খাচ্ছে।রাতে জারিফ-লিয়া দু’জনেরই ঠিকমতো ঘুম হয়না।একজনকে খাওয়িয়ে ঘুমিয়ে দিতেই আরেকজন কান্না করতে থাকে।রাত এগারোটা বাজতে চললো। বাচ্চাদের চোখে ঘুমের একফোঁটা চিহ্ন -ও নেই।জয় লিয়ার কোলে।লিয়া কোলে নিয়ে গম্ভীর মুখায়ব করে বসে আছে।আর জাহারা কে ফিড করিয়ে জারিফের কোলে দিয়েছে।জারিফ কোলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে দোলাতে থাকে।আর এটা সেটা গল্প করতে থাকে।জাহারা চোখ বড় বড় করে দুই ভ্রুয়ের মাঝে ভাঁজ ফেলে শ্রবণ করতে থাকে। বাচ্চার এটিটিউটড দেখে মনে হচ্ছে,সব যেনো বুঝতে পারছে।
জারিফ বড় করে হামি দেয়।তা দেখে লিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বলে,,”মেয়েকে ঘুম পারাতে গিয়ে নিজেই তো ঘুম আসতে চাচ্ছেন। আশ্চর্য!”
জারিফ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে,,”প্রিন্সেস মামনি আমার তোমার চোখগুলো ছোট হওয়ার থেকে আরো বড় হচ্ছে তো। নাহ্! আজকে ঘুমানোর কোনো সিমটম-ই নেই তোমার চোখে।অথচ তোমার বাবার চোখ ছোট হয়ে আসছে।রাজ্যের ঘুম ভেঙ্গে নামছে তোমার বাবার চোখে।তোমরা দুইভাই বোন তো আজকে একসাথে পণ করেছো সারাটা রাত নির্ঘুমে কাটাতে।”
জয় ঘুমিয়ে পড়েছে লিয়ার একহাতের উপর শুয়ে।লিয়া বালিশের উপর একহাত রেখে হাতের উপর মাথা দিয়ে ঝিমুচ্ছিলো।জাহারা ঘুম আসতেই জয়ের পাশে শুয়ে দেয়। অতঃপর জয়ের মাথাটা নরম বালিশে ঠিক করে দেয় ।জারিফ লিয়ার মাথার নিচ থেকে হাতটা সরিয়ে। আলতো করে লিয়ার মাথাটা বালিশের উপর রাখে। তারপর লাইট নিভিয়ে ডিম লাইট জ্বালিয়ে লিয়ার পাশে একহাতে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে।এভাবেই প্রতিটা দিন কাটতে থাকে।
(পর্ব বড় হওয়ার জন্য গ্রুপে শো করে না। বিধায় দুই ভাগে দেওয়া।বর্ধিতাংশের লিংক কমেন্ট বক্সে ।)