অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা #সূচনা_পর্ব

2
1513

‘তোমার এত সাহস! ভালোবাসার জন্য নিজের দেশ ছেড়ে একা অচেনা অজানা এক দেশে চলে এলে? তোমার কি একটুও ভয় করেনি, মেয়ে?’

প্রিয়তা মাথা নুয়ালো। এক হাত দিয়ে অন্য হাতের নখ খুঁটছে সে। অস্বস্তি, চিন্তা আর ভয়ে কুপোকাত যেন। তার পাতলা ফিনফিনে ঠোঁটে মৃদু আন্দোলন। সে ভীত সুরে বলল,

‘ভালোবাসার কাছে আমার এই ভয়টা তুচ্ছ হয়ে পড়েছিল।’

কপালের ভাঁজ দৃঢ় হলো দিলরুবা বেগমের। বীতঃস্পৃহ বোধ করলেন। গলার স্বর খানিকটা চওড়া করে বললেন,

‘আর তোমার এই অতি সামান্য ভালোবাসার জন্য যে আজ তোমার মা বাবা পাগলপ্রায়, সেটার দায়ভার কে নিবে? কী হলো এসব করে? কোথায় গেল তোমার সেই ভালোবাসার মানুষ? এত দূর ছুটে এসে পেলে তাকে? পাওনি তো। সবটাই কেবল একটা মরীচিকা ছিল। তুমি বোকা মেয়ে, তাই বুঝোনি।’

প্রিয়তা স্বচ্ছ অক্ষিযুগল ভিজে ওঠল। ওষ্ঠযুগলের আন্দোলন বাড়ল তার। নাক টেনে বলল,

‘এভাবে বলবেন না, প্লিজ। ওয়াদি আমাকে ঠকাতে পারে না, ওর ভালোবাসা মিথ্যে হতে পারে না। অন্তত আমি বিশ্বাস করি না এই কথা।’

প্রিয়তাকে অস্থির দেখাল। বিছানার পাশে এক কোণে নিশ্চল ভঙিতে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি এবার ধীর সুরে বলল,

‘আম্মি, ও এমনিতেই খুব কষ্ট পাচ্ছে। ওর কষ্ট বাড়িয়ে লাভ নেই। আমরা বরং ওকে একটু বিশ্রাম নিতে দেই।’

দিলরুবা বেগম গভীর নিশ্বাস ফেললেন। যদিও আজকাল কাউকে ঠিক মতো বিশ্বাস করা যায় না। তাও এই মেয়েটাকে সন্দেহ হচ্ছে না তাঁর। মেয়েটা সত্যিই অতি দুঃখ পেয়েছে। প্রেমিকের টানে নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে আসাটা চারটে খানি কথা নয়। একা মেয়ে হয়ে দারুণ এক কাজ করে বসেছে সে। তাই তিনি আর কথা বাড়ালেন না। কেবল বললেন,

‘তুমি আপাতত বিশ্রাম নাও। একটু পর আমার ছেলে আসলে তোমার সমস্যাটা আমরা সমাধানের চেষ্টা করব।’

প্রিয়তা ওড়নার এক কোণ দিয়ে চোখ মুছল। ঢোক গিলে বলল,

‘আপনারা আমাকে কেন সাহায্য করবেন? আপনারা তো আমাকে চিনেন না।’

‘তুমি হলে আমার দেশের মানুষ। বাংলাদেশে যায় না আজ পঁচিশ বছরেরও উপরে। কোনো যোগাযোগ নেই ঐ দেশের সাথে। এত বছর পর নিজের দেশের একজনকে পেয়েছি। মনে হচ্ছে যেন, আমার অতি নিকট আত্মীয় তুমি। এটা আত্মার টান, তুমি বুঝবে না। আর ভয় পেও না, আমরা খারাপ মানুষ নই। তোমার বয়সী আমারও একটা মেয়ে আছে। বিপদে পড়েছ বলেই সাহায্য করছি। ভরসা করতে পারো।’

প্রিয়তার হাতে করার মতো আর কিছু নেইও। এই মানুষগুলোকে বিশ্বাস করা ছাড়া আর কোনো উপায়ান্তরও সে ভেবে পাচ্ছে না। যার জন্য তার এই করুণ দশা সেও উধাও, ভাগ্যের কোন কুৎসিত পরিণাম লেখা আছে কে জানে।

দিলরুবা বেগম সেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। খাবার প্লেটটা হাতে তুলে নেয় মৌমি। প্রসন্ন হেসে বলে,

‘তুমি শুয়ে বিশ্রাম করো। ভাইয়া এসে ঠিক একটা সমাধান বের করে ফেলতে পারবেন।’

প্রিয়তা ম্লান হাসল। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,

‘আচ্ছা।’

মৌমিও বেরিয়ে এল। খাবারের প্লেট রান্নাঘরে রেখে এসে মায়ের ঘরে গেল সে। দিলরুবা বেগম চিন্তিত চিত্তে বিছানায় বসা। কপালের ভাঁজ এখনো সরেনি তাঁর। মৌমি গিয়ে তাঁর পাশে বসল। বলল,

‘আম্মি, আপনি কি খুব চিন্তিত?’

দিলরুবা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

‘হ্যাঁ।’

‘ভাইয়াকে নিয়ে?’

তিনি মেয়ের দিকে তাকালেন। ভীত দেখাল তাঁকে। বললেন,

‘তোর ভাইকে না জানিয়ে মেয়েটাকে তো নিয়ে এলাম, এবার ও বাসায় আসলে কী করব?’

‘কী করবে আর? সব খুলে বলবে।’

দিলরুবা বেগম চিন্তিত সুরে বললেন,

‘তোর ভাইকে তুই চিনিস না? এভাবে বলা নেই কওয়া নেই এক অচেনা মেয়েকে ঘরে তুললাম, পুরো বাড়ি না এসে মাথায় তুলে আমি সেই চিন্তাতেই আছি।’

মৌমিও সমান চিন্তায় পড়ল। বলল,

‘জি আম্মি, এই চিন্তা তো আমারও হচ্ছে। ভাইয়াকে কি এখনই একবার জানাবে?’

‘না না, এখনই বলা যাবে না। আজকে বলে গিয়েছে বেশি ব্যস্ত থাকবে, কল যেন না দেই; একেবারে বাসায় এলেই বলব সব।’

‘আচ্ছা।’

দিলরুবা বেগম আবারও চিন্তায় ডুবলেন। আনমনে বললেন,

‘মেয়েটাকে আবার বিশ্বাস করে ভুল করছি না তো?’

মৌমি চেয়ে বলল,

‘আমার তো ঐরকম মনে হয়নি, আম্মি। মেয়েটা সত্যিই ভীষণ বিপদে পড়েছে। ওর চোখ মুখ দেখছিলে না, কেমন ভীত সন্ত্রস্ত।’

দিলরুবা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অন্তঃস্থল জুড়ে অন্য এক প্রবাহ বইল তাঁর। কেন যেন মনে হলো, মেয়েটা তাঁরই আধুনিক রূপ। মায়া হলো তাঁর, নিজের প্রতি, মেয়েটার প্রতি। মনে মনে ঠিক করলেন, মেয়েটাকে সবটুকু দিয়ে সাহায্য করবেন।

_____

ঘড়িতে আটটা বেজে বিশ মিনিট। বাইরে থেকে গাড়ির শব্দ এলো। দিলরুবা বেগমের কানে শব্দস্রোত যাওয়া মাত্রই সতর্ক হলেন তিনি। তার একমাত্র পুত্র এলো বোধ হয়। চোখে মুখের দৃঢ়তা কমল না। বাড়ল বরং। ছেলেটাকে নিজের বাবার মতো ভয় পান। ছেলেও অবশ্য কম শাসন করে না। মা কম নিজের সন্তান ভাবে বেশি।

কলিং বেল বাজার আগেই আজ দরজা খুলে গেল। সুইচ টেপার উদ্দেশ্যে বাড়ানো হাতখানাটাও নেমে গেল তাই সঙ্গে সঙ্গেই। অবাক হলো ফারজাদ। পাশের দেয়ালে এক হাত ঠেকিয়ে জুতার ফিতা খুলতে খুলতে বলল,

‘কী ব্যাপার! মনে হচ্ছে যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিলি?’

মৌমি উত্তর দিল না কোনো। কেবল জোরপূর্বক হেসে পাশ হয়ে দাঁড়াল। জুতা খুলে ভেতরে ঢুকল ফারজাদ। তারপর সোজা চলে গেল নিজের ঘরের দিকে। যাওয়ার আগে মৌমিকে বলে গেল, এক গ্লাস পানি নিয়ে যাওয়ার জন্য।

ফারজাদের ঘরে পানির গ্লাস দিয়ে মৌমি ছুটে মায়ের ঘরে এল। জিজ্ঞেস করল,

‘এখনই সব বলবেন, আম্মি?’

‘না না, আগে ও একটু বিশ্রাম নিক, তারপর।’

‘আচ্ছা।’

গলায় ঝুলিয়ে রাখা তোয়ালেটা বারান্দায় নেড়ে বিছানায় এসে বসল ফারজাদ। আজ অফিসে চাপ গিয়েছে খুব। ক্লান্ত ভীষণ। সাইড টেবিলে রাখা পুরো পানিটুকু খেয়ে শুয়ে পড়ল সে। কিছু সময় যেতেই চোখও লেগে আসল।

ঘড়িতে ঢং ঢং করে দশটা শব্দ হলো। জানান দিল, দশটা বাজে। ভয়ে যবুথবু হয়ে বসে আছে প্রিয়তা। ওড়নার এক কোণ তার হাতের মুঠোয়। তার ঠিক সামনেই বসা মৌমি। সেও ভীত। প্রিয়তাকে দেখছে গভীর মনোযোগে। দিলরুবা বেগম সম্ভবত নিজের ঘরে। প্রিয়তা ঢোক গিলে বলল,

‘তোমার ভাই কি খুব রাগী?’

মৌমি ম্লান হেসে বলল,

‘না, অতটাও না।’

প্রিয়তা এবার একটু সময় নিয়ে বলল,

‘আচ্ছা, আমাকে কি উনি এখনই বাড়ি থেকে বের করে দিবেন? এত রাতে বের করে দিলে আমি কোথায় যাব?’

প্রিয়তার চোখে মুখে ভয়। মৌমি তাকে আশ্বস্ত করে বলল,

‘আরে না না, বের করবেন কেন? আমার ভাইয়া নির্দয় নন। একটু বেশি রক্ষণশীল সব ব্যাপারে, তাই বলে তোমাকে এই রাতে বাড়ি থেকে বের করে দিবেন না। তুমি শুধু ভাইয়ার সামনে কোনো কথা বলো না, যা বলার আম্মি’ই বলবেন।’

প্রিয়তা মাথা হেলিয়ে বলল,

‘আচ্ছা।’

এর মাঝেই দিলরুবা বেগম সেই ঘরে এলেন। রাশভারী স্বরে বললেন,

‘আমি ফারজাদের রুমে যাচ্ছি, ওর সাথে কথা বলার জন্য। আমি যখন ডাকব ওকে নিয়ে ভাইয়ের রুমে আসবে।’

মৌমি বলল,

‘ঠিক আছে।’

দিলরুবা বেগম চলে গেলেন। আরেকটু জড়োসড়ো হয়ে বসল প্রিয়তা। মৌমি তার হাতে হাত রেখে বলল,

‘চিন্তা করো না, আম্মি আছেন তো।’

ফারজাদ ফাইল হাতে রুম জুড়ে পায়চারি চালাচ্ছে। দিলরুবা বেগম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুধালেন,

‘ব্যস্ত, ফারজাদ?’

ফারজাদ ফিরে চেয়ে বলল,

‘না, আম্মি। আসুন।’

দিলরুবা বেগম রুমের ভেতর গেলেন। বিছানায় বসলেন তিনি। বললেন,

‘তোমার সাথে একটু কথা বলার ছিল।’

ফাইলটা বন্ধ করে ফারজাদ মায়ের পাশে বসল। বলল,

‘জি আম্মি, বলুন।’

দিলরুবা বেগম নিজেকে ধাতস্ত করে বললেন,

‘তোমাকে না জানিয়েই আমি একটা মেয়েকে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছি।’

ফারজাদ সঙ্গে সঙ্গেই ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘মেয়ে? কোন মেয়ে?’

চলবে….

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
#সূচনা_পর্ব

(অনেক দিনের অপেক্ষার পর অবশেষে নতুন গল্প। আপনাদের ভালোবাসা আশা করছি। আসসালামু আলাইকুম।)

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here