অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ২।

0
946

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২।

দিলরুবা বেগম খানিক সময় নিলেন। ছেলেটা ধাতস্ত হবার অপেক্ষা করলেন। অতঃপর রয়ে সয়ে বললেন,

‘মেয়েটা ভারী বিপদে পড়েছিল। একা এই শহরে এসে পথ হারিয়ে বসেছে। রাস্তায় কাঁদছিল বসে। উপায়ান্তর না পেয়ে নিয়ে এসেছি।’

ফারজাদ উত্তেজিত সুরে বলল,

‘আম্মি, আজকাল এসব একধরনের ট্র্যাপ, আপনি বুঝতে পারছেন না। বড়ো কোনো বিপদও হতে পারে। এভাবে অপরিচিত একটা মেয়েকে কীভাবে বাড়িতে নিয়ে এলেন? আর ঐ মেয়ে কি বাচ্চা, ওর ফোন নেই? কোনো পরিচিত কাউকে কল দিলেই তো হয়ে যেত।’

‘সেটা হলেও তো চলতো। মেয়েটা এই দেশেও নতুন। সিমও তুলেনি এখন অবধি। ইন্টারনেটেও সংযোগ করতে ব্যর্থ। এমতাবস্থায় মেয়েটার আর কী করণীয়, বলো?’

‘তাই বলে একটা বাইরের মেয়েকে…’

দিলরুবা বেগম তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

‘এভাবে বলে না, বাবা। বিপদে পড়লে মানুষকে সাহায্য করতে হয়। আর ও আমাদের দেশের মানুষ, বাংলাদেশ থেকে এসেছে। ওকে সাহায্য করতে না পারলে আমার মনে ভীষণ অশান্তি হতো। তুমি একবার শুধু মেয়েটার সাথে কথা বলেও নাও। তারপর যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিও।’

ফারজাদ জোরে নিশ্বাস ফেলল। দুনিয়ার যে করুণ দশা, এই অবস্থায় নিজের ছায়াকেও বিশ্বাস করতে দুবার ভাবা লাগে; সেখানে অপরিচিত অচেনা এক মেয়েকে সে কীভাবে বিশ্বাস করবে। তাও, মায়ের এত আকুতি অগ্রাহ্য করতে না পেরে রাজি হলো সে। দিলরুবা বেগম খুশি মনে মৌমিকে ডাকলেন, প্রিয়তাকে নিয়ে আসার জন্য।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মৌমি হাজির হলো, প্রিয়তা সমেত। দিলরুবা বেগম মৃদু হেসে বললেন,

‘এই যে, ও হলো প্রিয়তা। আর প্রিয়তা, ও আমার একমাত্র ছেলে ফারজাদ।’

প্রিয়তা ঢোক গিলে কম্পিত সুরে সালাম দিল। সালামের জবাব দিল ফারজাদ। প্রিয়তাকে পূর্ণ মনোযোগে পরখ করে নিল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ভয়ে সিটিয়ে আছে মেয়েটা। চোখ মুখ শুকনো। যেন কত দিন খায় না। দুর্ভিক্ষের খরা পড়েছে যেন পাতলা ঠোঁটে। চোখের পাতা বারবার পিটপিট করে জানান দিচ্ছে যে, সে এই মুহূর্তে ভয় আর দুশ্চিন্তায় মরমর হয়ে আছে।

ফারজাদ মৌমিকে বলল,

‘উনাকে চেয়ারটাতে বসা, মৌমি।’

মৌমি তাই করল। চেয়ারে জড়োসড়ো হয়ে বসল প্রিয়তা। মাথা তার নিচু করা। চোখের দৃষ্টি দুই হাতের ভাঁজে সীমাবদ্ধ। ফারজাদ হালকা গলা ঝেরে জিজ্ঞেস করল,

‘নাম কী আপনার?’

প্রিয়তা পল্লব নাড়িয়ে তাকাল একবার তার দিকে। মনে মনে হয়তো ভাবল, তখন না তার মা নাম বলল তাকে, তারপরও আবার নাম জিজ্ঞেস করছে কেন? পরক্ষণেই আবার ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে ক্ষীণ আওয়াজে বলল,

‘প্রিয়তা, প্রিয়তা জামান।’

দিলরুবা বেগম খানিকটা চমকালেন। মনে মনে নামটা আওড়ালেন দু’বার। ফারজাদ দ্বিতীয় প্রশ্ন করল,

‘পাকিস্তানে কেন এসেছেন?’

প্রিয়তা এবার বুঝতে পারল না কী বলবে। সত্য না-কি মিথ্যা? মৌমি তো তাকে বারণ করেছিল সত্য বলতে? তবে কি এখন মিথ্যে বলা উচিত? তার অতিরঞ্জিত ভাবনা বিরক্ত করছে ফারজাদকে। সে ফের বলে উঠল,

‘উত্তর দিচ্ছেন না যে?’

প্রিয়তা উত্তর সাজিয়ে বলার আগেই দিলরুবা বেগম বলে উঠলেন,

‘পড়াশোনা, পড়াশোনা করতে এসেছে।’

ফারজাদ ভ্রু কুঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,

‘কোন ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশন নিয়েছেন?’

মরার উপর খাড়ার ঘা মনে হলো যেন। এবার কী বলবে? কোন ইউনিভার্সিটির নাম বলবে? সে তো পাকিস্তানের কোনো ইউনিভার্সিটির নাম’ই জানে না। তার এই মুহূর্তে জনমের আফসোস হচ্ছে এটা ভেবে যে, কেন বান্ধবীদের কথা শুনে সে পাকিস্তানী ড্রামা দেখেনি। আজ ঐসব ড্রামা দেখা থাকলে কিছু হলেও পাকিস্তান সম্পর্কে ধারণা হতো তার। আর তখন অন্তত মিথ্যেটাও গুছিয়ে বলতে পারত। প্রচন্ড আফসোস নিয়ে মুখ কালো করল সে। তারপর কোনোরকমে কথা সাজিয়ে বলল,

‘এখনও অ্যাডমিশন হইনি, হবো।’

‘এখানে আপনার কোনো আত্মীয় আছে?’

‘না।’

মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল প্রিয়তা। ফারজাদ বলল,

‘তবে কোথায় থাকবেন?’

প্রিয়তা অসহায় সুরে বলল,

‘জানি না।’

ফারজাদ এহেন উত্তরে অসন্তুষ্ট হলো ভীষণ। জবাবে শক্ত স্বরে বলল,

‘জানি না বললে তো হবে না। ব্যবস্থা করুন। দু’দিনের বেশি এই বাড়িতে আপনাকে আমরা রাখতে পারব না। পরিবারের মানুষের সাথে যোগাযোগ করে অতি শীঘ্রই একটা ব্যবস্থা করবেন। আর সিমের ব্যবস্থা আমি করে দিব, আপনার আইডি কার্ড দিলেই হবে।’

প্রিয়তার গায়ে লাগল বোধ হয়। বলল,

‘দু’দিন রাখতে হবে না। কাল সকালেই আমি চলে যাব।’

প্রিয়তার জেদ দেখে অবাক না হয়ে পারল না ফারজাদ। বিরক্তও হলো বোধ হয়। তাই গম্ভীর স্বরে বলল,

‘ব্যবস্থা করতে পারলে চলে যাবেন, সমস্যা নেই। মৌমি, উনাকে এখন নিয়ে যা।’

মৌমি কাছে গিয়ে দাঁড়াল। প্রিয়তা উঠে দাঁড়াল নিজ থেকেই। মৌমি তাকে নিয়ে গেল গেস্ট রুমের দিকে।

তারা যেতেই ফারজাদ গম্ভীর সুরে বলল,

‘উনার ব্যবহার আমার পছন্দ হয়নি, আম্মি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসব ঝামেলা বিদায় করুন।’

‘তুমি ওভাবে বলছিলে বলেই হয়তো…’

‘আপনি মেয়েটার হয়ে সাফাই দিচ্ছেন?’

‘না না, তা কেন হবে? আচ্ছা, মেয়েটার বিপদ কেটে গেলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তুমি চিন্তা করো না।’

‘সময় দু’দিন, আম্মি। এর মাঝেই যা করার করুন।’

মেয়েটার ব্যবহার বিরূপ প্রভাব ফেলেছে বোধ হয়। দিলরুবা বেগম তাই আর প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। কেবল বললেন,

‘আচ্ছা, আমি সামলে নিব সব।’

___

‘তোমার ভাই ভীষণ অহংকারী।’

মৌমি বড়ো চোখে চেয়ে বলে,

‘এই না না, তুমি ভাইয়াকে ভুল বুঝছো।’

প্রিয়তা হাঁটু ভাঁজ করে বিছানার এক কোণে বসল। মনের বিষাদে এমনিতেই অবসন্ন সে। তার উপর এই লোকটার ব্যবহার তাকে আরো বেশি বিষন্ন করে তুলেছে। সে মৌমির দিকে চেয়ে বলল,

‘তোমার ভাই না বললে কি আমি আজীবন এখানে থেকে যেতাম? কাউকে সাহায্য করে এভাবে বলতে হয় না, সাহায্যের কোনো মূল্য থাকে না। যাই হোক, তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ আমি। কাল সকালেই আমি চলে যাব।’

‘কোথায় যাবে?’

প্রিয়তা দরজার দিকে চাইল। দিলরুবা বেগমকে দেখে মাথা নুয়াল সে। বলল,

‘কোথাও একটা ঠিক চলে যাব। আর সবথেকে বড়ো কথা হলো, আমার ওয়াদিকে খুঁজে বের করতে হবে।’

‘দেশে ফিরে যাও। তোমার মা বাবা নিশ্চয়ই তোমার জন্য দুশ্চিন্তা করছেন।’

প্রিয়তা ভেজা স্বরে বলল,

‘ওয়াদিকে না নিয়ে আমি কোথাও যাব না। আমি এত কষ্ট করে শুধুমাত্র ওর জন্য পাকিস্তানে এসেছি। আমি খালি হাতে ফিরতে পারব না।’

দিলরুবা বেগম অদ্ভুত বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। নিজেরই অন্য এক প্রতিবিম্ব দেখছেন যেন তিনি। এগিয়ে এসে বসলেন। প্রিয়তার মাথায় হাত রেখে বললেন,

‘ছেলেটা তোমায় ঠকিয়েছে, মা।’

প্রিয়তা আঁতকে উঠে, যেন ভয়ানক কিছু শুনে ফেলেছে। অস্থির স্বরে বলে,

‘এভাবে বলবেন না। আমার ভয় হয়। এমন কিছু হলে আমি বেঁচে থাকতে পারব না।’

দিলরুবা বেগম গলার স্বর এবার শক্ত করে বললেন,

‘অন্য কারোর সাথে নিজের বাঁচা মরার কোনো যোগসূত্র নেই। এটা একেবারেই একটা নিম্নমানের চিন্তা। কেউ কারোর জন্য ম রে না। তুমিও ম রবে না। সে যদি সত্যিই তোমায় ভালবাসতো তবে আজ তোমার এই হাল হতো না। তুমি না, ও নিজে যেত তোমার দেশে। তোমার মা বাবাকে রাজী করিয়ে বিয়ে করে নিয়ে আসত। অথচ এমন কিছুই না করে সে তোমাকে আসতে বলল, আর তুমি আসার পর সে উধাও। কালও যার সাথে কথা বললে, আজ, একদিনের ব্যবধানে সে কী করে উধাও হয়ে গেল? একবারও এই চিন্তা তোমার মাথায় আসছে না, মেয়ে?’

প্রিয়তা নির্বাক, নিষ্পলক চেয়ে আছে। উত্তর নেই মুখে। কথাগুলো কাটা ঘা-এ নুনের ছিটার ন্যায় বোধ হলো। তার হাত পা কাঁপছে। মস্তিষ্কটা যেন বিকল হয়ে এসেছে। দিলরুবা বেগম প্রিয়তার গালে হাত রাখলেন। নরম সুরে বললেন,

‘তোমার যাওয়ার ব্যবস্থা আমরা করে দিব। দেশে ফিরে যাও, মরীচিকার পেছনে ছুটে লাভ নেই।’

প্রিয়তা কম্পিত সুরে বলল,

‘আমি ওয়াদিকে ভালোবাসি, আমার দুই বছরের ভালোবাসা মিথ্যে হতে পারে না।’

দিলরুবা বেগম ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সংযত করে বললেন,

‘হতে পারে। বারো বছরের ভালোবাসা যেখানে ঠুনকো, দুই বছরের ভালোবাসা তো সেখানে কিছুই না।’

প্রিয়তা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চাইল। দিলরুবা বেগম সেই দৃষ্টি এড়িয়ে বললেন,

‘আমি তোমার খাবার নিয়ে আসছি। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।’

চলবে….

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here