#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩।
খাবার দাবারের পর্ব চুকিয়ে যার যার মতো ঘরে গেল সবাই। প্রিয়তার খাবার ঘরেই দেওয়া হয়েছিল। হয়তো খাবার খেয়ে এতক্ষণে সে শুয়ে পড়েছে। ফারজাদ তার বারন্দায়। খাবার শেষ করে কিছুটা সময় বারান্দাতেই কাটায় সে। ছোট্ট বাড়ি তাদের। আহামরি বিলাসিতা না থাকলেও সুখ আছে বেশ। তার বারান্দায় গ্রিল নেই। রেলিং-এ হাত চেপে আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত তার। অন্তরীক্ষে আজ চাঁদ নেই। কুচকুচে কালো মেঘগুলো মোটেও তার পছন্দ হচ্ছে না। তাই ফিরে ঘরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েও আবার থমকে দাঁড়ায়। কিছু একটা শুনতে পায় বোধ হয়। নিশ্চিত হবার জন্য মনোযোগ দেয়। হ্যাঁ, ঠিক শুনছে, একটা মেয়েলী সুর। ক্ষীণ আওয়াজ, গুনগুন করে বেজে যাচ্ছে। গান গাইছে কেউ। ফারজাদ উল্টো ঘুরে ঘাড় কাত করে একবার ডানদিকে তাকায়। ওপাশ দেখা না গেলেও স্মরণ হয়, তার ঠিক পাশের ঘরটাই গেস্ট রুম। সে রুমেই মেয়েটাকে থাকতে দেওয়া হয়েছে। সে নিশ্চিন্ত হয়, গানটা ঐ মেয়েটাই গাইছে। ফারজাদ নড়ে না আর।
চারদিক তখন নীরব, নিস্তব্ধ। রাস্তার ওপারের কুকুরগুলোও আজ শান্ত বেশ। বাতাসে কোনো শব্দ নেই। আকাশেরও মন খারাপ। অদ্ভুত, চারদিক যেন আজ একটু বেশিই বিষাদগ্রস্থ মনে হচ্ছে ফারজাদের। কিন্তু, কেন?
“পুষে রাখে যেমন ঝিনুক
খোলসের আবরনে মুক্তর সুখ
তেমনি তোমার গভীর ছোঁয়া
ভিতরের নীল বন্দরে,
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে”
থেমে গেল। ফারজাদ ডানদিকে চাইল আবার। থামল কেন মেয়েটা? সে কি কাঁদছে? ফারজাদ ভ্রু ভাঁজ করল। গানের সুরে তার ভেজা কম্পিত তরঙ্গ টের পাচ্ছিল ফারজাদ। মেয়েটার কি ভীষণ কষ্ট? না-কি তার কথাতেই সে কষ্ট পেয়েছে? পরক্ষণেই ফারজাদ আবার শরীর টানটান করে দাঁড়াল। নিশ্বাস ফেলল জোরে। এত ভেবে তো তার কোনো লাভ নেই। কে কাঁদল, কে হাসল, সেসব জেনে সে কী করবে?
ঘরে চলে আসে সে। বারান্দার দরজাটা আটকে দেয়। তারপর একটা ফাইল হাতে বিছানায় বসে।
___________
চোখের নোনতা জলে বালিশের একপাশ ভিজে আছে। মনের দুঃখের অন্ত নেই। অন্তঃস্থলে যে বিষাদের জোয়ার বইছে তার শেষ কোথায় কে জানে। মেয়েটা ওড়না দিয়ে নাক মুছে। ফোনটা এক হাতে তার চোখের সামনে ধরা। এখনও অপেক্ষা করছে সেই মানুষটার একটা বার্তার। যার জন্য এতকিছু, সেই মানুষটা তাকে ঠকিয়েছে, এই কথাটা যেন সে মানতেই পারছে না। এই তো একদিন আগেও কত ভালোবাসার কথা বলল সে। বলেছিল, পাকিস্তানে আসলেই বিয়ে করবে। তারপর দুজন মিলে ফিরে গিয়ে মা বাবাকে মানাবে। অথচ, কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সব শেষ হয়ে গেল! মা বাবাকে এখন কী করে মুখ দেখাবে সে? তার দেওয়া চিঠি পড়ে মা নিশ্চয়ই খুব কেঁদেছিলেন, বাবা আর ভাই হয়তো পাগলের মতো খুঁজে বেরিয়েছে তাকে। অথচ, সে সব ভুলে এক মিথ্যে মায়াজালে নিজেকে জড়িয়ে এখানে চলে এল? এত নিষ্ঠুর সে?
প্রিয়তা এবার শব্দ করেই কেঁদে ফেলল। মা, বাবা আর ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ছে তার। তাদের কাছে আবার কোনো মুখে ফিরে যাবে সে? গিয়ে কী বলবে? দুশ্চিন্তায় মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে যেন, মৃত্যু’ই একমাত্র এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারবে তাকে।
________
রোদ ঝলমলে সকাল। শুক্রবারের সকাল বলে মৌমির আজ কলেজ যাওয়ার তাড়া নেই। তাই একটু বেলা অবধিই ঘুমাবে সে। খাবার টেবিলে ফারজাদ আর দিলরুবা বেগম বসেছেন। ফারজাদ খাওয়ার মাঝেই জিজ্ঞেস করল,
‘ঐ মেয়েটাকে খাবার দিয়েছেন, আম্মি?’
দিলরুবা বেগম জবাবে বললেন,
‘ডেকেছিলাম একবার, ঘুমাচ্ছে বোধ হয়; তাই আর ডাকিনি। পরে উঠলে মৌমির সাথে খেয়ে নিবে।’
ফারজাদ বলল,
‘আচ্ছা আম্মি, আপনার মেয়েটার কথা বিশ্বাস হয়? কোনো কিছু ব্যবস্থা না করেই উনি নিজ দেশ ছেড়ে একেবারে অপরিচিত অচেনা এক দেশে চলে এলেন? এখানে এসে কীভাবে কী করবেন ভাবলেন না একবারও? আর উনার পরিবার’ই বা কেমন, এভাবে একা একটা মেয়েকে ছেড়ে দিল?’
দিলরুবা বেগম প্রসন্ন হেসে বললেন,
‘পড়াশোনার জন্য এসেছে, বাবা।’
ফারজাদ বলল,
‘উনি কোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবেন সেটাই জানেন না, এভাবে একেবারে দিক বেদিক না দেখেই চলে এলেন, আপনার কাছে অদ্ভুত লাগছে না ব্যাপারটা?’
দিলরুবা বেগম আর কী বলবেন ভাবছেন। ছেলেটাকে কাল থেকেই মিথ্যে বলে যাচ্ছেন তিনি। সত্যিটা তো অন্য। এই মেয়ে যে কী বিশাল বিপদে পড়েছে, সেই কথা তো এখন আর ছেলেকে বলতে পারবেন না। এমনিতেই এই প্রেম ভালোবাসাতে তার ভীষণ বিদ্বেষ, তার উপর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখলে এই মেয়েকে আর ঘরে রাখবে না, নিশ্চিত। তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললেন,
‘মৌমির কলেজ ফি’টা বাকি, বাবা। কবে দিবি?’
ফারজাদ ঠোঁট গোল করে বলল,
‘ওহ হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিলাম। মৌমিকে আজই দিয়ে দিব।’
‘আচ্ছা।’
________
মৌমি গেস্ট রুমের দরজার সামনে গিয়ে দেখল, প্রিয়তা তার ব্যাগ গুছাচ্ছে। কালকের কামিজ পাল্টে হলুদ রঙের নতুন একটা কামিজ পরেছে সে। উস্কো খুস্কো চুলগুলো বেশ পরিপাটি করে বাঁধা এখন। সে জিজ্ঞেস করল,
‘আসব?’
প্রিয়তা ফিরে চেয়ে তাকে দেখে হাসল। বলল,
‘এসো না, এটা তো তোমারই বাড়ি।’
মৌমি ভেতরে এল। প্রিয়তার মুখের হালকা সাজ নজরে পড়েছে তার। সে জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি ব্যাগ গুছাচ্ছো কেন?’
প্রিয়তা তাকিয়ে বলল,
‘চলে যাব যে, তাই।’
মৌমি শুকনো মুখে বলল,
‘ভাই বলল বলেই চলে যেতে হবে? দুটো দিন থাকো।’
প্রিয়তা হেসে বলল,
‘আরে না না, উনার বলাতে যাচ্ছি না। ওয়াদি বলেছে।’
‘ওয়াদি?’
‘হ্যাঁ, যার জন্য আমার এখানে আসা। আমার প্রিয় মানুষ। ও রাতে আমায় কল দিয়েছিল, একটা এড্রেস দিয়ে আমাকে সেখানে যেতে বলেছে। আমি বলেছিলাম না, ওয়াদি আমাকে ঠকাতে পারে না, ওর ভালোবাসা মিথ্যে হতেই পারে না। দেখছো ও ভুলেনি আমায়।’
মৌমি নিষ্পলক চেয়ে রইল। কিছু সময় পর বলল,
‘তুমি উনাকে অনেক বিশ্বাস করো, তাই না?’
প্রিয়তা মুচকি হেসে বলে,
‘হ্যাঁ, অনেক।’
মৌমি ক্ষীণ সুরে বলল,
‘আচ্ছা, খেতে এসো।’
‘বাইরে গিয়ে খাব?’
‘হ্যাঁ, ডাইনিং এ আমার সাথে বসে।’
প্রিয়তা ধীর আওয়াজে বলল,
‘তোমার ভাই আছেন না? আমি উনার সামনে যেতে চাই না।’
‘ভাইয়া উনার ঘরে। তুমি নিশ্চিন্তে আসতে পারো।’
প্রিয়তা ব্যাগের চেইন আটকে মৌমির পেছন পেছন ডাইনিং অবধি গেল। তার পদচারণ অতি নির্লিপ্ত। জড়োসড়ো হয়ে এক কোণে দাঁড়াতেই দিলরুবা বেগম এসে বললেন,
‘দাঁড়িয়ে আছো কেন, মা? বসো।’
প্রিয়তা অস্বস্তি নিয়ে চেয়ারে বসল। অন্যটাতে বসল মৌমি। প্লেটে খাবার নিতে নিতে সে বলল,
‘আম্মি, উনি নাকি এখন চলে যাবেন।’
দিলরুবা বেগম চিন্তিত সুরে বললেন,
‘কোথায় যাবে?’
প্রিয়তা চেয়ে মৃদু হেসে বলল,
‘ওয়াদি আমাকে রাতে কল দিয়েছিল। ও আমাকে একটা ঠিকানা দিয়েছে, দেখা করার জন্য। আমি ওর কাছেই যাব।’
দিলরুবা বেগম ভ্রু কুঁচকালেন। বললেন,
‘কথা হয়েছে তোমার? কোথায় যেতে বলেছে?’
‘আমি তো ঠিক চিনি না, তবে ও ঠিকানা দিয়ে বলেছে এখান থেকে যেকোনো একটা বাসে উঠে ঠিকানাটা বললেই হবে।’
দিলরুবা বেগম একপল ভেবে বললেন,
‘তোমার একা যেতে হবে না, আমি আর ফারজাদ নিয়ে দিয়ে আসব তোমায়।’
প্রিয়তা অপ্রস্তুত সুরে বলল,
‘না না, আপনারা এমনিতেই আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। আপনাদের আমি আর কষ্ট দিতে চাই না; আমি একা যেতে পারব।’
‘পারবে না, মেয়ে। এই দেশ, এই শহর সব তোমার জন্য নতুন। এখানে আনাচে কানাচে বিপদ উঁত পেতে আছে। আমরা পৌঁছে দিব তোমায়, তুমি খেয়ে নাও।’
প্রিয়তা অভিভূত হলো। এই অচেনা মানুষগুলো কত ভালো। আজকাল এত ভালো মানুষ হয় না-কি। যদিও ছেলেটা একটু খিটখিটে, তাও মনের দিক দিয়ে হয়তো খারাপ না।
প্রিয়তা খুশি মনে চটপট খেয়ে নিল। তারপর গেস্ট রুমে গিয়ে বাকি কাজ সেরে একদম তৈরি হয়ে নিল সে।
ফারজাদকে রাজী করাতে বেশ বেগ পোহাতে হলো দিলরুবা বেগমের। তাও অবশেষে সফল হয়েছেন তিনি। ফারজাদ গাড়ি বের করে বাইরে অপেক্ষা করছে।
প্রিয়তার হাত ধরে আছে মৌমি। মন খারাপ করে বলল,
‘বিয়ের পর ভাইয়াকে নিয়ে অবশ্যই আমাদের বাড়িতে আসবে।’
প্রিয়তা প্রসন্ন হাসল। বলল,
‘অবশ্যই আসব।’
তারপর দিলরুবা বেগম প্রিয়তাকে নিয়ে গাড়িতে বসলেন। গাড়ি স্টার্ট দিল ফারজাদ। গেইট থেকে বের হয়েই মা’কে বলল,
‘কাল অবধি উনার যেখানে কোনো আত্মীয় ছিল না, আজ হঠাৎ কোথ থেকে এই আত্মীয়ের উদয় হলো, আম্মি? উনি সত্যি বলছেন তো?’
চলবে….
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/