অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ২০।

0
609

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২০।

সূর্যের আলো চোখে মুখে আপতিত হতেই ঘুম ছুটে ফারজাদের। চোখ মেলে তাকায়। সোজা হয়ে বসে। সারারাত সোফাতেই হেলান দিয়ে বসে কাটিয়ে দিয়েছে। এখন তাই ঘাড়টা কেমন ম্যাচম্যাচ করছে যেন। ফারজাদ ডানে বামে ঘাড় কাত করে দাঁড়ায় উঠে। প্রিয়তা ঘুমাচ্ছে এখনো। ফারজাদ তার বেডের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকে এক পল। তারপর ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে যায়।

পুরো রাত ওয়াদি হাসপাতালেই কাটিয়েছে। প্রিয়তাকে এখান থেকে বের করার কোনো উপায় এখনো মাথায় আসেনি তার। সারারাতে এই নিয়ে ভেবে দু চোখের পাতাও এক করতে পারেনি। তাকে খবর পাঠানো লোকটা ঢুলতে ঢুলতে এগিয়ে আসে। হাতে তার কফির গ্লাস। একটা ওয়াদির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

‘ভাই, কফি।’

ওয়াদি কফি নেয়। এই মুহূর্তে কফি খেয়ে বুদ্ধি বের করতে হবে। এত কাছে পেয়েও পাখিকে সে হাত ছাড়া করে ফেললে এর থেকে কষ্টের আর কিছু হবে না। সে কফিতে চুমুক বসিয়ে বলল,

‘কী করি বল তো? ঐ মেয়েকে এখন কীভাবে এই হাসপাতাল থেকে বের করব?’

লোকটি বলল,

‘ভাই, কাজটা মোটেও সহজ হবে না। ঐ বেডা সারাক্ষণ মেয়েটার সাথে আঠার মতো লেগে আছে, ওর চোখ ফাঁকি দিয়ে মেয়েটাকে বের করে আনা সম্ভব না।’

‘কিন্তু, কিছু একটা তো করতেই হবে। প্রয়োজন পড়লে ঐ ছেলেকে আমাদের পথ থেকে সরিয়ে দিব, তাও হাল ছাড়া যাবে না। যেকোনো মূল্যে আমার ঐ মেয়েকে চাই, নয়তো আমার এত বছরের পরিশ্রম সব বৃথা যাবে।’

‘তো এখন কী করবেন, ভাই?’

‘সাথে আছে কিছু?’

‘না ভাই, সব বাসায়।’

‘যা একটা নিয়ে আয়। আজই খেলা শেষ করতে হবে। অনেক হয়েছে লুকোচুরি, এবার যা হবে সামনা-সামনি হবে।’

লোকটি নাকে মুখে কফিটা শেষ করে ছুটল। ওয়াদি মুখে মাস্ক লাগিয়ে হাঁটা ধরল প্রিয়তার কেবিনের দিকে। পরিস্থিতিটা একবার দেখে আসা দরকার।

আস্তে করে উঠে বসে প্রিয়তা। ঘুম হয়নি ঠিকঠাক। রাতে বারবার জেগে উঠেছে। প্রতিবার চোখ খুলেই ফারজাদের মুখটা দেখে আশ্বস্ত হয়েছে যদিও। কিন্তু তারপরও যেন মনে হতো, এই বুঝি ওয়াদি আসছে তাকে নিয়ে যেতে। এত ভয় নিয়ে কি আদৌ শান্তিতে থাকা যায়?
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জীবনের কিছু বীভৎস সময় সে কাটাচ্ছে। যদি কখনো ভালো সময় আসে, তবে এই সময়ের শিক্ষাগুলো সে অবশ্যই কাজে লাগাবে।

ফারজাদ দিলরুবা বেগমের সাথে কথা বলে জানিয়ে দেয়, তারা আজ বিকেলেই বাড়ি ফিরবে। দিলরুবা বেগম আসতে চাইছিলেন, ফারজাদ তাই এই বলে শান্ত করে তাঁকে।

সে ফোন কেটে প্রিয়তার কাছে এসে দাঁড়ায়। প্রিয়তা উস্কো- খুস্কো, এলোমেলো। চোখে মুখে পর্যাপ্ত ক্লান্তির ছাপ। ফারজাদ তাকে দেখে বলল,

‘আপনার ফ্রেশ হওয়া প্রয়োজন।’

প্রিয়তা বলল,

‘হাতের স্যালাইনটা খুলে দিতে পারবেন?’

ফারজাদ স্যালাইনের বোতলের দিকে চেয়ে দেখল, এখনো স্যালাইন চলছে। হয়তো ভোরের দিকে নার্স এসে আরেকটা দিয়ে গিয়েছে। সে বলল,

‘আপনার স্যালাইন তো শেষ হয়নি এখনো।’

প্রিয়তা অস্বস্তি নিয়ে বলল,

‘তাও খুলে দিন।’

প্রিয়তা মুখে না বললেও তার অসুবিধাটা বুঝল ফারজাদ। বলল,

‘একটু অপেক্ষা করুন, আমি নার্সকে ডেকে নিয়ে আসছি।’

সঙ্গে সঙ্গেই অস্থির গলায় প্রিয়তা বলল,

‘আমাকে একা ফেলে যাবেন না, প্লিজ।’

ফারজাদ থামল। তার দিকে চেয়ে বলল,

‘ঠিক আছে। নার্সের নাম্বার আছে, আমি কল করে ডেকে নিচ্ছি তাহলে।’

কল করেই নার্সকে ডেকে নিল ফারজাদ। নার্স ভেতরে প্রবেশের পূর্বেই সে দরজার কাছে গিয়ে ধীর সুরে বলল,

‘উনি বোধ হয় ওয়াশরুমে যাবেন, স্যালাইন খুলতে চাইছেন।আপনি একটু কষ্ট করে স্যালাইন সহ’ই উনাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যান।’

নার্স মাথা হেলিয়ে বলল,

‘আচ্ছা।’

‘আর শুনুন, আমি না আসা অবধি কেবিনেই থাকবেন। দেখলেন’ই তো একা থাকলে মেয়েটা কীভাবে অস্থির হয়ে উঠে।’

সে প্রিয়তার দিকে ফিরে চেয়ে বলল,

‘আমি ক্যান্টিন থেকে খাবার নিয়ে আসছি। ভয় পাবেন না, নার্স কেবিনেই থাকবেন।’

প্রিয়তার ইচ্ছে করছিল একবার বলবে, “তাও আপনার যাওয়ার দরকার নেই। এই মুহূর্তে আমি যে আপনাকে ছাড়া আর কাউকেই ঠিক মতো বিশ্বাস করতে পারছি না।”

কিন্তু সেইটুকু কথা মুখ অবধি আসার পূর্বেই গলাধঃকরন করে ফেলল সে। নার্স ভেতরে এসে সাহায্য করল তাকে ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য।

ফারজাদ ক্যান্টিন থেকে দুই গ্লাস কফি, এক প্যাকেট কেক আর দুই প্যাকেট বিস্কিট নিয়ে কেবিনের বরাবর আসল। ভেতরে প্রবেশ না করেই থমকে দাঁড়াল সে। ভ্রু কুঁচকাল। মাস্ক পরা ছেলেটার সাথে চোখে চোখ পড়তেই চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করল ফারজাদ। মনে হলো এই চোখ আগেও দেখেছে সে। এগিয়ে এল। ছেলেটা প্রিয়তার কেবিন পার হয়ে অনেকটা সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হয়তো ভেবেছিল, ফারজাদ অতশত না ভেবে কেবিনে চলে যাবে। কিন্তু হয়েছে তার উল্টো। ফারজাদ গিয়ে দাঁড়াল ঠিক তার মুখ বরাবর। জিজ্ঞেস করল,

‘ঐ কেবিনের সামনে কী করছিলেন?’

আচমকা প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ছেলেটা। আমতা আমতা করে বলে,

‘ক-কই কিছু করছিলাম না তো, ঐদিক দিয়ে হাঁটছিলাম শুধু।’

ফারজাদ তার আপাদমস্তক পরখ করে রাশভারী স্বরে বলল,

‘হাঁটাহাঁটির জন্য পুরো হাসপাতাল আছে, ঐদিকে যেন যেতে না দেখি।’

ফারজাদ ফিরে আসার জন্য উদ্যত হলো। প্রশ্ন ছুড়ল ছেলেটা,

‘কেন, কী করবেন গেলে?’

ফিরে চাইল ফারজাদ। চোয়াল শক্ত করল। বলল,

‘হাঁটার জন্য পা জোড়া আর রাখব না।’

ছেলেটা আর কথা বাড়াল না। কেবিনে ফিরে এল ফারজাদ। প্রিয়তা ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে বেডে বসে আছে। সে কফি, কেক, বিস্কুট একটা প্লেটে গুছিয়ে তার সামনে রাখল। অন্য কফির কাপটা নিয়ে বসল সোফায়। প্রিয়তা কাটা হাত দিয়ে তুলে আস্তে করে কেকটা মুখটা নিল। হাতে এখনো ব্যথা করছে বেশ। নাড়াতে কষ্ট হয়। ফারজাদ নার্সকে বলল,

‘আপনি উনাকে খাইয়ে দিন।’

প্রিয়তা বলল,

‘না, আমি পারব।’

‘পারবেন না। উনাকে দিন, উনি খাইয়ে দিবেন।’

ফারজাদের কথা মতো নার্স তাকে খাইয়ে দিল। খাওয়া দাওয়া শেষ করে প্রিয়তা বলল,

‘আপনি একবার পুলিশকে কল দিয়ে জানিয়ে দিন, আমি যে কাল রাতে ওয়াদিকে দেখেছি।’

ফারজাদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

‘সত্যি দেখেছেন?’

‘জি। বিশ্বাস করুন, একদম সত্যি।’

ফারজাদের খেয়ালে তখন বাইরের মাস্ক পরা ছেলেটার মুখটা ভেসে উঠল। সে আর ঐ ছেলেটার কথা তুলল না। বলল,

‘আচ্ছা। আমি খবর দিচ্ছি।’

ফারজাদ পুলিশকে কল করে জানাল সবটা। অফিসার সব শুনে বললেন, উনারা এক্ষুনি আসছেন। ব্যাপারটাকে মোটেও হেলাফেলা করা যাবে না। পুলিশ আসার খবর পেয়ে কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হলো প্রিয়তা।

ঘড়িতে তখন দশটা। ফারজাদের কল বাজছে। নাম্বারটা সেইভ না থাকলেও বুঝতে পারল, এটা ঐ জারার নাম্বার। রিসিভ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও রিসিভ করল সে। কানে লাগিয়ে সালাম দিল। জারা সালামের জবাব দিয়ে বলল,

‘অফিসে এখনো আসেননি কেন?’

‘আসলে ম্যাম, একটা জরুরি কাজে আমি হাসপাতালে আছি। আজকে আমি আসতে পারব না। দুঃখিত।’

‘হাসপাতালে?’

উদ্বিগ্ন শোনায় জারাকে। বলে,

‘কার কী হয়েছে? কোনো হাসপাতালে আছেন, বলুন; আমি এক্ষুনি আসছি।’

‘না না, ম্যাম। আপনার আসার প্রয়োজন নেই। আসলে আমার এক আত্মীয় একটু অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি। উনি এখন সুস্থ আছেন, বিকেলেই বাড়ি চলে যাব। আপনাকে আর তাই কষ্ট করে আসতে হবে না।’

‘কী যে বলেন, এখানে কষ্টের কী আছে? মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোই মানুষের ধর্ম। কোন হাসপাতালে আছেন, সেটা বলুন তো।’

উফ! এ তো মহা বিপদ। এমনিতেই কি ঝামেলা কম যে এখন আরেকটা এসে জুটতে চাইছে। তার থেকে উত্তর না পেয়ে জারা ফের একই প্রশ্ন করল। প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে হাসপাতালের ঠিকানা দিয়ে দিল ফারজাদ। কল কেটে সাথে সাথে ফোনটা বন্ধ করে দিল; এই মেয়েটাকে কেন যেন একটুও সহ্য হচ্ছে না তার।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here