অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ২৩।

0
731

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৩।

রাতটা প্রিয়তা কোনোরকমে কাটাল। এত এত নিরাপত্তার মাঝেও পুরো রাত ঠিক মতো ঘুমাতে পারেনি সে। চোখ বুজলেই মনে হতো যেন, এই বুঝি ওয়াদি চলে এসেছে, এই বুঝি এসে তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ফারজাদেরও ঘুম হয়নি খুব একটা। সোফায় বসে বসে পুরো রাত প্রিয়তার অস্থিরতা দেখেছে কেবল।

সকাল হতেই ডাক্তার এসে প্রিয়তার চেকআপ করলেন। জানালেন, আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ; বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে। বাড়ি ফেরার কথা শুনে প্রিয়তার চিত্তে শান্তি ফিরল; মনে হলো যেন, নিজের বাড়িতেই ফিরছে সে।

নার্স তাকে সাহায্য করল ফ্রেশ হতে। ফারজাদ নাস্তা নিয়ে এসেছে। একসাথে নাস্তা করল দুজন। নাস্তা শেষ করে ফারজাদ ডাক্তারের কাছ থেকে প্রিয়তার সমস্ত ঔষধপত্র বুঝে নেয়। প্রিয়তা ওয়াশরুমে তখন। এক হাতে ব্যান্ডেজ, আর অন্য হাতে চুল ঠিক করছে। তবে খোলা চুল বাঁধতে পারছে না কোনোমতেই। তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব গুছিয়ে একবার ওয়াশরুমের দিকে চাইল ফারজাদ। দেখল, প্রিয়তা ভীষণ যুদ্ধ চালাচ্ছে চুলের সাথে। অন্য হাত উপরে তুললেই টান লাগে। সে পারছে না। হাল ছেড়ে বেরিয়ে আসে। কেবিনে এখন নার্সও নেই। মাত্রই বেরিয়েছে। আরেকটু আগে বললেই হতো।

প্রিয়তা বের হয়ে এসে চুল বাঁধার ব্যান্ড’টা ব্যাগে রেখে দেয়। ফারজাদ ইতস্তত সুরে তখন বলে উঠে,

‘আমি সাহায্য করব?’

প্রিয়তা অপ্রস্তুত হয়ে বলে,

‘আপনি? না মানে, বাঁধতে পারবেন?’

ফারজাদ এগিয়ে আসে। ব্যাগ থেকে ব্যান্ড’টা তুলতে তুলতে বলে,

‘মৌমি আমার অনেক আদরের। ওকে আমি অনেক ভালোবেসে বড়ো করেছি; ওর জন্য ভাইও আমি, বোনও আমি। ওর চুল বেঁধেছি অনেকবার, আশা করছি পারব।’

সে দু হাত এগিয়ে প্রিয়তার সব চুল হাতের মুঠোয় ভরে ব্যান্ড দিয়ে সুন্দর মতো বেঁধে দেয়। প্রিয়তা চকিত হয়। কী সুন্দর বেঁধে ফেলল! সে ঘুরে তাকাতেই ফারজাদ মৃদু হেসে বলল,

‘পারফেক্ট।’

প্রিয়তাও হাসল কিঞ্চিৎ। বলল,

‘ধন্যবাদ।’

ফারজাদ বলল,

‘তৈরি পুরোপুরি? চলুন তবে।’

প্রিয়তা এক হাতেই ওড়না টেনে কাপড় দিল মাথায়। মুখে মাস্ক লাগাল। রাস্তায় যেন কোনোপ্রকার বিপদে না পড়তে হয়, সেইজন্য পুলিশের গাড়িতে যাবে তারা।

দুজনেই হাসপাতাল থেকে নেমে গাড়িতে ওঠল। গাড়িতে বসে থেকেই উশখুশ করছে প্রিয়তা। কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে চেয়েও পারছে না। ফারজাদ খেয়াল করেছে বিষয়টা। তাই সে নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করে,

‘কিছু বলবেন?’

প্রিয়তা হাঁসফাঁস করতে করতে বলে,

‘যদি কিছু মনে না করেন, তবে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’

‘জি, বলুন।’

‘কত টাকা বিল এসেছে?’

ফারজাদ ভ্রু কুঁচকাল। প্রিয়তার অস্বস্তির মাত্রা বাড়ল তাতে। মিইয়ে যাওয়া সুরে বলল,

‘না মানে, আমার জন্য আপনার…’

‘চিন্তা করবেন না, টাকাটা আমি ধার হিসেবে দিয়েছি; দেশে ফিরে সেটা মিটিয়ে দিলেই হবে।’

প্রিয়তা দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করার আগ্রহ পেল না। মুখ ভার করে বসে রইল। ধার দিয়েছে ভালো কথা, কিন্তু কত টাকা? সেটা জিজ্ঞেস করলে তো আবার নিশ্চয় ত্যাড়া উত্তর দিবে।

__________

দিলরুবা বেগম গেইটের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকেন। ফারজাদ আর প্রিয়তাকে পুলিশের গাড়ি থেকে নামতে দেখে তিনি বিচলিত হোন। সামনে এগিয়ে যান। প্রিয়তা সালাম দেয় তাঁকে দেখে। সালামের জবাব দিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেন,

‘তুমি ভালো আছো, মা?’

অপরাধীর ন্যায় মাথা নুইয়ে প্রিয়তা বলে,

‘জি, ভালো আছি।’

এরপর তিনি ফারজাদের দিকে চেয়ে বলেন,

‘পুলিশের গাড়িতে এলে যে? কোনো সমস্যা হয়েছে?’

ফারজাদ মিথ্যা বলল। বলল,

‘না আম্মি, কিছু হয়নি। নিরাপত্তার জন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। আপনি প্রিয়তাকে নিয়ে ভেতরে যান, আমি আসছি।’

মায়ের চোখ, যতই কিছু না বলুক তারপরও সেই চোখে অনেক কিছু ধরা পড়ে যায়। এই যেমন এখন ছেলে মিথ্যে বলছে, তিনি সেটা অনায়াসেই ধরে ফেলেছেন। তবে কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে তিনি ছেলের কথা মতো প্রিয়তাকে নিয়ে ভেতরে গেলেন।

প্রিয়তাকে দেখে মৌমি ছুটে এল। সে অস্থির হয়ে বলতে লাগল,

‘এটা কী করলে, আপু? তুমি এমন একটা কাজ কী করতে পারলে? জানো, আমি আর আম্মি কত কেঁদেছি, ভয় পেয়েছি কত?’

দিলরুবা বেগম ধমক দিলেন তাকে। বললেন,

‘আহা, মেয়েটাকে একটু বসতে দে না; কী শুরু করলি?’

মৌমির কথা আর অস্থিরতা দেখে প্রিয়তার খারাপ লাগল বড্ড। সে বসল সোফায়। ক্ষীণ সুরে বলল,

‘ক্ষমা করো আমায়। আবেগের বশে মারাত্মক ভুল করে বসেছিলাম। আমার জীবনটা ভুলে ভুলে ভরে গিয়েছে এখন, এত ভুলের প্রায়শ্চিত্ত কী করে করব আমি?’

দিলরুবা বেগম তার পাশে বসলেন। তার মাথায় হাত রেখে নরম সুরে বললেন,

‘ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে। জীবন দিয়ে দেওয়া কোনো কিছুর সমাধান হতে পারে না। এটা বোকামি আর মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই না। জীবনের সব রকম পরিস্থিতিতে সাহসের সাথে লড়ে যাওয়াটাই যোদ্ধাদের কাজ। তোমাকে সেরকম যোদ্ধাই হতে হবে। লড়াই করতে হবে, মা। শুরুতেই এভাবে আত্মসমর্পণ করে ফেললে কী করে হবে?’

প্রিয়তা ভেজা চোখে চাইল। সে বুঝতে পারে না, এই মানুষগুলো এত ভালো কেন? যদি পাকিস্তানে আসাটা তার বিশাল কোনো ভুল হয়ে থাকে, তবে সেই বিশাল ভুলের মধ্যে একটা চমৎকার সুন্দর হলো, এই মানুষগুলোর সাথে পরিচয় হওয়াটা। এই একটা জিনিসের জন্য সেই বিশাল ভুলটাকেও সে ভুলে যেতে পারবে নির্দ্বিধায়। প্রিয়তা সিক্ত চোখের নোনা জলকে সংযত করে বলল,

‘আপনাদের মতো মানুষের সাথে পরিচয় হয়ে আমি স্বার্থক। পাকিস্তানে আসা নিয়ে আমার আর কোনো আফসোস রইল না।’

দিলরুবা বেগম হেসে তার কপালে চুমু খেয়ে বললেন,

‘আর কখনো এই চিন্তা মাথায় আনবে না। মনে রাখবে, তুমি কোনো অন্যায় করোনি। নিজে ম’রবে না, প্রয়োজন পড়লে তাকে মা’রবে যে তোমার সাথে অন্যায় করেছে।’

এই কথাটা দরজার অভিমুখে দাঁড়িয়ে শুনল ফারজাদ। তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটল ঠোঁটের কোণে। মনে মনে ভাবল,
‘আপনি মা’রতে পেরেছিলেন সেই অন্যায়কারীকে?’

সে সোজা তার ঘরে গেল। অফিসে যাওয়া প্রয়োজন আজ। নয়তো বস আবার ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখবেন না। সে ফ্রেশ হয়ে মোবাইল হাতে নিতেই দেখে জারার মেসেজ। লেখা আছে, “আজ অফিসে আসতে হবে না। বাসায় গিয়ে রেস্ট নিয়ে দুইদিন পর থেকেই জয়েন করুন। আর ঐদিকের আপডেট জানতে আমি অপেক্ষা করছি।”

ফারজাদ অবাক হলো। জারা মেয়েটা তার প্রতি একটু বেশিই সদয় হচ্ছে। বস হলে নিশ্চয় এমন ব্যবহার করতেন না। সে পাল্টা মেসেজ লিখল, “ধন্যবাদ, ম্যাডাম। আমি কালই জয়েন করব, আর অবশ্যই সবটা জানাব আপনাকে।”

গেস্ট রুমটা ফারজাদের রুমের পাশেই। সে বের হতেই সেই ঘরে সবাইকে দেখতে পেল। প্রিয়তাকে নিয়ে বসে কী নিয়ে যেন কথা বলছেন দিলরুবা বেগম। ফারজাদ গলা কাশি দিয়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দিল। দিলরুবা বেগম চাইলেন তার দিকে। রাশভারী গলায় বললেন,

‘এতকিছু হয়ে গিয়েছে আর আমাকে কিছু জানানোর প্রয়োজন বোধ করোনি?’

মা এখনই সব জেনে গিয়েছে দেখে বিরক্ত হলো ফারজাদ। কপালে ভাঁজ ফেলে প্রিয়তার দিকে চাইল সে। মেয়েটা মাথা নত করে বসে আছে। এখন সে কী করে বোঝাবে যে, দিলরুবা বেগম কতটা জোর করে তার কাছ থেকে সবটা সত্যি বের করেছেন।

ফারজাদ গম্ভীর স্বরে জবাব দিল,

‘সব শুনলে অযথাই আপনি দুশ্চিন্তা করতেন, তাই কিছু জানায়নি। আর প্রিয়তা, আপনাকে কে আগ বাড়িয়ে সব বলতে বলেছে?’

‘ওকে একদম কিছু বলবে না। আমি জোর করেছি বলেই ও বলেছে। তোমার কি মনে হয়, মা’কে এত সহজেই বোকা বানাবে? মায়েরা সন্তানদের চোখ দেখলেই ঘটনার আদ্যোপান্ত সব বুঝে যায়, বুঝলে? খবরদার আর কোনোদিন কিছু লুকাবে না আমার কাছ থেকে।’

ফারজাদ জবাব দিল না। প্রিয়তার দিকে বিরক্ত চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে নিজের ঘরে গেল। প্রিয়তা না চাইলেও বেশ বুঝল, মানুষটা আবার তার উপর ক্ষেপেছে ভীষণ।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here